এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বইপত্তর

  • সৈকত (২য়) , সাহিত্য বিষয়ে মন্তব্য সমূহ

    oraphe
    বইপত্তর | ১৩ আগস্ট ২০১৮ | ২০৯৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • h | 340123.132.451223.86 | ১৩ আগস্ট ২০১৮ ১৭:৫২377092
  • সৈকত ২য়ঃ

    নইপল আমি একটিই পড়েছি আন আরেঅ ওফ ডর্ক্নেস্স, ষাটের দশকের মাঝামাঝি লেখা ট্রাভেলগ, নইপলের প্রথমবারের জন্য ভারতে আসা সে সময়ে। সারা বই জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ভারতের প্রতি নইপলের অত্যন্ত ক্রিটিকাল দৃষ্টি, প্রায় কিছুই পছন্দের ছিলনা নইপলের ঐ যাত্রায়, বইয়ের নামেই সেটা স্পষ্ট। সবচেয়ে বেশী অপছন্দের ছিল, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অপরিষ্কার, নোংরা আর দারিদ্র। বইটা এদেশে ব্যানও হয়েছিল, ঐ দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য।

    প্যরালাল টেক্স্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ভারতে ফিরে আসার পরে এই দেশ সম্বন্ধে মোহনদাস গান্ধীর মতামত, চিঠি, লেখালেখি। "বাইরের" লোক হিসেবে গান্ধী যা দেখেছিল, দেশের লোকদের সেই সব চোখ এড়িয়ে যেত, বাইরের লোক যারা তারাই বেশী দেখে, এরকমই ছিল নইপলের বক্তব্য ! নিজেও সেটাই বলতে চেয়েছিলেন মনে হয়। (কলকাতাতেও এসেছিলেন । সমালোচনা প্রবনতা কিছুটা কম ছিল, কলকাতা নিয়ে ? মূলতঃ কলকাতা শহরকেন্দ্রিক সাহিত্য-শিল্প সংক্রান্ত কাজকর্মের খোঁজ পেয়ে। ) শেষ পর্যন্ত, উত্তর প্রদেশের সেই গ্রামে, যেখান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষরা চলে গিয়েছিল ত্রিনিদাদ, সেখানে পৌঁছে, যখন নইপলের মনে হল, গ্রামের লোকেরা অপেক্ষা করছে তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা-আর্থিক সাহায্য, তখন প্রবল হয়ে ওঠে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে।

    নইপল, তায়েব সালিহ নয়, নীলনদের জলে জলে ডুবে যেতে যেতে যে সাহায্যের জন্যে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠবে। হয়ত কনরাড অনুসারীই বেশীটা, কলোনীর ক্ষত স্পষ্ট নয় বা তার থেকে আলাদা, কিছুটা বাইরে দাঁড়িয়ে।
  • সৈকত | 340112.99.675612.98 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১২:২৬377096
  • আর নুট হামসুন, লেখায় মডার্নিস্ট ধারার পুরোধা পুরুষ। টমাস মান, কাফকা, স্টিফেন জইগ হয়ে আইসাক বাশেভিস সিঙ্গার, সবাই কিছু না কিছু নিয়েছে হামসুনের লেখা থেকে। বিংশ শতক শুরুর আগে থেকে, ১৯২০ নাগাদ অবধি, হামসুনের লেখালেখির সেরা সময়। Hunger, Mysteries, Pan, Victoria হয়ে ১৯২০ তে নোবেল, মূলতঃ Growth of the Soil উপন্যাসের জন্য, সাগা বিশেষ। মোটামুটি একই সময়ে, হামসুন, স্ট্রিন্ডবার্গ আর এদোয়ার্ড মুঙ্খ, উপন্যাসে, নাটকে, আর ছবিতে - এক্সপ্রেসানিজমের চূড়ান্ত প্রকাশ, অন্তরমনের বিস্ফার !! স্ট্রীম অফ কনশাসনেস, ইন্টিরিয়র মনোলগ, ছেঁড়াখোঁড়া মানসিক অবস্থার প্রকাশ, মডার্নিস্ট লেখালেখির এই চিহ্নগুলো সবই` উপস্থিত নুট হামসুনের লেখায়।

    এখানে তো প্রেমেন মিত্র চেয়েছিলেন, কল্লোলের আতিশয্যে, গোর্কি আর হামসুনের লেখাকে মিলিয়ে লিখবেন। মাণিকবাবু সে কথা শুনে, হামসুন পড়তে গিয়েছিলেন, বুঝতে পারেননি ঐ মেলানোটা কি ভাবে সম্ভব !!

    রাজনীতি আর বক্তব্য যাই হোক, এসব লেখকদের, নাঃ, জাস্ট ছাড়া যায় না, শুধু দু-চারটে বইয়ের জন্যই ।
  • সৈকত | 340123.99.121223.134 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:১৫377097
  • - প্রসঙ্গটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতেই ছিল। হয় 'লেখকের কথা' বইয়ের কোন লেখায়, অথবা মার্ক্সবাদী পত্রিকায় বিতর্কের সময়ে মাণিকবাবুর বড় প্রবন্ধটায়, অথবা শরৎচন্দ্রের "শেষ প্রশ্ন" উপন্যাসের সমালোচনায়।
  • i | 452312.169.9005612.240 | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৪:৩৫377098
  • 'লেখকের কথায়' আছে। কালি কলমে প্রেমেন্দ্র মিত্র একটি চিঠি লেখেন- জীবনকে দেখাবার পাঠ নিতে যদি গোর্কি হ্যামসুনের পাঠশালায় গিয়েই থাকি তাতে দোষ কী-এযে জটিল দুর্বোধ্য জগৎ... ইত্যাদি। আরো লিখেছিলেন, এই জগতে এলে ইউক্লিডরা ফাঁপরে পড়ে।
    মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন, হ্যামসুনের বই তিনি পড়েছিলেন (হাঙ্গার সম্ভবতঃ), এই চিঠি পড়ে গোর্কি পড়তে গেলেন এবং মাদার পড়তে পড়তে আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন, হ্যামসুন আর গোর্কিকে প্রেমেন্দ্র মিত্র মেলাবেন কেমন করে...
  • সৈকত | 340112.99.675612.98 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৮377099
  • i-দিকে ধন্যবাদ জানালাম, ঠিক তথ্যটা দেয়ার জন্য।
  • ওরফে | 340123.99.121223.132 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:১৪377100
  • ইন্দোকে বলার, যে ড্যানিল খার্মস পড়তেই পার। যে কোনো অ্যাবসার্ডিস্ট লেখাপত্তর পড় উচিত, আরও উচিত ১৯২০-৩০ এর রাশিয়ার চরম আভাগার্দ লেখালেখিগুলো, শ্ক্লভস্কির ফর্ম্যালিস্ট স্কুলের সমালোচনা সাহিত্য সমেত !!
  • সৈকত | 342323.176.2389.171 | ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:২৪377101
  • ঈশানের আগের দুটো উপন্যাস, খেরোবাসনা ও মনেঞ্জোদারো, মূলতঃ প্যারানৈয়াক জগতের আখ্যান। প্রধাণ চরিত্রদুটি, ক্রমাগত তাদের চারপাশকে নিয়ন্ত্রন করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। খেরোবাসনায় সেটা শুধুই লোকজনকে লক্ষ্য করে যাওয়া, নোটবইতে তাদের সম্বন্ধে লিখে যাওয়া অথবা শিশুর ড্রয়িং-এর মত অদ্ভুত ছবি আঁকা; সবই যেন সে করে যাতে নিজের ওপর থেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলে, তার চেষ্টা। মহেঞ্জোদারোয়, জগতটা যেন আরও নিয়ন্ত্রনের বাইরে, তার চাপে বুনো, মুখ্য চরিত্রটি, নিজের চিন্তাভাবনাকেও পালটে ফেলতে চায়। সে যা চায় তা কখনই ঘটবে না জেনে, অথচ সেইগুলো ঘটুক সেরকমই ইচ্ছে বলে, নিজের চাওয়াগুলোও উল্টে দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনার আকাঙ্খা করে, কারণ 'আশা' যে সেগুলোও সে সত্যিই চাইছে বলে, সেগুলোও না ঘ'টে যা সে চায় সেগুলোই ঘটবে !! কিন্তু শেষরক্ষা হয়না, যারা পড়েছেন তারা জানেন যে প্রথম লেখাটায় , শেষ পর্যন্ত চারপাশটা মা্ছের বাজার হয়ে ওঠে, চোর সন্দেহে নিরপরাধ একটি ছেলেকে গণপিটুনির মধ্যে দিয়ে তুমুল ভায়োলেন্স শুরু হয়, আর কিছুই করার থাকে না। পরের লেখাটি শেষ হয় বান্ধবী বিচ্ছেদে এবং প্রাণপণে এই (বিপরীত) চাওয়াতে যে সে আর বাঁচতে চায় না, সত্যি সত্যি যাতে সে বেঁচে থাকতে পারে, জীবনের সবকিছু নিয়ে !!

    'দিনগুলি রাতগুলি'-তে প্যারানৈয়ার জগত অতখানি ব্যাপক নয়। একেবারে যে নেই, সেটাও নয়, উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ শেষই হচ্ছে এই বোধ দিয়ে যে চরিত্রটি কোন মানুষের মুখই স্পষ্ট করে চিনতে পারে না, মাঝামাঝি অংশে ফিরে আসছে একই কথা, যে পরিপ্রেক্ষিত বদলে গেলে কোন লোককে সে চিনতে পারে না, অথবা নন্দন চত্বরের পরিচ্ছেদেও একই রকম ঘটে, সুবেশ-সুবেশা মানুষ-মানুষীর ভিড়ে, ঠ্যালা আর গুঁতো খেতে খেতে মাথার ভেতরে এই বোধটা স্থিরই থাকে যে সে পৃথিবীর কোন লোককেই চিনতে পারে না। যেন সে এক অবোধ শিশু অথবা অপরিপক্ক মষ্তিষ্কশুদ্ধ এক মানুষের বোধ তার !!

    কিন্তু এর অরেও যে বুনো তার চারিদিককে নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করে না, তার কারণ সে নিজেকে যেন এক ঘোরের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে অথবা ঐ ঘোরের মধ্যে থেকে যাওয়াটাই তার একরকমের বেঁচে যাওয়া। এই ঘোরটা কামনার ছোঁয়া লাগা যৌনতা যা
    পর্নোগ্রাফির শরীর নয় অথবা প্লেটোনিক কিছু, শিরশিরানিময় এক অনুভূতি, ডিজায়ার বলি যাকে, অপ্রাপণীয় যা, তার থেকে এই কামনার ইশারাটা সমানে সে ধরতে পারে, বুনো সেই জন্যই হয়ত শেষ পর্যন্ত দৈনন্দিনটা কাটিয়ে উঠতে পারে, আগের দুটো উপন্যাসের মত নিয়ন্ত্রনহীন অদ্ভুত পরিপার্শ্ব তার সম্পূর্ন জগত নয়।

    চরিত্রের ক্রোনোলজি অনুযায়ী অথবা উপন্যাসের বাস্তব মানলে, দিনগুলি রাতগুলি যেন আগের ঘটনা, চরিত্রটি এরপর তার যৌবনকালকে ফেলে রেখে ধারালো পৃথিবীতে ঢুকে যাবে পরের দুটি লেখায়, কামনা বা যৌনতা সেখানে অনুপস্থিত, যা আছে তা সম্পর্ক নয়, সম্পর্কের ক্যরিকেচার, সেখানে ক্রন্দনেরও স্থান নাই। এও লক্ষ্য করে দেখি যে মহেঞ্জোদারো বা দিনগুলি রাতগুলিতে, দুটো উপন্যাসেই চরিত্রটির নাম বুনো ! খেরোবাসনায় কি ছিল মনে নেই, একই নাম থাকলেও বা না থাকলেও বিশেষ কিছু যায় আসে না বলেই মনে করি। অন্য কেউ নাম ধরে তাকে খুব কমই ডাকে (বুনো নামটিও অদ্ভুত, যেন কোন নামই নয়), প্রথম পুরুষে লেখা তিনটি উপন্যাসেই 'আমি'ই প্রধাণ, আমি-টি ক্রমাগতই নিজেকে একটা স্থিরতা দিতে চাইছে কারণ সে হয়তবা তার গৃহ হারিয়েছে।
  • সৈকত | 340112.99.675612.98 | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:১৩377103
  • 'গগন ঠাকুরের সিঁড়ি' নামে, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, ১৯৬০-৬১ সাল নাগাদ 'বিংশ শতাব্দী' নামে পত্রিকায় এগারোটি অধ্যায় প্রকাশ হওয়ার পরে, লেখাটি অসমাপ্ত অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায়। দেবেশ রায়, পরে, দীপেন্দ্রনাথ মারা যওয়ার পরই হয়ত পরিচয়-তে সেই লেখাটা ছাপিয়েছিলেন।কয়েক বছর আগে, উপন্যাস সমগ্রতে লেখাটি এসেছে, শেষের আরও কয়েকটি অধ্যায় সমেত; হয়ত লেখাটি সমাপ্ত হয়। কিন্তু আমার মতে লেখাটি তাও অসমাপ্ত, শুধু যেভাবে হঠাৎ করে শেষ হচ্ছে সেই জন্যই নয়, লেখাটির বিষয়ের কারণেই।পুরো উপন্যাসটি নিশানাথ নামে এক যুবকের চিন্তাস্রোত, পরিবার-মানুষজন-চারপাশটা-রাজনীতি, সব কিছু নিয়ে এক সর্বগ্রাসী মত ও অমত। আর কল্পিত এক বিচারসভায় তার উপশ্থিতি। আমার মনে হয়েছিল, নিশানাথ, তার পরিবেশ, সে যা দেখছে, সব কিছুই যে সে মনে করছে প্রায় নিরবয়ব, স্থানুতা পাচ্ছে না সেসব, ফর্মলেস, জোর করে যেন খাড়া করে রাখা হয়েছে সেসব, এই বোধের জন্যই, তার চিন্তাগুলো কখনই সমাপ্তি পাবে না, অতএব উপন্যাসটি অসমাপ্তই থাকবে !! বেশ কয়েকবার ভেবেছি উপন্যাসটির নামটি নিয়ে। উপন্যাসের মধ্যে গগন ঠাকুরের অবশ্য কোনো উল্লেখ নেই, নিশানাথ ছবিও দেখেনা। পরে বুঝেছি, নামের সাথে উপন্যাসের বিষয়ের অন্বয় স্থাপন করতে গেলে, উপন্যাসটির নামটি হতে পারত, 'গগন ঠাকুরের সিঁড়ির মত নিশানাথের চিন্তাভাবনা'। গগনেন্দ্রনাথের ছবিতে সিঁড়িগুলো যেমন, ক্রমাগত এক তল থেকে আর এক তল, আলোছায়ার খেলা, একটার পরে যেন আরো একটা থাকবে, উঁচু-নীচু, কক্ষ থেকে কক্ষান্তরের আভাস যেন বা, নিশানাথের চিন্তাগুলোও তেমনি, যেন তাদের তল খুঁজে পাওয়া যায় না।

    (এখানেও থাকল, তা না হলে বোধি এসে আবার !! আরও কিছু যোগ করারও ইচ্ছে আছে)
  • সৈকত | 238912.66.9003412.210 | ১০ অক্টোবর ২০১৮ ০২:০৪377093
  • এটা সেটা, বঙ্কিমবাবু প্রসঙ্গ -

    সীতারাম উপন্যাসের তৃতীয় খন্ড শুরু হয় ভূষনার যুদ্ধে সীতারামের জয় এবং সেই যুদ্ধে তোরাব খাঁর মৃত্যুতে। প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদে দুই বাক্যে এইটুকু বলে নিয়ে বঙ্কিম ঘটনার বিবরণ দেওয়া থেকে বেরিয়ে এসে পাঠকের সাথে সরাসরি কথা বলেন। এই সরাসরি কথা বলাটা বঙ্কিমের মোটামুটি সব উপন্যাসেই আছে; উপন্যাসে ব্যবহৃত একটা ট্রোপ যেন। ঘটনা নিয়ে, চরিত্র নিয়ে,আলাদা করে কিছু বলার জন্য বা গল্পটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হলে, সেই বলার স্বরটা বদলে নেন। অবশ্য এক্ষেত্রে অন্যরকম বিষয় আসে। মন্তব্য যেটা করেন সেটা উপন্যাস নিয়ে বা উপন্যাসের বিষয়বস্তু কী সেটা নিয়ে। বঙ্গদর্শন পেরিয়ে 'প্রচার' পর্বের বঙ্কিম, অনুশীলন তত্ত্ব পর্বের বঙ্কিম বা বাঙালীর ইতিহাসহীনতা নিয়ে আক্ষেপ করা বঙ্কিম লেখেন, "সে সকল ঐতিহাসিক কথা, কাজেই সেসব আমাদের কাছে ছোট কথা"। অতএব সেসবের বিস্তারিত বর্ণনায় সময় নষ্ট করা যায় না, কারণ "উপন্যাসলেখক অন্তর্ব্বিষয়ের প্রকটনে যত্নবান হইবেন", ইতিহাসের সাথে সম্বন্ধ রাখা নিষ্প্রয়োজন ! ইতিহাস একটা ফ্রেম যেন, গল্পের কাঠামোটা তৈরী করছে, কিন্তু উপন্যাস আলাদা কিছু যেটা মূলতঃ ব্যক্তিমানুষের অন্তর্মনের প্রকাশের একটা মাধ্যম, ইতিহাস বড়জোর যেন পরিপ্রেক্ষিত তৈরী করবে।

    (ইতিহাস আর উপন্যাসের এই সম্পর্ক বা দ্বন্দের জায়গাটা, শুধু এই উপন্যাসেই নেই, সম্পূর্ণ উল্টোভাবে কৃষ্ণচরিত্রতে আ্ছে। বঙ্কিমের উদ্দেশ্য সেখানে কৃষ্ণর ঐতিহাসিকতা নির্মাণ, পুরাণ আর ভাগবত ঘেঁটে আদর্শ চরিত্র হিসেবে খাড়া করা। ফলে যেখানেই সেই ঐতিহাসিকতার ক্ষতি হচ্ছে, যেখানেই পুরাণের গল্পে অলৌকিকতার প্রবেশ ঘটছে, যুক্তি দিয়ে বঙ্কিম কৃষ্ণচরিত্রের ব্যাখ্যা করতে পারছেন না, সেখানেই ঐসব অলৌকিক ঘটনা উপন্যাস মাত্র, কবিকল্পনা ইত্যাদি বলে যুক্তির ফাটলগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। )

    আগে মনে হয়নি, এবার মনে হল, তিন খণ্ডের উপন্যাসে শেষ খণ্ডে এসেই বা এই মন্তব্য কেন ? তাহলে তো ইতিহাসের কথাই বেশীই থাকল, মুসলিম শাসনে হিন্দু রাজা সীতারামের উত্থানের কথাই প্রাধান্য পেল, বঙ্কিমের শেষ পর্বের উপন্যাসের বা লেখার যা প্রকল্প বলে জেনে এসেছি। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখি, না, পৃষ্ঠাসংখ্যার হিসেবে ঠিকই আছে; একেবারে যেন মাপমতো লিখেছেন !! প্রথম দু'খণ্ড যেখানে প্রায় চুয়াল্লিশ পাতার, শেষ খণ্ডটি সেখানে চল্লিশ পাতার ! উপন্যাসের আধখানা যদি হয় ইতিহাসের গল্প , বাকী আধ্খানা প্রেম থেকে চ্যুত হয়ে, দখলদারি মনোবৃত্তির কারণে সীতারামের পতনের কাহিনী এবং উপন্যাসের শেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা। কিন্তু এই উপন্যাসে অত্যন্ত যুক্তি দিয়েই সীতারামের নৈতিক পতনের ধাপগুলো তৈরী করছেন; সীতারামের থেকে তার সঙ্গী-সাথী-মন্ত্রনাদাতারা সরে যাচ্ছে, স্ত্রীয়ের সাথে দ্বন্দ তৈরী হচ্ছে, এবং চরম পতন ঘটে যখন লোকসমক্ষে জয়ন্তীকে উলঙ্গ করে বেত মারার ব্যবস্থা করে সীতারাম !! ভুল শেষ পর্যন্ত সীতারাম বুঝতে পারবে, শেষ বারের জন্য নবাবের সৈন্যের সাথে লড়াইয় করবে মাত্র পঞ্চাশজন অনুচর আর স্ত্রী-পুত্র নিয়ে, কিন্তু চল্লিশ পাতার মধ্যে সেই ঘটনা হয়তবা আট-দশ পাতার। ব্যক্তির পতন দেখনোই যেন বঙ্কিমের মুখ্য উদ্দেশ্য এই লেখায়, অথবা সেরকম কিছু না, আমারই অনুমান, কিন্তু সব মিলিয়ে পড়লেও এই খণ্ডটি যেন ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা।

    কিন্তু দ্বন্দ অত সহজে যাওয়ার নয়। ঐ অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে নবাবসৈন্যর মধ্যে থেকে সীতারাম হয়ত আশ্চর্যজনকভাবে বেরিয়ে যায়, যদিও রাজ্য তার ধ্বংস হয়, তবুও বঙ্কিম আবার হোঁচট খান সেই ইতিহাস নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সীতারামের কী ঘটে ? উপন্যাসের পরিশিষ্টে রামচাঁদ আর শ্যামচাঁদ - যারা ইতিহাসের দুই উলুখড়ই যেন, কিন্তু সীতারামের নৈতিক পতনের সময়ে, রাজ্য শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সময়ে যারা চণ্ডীমণ্ডপে বসে সীতারামকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে মজা করতে ছাড়েনি অথবা জয়ন্তীকে বেত মারা উৎসাহভরেই দেখতে যায়, আমোদের জন্যই যেন বা অথবা সীতারামের সম্পূর্ন পতন দেখার জন্যই যেন বা- তারা রাজ্য ধ্বংসের আগে, যুদ্ধের আগে, প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাড়ীঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে এই আলোচনায় রত থাকে যে সীতারামকে আদৌ নবাবের সৈন্যরা শূলে চড়িয়েছে নাকি সীতারামকে দেবতারা এসে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন রকমের কথাকে নস্যাৎ করে এই সিদ্ধান্তে পৌছয় যে দুপক্ষের কথাই, হিন্দু আর মুসলমান দু'পক্ষের কথাই "রচা কথা, উপন্যাস মাত্র", সময়কালে হয়তবা যা দু'পক্ষেরই ইতিহাস হয়ে দাঁড়াত।

    হ্যাঁ, সীতারামের স্বাধীন রাজা হওয়ার ঘটনা, নবাবী শাসনের মধ্যেই বারো ভুঁইঞার ওপর আধিপত্য স্থাপন করে মহারাজ উপাধি নেওয়া বা ইতিহাস যেভাবে এই উপন্যাসে ব্যবহার হয়েছে, সেগুলো পুরোটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য, অন্তত যদুনাথ সরকারে সেরকমই মত ছিল (আমি অবশ্য সেই লেখা পড়িনি, উল্লেখ দেখেছি মাত্র অন্য লেখায়), কিন্তু বঙ্কিমের কাছে হয়ত সেই তথ্য ছিল না অথবা ইতিহাসে সেই বিবরণ ছিল না, যা দিয়ে রাজ্য ধ্বংসের কারণ নির্দেশ করা যায়। কিন্তু এই উপন্যাস লেখার সময়েও হিন্দু ইতিহাসের প্রতি একটা আনুগত্য থাকলেও, সেই আনুগত্য এত বেশী নয় যে বঙ্কিমের ঔপন্যাসিক সত্ত্বা সেই জন্য টাল খেয়ে যায়। ঔপন্যাসিকের মনটাই সেখানে প্রাধান্য পাচ্ছে, ফলে ইতিহাসকে হয় এড়িয়ে গিয়ে চরিত্রের মধ্যে ঢুকতে হচ্ছে, প্রধাণ চরিত্রটিকে পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে অথবা ইতিহাসের ধোঁয়াশাগুলোকে নিজের মত করে নস্যাৎ করতে হচ্ছে। আর এসব করতে গিয়ে সব মিলিয়ে একটা দ্বন্দ থেকেই যাচ্ছে লেখায়, জীবনের শেষ উপন্যাস লেখার সময়েও, যা মোটামুটি বঙ্কিমের সারা জীবনের লেখালেখিরই একটা প্রধান দিক বলে মনে হয়।

    (বঙ্কিম যখন লিখছেন, তখন তো আর ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারাটি তৈরী হয়নি বাংলায়, বঙ্কিমের তিন-চারটি উপন্যাস লেখার পরে যা তৈরী হল। বঙ্কিম তো একজন ঔপন্যাসিকই শুধু, প্রেমের উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস, এসব কিছুরই প্রথম বঙ্কিমেরই কলম থেকে, এরকম মত ইত্যাদি তো পরে তৈরী হয়েছে। সেসব ঠিক আছে, ক্যানোনাইজেসন পরেই ঘটে। কিন্তু অবাক লাগে কীভাবে সত্তর-আশি পাতার ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধারা মোটামুটি কয়েক দশকের মধ্যে বা বড়জোর একশো বছরের মধ্যেই, কিছু না হোক, কম করে শ'তিনেক পাতায় পৌছে গেল, যেখানে ইতিহাসের গল্পই প্রধান, মূলতঃ পীরিয়ড পীস যেন বা।)
  • oraphe | 340123.99.121223.135 | ১০ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৩৮377094
  • মান্তো ফিল্ম এর আলোচনা /আর্বানিটি/বাংলা সাহিত্য কনটেম্পোরারিটি উইথ অর্জুন অভিষেক/ট/দে/দমু/খ

    "৭০ পরবর্তীতে বাংলা লেখায় আর্বানিটির ফলে দলিত সাহিত্যটা তৈরী হল না, বোধির এই বক্তব্যটা বুঝিনি। মোটামুটি ষাট আর সত্তরের দশকে, মহারাষ্ট্রে যখন দলিত রাজনীতি আর দলিত সাহিত্যের বেড়ে ওঠা, এখানে তখন বামপন্থী আন্দোলন হয়ে নকশাল আন্দোলন। ফলে লেখালেখি যা তার একটা অংশ এইসব নিয়ে। কিন্তু নকশাল আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ারও পরে, সত্তরের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে যার লিখতে শুরু করলেন তার অনেকেই কর্মসূত্রে গ্রামে গেলেন, সেখানকার মানুষকে লেখায় নিয়ে এলেন। এদের কাছে কিছুটা মডেল হিসেবে হয়ত মহাশ্বেতা দেবীর লেখাপত্রভ ছিল, বাকিটা তারা যা দেখছেন, সেখান থেকে লেখা উঠে আসছে। আমার কাছে তো বরং উল্টোটা, সত্তর আর আশির দশকের বাংলায় লেখালেখি মূলতঃ নন-আর্বান, আমি দেশ-আনন্দর কথা বলছি না। দেবেশ রায়ের তিস্তাপাড়ও তো সত্তরের শেষ থেকে আশির দশকের প্রথম অবধি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকল কিন্তু সেটা দলিত সাহিত্য না হলেও, আর্বান সাহিত্য নয়।"
  • sors bhaaTa | 340112.99.675612.98 (*) | ১০ অক্টোবর ২০১৮ ১৭:৩৯377095
  • IP Address : 340112.99.675612.98 (*) Date:10 Oct 2018 -- 05:27 PM
  • সিএস | 162.158.158.236 | ১৬ মার্চ ২০২০ ১৭:৫৪730058
  • করোনার দিনগুলিতে বই
    =====================

    যখন এই সময়েও চারপাশ দেখে অ্যাংজাইটি আর প্যানিক কিছু মাত্রায় হলেও থাকছে, যদি বাড়িতে বন্দী হয়ে থাকতে হয় বা সেরকম না হলেও, পড়ে ফেলুন ড্যানিয়েল ডিফোর 'আ জর্নাল ওফ প্লেগ ইয়ার'। ১৭২২ এ প্রকাশিত, ডিফো তখন একটা ফর্ম পেয়ে গেছেন - যেখানে তথ্য আর ফিকশনের মিশ্রণ ঘটাতে পারছেন, বই বিক্রী হচ্ছে ভালই, উপরন্তু লোকেদের মধ্যেও ছাপা বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেশী পরিমাণে - তো সেই ফর্মটা ব্যবহার করেই এই বইখানি। পড়ে মনে হবে, রিয়েল মেমোয়ার এমন এক ব্যক্তির যে ১৬৬৫-র লণ্ডন শহরের প্লেগের সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে যাতে ঐ শহরের প্রায় এক-্চতুর্থাংশ মানুষ মারা যায়, কিন্তু না ডিফোর তো তখন পাঁচ বছর বয়স ফলে এই প্লেগ তিনি দেখেননি। ব্যবহার করেছিলেন ওনার এক কাকার লেখা ডায়েরী আর সরকারি তথ্য। কিন্তু verisimilitude এমনই , যেন মনে হবে আঁখো দেখা হাল, লন্ডন শহরের বিভিন্ন অঞ্চল যেখানে প্লেগের প্রকোপ বেশী বা কম হয়েছিল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা, সপ্তাহ অনুযায়ী মৃত্যুর হার, মানুষের রিয়াকশান, ঘরবন্দী করার সরকারি প্রয়াস কিন্তু ভয় পেয়ে অনেকেরই শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাওয়া, দরজা-জানলা ভেঙেও কারণ রোগ ছড়ানোটি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাড়ির দরজা বাইরে থেকে আঁটকে দেওয়া হয় কিন্তু ভেতরে পরিবারের লোকজনের বন্দী হয়ে পড়ার ভয়। সিম্পটম দেখা দেওয়া আর মৃত্যুর মধ্যে খুবই অল্প সময় অনেক ক্ষেত্রেই, প্রথম দিকে এতই মৃত্যু যে ঠিক্ঠাক কবরও না দিতে পারা, গর্ত খুঁড়ে শবদেহগুলো পুঁতে দেওয়া, গুজব, মানুষের হাল ছেড়ে দেওয়া, মানে একস্ট্রীম পরিস্থিতিতে একটা জায়গার মানুষের কী হতে পারে, তার সবেরই বিবরণ রয়ে গেছে এই বইটাতে।

    কিন্তু এর সাথে সারামাগোর 'ব্লাইণ্ডনেস" ই বা পড়বেন না কেন ? সমাজ-্সভ্যতা-মানুষের ওপর, তাদের আচরণের ওপর যদি খুব একটা বিশ্বাস না থাকে, সাধারণ সময়ে না হোক, বিশেষ পরিস্থিতিতে। যেমন বইটিতেও তো নামহীন শহরটিতে হঠাৎ করেই অন্ধ্ত্বর আক্রমণ শুরু হয়, ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লোকে অন্ধ হয়ে যেতে থাকে, তারপর তো কষ্টকর কোয়ারান্টাইন, ব্যবহার্য বস্তুর অপ্রতুলতা, প্যানিক, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সলিডারিটির ভেঙে পড়া, অস্ত্র হাতে লোকজনের রাস্তায় নেমে পড়া, মার ও মৃত্যু আর হতাশা। তারপর হঠাৎ করেই অন্ধ্ত্ব রোগটির মিলিয়ে যাওয়া, যেমন করে এসেছিল তেমন করেই, কোন আগাম কারণ বা আভাষ না দিয়েই।
  • সিএস | 162.158.158.236 | ১৬ মার্চ ২০২০ ১৭:৫৭730059
  • বয়সকালে এসে বুঝতে পেরেছি যে ডিফো, সুইফট বা সার্ভান্তেস, এই তিনজনের লেখা আর আর যাই হোক, শিশুতোষ লেখা নয় বা এরা ছোটদের লেখক নয়। ধারণাটা তৈরী হয়েছিল অতি অবশ্যই ছোটবেলায় কাহিনিগুলো পড়ে বা লেখাগুলোর সংক্ষিপ্ত ভার্শন, কিন্তু এখন বুঝেছি, এই তিনজনেই একদিকে যেমন অতিপ্রজ (সার্ভান্তেস সংখ্যার দিক দিয়ে না হলেও, আকারের দিক দিয়ে তো বটেও) তেমনি এমন কোন বিষয় নেই যা লেখায় নিয়ে আসতে সচেষ্ট নন। ডিফো আর সুইফট তো একই সাথে গপ্প লিখছেন (সেইজন্যই বাচ্চাদের জন্যই তাঁদের লেখাকে হাজির করা গেছে) আবার ঘোরতরভাবে চারপাশের ক্রিটিক। ডিফো তো প্যামফ্লেট লিখছেন, রাজনীতি নিয়ে, ধর্ম নিয়ে পজিশন নিচ্ছেন, রবিনসন ক্রুসো বইটাও যে কী নিয়ে - ব্যক্তির জীবনী, ইকোনমিক ম্যানের প্রতিভূ, কলোনির কাহিনি, সভ্যতার বেড়ে ওঠা, আধ্যাত্মিক যাত্রা - সে নিয়ে তক্ক আছেই, আবার কয়েক বছরের মধ্যেই সুইফ্ট যখন গালিভারের গপ্প লিখবেন, তখন একটা লক্ষ্য ছিল রবিনসনের গপ্পের সমালোচনা করা (একটা খন্ডের চরিত্রর নামই ছিল রবিনসন)। আর দু'জনেই কমবেশী স্যাটায়ারিস্ট, যেটা সার্ভান্তেসের লেখাতেও এসে পড়ে, প্রচলিত শিভালরির কাহিনিগুলোকে নিয়ে মজা করা; কিন্তু তারই মধ্যে দিয়ে আবার সেইসব যুগ হারিয়ে গেছে সেই নিয়েও খানিক বিষাদ, ইলুশনের মধ্যে বুড়ো কিহোতের ঢুকে পড়া, হাওয়ার সাথে কুস্তি করা !

    আর এটাও যে তিনজনেই - অন্তত ডিফো আর সার্ভান্তেস তো বটেই - নির্লজ্জভাবে যেন বাক্য আর লেখার মোহে পড়ে যাওয়া লেখক। বিরামহীন বাক্যস্রোত আর কাহিনি থেকে কাহিনি, ডাইগ্রেশনের চূড়ান্ত, পাঠককে সেসবের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া, এখনকার পাঠকের কাছে যা দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায়; না ব্রেভিটি এনাদের লেখায় বিশেষ নেই, ছোট, চৌকো লেখা এদের কাজে দেখা যায়না। হয়ত সংবাদপত্র আর খবরের যুগ তখনও চেপে বসেনি, সরকারি আর আইনের কাজে ভাষা যেভাবে ব্যবহৃত হত, হয়ত বা বাইবেলেও বা সারমনে, তার প্রভাব হয়ত এনাদের লেখায়, শিওর নই। কিন্তু এরা অতীব পপুলার, অর্থাৎ তৎকালীন পাঠকদের এইসব লেখা পড়তে বিশেষ অসুবিধে হয়নি বলেই মনে হয়, পাঠাভ্যাস তো যুগের হাওয়াতেই গড়ে ওঠে। আর ইংরেজী ভাষায় ডাইগ্রেশনের চূড়ামনি তো ডিফো-সুইফটের কয়েক বছর পরে আসবেন, লরেন্স স্টার্ন, ট্রিস্টাম শ্যান্ডি উপন্যাসখানি নিয়ে, একমুখী কাহিনিকে তুড়ি মেরে দেওয়া, চরিত্রটির জন্ম নিতেই কম করে পঞ্চাশটি পাতা পেরিয়ে যাবে, তো সেই লেখাও জনপ্রিয়তা পাবে খুবই আর সাগর পেরিয়ে ফ্রান্সে দিদেরোকে (প্রায় সমসময়ে) বা আরো পরে ব্রাজিলে মাচাদো দ্য আসিসকে। মানে বিন্দুগুলোকে যোগ করলে,মোটামুটি দুশো-তিনশো বছরের ব্যবধানে, সার্ভান্তেস-্ডিফো-সুইফট-্স্টার্ণ-্দিদেরো-মাচাদো দ্য আসিস, পশ্চিমী গদ্যসাহিত্যের শিখরশৃঙ্গগুলি, কমবেশী ক্রমান্বয়ে প্রভাবিত।

    বোধির মন্তব্য পড়ে যে ডিফো-সুইফট নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, তাও সেটা বি আই পি এল এর সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, আমার তো সেরকম কিছু মনে পড়ল না। কিন্তু এইসবই মনে হল।
  • o | 162.158.63.67 | ১৭ মার্চ ২০২০ ১৭:১২730088
  • এই পোস্টগুলো তুলে রাখলাম। যদি সিএস লেখেন কখনও, একটা কন্টিনিউটি পাওয়া যাবে। :-)


    সিএস | 162.158.118.245 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:৪০431545
    দ্যাখেন, বিয়াত্রিচেতেও 'ব' আছে, বনলতাতেও 'ব' আছে। জীবনানন্দ, দান্তে ভালো করেই পড়েছিলেন আর দান্তের লেখায় তো বিয়াত্রিচেই পথহারা দান্তেকে সঅর্গপানে নিয়ে যায়। কিন্তু জীবননান্দ অনেক পরের যুগের মানুষ হয়ে জানেন যে সঅর্গ ব্যাপারটা আর নেই, ফলতঃ অনেক ঘুরে, অনেক হাল ভেঙ্গে শেষ পর্যন্ত বিয়াত্রিচেকে আর পাওয়া যাচ্ছে না, বড়জোড় পড়ে থাকছে নাটোরের 'সাধারণ' বনলতা সেন।

    (দান্তে অ্যাংগেলটা আনতে পারলে, জীবনানন্দর কবিতা নিয়ে খানকতক লেখা সহজে নামানো যাবে।

    (আর, টাইপ করতে গিয়ে ঝামেলা, স এ ব এ সঅর্গ লিখতে পারলাম না)

    সিএস | 162.158.118.185 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৬:৩১431560
    জীবনানন্দ প্রসঙ্গে দান্তেকে আনা, মজা করে বলিনি। জীবনানন্দের কাছে পশ্চিমি সাহিত্যের তিনটে প্রধান (মহৎ) বিন্দু ছিল। হোমার-্দান্তে-জয়েস, এই তিনজনের এক যোগ ছিল। কিন্তু শুধু জীবনানন্দই নয়, আধুনিকেরা দান্তের নরক থেকে যত নিয়েছে স্বর্গ থেকে নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু নয়। এলিয়ট যখন ওয়েস্ট্ল্যান্ডে দান্তে কোট করেন (I had not thought death had undone so many), তখন লণ্ডন ব্রীজের ওপর যুদ্ধ পরবর্তী নতমুখ মানুষের হেঁটে যাওয়াকে দান্তের নরকের সাজাপ্রাপ্ত আত্মাদের সাথে তুলনা করেন। তো, দান্তের স্বর্গকে যে আধুনিকেরা নিতে পারছেন না (যদিও এলিয়টের ক্যাথলিক পর্বে, Four Quartrets ? এর ছোঁয়া আছে), তার কারণ দান্তের স্বর্গে আলোরই প্রাধান্য, আত্মাগুলির রূপ অনেক ক্ষেত্রেই থাকে আলো বিচ্ছুরণের মধ্যে, স্বর্গে ঈশ্বরের কোন মনুষ্যরূপ তো দেখানো হয়নি, সেও ছিল আলোই। কিন্তু দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী পর্যায়ে বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধর পরবর্তী পর্যায়ে, জীবননন্দের মত আধুনিকদের কাছে, আলো-টালো বিশেষ থাকছে না, বাণী-ফাণীও বিশেষ আসছে না , বড়জোর "চারিদিকে মহাপুরুষের উক্তি কোলাহল করে", তার বেশী কিছু নয়, ঈশ্বরের তো কোন উল্লেখই নেই, বাসমতীর উপাখ্যানে প্রধান চরিত্রটি লুক্রেশিয়াসের বইটি খুঁজে বেড়াচ্ছে, বইয়ের নাম হচ্ছে 'সাতটি তারার তিমির', অনেক জ্ঞানের পরও অন্ধকারই থাকছে, বড়জোর মানুষকে আশা দেখানোর জন্য রয়ে যাচ্ছে অনুসূর্য, পূর্ণ সুর্য কদাপি নয়।

    সিএস | 162.158.118.107 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৭:২৩431570
    ডিভাইন কমেডির তিনটে ভাগ তো সমমাপের, প্রতিটিতেই তেত্রিশটি ক্যান্টো, প্রতি ক্যান্টোতেই সমসংখ্যক পংক্তি। ফলে, স্বর্গ অংশটি ছোট করে বলা নয়, বরং প্যারাদিসো থেকে ধরলে, স্বর্গ বা স্বর্গের ছোঁয়া লাগা বিষয়ই বেশী।

    আর এই হল অনুসূর্যের গানঃ

    https://sites.google.com/site/mohaprithibi/Home/sattitarartimir/onusurjergaan

    সিএস | 162.158.118.39 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:২৪431608
    খ লিখেছে দেখলাম, আধুনিক সাহিত্যের মূল অবস্থানটাই হলো, কনটেম্পোরারিকে অ্যাড্রেস করা, এই নিয়ে দু'টো কথা লেখা যায়। মানে দান্তেকে টেনে এনে আর কি । ঃ-)

    সিএস | 162.158.119.46 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:৪৫431614
    লিখব বলেছি, কখন লিখব বলিনি । ঃ-)

    একোর মত না হলেও, এটা মনে করি, যে মডার্নিস্টদের সম্বন্ধে বলতে গেলে, এদেশ হোক বা ওদেশ, দান্তেকে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল; বিনা কারণে, এনারা দান্তেকে রেফার করেননি। পাঁচশো-ছশো বছরের আগে হলেও দান্তের সাথে এনারা যুগসখ্যতা খুঁজে পেয়েছিলেন হয়ত, জীবনান্দের প্রবন্ধে তো দান্তের প্রসঙ্গ আছে, মহাভারতের সাথেই।

    সিএস | 172.69.34.179 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৪:৫৪431638
    poetry of trance মনে হতে পারে কিন্তু তা বলে ট্রান্সের মধ্যে বসে লেখাগুলো লেখেননি, বা ব্রেঁতোদের মতো অটোমেটিক রাইটিংও নয়। শব্দ খুঁজে পেতে বসাতেন, পান্ডুলিপির কাটাকুটি সেটাই প্রমাণ করে। সমসময়ে এটাই প্রচলিত ছিল যে জীবনানন্দর কাছে কবিতা ঘোরের মতো আসে, কিন্তু মারা যাওয়ার পরে বিষ্ণু দে কবিতার পান্ডুলিপি দেখে বলেছিলেন, একি ইনি তো আমাদের মত করেই কবিতা লিখতেন, শব্দ খুঁজতে হত। এরকম উদাহরণও আছে যে প্রথমে ইংরেজী শব্দ বসিয়েছেন তারপর বাংলা শব্দ বসিয়েছেন। এটা আসলে ক্রাফটের ব্যাপার, এমনই সেই ক্রাফ্ট আর লেগে থাকা যে শেষে যে বস্তুটি দাঁড়ায় সেটি ঠিক যে বিষয়কে প্রকাশ করতে চাইছে অবিকল যেন তারই মতো। মৃত্যুর কথা লিখলে, স্বপ্ন অথবা বেদনার কথাও, যেন মনে গয় ঐসবের ভেতরেই ঢুকে যাওয়া গেছে। মৃত্যুর আগে কবিতাটি এর একটি বড় উদাহরণ, লোর্কা কথিত দুয়েন্দে যেন আমাদের হাতে ধরে দেখিয়ে দেওয়া হয়। আর্ট এটাই, আর্টিস্টের হাতটি দেখা যাচ্ছে না, শুধু হাতের কাজটি উপস্থিত।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন