এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • তথাগত | 233.29.194.6 | ০৭ এপ্রিল ২০১৭ ১৪:০৭366226
  • অনিমেষ ল্যাপটপটা ব্যাগে ভরে দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকালেন।সাড়ে সাতটা বাজে।ডাক্তার এর সাথে এপয়ন্টমেন্ট সাড়ে আটটায়, আধঘন্টা লাগবে যেতে। কালকের ইনকাম ট্যাক্স কেস এর কাগজপত্র গুলো একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাবে।
    অফিসে এখন চন্দন ছাড়া আর কেউ নেই,সাতটায় সবার ছুটি হয়ে যায়।শুধু চন্দন সব শেষে অফিস বন্ধ করে বেরোয়।চন্দনকে ডেকে ফাইলটা বার করতে বলে একটা সিগারেট ধরালেন অনিমেষ।
    টেবিল এর উপর রাখা মোবাইলটা কুঁ কুঁ করে বেজে উঠলো, বড় স্ক্রিনে স্মিতার মুখ ভেসে উঠেছে,ছবিটা অনিমেষের তোলা অফিসে বসে।
    অন্যমনস্ক ভাবে স্ক্রিনে চাপ দিলেন,
    ‘বলো’
    ‘আজ সারাদিন এত মুড অফ কেন?’
    ‘কালকের কেসটা নিয়ে চিন্তায় আছি খুব’
    ‘সত্যি না অন্য কোন কারণ আছে?’
    অনিমেষ একটা জোরে শ্বাস ছাড়লেন,ভাগ্যিস স্মিতা সামনে বসে নেই।
    ‘হুম...একটা কথা বলব, কিছু মনে করবে না তো?’
    ‘না...বলো’
    ‘তোমরা বিয়ে করছ কবে?’
    ‘তোমার মাথা মনে হচ্ছে আজ ঠিক নেই...কাল কেস হয়ে গেলে ক্লাবে চলো,ওখানে বসে কথা বলব’।
    ফোনটা কুট করে কেটে গেল।
    অনিমেষ ফাইলটা খুলে একটু উলটে পালটে দেখে রেখে দিলেন।মাথা সত্যি কাজ করছে না আজকে।

    অনিমেষ যখন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরোলেন মাথাটা অনেক হালকা হয়েছে। কাউন্সেলিং ব্যাপারটা সম্বন্ধে কোন ধারণা ছিল না আগে।চেম্বারে ঢুকে ভদ্রমহিলাকে দেখেই ভাল লেগেছিল। অপরূপ সুন্দরী, মধ্যবয়ষ্কা, সবার উপরে দেখলেই মনে হয় যে ভরসা করা যায়।
    মন উজাড় করে সব কথা বললেন অনিমেষ, ভদ্রমহিলা অনেক কিছু নোট নিলেন,সামনের সপ্তাহে আরেকদিন সময় দিলেন।
    গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে এসি চালিয়ে দিতে বলে চোখ বন্ধ করে সিটে এলিয়ে বসলেন।
    এত কথা যে বলতে পারবেন নিজেও ভাবতে পারেননি। গত তিন মাস ধরে যা ঝড় ঝাপ্টা যাচ্ছে তার উপর দিয়ে অন্য কেউ হলে বোধহয় পাগল হয়ে যেত নয় সুইসাইড করত।
    বাড়িতে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ফ্রিজ থেকে খাবারগুলো বার করে টেবিলের উপর রাখলেন। রান্নার লোক সকালে রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে, রাত এ শুধু গরম করে নেওয়া। তিন মাসে অনেকটাই অভ্যেস হয়ে গেছে।
    আলমারি খুলে ব্ল্যাক ডগের বোতল্টা বার করে একটা বড় পেগ ঢেলে সোফায় বসলেন। বড্ড চাপ গেছে আজ অফিসে। ইনকাম ট্যাক্সে দুটো বড় কেস ছিলো, কোনটাই মনমতো হল না। মন বসাতে পারছেন না কাজে ঠিকমত।

    পরের দিন কেস করে ক্লাবের সামনে এসে দাঁড়ালেন,স্মিতা আগেই এসে গেছে। বেগুনি রং এর সাড়ী আর ম্যাচিং ব্লাউজে এক ঝলক রোদ্দুরের মত দাঁড়িয়ে আছে। অন্য দিন হলে হয়ত কিছু বলতেন অনিমেষ, আজ একটু শুকনো হেসে ঈশারা করলেন ভিতরে ঢুকতে।
    অনিমেষ ইচ্ছা করেই একটু কোণের দিকে একটা টেবিল বেছে নিলেন, যদিও লোকজন খুব একটা কেউ নেই তাও সাবধান এর মার নেই।স্মিতার চোখ এ অনেক প্রশ্ন বুঝতে পারছেন।
    স্মিতাই প্রথম মুখ খুললো, ‘নতুন কিছু হল নাকি?’
