এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Muhammad Sadequzzaman Sharif | ১৫ জুন ২০১৭ ০০:৪৩366417
  • বর্ষা শুরু হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের জন্যই হোক আর আমাদের হুমায়ুন আহমেদের জন্যই হোক বর্ষা আমাদের জীবনে দারুন ভাবে মিশে আছে। ঝুম বৃষ্টি শুরু হবে আর কোন বাঙ্গালির মন আনচান করে উঠবে না তা বোধহয়য় কম ক্ষেত্রেই ঘটবে।আমাদের সাহিত্য জুড়ে রানী হয়ে বসে আছে বর্ষা। বর্ষা নিয়ে কতশত লেখা আছে তার বোধহয়য় কোন লেখাজোখা নেই। ইংরেজি সাহিত্যে যেমন তুষার আমাদের তেমন বর্ষা। বাংলাদেশে বর্ষা, পূর্ণিমার চাঁদ এগুলা নিয়ে মজে থাকা শিখিয়েছে হুমায়ুন আহমেদ। তার বইপত্রে, নাটক সিনামায় বর্ষা নিয়ে এত মাতামাতি যে কিছু মানুষ এসবের প্রেমে পরে গেল একেবারে চিরতরে। আমার অবশ্য হুমায়ুন আহমেদ পড়ার আগেই বৃষ্টির প্রতি আলাদা টান ছিল, কেন? আল্লাই জানে!! তবে চাঁদ দেখা, পূর্ণিমা রাতে ঘর ছেড়ে বাহিরে ঘুরাঘুরি শিক্ষার গুরু যে একমাত্র হুমায়ুন আহমেদ এ কথা না স্বীকার করে উপায় নেই।

    সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম।ক্লাস শুরু হতো বারোটা থেকে।খুব রাগ হতো বারোটায় স্কুলে যেতে।রাগ হতো সময় অসময় বলে না রাগ হতো বৃষ্টির জন্য।কারন বৃষ্টি শুরু হতো সকাল থেকে কিন্তু ঠিক বারোটার বাজার আগে আগে একদম বন্ধ হয়ে যেত,আম্মা বলত ''নিফুটি হয়ে গেছে''। আর আমাকে বিরস বদনে স্কুলের জন্য রউনা হতে হতো।সকালে ক্লাস থাকত আমার বড় ভাই বোনদের,তাদের দেখতাম কি সুন্দর স্কুলে না গিয়ে কাঁথার নিচে গল্পের বই নিয়ে টুপটাপ শুয়ে পড়ছে আর আমি আছি গভীর চিন্তায় বৃষ্টি কি বারোটা পর্যন্ত পড়বে? নাকি ঠিক সাড়ে এগারোটার সময় বন্ধ হবে!!! স্কুলে যেতে আপত্তি ছিল না আপত্তি ছিল বৃষ্টির দিনে স্কুলে যেতে।এমন বৃষ্টির দিনে কেন স্কুলে যেতে হবে আমার মাথায় ধরত না।ঝুম বৃষ্টিতে আমি ঘরে বসে আছি এই দৃশ্য খুব কমই রচিত হইছে।টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ পাওয়া মাত্র আমার বৃষ্টিতে নামা শেষ।এই কারনে ধরাও কম খায় নাই। নামলাম আর বৃষ্টি নাই!নাই তো নাই,কড়া রোদ উঠে গেছে অনেক বার!!বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এলাকায় টহল দিতাম।খালের পানি কতটুকু বাড়ল,কে কি মাছ ধরল!!

    এক এক দিন সকালে বা রাতে বৃষ্টি শুরু হতো তারপর চলত সারা দিন হয়ত বা টানা সাত দিন!!শেরপুরে আমার বাড়ি যে এলাকায় ওইখানে সাধারনত পানি উঠে না(বন্যার পানি না বৃষ্টির পানি,শেরপুর শহরে বন্যার পানি উঠার কোন সুযোগ নাই)কিন্তু মাঝে মাঝে প্রবল বর্ষণে রাস্তায় পানি জমে যেত,তখন শুরু হতো আমাদের মজা,পানির মধ্যে ঘুরাঘুরি।শুধু আমি না,এলাকার প্রায় সবাই,ছেলে মেয়ে,বড় ছোট সবাই রাস্তায় একপাক ঘুরে যেত।আমার কাজ যেত অনেক বেড়ে!!!সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নিতে হত আমার,কেউ এই দায়িত্ব আমাকে দেয় নাই আমি নিজেই নিয়ে নিছিলাম এই দায়িত্ব।

    আর একটু বড় যখন হলাম তখন আমার টহল দেয়ার এলাকা আরও বড় হল,তখন আমি বিভিন্ন এলাকায়,কার এলাকায় কতটুকু পানি জমল,কোন এলাকায় কেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে তা নজরদারি করে বেড়াতাম।পার্কের মাঠে কতটুকু পানি উঠল ঐ পানি কি কলেজ মাঠের পানি থেকে কম কিনা এই রকম নানা বিষয় ছিল তখনের আমার মাথা ব্যাথা!! এগুলা কারনেই বৃষ্টি কিভাবে জানি আমার রক্তে ঢুকে গেছে,কখন কিভাবে জানি না।প্রাইমারি পরে যখন হাই স্কুলে ভর্তি হলাম তখন সকালে যেতে হতো স্কুলে,কিন্তু তখন মনে হতো বৃষ্টি আমার সঙ্গে খেলা খেলত,দশটার আগে কিভাবে জানি বৃষ্টি থেমে যেত।
    আরও একটু যখন বড় হলাম,তখন টহল দেয়ার পরিধি আরও বড় হয়ে গেল।শেরপুর জামালপুর রোডে ড্রাইভেশন আছে একটা,ঐখানে প্রায়ই পানি আসত, আমার বা আমাদের মতো যারা ছিল তাদের ঐ পানিতে চুবানি না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি হতো না।ভয়ংকর ব্যাপার ছিল এই ব্যাপারটা।কারন ওইখানে তীব্র স্রোত থাকত এবং প্রতি বছর দুই একজন করে মারাও যেত।আমরা তাতে থোরাই কেয়ার করতাম।

    এই সবই বলছি সোনালি সময়ের কথা,যখন শেরপুরের ক্ষুদ্র একটা এলাকার ক্ষুদ্র একটা অংশের আমি ছিলাম অধিপতি।এখন আমার বর্ষা আসে বর্ষা যায় হালকা একটু বৃষ্টির ঝাপটা দিয়ে।কোন দিন বুঝতেই পারি না বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে।(ওইদিন এফবিতে স্ট্যাটাস দেখে বুঝলাম বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে!)এখন ইচ্ছা এবং সুযোগ থাকলেও বৃষ্টিতে নামা হয় না কারন ঢাকার রাস্তাঘাট বৃষ্টিতে হাটার জন্য উপযুক্ত হয় নাই এখনও।আমার বাসার গলি দু' ফোটা বৃষ্টি পরতেই ড্রেনের সমস্ত আবর্জনা নিয়ে আমার দরজায় এসে হাজির হয়,তাদের অবজ্ঞা করে বৃষ্টিতে ভিজা আমার কম্ম না।তবুও বৃষ্টিতে নামই,বৃষ্টিতে নেমে ভিজছি সংসদ ভবনের সামনে,ফার্মগেট পার্কে,ভিজেছি মনের সুখে তারপর ময়লা আবর্জনা কে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে রিক্সা করে বাসায় ঢুকছি।কিন্তু দিনে দিনে আমার বৃষ্টিতে ভিজার মাত্রা কমে আসছে আশঙ্কাজনক ভাবে। এখন বৃষ্টি হচ্ছে বুঝতে পারলে অফিসের জানালায় গিয়ে দাঁড়াই আর পিচগলা রাস্তায় বৃষ্টি ভেজা বাস দেখি,প্রাইভেট কার দেখি আর দেখি হকারের মাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাহাকার,পথিকের লম্বা লম্বা পায়ে আশ্রয়ের জন্য দৌড়।যে আমি টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতাম,যে আমি গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতাম,শুনতাম পুকুরের পানিতে ডুব দিয়ে পানির উপরে বৃষ্টি পরার শব্দ সেই আমি শব্দহীন বৃষ্টি দেখি থাই গ্লাসের আড়ালে দাড়িয়ে।দাড়িয়ে দাড়িয়ে শব্দহিন বৃষ্টি দেখি আর আতিপাতি করে খুজি এমন কেউ আছি কিনা যে বৃষ্টিতে ভেজার জন্যই ভিজতেছে,যে বৃষ্টি হয়া মাত্রই সমস্ত কাজকে ছুটি দিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে,যে জানে এর চেয়ে বড় ঘটনা এই মুহূর্তে আর নাই এই জগত সংসারে !!সত্যি কথা বলতে কি!!আমি মাঝে মাঝেই তাদের দেখা পাই।রাস্তায় তাদের দেখতে পেলেই আমি মনে মনে আশীর্বাদ করি,বলি তোরা চালায় যা ভাই,থামিস না,হেরে যাস না কোন মতেই। মাঝে মাঝে অফিসের নিচে নেমে দাঁড়াই,গায়ে বৃষ্টির ঝাপটা লাগে আর আমি ভাবি এইটুকুই তো লাভ,সামনে এতটুকুও পাবো কিনা কে জানে!!বৃষ্টির সাথে একটা আত্মার সম্পর্ক আছে আমার আর আমি চাই আমৃত্যু টিকে থাকুক সম্পর্কটা।
  • aranya | 172.118.16.5 | ১৬ জুন ২০১৭ ০৪:১১366418
  • বাঃ
  • পাই | 57.29.199.106 | ২০ জুলাই ২০১৭ ২১:১২366419
  • বেশ।

    কিছুদিন আগে হুমায়ূন আহমেদের বর্ষা নিয়ে একটা লেখা, পয়লা আষাঢ়ের, খুব ঘুরছিল। কেউ দিতে পারেন? অনেক ধন্যবাদ।
  • pi | 57.29.199.106 | ২০ জুলাই ২০১৭ ২২:২৪366420
  • পেয়ে গেছি। ফারহা দিল।

    '
  • pi | 57.29.199.106 | ২০ জুলাই ২০১৭ ২২:২৫366421
  • কয়েক বছর আগের কথা।ঢাকা শহরের এক কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে খেতে গিয়েছি।চমৎকার ব্যবস্থা।অতিথির সংখ্যা কম।প্রচুর আয়োজন।থালা-বাসনগুলি পরিচ্ছন্ন।যারা পোলাও খাবেন না,তাদের জন্যে সরু চালের ভাতের ব্যবস্থা।নিমন্ত্রিতদের মধ্যে দেখলাম বেশকিছু বিদেশী মানুষও আছেন।তারা বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে আগ্রহী।দেখাবার মতো কোনো অনুষ্ঠান নেই বলে কন্যা কর্তা খানিকটা বিব্রত।এটা শুধুমাত্র খাওয়ার অনুষ্ঠান তা বলতে বোধহয় কন্যা-কর্তার খারাপ লাগছে।বিদেশীরা যতবারই জানতে চাচ্ছে,মূল অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে?ততবারই তাদের বলা হচ্ছে,হবে হবে।
    কোণার দিকের একটা ফাঁকা টেবিলে খতে বসেছি।আমার পাশের চেয়ারে এক বিদেশী ভদ্রলোক এসে বসলেন।আমার কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো।মেজাজ খারাপ করার প্রধান কারণ - উনি সঙ্গে করে কাঁটা চামচ নিয়ে এসেছেন।এদের আদিখ্যেতা সহ্য করা মুশকিল।কাঁটা চামচ নিশ্চয়ই এখানে আছে।সঙ্গে করে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিলো না।আমি আগেও লক্ষ করেছি,যারা কাঁটা চামচ দিয়ে খায় তারা হাতে যারা খায় তাদেরকে বর্বর গণ্য করে।যেন সভ্য জাতির একমাত্র লোগো হলো কাঁটা চামচ।পাশের বিদেশী তার পরিচয় দিলেন।নাম পল অরসন।নিবাস নিউমেক্সিকোর লেক সিটি।কোনো এক এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত আছেন।বাংলাদেশ এসেছেন অল্পদিন হলো।এখনো ঢাকার বাইরে যান নি।বিমানের টিকেট পাওয়া গেলে সামনের সপ্তাহে কক্সবাজার যাবেন।
    কিছু জিজ্ঞেস না করলে অভদ্রতা হয় বলেই বললাম,বাংলাদেশ কেমন লাগছে?
    পল অরসন চোখ বড় বড় করে বলল,হ,োন্দের্ফুল!
    এদের মুখে হ,োন্দের্ফুল শুনে আহ্লাদিত হবার কিছু নেই।এরা এমন বলেই থাকে।এরা যখন এদেশে আসে,তখন তাদের বলে দেওয়া হয়,নরকের মত একটা জায়গায় যাচ্ছ।প্রচণ্ড গরম।মশা-মাছি।কলেরা-ডায়রিয়া।মানুষগুলিও খারাপ।বেশির ভাগই চোর।যারা চোর না তারা ঘুষখোর।এরা প্রোগ্রাম করা অবস্থায় আসে,সেই প্রোগ্রাম ঠিক রেখেই বিদেয় হয়।মাঝখানে হ োন্দের্ফুল জাতীয় কিছু ফাকা বুলি আওড়ায়।
    আমি পল অরসনের দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললাম,তুমি যে ওয়ান্ডারফুল বললে,শুনে খুশি হলাম।বাংলাদেশের কোন জিনিসটা তোমার কাছে ওয়ান্ডারফুল মনে হয়েছে?
    পল বলল,তোমাদের বর্ষা।
    আমি হকচকিয়ে গেলাম।এ বলে কী!আমি আগ্রহ নিয়ে পলের দিকে তাকালাম।পল বলল,বৃষ্টি যে এত সুন্দর হতে পারে এদেশে আসার আগে আমি বুঝতে পারিনি।বৃষ্টি মনে হয় তোমাদের দেশের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।তুমি শুনলে অবাক হবে,আমি একবার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রিকশার হুড ফেলে মতিঝিল থেকে গুলশানে গিয়েছি।আমার রিকশাওয়ালা ভেবেছে,আমি পাগল।
    আমি পলের দিকে ঝুঁকে এসে বললাম,তোমার কথা শুনে খুব ভালো লাগল।অনেক বিদেশীর অনেক সুন্দর কথা আমি শুনেছি,কিন্তু তোমার মতো সুন্দর কথা আমাকে এর আগে কেউ বলেনি।এত চমৎকার একটি কথা বলার জন্যে তোমার অপরাধ ক্ষমা করা হলো।
    পল অবাক হয়ে বলল,আমি কী অপরাধ করছি?
    পকেট থেকে কাঁটা চামচ বের করে অপরাধ করেছ।
    পল হো-হো করে হেসে ফেলল।বিদেশীরা এমন প্রাণখোলা হাসি হাসে না বলেই আমার ধারণা।পল অরসনের আরো কিছু ব্যাপার আমার পছন্দ হলো।যেমন,খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে বলল,নাও,সিগারেট নাও।
    বিদেশীরা এখন সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে।তারা সিগারেট তৈরি করে গরিব দেশগুলিতে পাঠায়।নিজেরা খায় না।ভাবটা এরকম - অন্যরা মরুক,আমরা বেঁচে থাকবো।তারপরেও কেউ কেউ খায়।তবে তারা কখনো অন্যদের সাধে না।
    আমি পলের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিলাম।পানের ডালা সাজানো ছিল।পল নিতান্ত পরিচিত ভঙ্গিতে পান মুখে দিয়ে চুন খুঁজতে লাগল।এধরণের সাহেবদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করা যায়।বর্ষা নিয়েই কথা বলা যেতে পারে।তাছাড়া গরম পড়েছে প্রচণ্ড।এই গরমে বৃষ্টির কথা ভাবতেও ভালো লাগে।আমি বললাম,পল,তোমার বর্ষা কখন ভালো লাগল?
    পল অরসন অবিকল বৃদ্ধা মহিলাদের মতো পানের পিক ফেলে হাসিমুখে বলল,সে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে ঢাকা এসে পৌঁছেছি দুপুরে।প্লেন থেকে নেমেই দেখি প্রচণ্ড রোদ,প্রচণ্ড গরম।কিছুক্ষণের মধ্যেই গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল।আমি ভাবলাম,সর্বনাশ হয়েছে!এই দেশে থাকব কী করে?বনানীতে আমার জন্য বাসা ঠিক করে রাখা হয়েছিল।সেখানে এয়ারকুলার আছে বলে আমাকে চিঠি লিখে জানানো হয়েছে।আমি ভাবছি,কোনোমতে বাসায় পৌঁছে এয়ারকুলার ছেড়ে চুপচাপ বসে থাকবো।ঘরে কোনো চৌবাচ্চা থাকলে সেখানেও গলা ডুবিয়ে বসে থাকা যায়।
    বাসায় পৌঁছে দেখি,এয়ারকুলার নষ্ট।সারাই করার জন্যো ওয়ার্কশপে দেয়া হয়েছে।মেজাজ কী যে খারাপ হলো বলার না।ছটফট করতে লাগলাম।এক ফোঁটা বাতাস নেই।ফ্যান ছেড়ে দিয়েছি,ফ্যানের বাতাসও গরম।
    বিকেলে এক মিরাকল ঘটে গেল।দেখি,আকাশে মেঘ জমেছে।ঘন কালো মেঘ।আমার বাবুর্চি ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল,কালবোশেখি কামিং স্যার।ব্যাপার কিছুই বুঝলাম না।মনে হলো,আনন্দজনক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।হঠাৎ করে গরম কমে গেল।হিমশীতল হাওয়া বইতে লাগল।শরীর জুড়িয়ে গেল।তারপর নামল বৃষ্টি।প্রচণ্ড বর্ষণ,সেই সঙ্গে ঝরো হাওয়া।বাবুর্চি ইয়াছিন ছুটে এসে বলল,স্যার শিল পড়তাছে,শিল।বলেই ছাদের দিকে ছুটে গেল।আমিও গেলাম পেছনে পেছনে।ছাদে উঠে দেখি,চারদিকে মহা আনন্দময় পরিবেশ।আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করে শিল কুড়াচ্ছে।আমি এবং আমার বাবুর্চি আমরা দু'জনে মিলে এক ব্যাগ শিল কুড়িয়ে ফেললাম।আমি ইয়াছিনকে বললাম,এখন আমরা এগুলি দিয়ে কী করব?
    ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল,ফেলে দিব।
    আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল।প্রথম তুষারপাতের সময় আমরা তুষারের ভেতর ছোটাছুটি করতাম।তুষারের বল বানিয়ে একে অন্যের গায়ে ছুড়ে দিতাম।এখানেও তাই হচ্ছে।সবাই বৃষ্টিতে পানিতে ভিজে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
    আমি পলকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
    এসো কর স্নান নবধারা জলে
    এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।
    পল বলল,তুমি কী বললে?
    রবীন্দ্রনাথের গানের দু'টি লাইন বললাম।তিনি সবাইকে আহবান করছেন - বর্ষার প্রথম জলে স্নান করার জন্যে।
    বলো কী!তিনি সবাইকে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে বলেছেন?
    হ্যাঁ।
    তিনি আর কী বলেছেন?
    আরো অনেক কিছুই বলেছেন।তাঁর কাব্যের একটি বড় অংশ জুড়েই আছে বর্ষা।
    বলো কী!
    শুধু তাঁর না,এদেশে যত কবি জন্মেছেন তাঁদের সবার কাব্যের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে বর্ষা।
    পল খুব আগ্রহ নিয়ে বলল,বর্ষা নিয়ে এপর্যন্ত লেখা সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটি আমাকে বলো তো,প্লিজ।
    আমি তৎক্ষণাৎ বললাম,
    বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।
    এই এক লাইন?
    হ্যাঁ,এক লাইন।
    এর ইংরেজি কী?
    এর ইংরেজি হয় না।
    ইংরেজি হবে না কেনো?
    আক্ষরিক অনুবাদ হয়।তবে তার থেকে কিছুই বোঝা যায় না।আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে - অত্তের পত্তের রইন দ্রোপ্স,ফ্লূদ ইন থে রিভের।
    পল বিস্মিত হয়ে বলল,আমার কাছে তো মনে হচ্ছে খুবই সাধারণ একটা লাইন।
    সাধারণ তো বটেই।তবে অন্যরকম সাধারণ।এই একটি লাইন শুনলেই আমাদের মনে তীব্র আনন্দ এবং তীব্র ব্যথাবোধ হয়।কেন হয় তা আমরা নিজেরাও ঠিক জানি না।
    পল হা করে তাকিয়ে রইল।একসময় বলল,বর্ষা সম্পর্কে এরকম মজার আর কিছু আছে?
    আমি হাসিমুখে বললাম,বর্ষার প্রথম মেঘের ডাকের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের কিছু মাছের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়।তারা পানি ছেড়ে শুকনায় উঠে আসে।
    আশা করি তুমি আমার লেগ পুলিং করছো না।
    না,লেগ পুলিং করছি না।আমাদের দেশের এরকম ফুল আছে যা শুধু বর্ষাকালেই ফোটে।অদ্ভুত ফুল।পৃথিবীর আর কোনো ফুলের সঙ্গে এর মিল নেই।দেখতে সোনালি একটা টেনিস বলের মতো।যতদিন বর্ষা থাকবে ততদিন এই ফুল থাকবে।বর্ষা শেষ,ফুলও শেষ।
    ফুলের নাম কী?
    কদম।
    আমি বললাম,এই ফুল সম্পর্কে একটা মজার ব্যাপার হলো - বর্ষার প্রথম কদম ফুল যদি কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দেয়,তাহলে তাদের সম্পর্ক হয় বিষাদমাখা।কাজেই এই ফুল কেউ কাউকে দেয় না।
    এটা কি একটা মিথ?
    হ্যাঁ,মিথ বলতে পারো।
    পল তার নোটবই বের করে কদম ফুলের নাম লিখে নিল।আমি সেখানে রবীন্দ্রনাথের চারটি চরণও লিখে দিলাম।
    তুমি যদি দেখা না দাও
    করো আমায় হেলা
    কেমন করে কাটে আমার
    এমন বাদল বেলা।
    (ঈফ থৌ শোেস্ত মে নোত থ্য ফে,
    ঈফ থৌ লেঅভেস্ত মে ্হোল্ল্য অসিদে,
    ঈ ক্নো নোত হো ঈ অম তো পস্স
    ঠেসে লোঙ্গ রইন্য হৌর্স।)

    পল অরসনের সঙ্গে আর আমার দেখা হয় নি।তবে ঘোর বর্ষার সময় আমি যখন রাস্তায় থাকি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে তাকাই,যদি রিকশার হুড-ফেলা অবস্থায় ভিজতে ভিজতে কোনো সাহেবকে যেতে দেখা যায়।

    বর্যা যাপন
    হুমায়ূন আহমেদ।
  • | 52.110.161.198 | ২০ জুলাই ২০১৭ ২২:৩৬366422
  • বাহ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন