এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দুর্লভ শৈশব 

    Suvasri Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ মার্চ ২০২৪ | ১৩৫ বার পঠিত
  • শিশুরা সুন্দর, নিষ্পাপ, অনলিন। তাদের সঙ্গে সময় কাটালে মন ভালো হয়ে যায়। তাদের গায়ের গন্ধ নিলে মাটির পবিত্র অকৃত্রিম গন্ধ আসে। শিশুরা অপরিণত মনের অধিকারী তা বলে তাদের বুদ্ধি কম নয়। তাদের নানা রকম কথাবার্তা শুনে মজা লাগে। শিশুমনের অপূর্ব কল্পনার পাশাপাশি তাদের কথায় বুদ্ধির ছাপও থাকে। তার ওপর তাদের নানা রকম দুষ্টুমি তো আছেই।

    সবার আগে বলি আমার ভাইঝি তিতু'র কথা। সে আমার এক মাসতুতো দাদার মেয়ে। এখন অবশ্য সে অনেক বড়। সুন্দরী ও মেধাবিনী এবং বড় চাকরিরতা তিতু বিয়ের পর থেকে দিল্লিতে থাকে। এই তিতু বরাবরই খুব হাসিখুশি এবং প্রাণচঞ্চল। ঠাকুর্দা, ঠাকুমার প্রাণ ছিল সে এবং আমারও খুব প্রিয়। এখানে তার শৈশবের দুয়েকটা কথা বলি। 

    বছর তিনেকের তিতু মৃত্যুর কথা শুনেছে। তারপর বিষয়টা নিয়ে তার ভারি আগ্রহ! তার ঠাম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল- মরে যাওয়ার পর মানুষ কোথায় যায়? তার ঠাকুমা যথাসাধ্য সহজ ভাষায় তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে মরে যাওয়ার পর মানুষ আর আমাদের সামনে থাকে না, আকাশে চলে যায়। তখন তিতুম ভারি চিন্তায় পড়ে গেল। তারপর ঠাম্মাকে বলল- "মরে যাওয়ার পর আকাশে গিয়ে মাথাটা নিচের দিকে আর পা দুটো ওপর দিকে করে তুমি ঝুলে থাকবে যাতে আমি দেখতে পাই।" কথার মতো কথা বটে!

    এই তিতু'র শিশুবাক্যে বুদ্ধির ছাপ থাকত। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি এক দিন বলেছিলাম - বাবরের ছেলে হুমায়ুন, হুমায়ুনের ছেলে  অাকবর। সঙ্গে সঙ্গে সে বলল- পাগলের ছেলে তিন বর, টাগলের ছেলে পাঁচ বর। তখনো তার চার বছর বয়স হয়নি। সাধে কী আর বড় হয়ে অঙ্কে এত ভালো হয়েছে!

    তিতুর আরেকটা কান্ড বলি। সে দিন তাদের বাড়িতে জল ছিল না। তার মা, আমাদের বৌদি কষ্ট করে জল সংগ্রহ করে বাড়ির সব কাজ করে নিয়েছিলেন এমন কী রান্নাবান্নাও। শুধু নিজের স্নানটা তখনো হয়নি। স্নানের জন্য এক বালতি জল রেখে দিয়েছিলেন তিনি। সে দিনও আমরা তাদের বাড়ি গিয়ে পড়েছিলাম। সেই সময়টায় হুটহাট আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া চলত। যাই হোক, গিয়ে জল না থাকার ব্যাপারটা শুনলাম। তার মধ্যেই অনেক কথা, গল্প হচ্ছিল। কি একটা প্রসঙ্গে মাসি বললেন- তিতু খুব ভালো মেয়ে। অনেক কাজ করে। বৌদিও বললেন- তা ঠিক, তিতু আমাকে কাজকর্মে অনেক সাহায্য করে। আমরা সবাই বাহবা দিতে লাগলাম। তিতু দেখল, সে কত কাজ করে তার একটা প্রমাণ দেওয়ার এই সুযোগ। একটা এঁটো থালা নিয়ে তার মায়ের স্নানের জলের বালতিটায় ডুবিয়ে দিল! বৌদির স্নান চৌপাট!

    এবারে সোহম সরকারের প্রসঙ্গে আসি। তিনিও এখন অনেক বড়, নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। শৈশবে অবশ্য আমাদের বাড়িটা ছাড়া কিছু জানতেন না। শৈশবে তিনিও বেশ কথার ঝাপটা দিতেন এবং রাগ হলেই আমাকে মারধর করতেন। 

    সোহমের তখন বছর দুয়েক বয়স। সেই সময় থেকে আমাকে দেখে তাঁদের একতলার বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতেন- ন, অম্মি! ন অর্থাৎ লজেন্স, অম্মি বলতে হজমি। 

    এক দিন আমি তিন বছরের সোহমকে নিয়ে কাছাকাছি বেড়াতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় এক জায়গায় মুর্গির খাঁচার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। আমি তো ভয়ে মরি" মুর্গিওয়ালা রেগে গিয়ে আমাকে কিছু বলতে পারে কিম্বা মুরগি ওর আঙুল কামড়েটামড়ে দিতে পারে। সৌভাগ্যবশত দুটোর একটাও হয়নি।

    সোহমের মা তেজী বৌদি আমাকে বলে দিয়েছিলেন, মৌ তুই যখন ওঠানামা করবি, ওর সঙ্গে ইংরিজিতে দুয়েকটা করে কথা বলবি। একেক দিন বেরোবার কী ঢুকবার সময় দেখতাম, জানলার কাছে টেবিলচেয়ারে তিনি পড়াশোনা করছেন। আমি হয়তো বললাম- হে গুল্লু, হোয়াট আর ইউ ডুয়িং বেবী? তিনি উত্তর দিতেন- আই অ্যাম রিডিং। আমি বলতাম - বাবু, আই অ্যাম রিডিং নয়, বলো আই অ্যাম স্টাডিং।

    সোহমের দুষ্টুমির সীমা ছিল না। আমাদের বাড়িতে এসে মনোযোগ না পেলেই তাঁর রাগ হয়ে যেত। এক দিন বাড়িতে অতিথি আসায় তাঁকে আমরা মনোযোগ দিচ্ছিলাম না। বছর ছয়েকের সোহমবাবু রেগে গিয়ে অতিথির চটি ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। 

    জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখা তাঁর প্রিয় খেলা ছিল।  একবার আমাদের ফ্রিজের চাবিটা আমাদেরই বাথরুমে সাবানদানীর নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর লুকিয়ে রাখতেন রিমোট। একবার কাগজে মুড়ে আমাদের রিমোটটা চারতলা থেকে এক তলায় ছু্ঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। একবার আমাদের পুঁচকি কমলা রঙের টর্চটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বৌদি খুশবুর হাতে সেটা দেখেন। সোহম টর্চটা নিয়ে গিয়ে ওদের একতলার জানলার পাশে হাল্কা ঝোপঝাড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। খুশবু দেখতে পেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তেজী বৌদি তাকে ব্যাপারটা বলে টর্চটা আমাদের ফেরত দিয়ে দেন।

    সোহমকে আমি বলতাম পামোফছে। পাকা, মোটা, ফর্সা ছেলে সংক্ষেপে "পামোফছে"। একেক সময় ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলতাম, পামোফছে। অমনি তিনি চোখমুখ ঘুরিয়ে বৌদির কাছে গিয়ে নালিশ করতেন - দেখো মা, বলে কী- পাকা মোটা ফর্সা ছেলে। বৌদি হেসে খুন। এ প্রসঙ্গে বলি, শিশুটি মোটা, ফর্সা ও অসম্ভব সুন্দর না হলেও আমার তেমনই স্নেহ পেতেন। শিশুর প্রতি ভালোবাসা গায়ের রং দেখে আসে না। সোহমকে আমরাই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। ফলস্বরূপ ব্যাখ্যার অতীত টান জন্মানো অনিবার্য যদিও এ সম্পর্ক রক্তের নয়। একা আমি নই, আমরা সবাই তাঁকে ভালোবাসতাম, বাসি।

    এক বার তাঁকে টুকটাক ইংরিজি শব্দের বাংলা মানে শেখাচ্ছিলাম। কৃষক, শ্রমিক, পরিশ্রম, ঘাম, অত্যাচার এই সব।  তা তিনি চীৎকার করে বলতে লাগলেন- শুনব না, শিখব না। আমার বাবা চিরকাল চট করে রেগে যেত। আমাকে বলল- তোমার লজ্জা করে না, সাত বছরের একটা বাচ্চাকে ইংরিজি শেখাচ্ছ? মা আমার সমর্থনে বলল- সব কিছুই শিখে রাখা ভালো। ততক্ষণে সোহম তিতিবিরক্ত। তিনি বলে উঠলেন- আমি তো আর তোমাদের মতো অসভ্য নই যে এই সব অসভ্য অসভ্য কথার ইংরিজি শিখব!

    রাগ হলে আমাকে মেরে পাটপাট করে দিতেন পুঁচকে সোহম। 

    একবার এই রকম মারধর খেয়েই হয়তো কিছু দিন তাঁর সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তারপর এক দিন বিকেলে নিচে নেমে দেখি, একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ের মাথা লক্ষ্য করে তিনি বারবার ফুটবল ছুঁড়ছেন। আমি বৌদিকে বললাম- দেখছেন তো কী করছে? বছর পাঁচেকের সোহম অমনি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে উঠলেন- আমি মারছি তো ওর কী? রুনি কী ওর মেয়ে?

    সোহমকে নিয়ে এরকম অনেক মজার স্মৃতি। পরে আরো লেখার ইচ্ছা আছে। 

    শেষে নিজের শৈশবের একটা সামান্য ঘটনা বলি। তখন আমি প্রথম শ্রেণি। নেশা দিয়ে বাংলা বাক্যরচনায় লিখেছিলাম- আমার মদের নেশা আছে। শিক্ষিকা কান মুলে দিয়েছিলেন, তাও মনে আছে।

    স্মৃতিভাণ্ডার খুললে এরকম কত শিশুকথা, কত অভিজ্ঞতা বেরিয়ে আসবে। একটু একটু করে লিখব।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Subrata Bharadwaj | ১৫ মার্চ ২০২৪ ১৭:৩৭529399
  • খুব সুন্দর  লেখোনি 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন