এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • পায়ের তলায় সর্ষেঃ জর্ডন

    Shuchismita
    অন্যান্য | ১৫ জুন ২০১৭ | ১৮১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৫ জুন ২০১৭ ০১:২৪366389
  • আম্মানে ল্যান্ড করলাম, তখন বোধহয় সন্ধ্যে সাতটা হবে। ইমিগ্রেশনে আমাদের জন্য আবু মোহাম্মেদ অপেক্ষা করছিলেন। ভিসার কাগজপত্রে স্ট্যাম্প মারিয়ে বাইরে বেরোতে আরো ঘন্টাখানেক লাগল।ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। হাল্কা শীত আছে। আবু মোহাম্মেদ আকাশের দিকে তাকিয়ে উদ্ভাসিত মুখে বললেন, কাল থেকে বৃষ্টি হবে। আমরা হতচকিত। শিকাগো থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে চারদিনের স্টপওভার নিয়েছি আম্মানে। এই কদিনে যেটুকু পারা যায় দেশটাকে দেখে নিতে হবে। এর মধ্যে বৃষ্টি নামলে কত কিছু না দেখা থেকে যাবে এইসব খেলা করছে তখন মাথায়। জর্ডন যে মরুভূমির দেশ, বৃষ্টি এখানে এক পরম আকাঙ্খিত বস্তু, সেসব আর ভাবছি না তখন।

    আমাদের ড্রাইভার মোফেক পার্কিংলটে দাঁড়িয়েছিলেন। পঞ্চাশোর্ধ টাকমাথা একজন মানুষ। প্রায় কুড়ি বছর ধরে ট্যুরিস্টদের দেশ দেখিয়ে বেড়ান। এয়ারপোর্ট মূল শহর থেকে কিছু দূরে। আমাদের যেতে হবে মিনিট পঞ্চাশ। আবু মোহাম্মেদ আমাদের সাথেই গাড়ীতে উঠলেন। নেমে যাবেন একটু পরে। মোফেক জানতে চাইলেন, আরব দেশে এই প্রথম কিনা? বললাম কাছাকাছি এসেছিলাম ২০১৪ এ টার্কিতে। মোফেক খুব একটা খুশী হলেন না। টার্কিতে তো টার্করা থাকে, ওরা আরব নয়। টার্কদের সাথে আরবদের কোন মিল নেই। ইজিপ্টকে আরব বলা উচিত কি উচিত নয় দোনামনা করতে করতে বলেই ফেললাম ইজিপ্ট যাওয়ার কথা। এবার একটু কৌতূহল দেখালেন। জানতে চাইলেন, কবে এসেছিলেন? বিফোর অর আফটার আরব স্প্রিং? এই প্রশ্নটার দুবার উত্তর দিলাম একই দিনে। আম্মান আসার প্লেনে পাশে বসেছিলেন একজন ইজিপশিয়ান মহিলা। ওনাকে যখন বলেছি গিয়েছিলাম একবার সে দেশে, উনিও জানতে চাইলেন বিফোর অর আফটার। কাজেই জানি এর পর মোফেক কি বলবেন। আরব স্প্রিংএর পর বদলে গেছে সব।

    গাড়ী চলছে হাইওয়ে দিয়ে। আমরা যাচ্ছি উত্তরে। ডানদিকে রোডসাইন - ইরাক বর্ডার, সৌদি বর্ডার। উত্তরে আম্মান শহর ছাড়িয়ে আরো ওপরে উঠতে থাকলে পৌঁছে যাব সিরিয়ায়। সিরিয়ায় গেছেন আপনি? - প্রশ্নটা করেই বুঝলাম বোকার মত কথা বলেছি। মোফেক শব্দ করে হাসলেন। তারপর গম্ভীর হয়ে গেলেন একটু। - কয়েক বছর আগেও ট্যুরিস্ট নিয়ে দামাস্কাস গেছি। আর যাই না। ডু ইউ নো দামাস্কাস ইজ দ্য ওল্ডেস্ট ইনহ্যাবিটেড সিটি অন আর্থ? জানতাম না স্বীকার করলাম। মোফেক বলে চলেছেন, কেন এটা ওল্ডেস্ট ইনহ্যাবিটেড সিটি বলুন তো? এই শহর তৈরী হওয়ার পর থেকে কখনও এটা পরিত্যক্ত হয় নি। থার্ড মিলেনিয়াম বিসি থেকে আজ পর্যন্ত এই শহরে সব্সময় মানুষ থেকেছে। এরপর খানিকক্ষণ চুপচাপ। পাঁচহাজার বছর ধরে মানুষ যে শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তার ধ্বংস যেন জীবদ্দশায় না দেখতে হয় - গাড়ীর তিনটি মানুষই বোধহয় মনে মনে এই প্রার্থনা করল, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে।

    আম্মান শহর আসতে মোফেককে বললাম, কোন স্যান্ডুইচ প্লেসে গাড়ী দাঁড় করাতে। রাতের খাবার নিয়ে হোটেলে ঢুকে যাব এমনই ইচ্ছা। দিল্লী রোডের ধারে যেমন চা-কচুরীর দোকান থাকে তেমন একটা দোকানে মোফেক দাঁড়ালেন। লাবাশের (রুমালী রুটি) মধ্যে হামাস, আলুভাজা, বেগুন ভাজা আর কপিভাজা দিয়ে চমৎকার র‌্যাপ পাওয়া যাচ্ছিল। লাল আর সবুজ লঙ্কাপেস্ট আছে দেখে আমি সেটাও একটু বেশী করে দিতে বললাম আমার র‌্যাপটায়। আমাদের তখনও ফরেন এক্সচেঞ্জ করা হয়নি। মোফেক পয়সা দিলেন। আমরা ভেবেছিলাম ধার নিচ্ছি। পরের দিন ডলার ভাঙিয়ে শোধ দিয়ে দেব। কিন্তু মোফেককে চেনার তখনও অনেক বাকি ছিল। বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল। হোটেলে এসে তাড়াতাড়ি চান করে র‌্যাপে কামড় দিলাম। খাবারটা এত ভালো ছিল, বাড়ী এসেও বানিয়েছি অনেকবার।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৫ জুন ২০১৭ ০২:৫৭366400
  • পরের দিন সকালটা খুব ভালো শুরু হল। ঘুম ভেঙে গেছে খুব সকালে। সারাদিন অনেকটা ড্রাইভিং। গাড়ী চালাবেন যদিও মোফেক। আমাদের বসে থাকা আর গাড়ী থামলে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া কাজ নেই। চান করে রেডি হওয়ার পরেও দেখি ব্রেকফাস্টের সময় হতে মিনিট পনেরো বাকি আছে। হোটেলের চারপাশেই একটু ঘুরে এলাম। আকাশ মেঘলা করে আছে। অল্পস্বল্প গাড়ী চলছে রাস্তায়। আশেপাশে দোকানপাট বিশেষ নেই। হোটেলের পাশে একটা বহুতল। হোটেলের সিকিউরিটি আর বহুতলের সিকিউরিটি আড্ডা দিচ্ছে। পনেরো মিনিট হতেই হ্যাংলার মত ব্রেকফাস্ট এরিয়ায় চলে এলাম। আমরাই প্রথম। বসার জায়গার বাইরে একটা বড় মাটির ওভেনে লাবাশ বানানো হচ্ছে। যিনি বানাচ্ছিলেন তাঁর নাম আহমেদ। আমরা যেতেই রুটি নেব কিনা জিজ্ঞেস করে বানাতে শুরু করে দিলেন। আমি দেখ্লাম গোল গোল করে কাটা বেগুন ভাজা আছে। সেই সাথে আলুচচ্চড়ির মত করে কাটা আলু ভাজা আর লঙ্কা ভাজা। আরো অনেক কিছুই ছিল যেমন অনেক জায়গাতেই থাকে। কিন্তু রুটি বেগুনভাজা, আলুভাজা পেলে অন্য কিছু খাওয়ার মানেই হয় না। শেষে খেজুর আর হালয়া দিয়ে মিষ্টিমুখ করে এক কাপ কফি। দিনের শুরুটা ভালো হল কিনা?

    মোফেক ঠিক সাড়ে সাতটায় চলে এলেন। এই চারদিন উনি আমাদের সাথেই ঘুরবেন। গাড়ির ট্রাঙ্কে আমাদের সুটকেসের সাথে ওনার সুটকেস আর প্রেয়ার ম্যাট। উনি বললেন আম্মান সিটাডেল আর উম্মায়েদ প্যালেস দেখে সাড়ে দশটার মধ্যে শহর থেকে বেরিয়ে পরতে পারলে ভালো হয়। বেরোনোর সময় আমরা ফরেন এক্সচেঞ্জ করে নেব। সিটাডেল আটটায় খোলে। সেখানে যাওয়া হবে সবার আগে। আর সব প্রাচীন সভ্যতার মতই আম্মান সিটাডেলও পাহাড়ের মাথায়। সেখানে ওঠার পথে একটা রোমান থিয়েটার পড়ে। বেশ বড় থিয়েটার। ছ'হাজার লোক বসার মত। মোফেক বললেন, যান ঘুরে আসুন। আমরাই একমাত্র ট্যুরিস্ট। থিয়েটারের সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা উঠে আম্মান শহরের চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। সেই ছবি নেওয়া হল। থিয়েটারের নিচে যেখানে কলাকুশলীরা সাজগোজ করত সেই জায়গাটাকে একটা মিউজিয়াম করা হয়েছে। বাইজান্টাইন আমলের অনেক মোজাইক আছে সেখানে। এইসব জায়গা মোজাইকের জন্য খুবই বিখ্যাত। একটা মোজাইক দেখে চোখ আটকে গেল। খাঁচার মধ্যে একটা পাখী, আরেকটা খাঁচার বাইরে। নিচে লেখা আছে "ঈন য়অন্তিনে সৌেস, থে গেদ বির্দ ইস থে স্য়্ম্বোল ওফ সৌল ইম্প্রিসোনেদ ইন থে হুমন বোদ্য"। "খাঁচার ভিতর অচিন পাখী" মনে পড়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে মোফেককে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা সকালে এসেছি বলে এমন ফাঁকা, নাকি এই সময় ট্যুরিস্ট কম? মোফেক বললেন, ট্যুরিস্ট আসা অনেকদিন ধরেই বন্ধ। আপনাদের মত দুয়েকজন আসছেন। মনে পড়ল, আমার বন্ধু টিনা মাস ছয়েক আগে জর্ডন ঘুরে গিয়ে একই কথা বলেছিল। ট্যুরিস্ট খুব কম। ফলত জিনিসপত্রের দাম বেশী। পাঁচ বছর আগেও যখন জর্ডন ঘোরার খরচাপাতির খবর নিয়েছি তখন এখনকার চেয়ে সস্তা ছিল। এত কম ট্যুরিস্ট নিয়ে ট্যুর কোম্পানিগুলোকে সার্ভিস দিতে হচ্ছে বলে তাদেরও খরচ না বাড়িয়ে উপায় নেই।

    সিটাডেলে আমরা একজন গাইড নিলাম। তাঁর নাম আবদেস সালেম। পাহাড়ের ওপর সিটাডেল। সেখান থেকে আম্মান শহরকে ভারী সুন্দর লাগছে। বাড়ীগুলো সবই হলুদ ঘেঁসা রঙের। তার ওপর মেঘের ছায়া পড়েছে। মাঝে মাঝে মেঘ কেটে রোদ বেরোচ্ছে। বাড়ীগুলো ঝকঝক করছে তখন। আমার প্রথম আর্কিওলজিকাল ট্যুর ইজিপ্টে আমাদের গাইড মরিয়ম লুক্সর শহরের একটা মসজিদ দেখিয়ে বলেছিল ফারাওদের আমলে এখানে ছিল একটা প্যাগান মন্দির, তারপর ক্রিশ্চানরা আসার পর তৈরী হয়েছিল চার্চ, আর এখন দেখছ মসজিদ। একটুকরো জমির ওপর নানা ধর্মের ভগবানদের আনাগোনা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম সেবার। তারপর থেকে আরো অনেক আর্কিওলজিকাল সাইটে একই জিনিস দেখেছি। আম্মান সিটাডেলও সেই রকম। রোমান মন্দির আছে। সেটা নাকি টেম্পল অফ হারকিউলিস। হারকিউলিসের পাহাড়প্রমাণ মূর্তির তিনখানি আঙুল পড়ে আছে। সেই মন্দিরের পাথর দিয়ে তৈরী হয়েছে বাইজান্টাইন চার্চ। সম্রাট কনস্টানটাইনের মা হেলেনা এই চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। তারপর সেই চার্চের পাথর দিয়ে তৈরী হয়েছে উম্মাইদ প্যালেস - সিটাডেলের সবচেয়ে নতুন স্থাপত্য, উম্মাইদ বংশের খলিফাদের থাকার জায়গা। তবে তার বয়েসও চোদ্দোশো বছর হতে চলল। আমি আবদেস সালেমের সাথে গল্প করতে করতে এগিয়ে গেছিলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি মিঠুন তিনটে বাচ্চার সাথে ভাব জমিয়েছে। বাচ্চারা "গুড মর্ণিং"-এর বেশী ইংরিজি জানে না, আর আমাদের আরবীর দৌড় তো ততটুকুও নয়। তবুও মানুষের হাসির একটা ভাষা থাকে। সেই ভাষা দিয়ে আমরা বুঝে গেলাম আমাদের দেখে ওরা খুশী হয়েছে। মিঠুন ওদের ছবি তুলতে চাইল। ওরা খুব খুশি হয়ে পোজ দিল। স্কুলে যাচ্ছিল ওরা। মিঠুনকে একটা খেজুরভরা কুকি দিয়ে গেল। আমাদের আর কিই বা দেওয়ার আছে এই দেবশিশুদের, মুহূর্তটাকে স্মৃতিবন্দী করা ছাড়া!

    একটা বাটার দোকানের পাশে ফরেন এক্সচেঞ্জের দোকান। সেখান থেকে ডলার ভাঙিয়ে আমরা আম্মান ছাড়লাম। বাটার দোকান দেখলেই দেশের কথা মনে পড়ে। বহুদিন পর্যন্ত জানতামই না এটা ইন্ডিয়ান কোম্পানী নয়।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৫ জুন ২০১৭ ০৩:৫৪366410
  • জর্ডন দেশটা খুব ছোটো। উত্তরে সিরিয়া বর্ডার থেকে নিচে আকাবা পর্যন্ত ছ'সাত ঘন্টায় ড্রাইভ করে ফেলা যায়। পূর্বদিকে ইরাক। পশ্চিমে ইজরায়েল। ইজরায়েল আর জর্ডনের মাঝে বইছে জর্ডন নদী। যাওয়া যাবে জর্ডন নদীর ধারে? মোফেক হাসলেন। - নাহ, পারমিট লাগবে। আম্মান শহরে দেখছি অনেক চার্চ। এগুলো অ্যাকটিভ? মোফেক বললেন, অবশ্যই। জর্ডনে ৯৭% সুন্নি মুসলিম, ৩% ক্রিশ্চান। দেয়ার ইজ নো শিয়া ইন জর্ডন। সেইজন্য জর্ডন এত পিসফুল। ক্রিশ্চানদের সাথে আমাদের কোন ঝামেলা নেই। সিটাডেল থেকে নামতে নামতে মোফেক কয়েকটা বাড়ী দেখাচ্ছিলেন, ঐ যে দেখছেন, ওটা রাজার কাজিনের বাড়ি, ওটা রাজার মাসীর বাড়ি - এইসব। কাজিন নাকি মাসী নাকি অন্যকিছু সেসব এতদিন পর আমার মনে নেই। মোটকথা রাজার আত্মীয়দের বাড়ী। মনের মধ্যে যে প্রশ্নটা অবাধ্যতা করছিল সেটা করেই ফেললাম, হাউ ডাজ ইট ফিল টু লিভ ইন আ কিংডাম? মিঠুন চোখ দিয়ে ধমক দিল। কিন্তু হাতের তীর আর মুখের কথা ফসকে বেরিয়ে গেলে তো আর ফেরে না। মোফেক রাজার খুব প্রশংসা করলেন। এই হাশেমাইত ফ্যামিলি প্রফেট মুহাম্মদের নিজের বংশধারা। এর চেয়ে বড় যোগ্যতা আর কি হতে পারে! কথাটা অনস্বীকার্য। আমরা রাস্তায় মন দিলাম। বিকেলের মধ্যে আমাদের ওয়াদি রাম পৌঁছতে হবে। সেখানে সূর্যাস্ত দেখে পেট্রায় ফিরে রাত্রিবাস। আম্মান থেকে দক্ষিনে যাওয়ার দুটো রাস্তা আছে। আমরা যেটা নিয়েছি সেটা ডেজার্ট হাইওয়ে। এটা সমতলভূমির ওপর দিয়ে গেছে। স্পীড লিমিট বেশী। অন্যটা গেছে পাহাড়ের ওপর দিয়ে। তার নাম কিংস ওয়ে। সে রাস্তা দিয়ে না হোক দুহাজার বছর ধরে মানুষ চলাচল করছে। ফেরার সময় সে রাস্তা নিয়েছিলাম আমরা। তবে সে প্রসঙ্গ পরে।

    ডেজার্ট হাইওয়ের রাস্তায় অন্তত তিনটে অটোমান ক্যাসেল রয়েছে। সেগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মোফেক আমাদের দেখালেন। কিছুদিন আগে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, তাতে এই রকম একটা অটোমান ক্যাসেল আর রেলরোড ছিল। আমরা সেগুলো নিয়ে গল্প করলাম। কিন্তু বুদ্ধির দোষে একটা ক্যাসেলেরও ছবি তুললাম না। পরে যখন খেয়াল হল মোফেক বললেন, আর তো পড়বে না রাস্তায়। তখন আর দুঃখ ভোলায় কে! রাস্তার ধারে মাঝে মাঝেই দেখি টমেটো স্তূপ করে বিক্রি হচ্ছে। জর্ডনের টমেটো নাকি খুব ভালো। মোফেক ফেরার সময় কিনবেন বাড়ীর জন্য। রেলরোড চলছে আমাদের সাথে সমান্তরালে। কিন্তু ট্রেন তো দেখছি না একটাও। জানা গেল অটোমান রেলরোড অটোমান আমলের পর থেকেই পরিত্যক্ত। তাহলে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট? মোফেক বাস দেখিয়ে দিলেন। অনেকগুলো বাস পেলাম আমাদের যাওয়ার পথে। দেড়টা নাগাদ পেট ক্ষিদেয় চুঁইচুঁই। সকালের রুটি বেগুনভাজা কোথায় তলিয়ে গেছে। মোফেক একটা রেস্ট এরিয়ায় গাড়ী থামালেন। আমাদের খাবার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে উনি গেলেন নমাজ পড়তে। লেন্টিল সুপ, অর্থাৎ মুসুর ডাল নিলাম। সাথে ভাত, রুটি আর আরেকটা মন ভরানো জিনিস। লেখা ছিল মিটবল। মিটবলই বটে, কিন্তু আমেরিকান মিটবলের চেয়ে এক কোটি গুন ভালো খেতে। আমাদের দেশে মাংসের চপ যেমন হয় তেমন। চারটে চপ, এক বাটি ডাল। একটু ভাত-রুটি। দুপুরের খাওয়াটাও কিছু মন্দ হল না। আবার গাড়ী ছুটছে ওয়াদি রামের দিকে।
  • | ১৫ জুন ২০১৭ ০৫:২৫366411
  • আহা তাপ্পর?
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৫ জুন ২০১৭ ০৫:২৬366412
  • ওয়াদি কথার অর্থ উপত্যকা। রাম এসেছে রোমান থেকে। ওয়াদি রাম তাহলে সেই উপত্যকা যেখানে একাকালে রোমানদের যাতায়াত ছিল। এই অঞ্চলে অবশ্য রোমান বলতে সেকালে গ্রীকদেরও বোঝাত। যারা আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে ক্যানিয়নগুলোর মধ্য দিয়ে বা মনুমেন্ট ভ্যালি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে গাড়ী চালিয়েছেন তাঁদের কাছে ওয়াদি রামের ভূপ্রকৃতি চেনা ঠেকবে। আরো সুবিধের জন্য বলা যায় ম্যাট ডেমনের মার্শিয়ান ছবির শুটিং এখানে হয়েছিল। মার্শিয়ান ছবিতে যে মঙ্গলগ্রহের ভূপ্রকৃতি দেখা যায় তা আসলে আমাদের পৃথিবীর ওয়াদি রাম। ওয়াদি রামের কাছাকাছি আসতেই মাটির রং প্রথমে কালো, তারপর লাল হয়ে গেল। তারপর শুরু হল বিভিন্ন রকমের রক ফর্মেশন। ওয়াদি রামের ভেতরে জিপ ছাড়া ঢোকা যাবে না। এই উপত্যকাটা পুরোটাই এক বেদুইন গোষ্ঠীর পরিচালনায় চলে। তারাই জিপ ভাড়া দেয়, সাথে ড্রাইভার দেয়। অনেকে রাতে ওয়াদি রামে থেকে যান। তাঁদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা, খাবার ব্যবস্থা সবই বেদুইনরা করেন। আমাদের সময় অল্প ছিল বলে আমরা এটা করতে পারিনি। মোফেক খুব দুঃখ করছিলেন। ওয়াদি রামে উটের পিঠে চেপে সূর্যোদয় না দেখলে জর্ডনে কিছুই দেখা হল না। আমরা দুঃখী মুখে বেদুইন জিপে গিয়ে বসলাম। বেদুইন ড্রাইভারের নামটা আমি ভুলে গেছি। মোফেক ড্রাইভারের পাশে বসলেন। আমরা জিপের পেছনে হুডখোলা জায়গায় বসলাম। ওয়াদির মধ্যে হাই স্পিডে জিপ ছুটছে। হুহু করে হাওয়া দিচ্ছে। ছবি তুলব কি, নিজেরা পড়ে যাচ্ছি না ভাগ্য ভালো। আরো দুএকটা জিপ দেখতে পাচ্ছি। তার মানে আরো কিছু ট্যুরিস্ট আছে। হাজার বছর ধরে মানুষ এই মরুভূমি এপার ওপার করেছে। পাথরের গায়ে পেট্রোগ্লিফসে ক্যারাভ্যানের ছবিতে তার প্রমাণ। বাথরুম ব্যবহারের দরকার ছিল। বিকেলের আলো মরে আসবে বলে আমরা কোন ব্রেক না নিয়ে জিপে উঠেছিলাম। ওয়াদির মধ্যে একজায়গায় পিট টয়লেটের ব্যবস্থা করা আছে। মিঠুন গেছে সেখানে। আমি জিপের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। ওয়াদি রামের এই জায়গাতে লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া, কিং ফয়জল এবং অটোমান রাজাদের একটা মিটিং হয়েছিল। পাথরের ওপর এদের তিনজনের মুখের ছবি খোদাই করা রয়েছে। মোফেক আমায় গল্প বলছেন। হঠাৎ চেনা ভাষা কানে এল। দুজন ভারতীয় চেহারার মানুষ টয়লেটের দিক থেকে আসছেন। আলাপ হল। এনারা পাকিস্তানী। আকাবায় কনস্ট্রাকশনের কাজ করেন। ওয়াদি রাম দেখতে এসেছেন। মিঠুনও চলে এসেছে ততক্ষনে। একটু কথা হল। তারপর যে যার জিপে। যাওয়ার সময় ওরা বলে গেলেন, কতদিন পর কারোর সাথে হিন্দীতে কথা বললাম। খুব ভালো লাগল। জীবনে বোধহয় সেই প্রথম দুঃখ হল হিন্দী ভাষাটা ভালো করে না জানার জন্য। কত অল্পে খুশী হয় আমার দেশের মানুষ!

    আমাদের ড্রাইভার খুব ব্যস্ত ছিলেন মার্শিয়ানের শুটিং স্পটগুলো দেখানোর জন্য। আমরা বললাম প্রত্যেকটা স্পট না দেখলেও চলবে। আমরা কোথাও বসে আরাম করে সূর্যাস্ত দেখতে চাই। মোফেক একটা টিলার সামনে গাড়ী দাঁড় করাতে বললেন। সূর্য ডুবতে বেশী বাকি ছিল না। আমরা টিলায় পা ছড়িয়ে বসে সূর্য ডোবা দেখলাম। আকাশটা একটা নরম গোলাপী আলোয় ভরে গেল। মার্শিয়ানের একট স্পট না দেখিয়ে কিছুতেই ওদের শান্তি হচ্ছিল না। সেটা বেশ উ`চু। হাঁচোড়্পাঁচোড় করে ওঠা, ছবি তোলা, নামা - এসবের পর জিপে উঠে পা ছড়িয়ে বসলাম। আকাশের গোলাপী ততক্ষণে বেগুনী হয়েছে। তারা ফুটছে একটা দুটো। মোফেক আর ড্রাইভার সিগারেট ধরিয়েছেন। আমরা এই কোটি বছরের পুরোনো উপত্যকা আর মাথার ওপরে অনাদি অনন্ত মহাকাশের বিশালতায় টইটম্বুর। মিঠুন বলল, আমায় একটা জায়গা খুঁজে দাও, আমি এখানে থেকে যাই। মোফেক বললেন, ওটি হবে না। বেদুইনকে দেখিয়ে বললেন, এই যে একে দেখছেন এটা এদের জায়গা। এখানে আর কেউ থাকতে পারে না। রাজার আত্মীয়কে ঘুষ দিয়ে ওয়াদি রামের জমি কিনে নেয়ার চেষ্টা করেছিল বাইরের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এরা রুখে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য কতদিন পারবে কে জানে! আসলে জানেন, আই লাভ ডেমোক্র্যাসি। আই রেসপেক্ট ইন্ডিয়া। ইউ আর লাকি। ইউ হ্যাভ ডেমোক্র্যাসি। আমরা বলতে গেলাম, ডেমোক্র্যাসি থাকলেই সব কিছু ঠিক চলে এমন নয়। মোফেক থামিয়ে দিয়ে বললেন, ডেমোক্র্যাসির কি ভ্যালু তা আপনারা ডেমোক্র্যাসি না থাকলে বুঝবেন না। মিঠুন জিজ্ঞেস করল, আপনারা ডেমোক্র্যাসি চান? - নাহ চাই না। আমরা ডেমোক্র্যাসি চাই বললেই আমেরিকা আসবে সাহায্য করতে। আর তারপর কি হবে আমরা জানি। চাই না আমরা ডেকোক্র্যাসি।

    আকাশ ভরে তারা ফুটেছিল। জিপে করে বেদুইন টেন্টে ফিরে এলাম। আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল একজায়গায়। আগুনের ধারে বসে কাঁচের গেলাসে চা খেলাম। বেশি করে চিনি দেওয়া দুধ ছাড়া চা। তারপর বেদুইনের সাথে হ্যান্ডশেক করে আমাদের গাড়ীতে। রাতে থাকা হবে পেট্রায়।
  • | ১৫ জুন ২০১৭ ০৮:৩০366413
  • লেখো লেখো।
  • পুপে | 131.241.184.237 | ১৫ জুন ২০১৭ ১০:৩৮366414
  • গল্প শুনতে বসে পড়েছি মাদুর পেতে। তাড়াতাড়ি এগোক।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৫ জুন ২০১৭ ১১:১৫366415
  • পেট্রায় সারাদিন আর মোফেকের সাথে দেখা হয়নি আমাদের। আগের দিন রাতে হোটেলে ঢোকার আগে আমরা যথারীতি খাবার তুলে নিলাম। এই দোকানটা ট্রিপ অ্যাডভাইসার থেকে আগেই দেখে রেখেছিলাম। শাওর্মার দোকান। টিনা বলে দিয়েছিল কুনাফা নামের মিষ্টি খেতে। মোফেক শাওর্মা তোলার পর মিষ্টির দোকানে নিয়ে গেলেন। থরে থরে বারকোশে সাজানো মিষ্টি। ওজনদরে বিক্রি হয়। আমরা একশো গ্রাম কুনাফা নিলাম। কটেজ চিজ পেস্ট্রি, রসে একবার চুবিয়েই তুলে নেওয়া হয়েছে। গরম গরম খেতে হয়। হোটেলে নামিয়ে আমাদের হাতে পেট্রার টিকিট ধরিয়ে দিয়ে মোফেক চলে গেলেন। উনি থাকবেন ওনার বন্ধুর বাড়ী।

    পেট্রাকে জর্ডনের সবচেয়ে বড় দ্রষ্টব্যের মর্যাদা দেওয়াই যায়। আরবদের যে শাখা এই অঞ্চলে বাস করত তাদের নাম নাবেতিয়ান। পেট্রা ছিল এই নাবেতিয়ানদের রাজধানী। খ্রীষ্টজন্মের আগের কথা। তখনও এরা সবাই প্যাগান। নাবেতিয়ান আরবরা মরুভূমিকে হাতের তালুর মত চিনত। ব্যবসাবাণিজ্য করত। তারপর একদিন মরুভূমির বুকে পাহাড়ের আড়ালে বানিয়ে ফেলল এই আশ্চর্য শহর। জল হল জর্ডনের সবচেয়ে বহুমূল্য সম্পদ। পেট্রায় জল সরবরাহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা দেখবার মত। ব্যবসাবাণিজ্যের সূত্রে নাবেতিয়ানরা নানা জাতের মানুষের সংস্পর্শে আসত। এদের স্থাপত্যে তাই নানা দেশের পাঁচমেশালী ছাপ এসে মিশেছে। যারা ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড সিনেমাটা দেখেছেন তাদের পেট্রা কিছুটা দেখা হয়ে গেছে। মনে করে দেখবেন, পার্থেননের চুড়োর মত ত্রিকোণাকার গেট, কারুকার্য মন্ডিত করিন্থিয়ান কলাম - গ্রীক উপাদান যথেষ্ট পরিমানেই মজুত, অথচ সব মিলিয়ে ব্যাপারটা ঠিক গ্রীক নয়। ছবি ছাড়া বোঝানো মুশকিল। আর এটা বোঝার জন্য ইন্টারনেটেই অনেক ভালো আর্টিকেল পাওয়া যাবে, কাজেই আমি সে চেষ্টা করব না। আমি বরং আমাদের পেট্রার সকালে ফিরি। পেট্রায় আমাদের গাইড ছিলেন আশরাফ। ইনি একজন বেদুইন। পেট্রার যে অংশ এখন UNESCO হেরিটেজ সাইট সেটা আশির দশকেও ওয়াদি মুসার বেদুইনদের নিজেদের ঘরবাড়ি ছিল। আশরাফের বাবার জন্ম হয়েছিল পেট্রার একটা গুহায়। পেট্রা হেরিটেজ সাইট ঘোষিত হওয়ার পর বেদুইনদের আশেপাশের গ্রামে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে পেট্রার গাইডরা, স্যুভেনির নিয়ে বসা দোকানীরা, উট আর খচ্চরচালকেরা সকলেই বেদুইন। আর এদের বেশীরভাগই রীতিমত ভালো ইংরিজি বলে।

    আটটায় মেন গেট খোলামাত্র আমরা ঢুকেছি। পেট্রার এখনও বেশীরভাগটাই মাটির নিচে। এই বিশাল চত্ত্বরে তাই প্রচুর হাঁটতে হয়। হাঁটার রাস্তাও সর্বত্র মসৃন নয়। তাই পায়ের ওপর ভালোই চোট পড়ে। সকালে অবশ্য তার কিছুই বুঝিনি। পুরো সাইটটাই যেহেতু পাহাড় দিয়ে ঘেরা তাই সূর্য উঠে তার উত্তাপ পৌঁছতে বেশ সময় লাগে। আমাদের তো বেশ ঠান্ডাই লাগছিল। অধিকাংশ প্রাচীন সভ্যতার মত নাবেতিয়ানরাও মৃত্যুর পরের অবস্থাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিত। ইন্ডিয়ানা জোনসের সিনেমাতে যে মন্দির দেখা যায়, পেট্রায় যা আল খাজানা বা ট্রেজারি নামে বিখ্যাত তাও আসলে সমাধিস্থান ছাড়া আর কিছু নয়। একসময় ধারনা ছিল এখানে অনেক ধনরত্ন লোকানো আছে। তাই এর নাম খাজানা। ইন্ডিয়ানা জোনসের সিনেমা যাদের মনে আছে তাদের এটাও মনে পড়া উচিত খাজানাতে পৌঁছনোর আগে হ্যারিসন ফোর্ড আর শন কনারি ঘোড়ার পিঠে চেপে পাহাড়ের মধ্যে একটা সরু ফাটলের মত পথ ধরে মন্দিরের দিকে যাচ্ছিল। ঐ সরু ফাটলের মত পথের নাম সিক (Siq)। মেন গেট থেকে অন্তত কুড়ি মিনিট হেঁটে সিকে পৌঁছনো গেল। এরপর সিকের মধ্যে আরো এক কিলোমিটার। পেট্রার যে ছবিটা সর্বত্র দেখা যায়, সেই আল খাজানা আসবে সেই পথের শেষে।
  • সিকি | 158.168.96.23 | ১৫ জুন ২০১৭ ১২:২৩366416
  • "- নাহ চাই না। আমরা ডেমোক্র্যাসি চাই বললেই আমেরিকা আসবে সাহায্য করতে। আর তারপর কি হবে আমরা জানি। চাই না আমরা ডেকোক্র্যাসি।"

    এর পর শুধু চুপ করে বসে থাকতে হয়।

    পড়ছি।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৬ জুন ২০১৭ ০০:৪১366390
  • সিক মাঝে মাঝে এত সরু যে বড়জোর তিনজন মানুষ পাশাপাশি চলতে পারে। ওপরের দিকে চাইলে লাল পাথরের মাঝে আঁকাবাঁকা সরু নীল ফিতের মত আকাশ দেখা যাচ্ছে। আশরাফ আমাদের দেখাতে দেখাতে চলেছেন। - এই যে দেখছেন পাথরের দেয়ালের গায়ে কুলুঙ্গির মত, এটা ঠাকুর রাখার জায়গা। নাবেতিয়ানদের রিচুয়াল খুব সিম্পল। এরা ব্যবসার কাজে ঘুরে বেড়াত। কিছুদিনের জন্য যেখানে থাকত সেখানে ঠাকুর রাখত কুলুঙ্গিতে। চলে যাওয়ার সময় আবার ঠাকুর নিয়ে নিত ঝোলায়। আমরা ভাবছি, এ আর আমাদের বোঝাতে হবে না। মায়েরা যখনই আসেন আমাদের কাছে তাঁদের ঝোলা থেকে ঠাকুর বেরোতে দেখি। যা দুএকটা প্যাগান ধর্ম এখনও টিকে আছে পৃথিবীতে তারই একটার সংস্কৃতিতে লালিত হওয়ার জন্য এইসব খুঁটিনাটি আমাদের অচেনা নয়। সিকের দুধারে আমাদের সাথে সাথে চলছে পেট্রার বিখ্যাত জলের পাইপ। দুহাজার বছরের পুরোনো, কিন্তু এখনও রীতিমত অটুট। এই মরুভূমির দেশে জলের যোগান বজায় রাখা এই শহরের বাসিন্দাদের কাছে সবচেয়ে জরুরী ছিল। আমাদের দেশে রাস্তার ধারে যেমন ছোট ছোট শনি মন্দির থাকে, বড়ঠাকুরের মন্দির বলা হয় যাদের, সেইরকম ছোট একটা মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা একটু জিরিয়ে নিচ্ছি। আশরাফ বললেন, আমি এখানে রোজ আসি জানেন। যেদিন গাইডের কাজ থাকে না সেদিনও আসি। দিনে একবারও এখানে আসতে না পারলে হাঁফিয়ে যাই। এমন কোন জায়গা আছে কি আমার যেখানে দিনে একবারও আসতে না পারলে অস্থির হয়ে উঠব? একটু হিংসেই হল। আরেকটু এগিয়ে সিকের জলের পাইপের সামনে একটা খাড়া শিলের মত জিনিস। তার উল্টোদিকে কুলুঙ্গি। আশরাফ মিঠুনকে বললেন, আপনি গিয়ে ঐ শিলের ডানদিকে দাঁড়ান। আমাকে বললেন বাঁদিকে দাঁড়তে। এবারে শিলের ওপর দিয়ে একে অপরের হাত ধরুন। দুজনে দুজনের দিকে তাকান। তারপর তাকান সামনে কুলুঙ্গির দিকে। ব্যাস, বিয়ে হয়ে গেল আপনাদের। সহজ, অনাড়ম্বর দুসেকেন্ডের বিয়ে করে আমরা আবার এগোলাম সিকের সরু রাস্তা ধরে।

    এবং অবশেষে পাথরের ফাটলের মধ্যে দেখা দিল সেই গোলাপী পাথরের আল খাজানা। আমাদের অবস্থা "দেখে দেখে নয়ন না ফিরে"। আমাদের দেখে আশরাফের একমুখ হাসি। অত সকালে হাতেগোনা কয়েকজন ট্যুরিস্ট। আর কোন আর্কিওলজিকাল সাইটে এমন ফাঁকায় ফাঁকায় ছবি তোলার সুযোগ হয় না। আমরা ছবি তুলে ভাবছি বাহ বেশ সকাল সকাল পেট্রা দেখা হয়ে গেল, বাকি দিনটা তাহলে কি করা যায়। আশরাফ বোধহয় আমাদের মনের কথা পড়তে পারলেন। - মোটেই ভাববেন না পেট্রা দেখা শেষ হয়ে গেল। বরং পেট্রা শুরু হল এখান থেকে। আরো যত ভেতরে যাব আমরা আল খাজানার মত আরো অনেক সমাধি দেখবেন ছড়িয়ে আছে। পেট্রার মানুষেরা যেখানে থাকত, বেদুইনরা যেখানে থাকত, আমার বাবার জন্ম হয়েছে যেখানে সেইসব গুহা আছে। বাইজান্টাইন চার্চ আর তার অপূর্ব মোজাইক আছে। রোমান থিয়েটার আছে যেখানে এখনও এক্সক্যাভেশন চলছে। আর যদি হাজার সিঁড়ি ভাঙতে পারেন তাহলে আল খাজানার চেয়েও বড় একটা মন্দির আছে পাহাড়ের মাথায় যার নাম মনাস্টারি। ক্রিশ্চান আমলে চার্চ হিসেবে ব্যবহার হত ওটা। তাহলে আর কি! সময় নষ্ট না করে এগোনো যাক। ইতিমধ্যে সূর্যের আলো ঢুকে পড়েছে পাথরের ফাটল দিয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে গরম লাগতে শুরু করেছে। জ্যাকেটগুলো খুলে ব্যাকপ্যাকে ভরে নেওয়া গেল। আশরাফ বললেন, আমি আপনাদের সাথে আরেকটু গিয়ে সব পথগুলো চিনিয়ে দেব। তারপর আপনারা নিজেরা ঘুরে নেবেন। যদি হাঁটতে কষ্ট হয় খচ্চর নিতে পারেন। আমাদের তখনও প্রচুর এনার্জি। খচ্চর নেওয়ার কথা ভাবছিই না। সবকিছু পায়ে হেঁটে ঘুরব এমনই ইচ্ছে।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৬ জুন ২০১৭ ০১:৫৮366391
  • মিঠুন বলল মনাস্টারিটা আগে দেখে নেওয়া যাক। পরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লে হাজার সিঁড়ি ভাঙা যাবে না। আশরাফ সিঁড়ির কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু গিয়ে দেখলাম একে সিঁড়ি ঠিক বলা যায় না। পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি কাটার চেষ্টা হয়েছিল কে জানে কতশো বছর আগে। এখন সেই সিঁড়ি ক্ষয়ে গেছে অনেক জায়গাতেই। আমরা ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা করতেই অনেক বেদুইন খচ্চরচালক এগিয়ে এলেন। - হেঁটে উঠতে কষ্ট হবে, খচ্চর নিন। আচ্ছা না হয়, দুপিঠের নিতে হবে না, খচ্চর উঠিয়ে দিয়ে আসবে, আপনারা নিজেরা নামবেন। তারপর মিঠুনকে, আপনার জন্য নাই নিলেন, টেক ইট ফর হার। পাহাড়ের পথে নিজের পা কেই বিশ্বাস নেই, খচ্চরে কি ভরসা করব। তাদের সকলকে সরি বলে দুজনে হাঁটা শুরু করলাম। পথনির্দেশ ভালো করে দেওয়া নেই। পাথরের ফাটলে কাঁটাঝোপ। ওপরে ওঠার সাথে সাথে ঝোপঝাড় কমে গেল অবশ্য। আর মাঝে মাঝেই বাঁক পেরোলে আশ্চর্য সব মন্দির। খুব বড় নয়, ছোট ছোট। কিন্তু অবিস্মরণীয়।

    তখনও বেশিদুর যাইনি আমরা। সিঁড়ির এক পাশে দুই বেদুইন বোন পশরা সাজিয়ে বসেছে। আমরা পাশ দিয়ে যেতেই আমাদের ডাকতে শুরু করল কিছু নেওয়ার জন্য। আমরা বললাম, ওঠার পথে কিছু নেব না। ওদের মধ্যে ছোট মেয়েটি বলল, ঠিক আছে কিছু নিতে হবে না, চল তোমায় একটা জিনিস দেখাই। বলে আমার হাত ধরে পাথর টপকাতে শুরু করল। মিঠুনও এল আমার সাথে। দেখলাম পাথরের আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা খুব সুন্দর মন্দির। মন্দির লিখছি বটে, আসলে এগুলো সমাধি। আল খাজানার ধাঁচের ত্রিকোণাকার গেট। দরজার দুপাশে খোদাই করা সিংহ। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায় থাকো? - মেন গেটের বাইরে গ্রামে থাকি। - স্কুলে পড়ো? - হ্যাঁ, স্কুলে যাই তো। - আজ যাও নি কেন? - আজ তো প্রফেট মুহাম্মদের জন্মদিনের ছুটি। আমি তাই দিদিকে হেল্প করছি। মনে পড়ল আশরাফ যেখানে আমাদের ছেড়ে দিলেন সেখানে এক দোকানী আমাদের খেজুরের কুকি খেতে দিলেন। আমরা প্রথমে নিতে চাই নি। আশরাফ বললেন, আজ প্রফেটের জন্মদিন। তাই ইনি আপনাদের খাওয়াতে চাইছেন। আপনারা নিলে খুশি হবেন। আমরা তখন কুকি নিলাম। আগের দিন আম্মান সিটাডেলে বাচ্চারা যে কুকি দিয়েছিল সেটা তখনও ব্যাকপ্যাকে। মনে পড়ল সেসব। মেয়েটাকে কিছু দেব ঠিকই করেছিলাম। তার আগেই মেয়েটা বলল, মে বি ইউ ক্যান গিভ মি সাম গিফ্ট। বললাম, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? - গিভ মি সাম মানি। দু'দিনার দিয়ে এলাম ওকে। তখন এক দিনার মানে ১়৪ আমেরিকান ডলার। জানিনা ও আরও বেশি আশা করেছিল কিনা।

    আমরা ধীরেসুস্থে চলছি। আমাদের পাশ দিয়ে খচ্চরে করে একজন জাপানী মহিলা উঠে গেলেন। খচ্চরের খাদ ঘেঁসা নড়বড়ে পদক্ষেপের দিকে সভয়ে চেয়ে রইলাম। পথের পাশে কিছু দুরে দুরে বেদুইনরা সুভ্যেনির নিয়ে বসেছে। সবাই ডাকে তাদের থেকে নিতে। সুভ্যেনির কিনতে আমি ভালোবাসি। কিন্তু এদের জিনিস দেখলাম খুব একটা ভালো নয়। পুঁতির মালার পাথর খসা। সবকিছুই কেমন বিবর্ণ, ধুলো ধুলো। তাও একটা পিতলের নাবেতিয়ান উট কেনা হল। ম্যাগনেট নিই সব জায়গা থেকে। এখানেও নিলাম। কিন্তু পছন্দসই হল না। এর মধ্যে একটা ছাউনি দেয়া জায়গায় ফ্রেশ জুস বিক্রি হচ্ছে দেখলাম। জাপানী মহিলাটিকেও খচ্চর এখানে নামিয়ে দিয়ে নেমে যাচ্ছে। এই দেখে আমাদের ধারনা হল আমরা মনাস্টারিতে এসে গেছি। মিঠুনকে বললাম, একটু জুস খেয়ে নেওয়া যাক। বসার জায়গাটাও পাহাড়ের কোলে ভারী সুন্দর করেছে। মিঠুনের জন্য অরেঞ্জ, আমার জন্য লাইম উইথ মিন্ট বলা হল। জুসের দোকানের উল্টোদিকে বড় স্যুভেনিরের দোকান। সেখানে আবার ফ্রি ওয়াই-ফাইএর বিজ্ঞাপন ঝুলছে। স্যুভেনির যদিও বাইরে থেকে যা দেখতে পেলাম তা ট্যিপিকাল টার্কিশ, গ্রীক স্যুভেনির। এমনকি ভারতীয় পাথরের হাতিও চোখে পড়ল। জুসের দোকানদার বলল এখনও কিছুটা উঠতে হবে। তবে এর পর খচ্চর যায় না। সবাইকে পায়ে হেঁটে উঠতে হয়। জাপানী মহিলার রহস্য বোঝা গেল। আমরা খানিকক্ষণ আরাম করে নিয়ে আবার হাঁটা দিলাম। ইতিমধ্যে এক ভারতীয় দম্পতির সাথেও দেখা হয়েছে। তাঁরাও আমাদের মত চারদিনের জন্য জর্ডন ঘুরতে এসেছেন।

    মনাস্টারি সত্যিই আল খাজানার চেয়েও বড়। তবে কারুকার্যের দিক থেকে আল খাজানা আরো সুন্দর। আসলে এতটা উঁচুতে উঠে এসে পাহাড় কেটে বানানো এমন একটা স্থাপত্যের একটা আলাদা মহিমা আছে। মোফেক বলেছিলেন, মনাস্টারি থেকে আরো খানিকটা হাঁটলে পাহাড়ের ওপর থেকে পুরো ওয়াদি মুসা দেখা যায়। মিঠুন সেটা দেখতে গেল। আমি মনাস্টারির সামনে স্যুভেনির শপের সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা চেয়ারে বসে মুহুর্তটাকে উপভোগ করছিলাম। ক্ষিদে পেয়েছিল আমাদের। লাঞ্চ করার সময় হবে না জানাই ছিল। গ্রানোলা বার খেয়ে একটু ক্যালোরি সঞ্চয় হল। তারপর নামা। আবারও স্যুভেনির নেওয়ার জন্য বেদুইন মহিলাদের ডাকাডাকি। তখন প্রায় একটা বাজতে চলেছে। কাউকে কাউকে দেখলাম নিজেদের পসরার পাশেই আগুন জ্বালিয়ে রুটি বানাতে বসেছে। অনেকটা নেমে এসেছি। একটা গুহার মধ্যে থেকে একজন মহিলা ডাকলেন, প্লিজ টেক সামথিং ফ্রম মি। দেখলাম সে পেট্রারই কিছু গোলাপী পাথর সাজিয়ে বসেছে। এই পাথর নিয়ে যাওয়া আইনসম্মত কিনা জানি না, কিন্তু অনেকেই এটা করছে দেখলাম। আমি বললাম, আমরা কিছু নেব না। সে বলল, দেন গিভ মি সামথিং টু ইট। আই অ্যাম ভেরি হাংরি। এবার লক্ষ্য করলাম, মেয়েটি গর্ভবতী। আমাদের দুটি গ্র্যানোলা বার বেঁচেছিল। দিয়ে দিলাম। নিচে নেমে দেখি আমাদের যে খচ্চর দিতে চেয়েছিল সে তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে হেসে বলল, হাউ ডু ইউ ফিল? বললাম আমার খচ্চর নিতে। তাহলে কত তাড়াতাড়ি দেখা হয়ে যেত তোমাদের। এখন চ্ল বাকিটা তোমাদের খচ্চরে করে দেখিয়ে আনি। অগত্যা বলতেই হল, খচ্চরে আমার বড় ভয়। হেঁটেই যতটুকু পারি দেখব।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৬ জুন ২০১৭ ০৩:৩৫366392
  • বাইজানটাইন চার্চের মোজাইক সত্যিই দেখার মত। এগুলো সব মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। কিছুই নষ্ট হয়নি। আল খাজানার মত আরো অজস্র সমাধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সবই পাহাড়ের দেওয়াল কেটে তৈরী। অপূর্ব তার রং। দেখে মনে হয় বেশ কাছে। কিন্তু জায়গাটা বিশাল। আর এখনও এক্সক্যাভেশন চলছে বলে সব জায়গায় যাওয়ার পথ সুগম নয়। একটা মন্দির দেখে মুগ্ধ হয় হাঁটা দিলাম। অর্ধেক পথ গিয়ে দেখি খাদ। আশেপাশেও কেউ নেই জিজ্ঞেস করার। অন্য পথ খোঁজার চেষ্টা করছি। একটি বাচ্চা বেদুইন ছেলে এসে বলল, তোমাদের কাছে কিছু খাবার আছে? গ্র্যানোলা বারগুলো দিয়ে দেওয়ার পর আমাদের কাছে আর কিছুই ছিল না। আমরা ওকে কিছু নেই বলে এগিয়ে চলেছি। মিঠুনের মনে পড়ল, আম্মানের বাচ্চাদের দেওয়া খেজুরের কুকি ওর কাছে রয়েছে তখনও। বাচ্চাটিকে ডেকে সেটা দেওয়া হল। তারপর আবার পথ খোঁজা। এবারে আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। কিন্তু এটাও বুঝছি ব্যথাকে বেশি পাত্তা দিলে ঘোরা হবে না। কোনমতে পৌঁছনো গেল সেই মন্দিরে। ওপরের একটা গুহা দেখে খুব যেতে ইচ্ছে করছে। চেষ্টাচরিত্র করে বেশ কিছুদূর ওঠার পর দেখা গেল পথ বন্ধ। এইসব কয়েকবার হওয়ার পর রনে ভঙ্গ দিলাম। ঘড়িতেও প্রায় চারটে বাজে। খচ্চর মালিকেরা আল খাজানার দিকে হাঁটছে দেখতে পাচ্ছি। আমরাও নেমে এলাম মূল রাস্তায়। একটি স্যুভেনির দোকানের সামনে হাল্কা ভীড়। এক্জন বেদুইন তারযন্ত্র বাজাচ্ছেন একটা। আর আরেকজন তার সাথে হাতে তাল দিয়ে গান গাইছেন। দেখে মনে হল দোকানটা এদেরই। দিনের শেষে ব্যবসা গুটিয়ে গানবাজনা। খুব ভালো লাগল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গান শুনতে। ফেরার পথ আর শেষ হতে চায় না। সেদিন রাতে আমাদের আবার আসার কথা এখানে মোমবাতির আলোয় আল খাজানার সামনে বেদুইন গান শুনতে। একবার মনে হচ্ছে রাতের প্রোগ্রামটা না থাকলেই ভালো হত। পরক্ষণেই ভাবছি আর তো কখনও দেখতে পাবো না। একটু কষ্ট করিই না হয়।

    আশরফ আমাদের অথেন্টিক জর্ডনিয়ান খাবার খাওয়ার জন্য একটা রেস্তোঁরার খোঁজ দিয়েছিলেন। পা দুটোকে কোনমতে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই রেস্তোঁরায় আশ্রয় নিলাম। সেখানে আরেক চমক অপেক্ষা করছিল। যে মহিলা অর্ডার নিতে এলেন তিনি আমরা ভারতীয় দেখে হিন্দীতে কথা বলতে শুরু করলেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ভারতীয়? উনি বললেন, না আমি ইয়েমেনি। বিয়ের পর জর্ডনে এসেছি। - তাহলে এত ভালো হিন্দী জানেন কিভাবে? - শাহরুখ খানের সিনেমা দেখে শিখেছি। শাহরুখ খানের দেশের মানুষদের ভালোই খাতির করলেন তিনি। আমরা অর্ডার করলাম ল্যাম্ব মানসাফ আর চিকেন মাকলাভা। মানসাফে মাংসটা রান্না করা হয় দই আর ঘি দিয়ে। সার্ভ করা হয় লাবাশের ওপর পাইন নাটস মেশানো সরু চালের ভাতের সাথে। মাকলাভার ইংরিজি ট্রানস্লেশন আপ সাইড ডাউন। এটা পোলাওএর মত। মাংস, কপিভাজা, বেগুনভাজা, পাইন নাটস সব কিছু দিয়ে হলুদ রঙের ভাত রান্না করা হবে একটা বাটিতে। পরিবেশনের সময় বাটিটা উল্টে দেওয়া হবে। দুটো খাবার খেয়েই প্রাণ ভরে গেল। আশরাফকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে।

    হোটেলে ফিরে ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করেই আবার বেরোনো নাইট ইন পেট্রা দেখতে। দুজনের পায়ের অবস্থাই তখন রীতিমত খারাপ। তাও আকাশ জোড়া চাঁদের আলোয় পেট্রা এক অন্যরকমের অনুভূতি। সিকের মধ্যে চাঁদের আলো ভালো করে ঢোকে না। সেখানে কিছু দূরে দূরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। সকালের চেনা রাস্তা সেই মোমবাতির আলোয় কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। আল খাজানার সামনে এসে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। প্রায় পাঁচশো মোমবাতি বিছিয়ে রেখেছে খাজানার সামনে। সেই আলোতে গোলাপী পাথর কেমন ঠান্ডা আগুনের মত জ্বলছে। বসার জন্য চাটাই বিছিয়ে দিয়েছে। সবাই বসার পর আবার সেই বেশি মিষ্টি দেওয়া লাল চা দিয়ে গেল। তারপর শুরু হল অনুষ্ঠান। একজন বুড়ো মানুষ তারযন্ত্র বাজিয়ে গান ধরলেন। ভারী অপূর্ব লাগছিল। তিনটে গান হল পরপর। তারপর আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
  • aranya | 172.118.16.5 | ১৬ জুন ২০১৭ ০৩:৫৫366393
  • পড়ছি, ভাল লাগছে
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৬ জুন ২০১৭ ০৮:২৬366394
  • পরের দিন সকালে মোফেক এসে গেলেন ঠিক আটটার সময়। পেট্রা থেকে উত্তরে ফিরতে হবে আবার। দিনের শেষ গন্তব্য ডেড সি আম্মান থেকে মোটে এক ঘন্টার দূরত্বে। সেদিন যে রাস্তা দিয়ে আম্মান থেকে এসেছি সেই রাস্তা দিয়েই ফেরা যায়। কিন্তু মোফেক আমাদের নিয়ে যাবেন কিংস ওয়ে দিয়ে। এই রাস্তা অন্তত দুহাজার বছরের পুরোনো। ইজিপ্ট থেকে শুরু হয়ে জর্ডন হয়ে দামাস্কাস পেরিয়ে ইউফ্রেতিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। নাবেতিয়ানরা এই পথ দিয়েই তাদের ব্যবসাবাণিজ্য বাড়িয়েছিল। পার্বত্য জর্ডনের অদ্ভুত মায়াবী সব উপত্যকার বুক চিরে চলেছে পথ। মোফেক জানতে চাইলেন পেট্রা কেমন দেখলাম। আমাদের মুগ্ধতা তো তখনও কাটেনি। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছি বললাম। মানসাফ আর মাকলাভার কথা বললাম। বেদুইনদের কথা বললাম। - সিরিয়ার যুদ্ধের আঁচ কি এই দক্ষিণেও পড়েছে? মোফেক বললেন, রিফিউজি এসেছে মূলত উত্তরে। জর্ডন সবচেয়ে বেশি রিফিউজি নিয়েছে। শুধু সিরিয়ান রিফিউজি না, প্যালেস্তাইনের রিফিউজি আছে অনেক। জেরাশ, আম্মান এসব জায়গায় প্রচুর রিফিউজি। তবে পেট্রা অর্থাৎ ওয়াদি মুসায় সিরিয়ান রিফিউজি খুব একটা নেই। যাদের দেখলেন তারা সবাই বেদুইন। - বেদুইনরা গভর্নমেন্টের থেকে কোন সাহায্য পায় না? - হ্যাঁ, পায়। সরকার থেকে স্কুল করে দিয়েছে। থাকার জায়গা দিয়েছে। তবে বেদুইনরা ওদের ট্র্যাডিশনাল লাইফস্টাইলই বেশি পছন্দ করে। ওরা এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভালোবাসে না। আরব দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত করার জন্য ওদের স্পেশাল পারমিট আছে। ওরা ইচ্ছামত ঘুরে বেড়ায়। বুঝলাম, রবীন্দ্রনাথ এমনি এমনি "ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন" লেখেন নি। সত্যিই এদের বাধাবন্ধনহীন জীবন।

    মোফেক নাম বলছেন উপত্যকাগুলোর। সবকটা মনে রাখতে পারছি না। ডানা ওয়াইল্ড লাইফ রিজার্ভের নাম শোনা ছিল। ওয়াদি ডানা শুনে মিঠুন উসখুস করতে লাগল আশেপাশে কিছু দেখা যায় কিনা। মোফেক বললেন সে জায়গা অনেক দূরে আর সেখানে যেতে গেলে অনেকটা সময় হাতে নিয়ে আসতে হবে। আবার পরে কখনও আমরা ডানা দেখব, জেরাশ দেখব, ওয়াদি রামে রাত কাটাব কথা হয়ে রইল। তিনদিন আগের বৃষ্টির পূর্বাভাস সফল হয়নি। মাঝে মাঝে আকাশে মেঘ আসে। কিন্তু বৃষ্টি হয় না। সেদিনও মেঘ খেলা করছিল উপত্যকার হলুদ সবুজের বুকে। মোফেক চাইছিলেন বৃষ্টি আসুক। জর্ডনে এমনিতেই জলের অভাব। তার ওপর দলে দলে রিফিউজি আসার ফলে জলের সমস্যা আরো বেড়েছে। গোটা দেশ তাই বৃষ্টির প্রত্যাশী।

    রাস্তার ধারে গাড়ী দাঁড় করিয়ে মোফেক বললেন, ঐ দেখুন। প্রথমে ঠিক বোঝা গেল না। তারপর খড়ের রঙের ন্যাড়া পাহাড়ের ওপর একটা দুর্গের অবয়ব স্পষ্ট হল। ক্রুসেডারদের ক্যাসেল। পরে সালাহ`দিনের দখলে আসে। পাহাড়ের সাথে রঙ মেলানো দুর্গ। - আমরা যাব ওখানে? - এটাতে যাব না। এটার নাম মন্ট্রিল ক্যাসেল। এর পর কেরাক ক্যাসেল আসবে। সেখানে যাব। কেরাক ক্যাসেলও সালাহ`দিনের দুর্গ। এই দুর্গের গল্প কিছুটা দেখা গেছে কিংডম অফ হেভেন সিনেমায়। ইজরায়েল, জর্ডন, সিরিয়া, লেবানন জুড়ে এমন অনেক দুর্গ আছে যেগুলো ক্রুসেডের সময় বানানো। তারপর হাতবদল হয়। কেরাক ক্যাসেলে এসে আমরা একজন গাইড নিলাম। এনার নাম আবু ফাদি। বুড়ো মানুষ। লাঠি নিয়ে হাঁটেন। দুর্গের নিচের তলাটা দেখালেন। ওপরে আর উঠলেন না। বললেন নিজেরা ঘুরে নিতে। রীতিমত বড় দুর্গ। দোতলা আস্তাবল। বেসমেন্টে বন্দীশালা। দুর্গের ছাদে উঁচু পাঁচিল। সেখানে তীর ছোঁড়ার জন্য ফুটো করা। সেই ফুটোয় চোখ রেখে দেখতে পেলাম দূরদুরান্ত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আকাশে আবার মেঘ ঘনিয়েছে। হু হু হাওয়া দিচ্ছে। আবু ফাদি বললেন, আজ বোধহয় বৃষ্টি নামবে। হলুদে সবুজে মেশানো কেরাক ভ্যালি অপেক্ষা করে আছে।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৬ জুন ২০১৭ ১০:১৯366395
  • দুপুরে খাবার জন্য মোফেক যেখানে নিয়ে গেলেন দেখা গেল সেই রেস্তোঁরা বন্ধ। আমরা ঠিক করলাম আগের দিনের মত গ্রানোলা বার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেব। ডিসেম্বরে এসেছি বলে দিনের আলো কম পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে খাওয়ার জন্য বেশি সময় নষ্ট করা যায় না। মোফেক বললেন পথে কোথাও না দাঁড়ালে আড়াইটের মধ্যে মাদাবা পৌঁছে যাওয়া উচিত। মাদাবা মোজাইকের জন্য বিখ্যাত। মাদাবার এক চার্চে ইজরায়েল, জর্ডন সহ পুরো হোলি ল্যান্ডের একটি প্রায় অক্ষত মোজাইক রয়েছে। সেটা তো দেখতেই হবে। তারপর আছে মাউন্ট নেবো যেখান থেকে মোজেস প্রমিসড ল্যান্ড দেখেছিলেন। অতএব গাড়ি চলল দৌড়ে। কখনও বাঁয়ে, কখনও ডানে ঢেউ খেলানো উপত্যকা। খড়ের রঙের পাহাড়। মধ্যে মধ্যে সবুজ ছোপ। একসময় বেশ বড় একটা লেকের মত দেখা গেল। - এত বড় লেক এখানে? - লেক নয়, এটা ড্যাম। বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয় এখানে। মোফেক গাড়ী থামালেন রাস্তার ধারে একটা ঝুপড়ির সামনে। ঝুপড়ির মালিক বেরিয়ে এলেন। ঝুপড়ি লিখছি বটে, তবে বেশ সাজানো গোছনো। রাতে থাকার মত ব্যবস্থা আছে। কেউ থাকতে চাইলে উনি ভাড়া দেন। ঝুপড়ির পেছনে খাদের দিকে বসার ব্যবস্থা আছে। সেখান থেকে ভ্যালি ও ড্যামের চমৎকার ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। ঝুপড়ি মালিক আমাদের জন্য চা বানাতে গেলেন। আমরা বাথরুম ব্যবহার করে ফ্রেশ হয়ে বসলাম। আবার সেই লাল চা, তবে এবারে কম মিষ্টি। - আপনি এখানে একা থাকেন? - হ্যাঁ। আমার বাড়ি পাশের গ্রামে। তবে আমি এখানেই থাকি। - গ্রামে কে আছেন আপনার? - টু ওয়াইভস, সিক্স চিল্ডরেন। আমি ভাবলাম ঠিক শুনলাম কিনা। পরে বেরিয়ে এসে মিঠুনকে জিজ্ঞেস করে দেখি ঠিকই শুনেছি।

    মাদাবা এসে পৌঁছলাম তিনটে নাগাদ। মাদাবা বেশ ব্যস্ত শহর। মোফেক আমাদের চার্চে নামিয়ে দিয়ে পার্কিং খুঁজতে গেলেন। আমরা টিকিট কেটে চার্চে ঢুকলাম। বাইজান্টাইন আমলের চার্চ। পরে অনেক সংস্কার হয়েছে যদিও। তবে হোলি ল্যান্ডের ম্যাপটা প্রায় পুরোটাই আছে। মেঝের ঐ জায়গাটা শিকল দিয়ে ঘেরা। আমরা স্যুভেনির শপ থেকে একটা ম্যাগনেট কিনে ইংরিজি ট্রানস্লেশনের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে জায়গাগুলো চেনার চেষ্টা করলাম। মূল ম্যাপটা গ্রীক ভাষায় লেবেল করা। মোজাইক কেনার ইচ্ছে ছিল খুব। একটু বেশি সময় হাতে নিয়ে এলে হয়ত মাদাবার বাজারে ঘুরে ঘুরে কেনার সুযোগ মিলত। কিন্তু সে উপায় নেই বলে মোফেকের হাতেই সব ছেড়ে দিলাম। উনি একটা মোজাইক ইন্স্টিটিউটে নিয়ে গেলেন। সেখানে যাঁরা কাজ করছিলেন তাঁরা দেখালেন কিভাবে মোজাইক তৈরী হচ্ছে। দাম সাঙ্ঘাতিক। ইচ্ছে ছিল ট্রি অফ লাইফ কেনার। জেরিকোর একটা চার্চে এই মোজাইক আছে। সেটা সাধ্যে কুলোলো না। দরদাম করে একটা মাদাবা ট্রি কেনা হল শেষ পর্যন্ত। এটা মাদাবার একটা চার্চের মোজাইকের রেপ্লিকা। খুব ইচ্ছে করছিল এই সবকটা চার্চ ঘুরে ঘুরে দেখার। কিন্তু বড্ড কম সময় নিয়ে এসেছি।

    মোজাইক কিনতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছিলাম। মোফেক খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে চারটে পঁচান্নতে মাউন্ট নেবোতে পৌঁছে দিলেন। আমরা টিকিট কাটতে পারলাম। কিন্তু চার্চের সামনে গিয়ে দেখলাম দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। যে জায়গা থেকে মোজেস হোলি ল্যান্ড দেখেছিলেন বলে মনে করা হয় সেখানে একটা ম্যাপ দেওয়া আছে। দেখতে পাচ্ছি লেখা আছে জেরুজালেম ৪৬ কিলোমিটার, বেথেলহেম ৫০ কিলোমিটার, জেরিকো ২৭ কিলোমিটার, হেব্রোন ৬৫ কিলোমিটার। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। জায়গাগুলো এত কাছে। অথচ মাঝে কাঁটাতারের বাধা। যাওয়া যাবে না কোথাও। ডেড সি দেখতে পাওয়ার কথা এখান থেকে। মনে হল যেন দেখতে পাচ্ছি। নিশ্চিত হতে পারলাম না।

    মোফেক বললেন, দুপুরে তো খাওয়া হয় নি। রাতে কোথায় খাবেন? আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। খাওয়ার কথা ভুলেই ছিলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ভুলে থাকা যাবে না। উপরন্তু ট্রিপ অ্যাডভাইসারে পড়ে এসেছি ডেড সি অঞ্চলে খাওয়ার খরচ প্রচুর। মোফেককে সে কথাই বললাম। মোফেক সায় দিলেন। - ঠিকই শুনেছেন। ডেড সি রিসর্ট এরিয়া। ওখানে খাবার দাম অনেক। কিন্তু কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। দেখি কি করা যায়। এই বলে মোফেক ফোন লাগালেন। কথা শেষ করে বললেন, হয়েছে। একটা সস্তার বাফে আছে। সেখানে আপনাদের খাইয়ে দেব। কিন্তু সেটা ছ'টায় বন্ধ হয়। দেখি তার মধ্যে পৌঁছনো যায় কিনা। পৌঁছতে সাড়ে ছ'টা বাজল। রেস্তোঁরা বন্ধ। তবে আমাদের তিনজনের জন্য প্লেট উপচানো খাবার তোলা ছিল। সবই মোফেকের বন্দোবস্ত। আমাদের কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। মাকলাভা ছিল। মোফেক বললেন, আপনারা তো এটা ভালো খেয়েছিলেন কাল। তবে জানেন আমাদের খাওয়ার রীতি হচ্ছে একটা বড় থালায় খাবার দেওয়া হবে। সব অতিথিরা এক থালা থেকে খাবার খাবেন।

    হবে নিশ্চয়ই কোনদিন। আবার যদি আসি। ক্ষিদের মুখে সব কিছুই অমৃত লাগল। সেদিন রাতে আমরা থাকব ডেড সিতে। মোফেক ফিরে যাবেন আম্মানে নিজের বাড়ি।
  • pi | 57.29.246.154 | ১৬ জুন ২০১৭ ১১:১২366396
  • ভাল লাগছে।
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৭ জুন ২০১৭ ০৬:৪৬366397
  • ডেড সির হোটেলে একটা অপ্রত্যাশিত আপগ্রেড পেয়ে গেলাম। আমাদের সাধারণ ঘরই বুক করা ছিল। কিন্তু পাওয়া গেল সি ফেসিং কর্ণার রুম। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরের দুই দেওয়াল জোড়া জানলায় অন্ধকার ডেড সির আভাস পাওয়া যায়। আকাশ জুড়ে ঘন মেঘ। সারাদিনের ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি ঘুম এসে গেল। শেষরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি মেঘ কেটেছে। প্রায় নিটোল পূর্ণচন্দ্র নিকষ কালো ডেড সির জলে নরম আলো বিছিয়ে রেখেছে। মোহাবিষ্টের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অন্ধকার ফিকে হয়ে এল। সোনালী আর নীলে মাখা আরেক রূপ তখন। দিনটা ছিল ডিসেম্বর চোদ্দ। তিনদিন পর সকালে একটু সময় পাওয়া গেছে কাগজ পড়ার। হোটেলের ওয়াইফাইতে ফোন কানেক্ট করে দেখি সিরিয়ায় রেবেলদের গৃহবন্দী করে বম্বিং করছে আসাদের সেনা। নেট কানেকশন অফ করে জানলা খুলে দিই। বাইরে ঝড়ের মত হাওয়া দিচ্ছে।

    ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে রিসেপশনে জানতে চাইলাম ডেড সিতে কিভাবে নামতে হবে। বিচে কোন গার্ড থাকবে কিনা। ওনারা বাইরের অবস্থা দেখে বললেন, আজ ভীষন হাওয়া দিচ্ছে, ডেড সিতে না নামাই ভালো। আমি নাছোড়, ডেড সিতে তো শুনেছি কেউ ডোবে না, তাহলে কেন বারন করছেন? - ডোবে না ঠিকই, কিন্তু ডেড সির জল অসম্ভব লবণাক্ত। আজ এত ঢেউ দিচ্ছে যে জল চোখে ঢুকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ঐ জল চোখে যাওয়া খুব খারাপ। মানুষ অন্ধও হয়ে যেতে পারে। আমরা স্ট্রংলি রেকমেন্ড করছি আপনারা আজ যাবেন না।

    আজ না গেলে আর যাওয়া হবে না। সাড়ে এগারোটায় মোফেক এসে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবেন। নিজেরা ভাসতেও জানি না যে জোর করে নেমে যাব। এক বুক হতাশা নিয়ে বিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। অজস্র নুড়ি ছড়িয়ে আছে। নুন জমে আছে নুড়ির গায়ে। জলে হাত দিয়ে জিভে ঠেকালাম। ঝাঁঝালো নোনতা স্বাদে মুখ অসাড় হয়ে গেল। জল শুকোনোর পরে হাত চটচট করতে থাকলো অনেকক্ষণ। একজন মানুষ দেখলাম দূরে এক জায়গা থেকে পাথরের মত কি একটা বয়ে আনছেন। কাছে আসার পর বুঝলাম সেটা নুনের চাঙড়। ভদ্রলোক ইংরিজি জানেন না। ইশারায় একটা বালতি দেখালেন। তাতে জমাচ্ছেন কাদা। ডেড সির নুন আর কাদা রূপটান হিসেবে খুব বিখ্যাত। বিক্রি হয় চড়া দামে। ওনার সাথে কথা বলতে বলতেই সেই বহু প্রতিক্ষিত বৃষ্টি নামল। দ্রুত পায়ে হোটেলের সুইমিং পুলের কাছে একটা ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টির মেয়াদ বেশিক্ষণ না। পাঁচ মিনিট পরেই থেমে গেল। আমরা আরো খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, বিচ থেকে কয়েকটা নুড়ি কুড়িয়ে এয়ারপোর্টের জন্য রেডি হব ভেবে হোটেলের দিকে ফিরছি। লবিতে ঢোকার আগে আরেকবার ডেড সির দিকে তাকাবো বলে মুখ ঘুরিয়েই দেখি আকাশজোড়া রামধনু উঠেছে ডেড সির জলে। ওপারে ইজরায়েল।

    এয়ারপোর্টের দিকে যেতে যেতে মনে হল প্রথম দিনের সেই হামাস র‌্যাপ আরেকবার খেলে হয়। মোফেককে মনের ইচ্ছে জানালাম। উনি বললেন, আজ তো অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। দেখছি এই রাস্তায় ঐরকম দোকান আছে কিনা। থাকলে দাঁড়াব। আমরা শেষবারের মত জর্ডনের রাস্তা দেখে নিচ্ছি। আবার এক পশলা বৃষ্টি এল। মোফেক বেশ খুশি। শুনলাম এখানে লোকের বাড়িতেও বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকে। এতদিন পর জানতে চাইলাম ওনার বাড়িতে কে আছে। - আমার স্ত্রী, এক মেয়ে, দুই ছেলে। মোফেক মিনস লাকি। আই অ্যাম আ লাকি ম্যান। আই হ্যাভ এভরিথিং। বড় ছেলের পড়াশোনা শেষ। চাকরী করছে। মেয়ে আর ছোট ছেলে এখনও পড়ছে। একটা বাজারের মধ্যে একটা ধাবার ধারে মোফেক গাড়ি থামালেন। - আমি এখানে আগে খাই নি কখনও। আপনারা বসুন, আমি দেখছি আপনারা যা চাইছেন তা পাওয়া যায় কিনা।

    একটু পরে ফিরে এসে বললেন, আপনার মিট র‌্যাপ খাবেন তো? - অবশ্যই খাবো। মোফেক চলে গেলেন। একটু পরে মিঠুনও বলল - আমিও দেখে আসি, তুই গাড়িতে বোস। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ওরা ফিরল। সেদিন আমাকে না নেওয়ার জন্য মিঠুন অনেক বকুনি খেয়েছে। মিঠুন বলে, ও দোকানে গিয়ে এতটাই হতবাক হয়ে গেছিল যে আমাকে ডাকার কথাও ওর মনে আসেনি। দোকানের মালিক সিরিয়ান রিফিউজি। যুদ্ধ বাধার পরে আলেপ্পো থেকে পালিয়ে এসে যেটুকু পুঁজি ছিল তা দিয়ে দোকান দিয়েছেন। সেদিন দোকানে ছিল ওনার ভাই আর ছেলে। ভাইটি সতেরো-আঠারো, ছেলে বছর আষ্টেকের, নাম রশিদ। ভাষাগত কারনে মিঠুন ওদের সাথে কথা বলতে পারে নি। কিন্তু ভাষা না জানলেও মানুষগুলো আলাপি। ল্যাম্ব কাবাব, গ্রিলড টোমেটো আর গ্রিলড পেঁয়াজ লাবাশের মধ্যে মুড়ে স্যান্ডুইচ বানানো হয়েছে। বানাতে বানাতেই খাওয়া চলেছে। মিঠুন আর মোফেক টেস্ট করেছেন। সঙ্গ দিয়েছে রশিদ। গাড়ীতে উঠে মিঠুন বলল, কত দাম নিল বলুন, ওখানে তো আপনি দিয়ে দিলেন। মোফেক বলছেন, না না দাম এমন কিছু না, আপনারা খান। এবার আমি চেপে ধরলাম, প্রথম দিনেও আপনি দাম নেন নি। আজকে আপনাকে দাম বলতেই হবে। আমরাই তো খেতে চাইলাম। আপনি কেন দাম দেবেন? - আপনারা আমার অতিথি। আমাদের দেশে কাউকে খাইয়ে পয়সা নেওয়ার নিয়ম নেই। আপনার খেয়ে ভালো লাগলেই আমি খুশি।

    আর কিছু বলার থাকে না। চারদিনের ড্রাইভারের সাথে এমন সম্পর্ক তো হওয়ার কথা ছিল না। এয়ারপোর্ট এসে যায়। সাথে সাথে বৃষ্টিও। আমাদের নামিয়ে দিয়ে মোফেকের গাড়িটা দীর্ঘ বৃষ্টিফোঁটায় হারিয়ে যায়।
  • | ১৭ জুন ২০১৭ ০৮:৩৯366398
  • যাঃ শেষ!?
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৭ জুন ২০১৭ ০৯:৪৫366399
  • হ্যাঁ।
  • dd | 59.207.60.185 | ১৭ জুন ২০১৭ ১১:২৮366401
  • তো ? আবার যাও,আবার লেখো
  • Du | 57.184.32.243 | ১৮ জুন ২০১৭ ০২:১৫366402
  • আমাদের অদেখা অজানা সুন্দর দেশটা এত ভালো করে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য হুচিতিমিকে ধন্যবাদ।
  • সিকি | ১৮ জুন ২০১৭ ১৬:৪০366403
  • এই জন্যেই রাস্তায় নামতে হয়। আমাদের চেনা স্বার্থপর পৃথিবীর বাইরেও আরও অনেক রকমের, আরও অনেক রঙের পৃথিবী রয়েছে, এই মানুষগুলো রয়েছে - এ সব পথে না নামলে কী করে দেখবো? কী করে দেখা করবো? স্থাপত্য দেখতে তো অনেকেই যায় - এই লোকগুলোর দেখা কজন পায়?
  • Shuchismita | 78.62.246.238 | ১৮ জুন ২০১৭ ২১:০৭366404
  • স্থাপত্য দেখারও দরকার আছে বইকি। প্যাগান সৌধের ওপর ক্রিশ্চান সৌধ, তার ওপর মুসলিম সৌধ যে ইতিহাসের স্বাভাবিক নিয়মে হয় তা বুঝলে অনেক দাঙ্গা এড়ানো যেত। ইস্তান্বুলের আয়া সোফিয়া প্রথমে ছিল গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ, তারপর ফোর্থ ক্রুসেডের পর রোমান ক্যাথলিক, তারপর আবার গ্রীক অর্থোডক্স এবং সব শেষে অটোমান আমলে মসজিদ। নতুন মিনার যোগ হল তখন। কামাল পাশা আসার পর করে দিলেন মিউজিয়াম। এখনও মিউজিয়ামই আছে। ক্রিশ্চান এবং ইসলামিক দুই ধর্মের রেলিক নিয়ে। পার্থেননের একই গল্প। প্রথমে আথেনার মন্দির, তারপর চার্চ, অটোমান আমলে মসজিদ। তারপর সেটাও ভেঙে যাওয়ার পর সেনা ছাউনি। কিংবা ধর ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন, ড্যানদা যাকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন। সেটা তো ক্রিশ্চান রাজার তৈরী। কিন্তু সিস্টার্ন বানাতে তুলে এনেছে প্যাগান মন্দিরের পিলার। মেডুসার মাথা ভেঙে ফেলতে তো পারে নি। সব চিহ্ন মুছে ফেলা যায় না। মিশরের রানী হাতশেপসুত। একমাত্র মহিলা ফারাও যে আঠারো বছর শাসন করেছিল। তার মৃত্যুর পর সব প্রমাণ লোপাট করে দেওয়া হয়েছিল।কার্নাক মন্দিরে তার ওবেলিস্ক পাথর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হল। কে জানে কতশো বছর পর ভূমিকম্প হয়ে বাইরের আস্তরন ভেঙে গিয়ে আবার প্রকাশ হল তার নাম। স্থাপত্য তো মানুষেরই গল্প বলে।
  • San | 160.242.63.8 | ১৮ জুন ২০১৭ ২২:০১366405
  • থ্যাংকু , হুচি। বড় ভাল্লাগল।
  • Atoz | 161.141.85.8 | ১৮ জুন ২০১৭ ২২:৪৯366406
  • কী অপূর্ব!!!!
    "যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী"
  • I | 57.15.13.130 | ১৮ জুন ২০১৭ ২৩:৩৭366407
  • হুচি,বড় ভালো লিখলা।ঝরঝরে।এত মনে রাখো কী করে?আমি তো বিদেশী নামধাম আজ বাদে কাল ভুলে যাই।
  • শঙ্খ | 57.15.9.35 | ১৮ জুন ২০১৭ ২৩:৩৯366408
  • বাহ দারুণ লাগলো। তবে শেষটা যেন বড়ই জলদি চলে এলো। মন ভরলেও যেন আরেকটু প্রত্যাশী রয়ে গেলুম।
  • শিবাংশু | ১৯ জুন ২০১৭ ২১:১২366409
  • ভারি অন্তরঙ্গ লেখা। কতোদিনের ইচ্ছে, জেরুজালেম আর জর্ডন। কে জানে কবে হবে?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট মতামত দিন