    ‘হুম...কাল নোটিস পেয়েছি, কোন খোরপোষ চায়নি...শুধু ডিভোর্স ।এখন তুমি বল আমার কি করা উচিত? সব ভুল মেনে নিয়ে একটা চেষ্টা করব?’
    স্মিতা মাথা নিচু করে বলল,’কোন বিবাহিত মানুষ অন্য কাউকে ভালবাসতে পারে,সেটা তো অপরাধ নয়, আবার সেটা জেনে তার স্ত্রী তার উপর রাগ করতে পারে, সেটাও ভুল নয়।তুমি কি চাইছো বল?’
    অনিমেষ এর কাছে ব্যাপারটা আরো গুলিয়ে গেল। স্মিতার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক কবে থেকে গড়ে উঠেছে নিজেও ভুলে গেছেন। ও কাজ করতে এসেছিল অফিসে দীপেন এর রেফারেন্সে, দীপেন স্কুল জীবনের বন্ধু। দীপেন এর পাশের ফ্ল্যাটে থাকত স্মিতার পরিবার, মানে ও আর ওর মা, বাবা মারা গেছেন অনেকদিন। সাংসারিক প্রয়োজন তো ছিলোই, আরেকটা কারণও স্মিতার কাছে বড় ছিলো,যে ছেলেটির সাথে ওর প্রেম ছিল সে তখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। কোন কাজ এ না ঢুকলে ওর কাকা আর বোঝা টানতে চাইছিলেননা।গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেছে, দেখতে সুন্দরী, বাড়িতে বসে কি করবে? সব কিছুই দীপেন এর থেকে শোনা।
    তারপর কাজ শিখিয়েছেন অনেক যত্ন করে, খুব বুদ্ধিমতী না হলেও চলে যাওয়ার মত। সেই সময় অফিসে লোকের ও প্রয়োজন ছিলো। স্মিতার সমস্যা ছিলো, কাজটা শুধুমাত্র কাজ নয়, ওকে কাজ করতে হবে বিয়েটা নিশ্চিত করার জন্য। সেইজন্য কাজে কোন ভুল হলে অন্যভাবে একটু নজড় কাড়ার চেষ্টা করতো।কাজের জায়গায় একটু আধটু ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে এই যুগে কেউ মাথা ঘামায় না,কিন্তু যখন অনিমেষ দেখলেন উল্টোদিক থেকে প্রশ্রয় যথেষ্ঠ আছে, তখন সাহস বেড়ে গেল।স্মিতাও যেন ভেসে গেল একসাথে, যে কারণে কাজ করা, সেটা তখন গৌণ হয়ে গেছে।এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দুজনে কাটাতে থাকলেন।
    বিপদ কোন দিক থেকে আসে কেউ জানে না, এটা যে কত বড় সত্যি কথা অনিমেষ এখন বিলক্ষণ জানেন।
    একত্রিশে মার্চ প্রতিবার এর মত কাজ শেষ হলে অফিসে খাওয়া দাওয়া হয় কর্মচারীদের, তার ব্যবস্থা করে বেরিয়ে পড়েছিলেন, স্মিতাকে আগে থেকে বলাই ছিল কোথায় দাঁড়াবে,সেখান থেকে ওকে তুলে সোজা চলেগেছিলেন রাজারহাট এ নতুন ফ্ল্যাটে।কমপ্লেক্সে ঢুকে গাড়িটা পারকিংয়ে রেখে লিফটে উঠলেন দুজনে,এন্ট্রি খাতায় সই করা হয়নি, মনে মনে ভাবলেন, বেরোবার সময় করে দেবেন ভেবে রাখলেন। কিন্তু সেটা যে একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে, পরে বুঝেছিলেন অনিমেষ।লিফট থেকে নামার জন্য দরজাটা খুলতেই যেন অনিমেষের মাথায় যেন কেউ রডের বাড়ি মারলো, লিফটে ওঠার জন্য দাঁড়িয়ে আছে নীলা।
    কয়েক মুহূর্ত স্থবির হয়ে গেছিলেন তিন জন। লিফট থেকে বেরিয়ে স্মিতা পরিস্থিতি সহজ করার জন্য বলেছিল,’বউদি কেমন আছেন?’নীলা কোন কথার উত্তর না দিয়ে আগুন ঝরিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল ওকে,তারপর লিফটে উঠে নেমে গেছিল।
    সেদিন বাড়িতে সারা রাত দুজন জেগে, কেন স্মিতা কে নিয়ে গিয়েছিলেন, তার কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।তার উপর মোবাইল ঘেঁটে কিছু স্মিতার করা কিছু মেসেজও নীলা বার করে নিয়েছিল।
    তারপর সব ওলট পালট হয়ে গেছে অনিমেষের জীবন এ। সাতদিন এর মধ্যে নীলা বাপের বাড়ি চলে যায়। সন্তান থাকলে
    হয়ত দু’বার ভাবত, কিন্তু একা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল। গত তিন মাসে অনেকবার কথা বলেও বিন্দুমাত্র
    টলাতে পারেননি। ওর মা ও অনিমেষের সাথে কথা বলতে চাননি। নীলার অফিসে গিয়ে দেখা করার সাহস অনিমেষ
    দেখাতে পারেননি।
    বাড়িতে একা থাকাটা আস্তে আস্তে সয়ে গেছে, রান্নার লোক রান্না করে দিয়ে যায়। অনিমেষ ভেবে দেখেছেন দশ বছরের
    দাম্পত্য জীবনে শেষ বছর দেড়েক সম্পর্ক একদম তলানিতে এসে ঠেকেছিল,সন্তানহীনতা, অনিমেষের সংসারে সময় না
    দেওয়া সবকিছু মিলিয়ে। অনিমেষও কোন মানসিক সন্তোষ পেতেন না নীলার সাথে কথা বলে। দিনে দু-তিনটের বেশী
    প্রয়োজনের কথা ছাড়া কথা হত না দু’জনের মধ্যে।

    স্মিতার সাথে সম্পর্ক একইরকম রয়ে গেছে। নীলা যদি ঝগড়া করত, গালাগালি করত, চলে না যেত, তাহলে হয়ত স্মিতার
    থেকে তিনি সরে আসতেন, কিন্তু নীলা চলে যাওয়ার পরে সেটারো আর প্রয়োজন অনুভাব করেননি অনিমেষ।স্মিতাও যেন
    আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরেছে তাকে।ওর বাড়ি থেকে বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে গেছে, তাতেও আপত্তি করে নি। প্রতিদিন অফিসের পর ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটান দুজনে।

    অডিট করতে পুরুলিয়া গেছিলেন একদিন, স্মিতাকে সাথে নিয়েছিলেন, ফেরার পথে গাড়িতে বসে স্মিতা বলেছিল,’তোমার
    সাথে আমার বয়সের অনেক তফাৎ , কখনই আমাদের বিয়ের কথা ভাবা উচিত নয়, তাই বাড়ির পছন্দ মেনে নিলাম।
    ছেলেটিও ভাল। কিন্তু বাড়ির বাইরে আমাদের সম্পর্ক একই থাকবে, আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। আবার
    তোমার মত ধরাও পড়ব না।‘ বলে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল।

    অনেকক্ষণ পর অনিমেষ বাস্তবে ফিরলেন। স্মিতা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।খুব আস্তে বলল, ‘তুমি একটা কাজ
    করো,তোমার বউ এর কাছে যাও,যেভাবে হোক মিটিয়ে নাও। তুমি এই চাপ নিয়ে চলতে পারবে না।‘
    ‘সেটা আর হয় না। আমার সব শেষ হয়ে গেল বোধহয়।‘
    স্মিতা খর চোখে তাকিয়ে বলল,’তোমার কি মনে হয় আমি দায়ী এই পরিস্থিতির জন্য?’
    অনিমেষ মাথা নিচু করে বসে রইলেন।কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্মিতা বলল,
    ‘আমার উত্তর আমি পেয়ে গেলাম।আমি বেরোব এবার,শুধু একটা কথা জানানো দরকার তোমাকে, আমার
    বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে।আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ছেলের বাড়িতে কিছু আঁচ পেয়েছে কোনভাবে, সেই কথা বাড়িতে
    জানিয়ে দিয়েছে।‘
    আর কোন কথা না বলে স্মিতা উঠে দাঁড়ালো, মুখে জমে আছে অনেক রাগ, দুঃখ। অনিমেষ এর ক্লাবের গেটের সামনের
    থালা নেড়ে ভিক্ষা করা বোবা ভিখারিটার মত নিজেকে মনে হল।চারপাশে চাপচাপ অন্ধকার নামছে যেন।

    তিন দিন মত লাগলো অনিমেষের সুস্থ হয়ে অফিসে ফিরতে।কাজকর্ম অনেক জমে গেছে,নতুন লোক নিতে হবে।একটি
    মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে,কাজ জানে, সুন্দরী । সব থেকে বড় কথা ডিভোর্স এর জন্য নীলার পাঠানো কাগজটা অফিসে
    রয়েছে। নিজের চেয়ার এ বসে কাগজটা খুঁজতেই থাকলেন অনিমেষ।
  • ফরিদা | ০৯ এপ্রিল ২০১৭ ১৩:১৭366227
  • তথাগত,
    লিখতে থাকুন। গল্পরা আরও দানা বাঁধুক, ঘুর্ণিপাক হোক।
    বলে রাখি, আরও একজন তথাগত “কুমুদি র রোমহর্ষক” টই তে রচিত হচ্ছেন। তাতে বিভ্রান্ত হবেন না :)
  • kumu | 37.56.186.110 | ০৯ এপ্রিল ২০১৭ ১৮:২৭366228
  • হ্যাঁ,আমার গল্পের তথাগত এতদিনে বৃদ্ধ।তার সঙ্গে এই টই রচয়িতার কোন সম্পর্ক নাই।
    সুন্দর গল্প।
  • tathagata chattaraj | ০৯ মে ২০১৭ ২১:৫৪366229
  • ২৫শে বৈশাখ

    সাবিনা আজ একটু সাজগোজ করে স্কুলে এসেছে, রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান আছে, পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ওর ঘাড়ে। ছাত্রীরা ডাকঘর নাটকটা করবে, কয়েকজন গানও গাইবে। ওর নিজেরও গোটা তিনেক গান আছে। সবে মাস ছয়েক চাকরি হয়েছে, এর মধ্যে ছাত্রীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
    স্কুলের পরে আক্রম ষ্টেশনে আসতে বলেছে,৪টে১০এর ট্রেন ধরবে,রবীন্দ্র সদনে যাওয়ার কথা। গত দু’দিন ধরে আক্রমের সাথে সেভাবে কথা হয়নি। ওদের স্কুলে কিছু একটা সমস্যা চলছে গত কয়েকদিন ধরে, তাই নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। আক্রমের ছোট থেকেই এই এক স্বভাব, গণ্ডগোল দেখলেই তার মধ্যে জড়িয়ে পড়া। অনেক বলেও সাবিনা এই স্বভাব পরিবর্তন করতে পারেনি।
    নাটক শেষ হওয়ার পর সাবিনা ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করলো আক্রমকে ফোন করবে বলে, পাঁচটা মিসকল আক্রমের। তাড়াতাড়ি বোতাম টিপলো মোবাইলের,একবার রিং হতেই ফোন ধরলো, ‘স্কুলে বেশ সমস্যা চলছে, কলকাতা যাওয়া ক্যানসেল। তুমি ছ’টার সময় কমলা কেবিন এর সামনে দাঁড়াও।‘ বলেই ফোন কেটে দিল। সাবিনা ওদিক থেকে বেশ হট্টগোল এর আওয়াজ পাচ্ছিলো। একবার ভাবলো আবার ফোন করে কিন্তু আবার ভাবলো এখন বিরক্ত করে লাভ নেই, আক্রম আরো রেগে যাবে।
    ছ’টার একটু আগেই সাবিনা কমলা কেবিন এর সামনে চলে এল,অনেকবার ফোন করেছে আক্রমকে, একবারও ধরেনি, কি হয়েছে কিছু বুঝতে পারছে না, স্কুলের অন্য কারুর মোবাইল নম্বর ওর কাছে নেই। খুব অসহায় লাগছিলো নিজেকে। চারদিকে বেশ কিছু মাইক লাগানো, সন্ধেবেলার অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি।কিন্তু একটু ফাঁকা লাগছে অন্যদিনের তুলনায়। আক্রমের কথা ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল।
    সামনে একটা বাইক এসে দাঁড়ানোয় সম্বিত ফিরলো সাবিনার। আক্রমের বন্ধু সুবীর। সাবিনার মেজাজটা আরো খিঁচড়ে গেল। একসময় খুব পিছনে ঘুরত ওর।সামাজিক বাধাটা বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি, না হলে প্রেম জানিয়ে ফেলতো নিশ্চয়। তারপর তো আক্রমের সাথে সম্পর্ক, তাও চার বছর হয়ে গেল। কলেজে সাবিনার গান শুনে প্রেমে পড়েছিল আক্রম।সুবীর মধ্যস্থতা করেছিল, কেন করেছিল ঠিক বুঝতে পারে নি সাবিনা।
    ‘তুই কি করছিস এখানে?’
    ‘আক্রমের আসার কথা, ফোনে পাচ্ছি না, তুমি জানো কিছু?’
    ‘ওদের স্কুলে তো খুব ঝামেলা, তুই জানিস না?’
    ‘না, আমায় তো কিছু বলেনি।‘
    সুবীর একটু অবাক হল।বললো, পরশু শুকুর খান, পঞ্চায়েত এর নেতা, ওর ছেলে আক্রমের স্কুলের একটা মেয়েকে প্রপোজ করেছে, মেয়েটা আবার শীতলা মব্দিরের পুরোহিত এর মেয়ে। মেয়েটা রাজী হয় নি বলে কাল স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দলবল নিয়ে। ছুটির সময় মেয়েটা যখন বেরোচ্ছে, হাত ধরে টানাটানি করেছে, বোধহয় কোন গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছিল। আক্রমও তখন স্কুল থেকে বেরোচ্ছিল, ওই অবস্থা দেখে মেটাতে গেছিলো। ছেলেগুলো তখন আক্রমকেও গালাগালি করে, আক্রমও দু’তিনটে চড়-থাপ্পড় মেরেছে। এর মধ্যে আরো লোকজন এসে থামিয়ে দিয়েছে। ছেলেগুলো শাসানি দিয়ে তখনকার মত চলে যায়।
    আক্রম মেয়েটি কে বাড়ি অবধি নিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে সাথে নিয়ে থানায় ডায়েরি করিয়েছে। কাল বিকেলে ছেলেগুলো আবার এসে আক্রমকে শাসিয়ে গেছে।
    সাবিনার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। এত বড় ঘটনা ঘটেছে আর আক্রম তাকে কিছু বললো না। সারাজীবন কি আক্রম এভাবেই কাটাবে। অভিমানে চোখে জল এসে গেল সাবিনার।সুবীর ওর অবস্থা দেখে চুপ করে গেল।
    পরক্ষণে সাবিনার মনে একটা সন্দেহ হল, এতো কালকের কথা। আজ সকালেও তো কথা হয়েছে। দুপুরের পরে কিছু হয়েছে তাহলে, যে কারণে বেড়ানোর প্ল্যান বাতিল করেছে।
    সুবীরের দিকে চোখ তুলে তাকাতে দেখল সুবীর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মনের প্রশ্নটা অনুমান করে বলল, আজ দুপুর থেকে ব্যাপারটা আরো ঘোরালো হয়েছে।শীতলা মন্দিরের পুরোহিতের মেয়ে, বুঝতেই পারছিস, এদিকেও সবাই এককাট্টা হয়ে গেছে, কিছু একটা করতেই হবে। দুপুরে শুকুর খানকে ধরেছিলো কয়েকজন, সে ঘটনাটা পুরো উড়িয়ে দিয়েছে, বলছে তিলকে তাল করা হচ্ছে। পুরো দোষ দিচ্ছে আক্রমকে, ওর জন্য নাকি ব্যাপারটা বেড়েছে এত। ওর কোন বাজে মতলব ছিল।
    সাবিনার আর এত কিছু শুনতে ভাল লাগছিল না। মাথার উপরে লাউডস্পীকারে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন শুরু হয়ে গেছে, সাবিনা চেঁচিয়ে উঠলো, কিন্তু আক্রম কোথায়?
    সুবীর একটু সময় নিলো,’মাথা ঠান্ডা করে শোন, উত্তেজিত হোস না। শুকুর খান আক্রমকে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছে।‘
    সাবিনা অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কিন্তু কেন?’
    সুবীর শীতল চোখে তাকাল, ‘এদিকের লোকরা এখন বলছে থানায় না গেলে ব্যাপারটা এত জটিল হত না। বাচ্চা ছেলে-মেয়ের ব্যাপার, দু’চারজন লোক দেখেছিল, মিটে যেত, যত গণ্ডগোল আক্রম করেছে থানায় গিয়ে। আসলে ওর ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে বেইজ্জত করার। শুকুর খানও তলে তলে এটাকে মদত দিচ্ছে যাতে ওর ছেলে বেঁচে যায়। চারদিকে এটাই লোক বিশ্বাস করছে এখন। ওদিকের লোকরাও বলছে ওর জন্য মান সম্মান গেল ওদের।
    সাবিনার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়,অসহ্য লাগছে কানের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান,ঝরঝর করে দু’চোখ দিয়ে নেমে আসা জল ভিজিয়ে দিচ্ছে দুই গাল।সুবীর নরম স্বরে বলল অত চিন্তা করিস না, আমরা আছি, দিন কয়েক যাক, সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।তুইও বাড়ি যা। আমি তোকে নামিয়ে দিচ্ছি।
    সাবিনা মাথা নীচু করেই বলল, ‘আমি থানায় যাব।‘সুবীর এবার রেগে উঠলো, কি পাগলামি করছিস? তোদের সম্পর্ক অনেকেই জানে, থানা যেতে হলে তোকে জেলেপাড়া পেরোতে হবে, তোকে চিনতে পারলে রক্ষা থাকবে না।‘
    সুবীর ওর হাতটা ধরে টানলো, বাইকে ওঠ। আমি যা করার করছি, তুই কিছু করতে পারবি না। তোর বাড়িও অনেকটা রাস্তা, হেঁটে যেতে হবে না। কেউ চিনতে পারলে মুশকিল। পুকুরপাড় জায়গাটা ভালো না।কথা বলতে বলতেই বাইক স্টার্ট দিল। সাবিনার মাথা কাজ করছিল না,চুপচাপ উঠে পড়ল বাইকে।
    অন্ধকার নেমে এসেছে, ইতস্তত মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে, সাবিনার মনে হল দু’তিন ঘণ্টায় জীবন কিরকম পালটে গেল, এখন তাকে বাড়িতে বোঝাতে হবে, স্কুলে, বন্ধুদের সবাইকে বোঝাতে হবে আসল ঘটনা কি? সবার আগে কাল যে করে হোক আক্রমের সাথে দেখা করতে হবে, অনেক লড়াই সামনে। শীতলা মন্দিরের সামনে এসে ঘোর কাটলো সাবিনার, বিক্ষিপ্ত জটলা চারদিকে, উত্তেজিত চোখমুখ।
    সুবীর জায়গাটা পেরিয়ে সিগারেটের দোকান দেখে একটু দাঁড়ালো।পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে একটা সিগারেট মুখে লাগিয়ে দোকানে ঝোলানো দড়ি থেকে সিগারেট ধরালো, নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছিলো সুবীরকে।
    সাবিনার মনেও তখন আগে বাড়ি যাওয়ার একটা তাড়া কাজ করছিল, সুবীরকে কিছু বলার আগেই জোরে বাইকটা চালিয়ে দিল।সামনের পুকুরপাড় পেরোলেই সাবিনার পাড়া, পুকুরপাড়ের সামনে আসতেই মাইকের আওয়াজ,সখী ভালবাসা কারে কয়, সে যে কেবলই যাতনাময়, গলাটা চেনা লাগল সাবিনার, পাড়ারই কেউ গাইছে মনে হয়।
    তখনই মাটি ফুঁড়ে যেন উঠে এল সাত-আটটা লোক, সবার হাতে রড, প্রথম রডটা চালালো বাইকের চাকায়, ছিটকে পড়ল দুজনে। চোখে পড়ল সুবীর উঠে পালানোর চেষ্টা করছে, ওর দিকে ঘুরেও তাকালোনা কেউ, সাত-আট জোড়া হাত ছিঁড়ে খেতে লাগলো একটা রক্ত মাংসের শরীর।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন