এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আকুতি

    Rashmita Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০৭ বার পঠিত
  • সে তার ব্যাগপত্র কোনোভাবে নিজের ঘরে রেখে দিয়েই তড়িঘড়ি করে দাদুর ঘরে চলে এসেছিল। ধীর পায়ে ঢুকেছিল সে দাদুর ঘরে। আস্তে করে দাদুর বিছানার পাশে রাখা চেয়ারখানি নিয়ে বসেছিল। তারপর সে নিষ্পলক তাকিয়েছিল দাদুর চোখের দিকে আর দাদুর যন্ত্রনাক্লিষ্ট চোখ দুখানি স্হিরভাবে নিবদ্ধ ছিল তাতানের চোখের দিকে। বেশ কিছুক্ষণের এই নিস্তব্ধতাতেই নিঃশব্দে হয়ে গেল অনেক কথার মূক বিনিময়। যাবার সময়ে তাতান দাদুর হাত ধরে বলেছিল, "দাদু... তুমি এই ঘরে আর একা থাকবে না। আমি আমার ব্যাগপত্র নিয়ে এই ঘরে আসছি। বাইরের লোক নয়, এবার থেকে আমিই তোমার সেবাযত্ন করব। "
    বৃদ্ধ ভগ্নকন্ঠে কোনোমতে বললেন, "আমায় একটু একা থাকতে দে দাদুভাই, একটু একা থাকতে দে"।
    তাতান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, "তা কি করে হয় দাদু... তোমার শরীরের এই অবস্হায়...
    "শ্ শ্ শ্ শ্ শ্"...
    চাপা অথচ প্রখর তীব্র কন্ঠে দাদু তার মুখের কাছে আঙুল এনে দৃঢ়স্বরে বললেন, এই বিষয়ে আর একটাও কথা নয়। এটা আমার আদেশ। "
    তাতান যারপরনাই বিস্মৃত হল। তারপর ধীরকন্ঠে বলল, "ঠিক আছে দাদু। যেমন তোমার ইচ্ছা... আমি মাঝে মাঝে তোমায় দেখতে আসব। সাবধানে থেকো !আর আমার ঘর তো কাছেই, দরকার মতো আমায় ডেকে নিও কেমন!"
    এই বলে সবেমাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তাতান। এমন সময়ে দাদু হঠাৎই এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলেন। তিনি তাতানের হাত দুখানি জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,
    "আামার একটা কাজ করে দিবি দাদুভাই?"
    অবাক হয়ে তাতান বলল, "হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বলো না দাদু"।
    দাদু বললেন, "আমায় একটা বড় ক্যানভাস আর কিছু রং তুলি এনে দিবি?"
    তাতান অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এই শরীর নিয়ে রং তুলি ক্যানভাস নিয়ে কি করবে?
    রোগক্লিষ্ট মুখে অল্প হাসি এনে দাদু বললেন, এনে দে না রে দাদুভাই... মরবার আগে একটু বেঁচে নিই...
    দাদুর সারা মুখে এক অদ্ভুত আকুতি দেখল তাতান। মৃদুস্বরে সে বলল, ঠিক আছে দাদু। আমি আজ বিকেলের মধ্যে তোমায় এনে দেব। এখন আমি আসি... সাবধানে থেকো...
    ঘরের পরদা সরিয়ে ধীরপায়ে ঘর থেকে বিদায় নিল সে। সেদিন বিকেলের মধ্যে সে একটা বড় ক্যানভাস আর কিছু রংতুলি কিনে এনে দাদুকে দিয়ে এল। তার অল্পকিছু দিন পর পরই দাদুর মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল। দাদুর শরীর থেকে যেন কোনো অজানা যাদুমন্ত্রে রোগ যন্ত্রণার সমস্ত লক্ষণ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকল। এমনকি দাদুর মধ্যে ক্রমশ বার্ধক্যের সমস্ত লক্ষণ ও চিহ্নও অবিশ্বাস্যভাবে গায়েব হয়ে যেতে থাকল। আশি পার করা দাদুর সারা শরীর ক্রমশ বিশবর্ষীয় অকাল তারুণ্যে লাবণ্যময় হয়ে উঠতে লাগল যেন। দাদু মরার আগে তাঁর চার ছেলের মধ্যে কোনজন আগে সিংহভাগ সম্পত্তি তাঁকে দিয়ে নিজের নামে লিখিয়ে নেবেন সেটা নিয়ে যখন পরিবারের প্রতিটি আনাচ কানাচ জুড়ে চাপা উত্তেজনার পারদ ক্রমাগত উচুতে চড়ছিল, ঠিক সেই সময়ে তাঁর অপ্রত্যাশিত এবং অপার্থিব এই ভোলবদলে গোটা পরিবার এখন বিস্ময়ে একেবারে বাকরুদ্ধ। দাদু এখন শয্যাত্যাগ করেছেন এবং একেবারে রোগমুক্ত সুস্হ শরীর নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। কিন্তু যেটা আশ্চর্য ব্যাপার, সেটা হল, তিনি সব সময়ে নিজের ঘর বন্ধ রাখেন এবং বন্ধ দরজার আড়ালে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করে এক অজ্ঞাত অতিপ্রাকৃতিক একাকিত্বে মগ্ন জীবন যাপন করেন। বন্ধ দরজার বাইরের পৃথিবীর যেন জানা বারণ তাঁর এই আত্মমগ্ন জীবনের স্বরলিপি।
    তাতান যত সবকিছু সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করতে থাকল ততই বিস্ময়ে হতবুদ্ধি স্তব্ধ হয়ে যেতে থাকল। চারপাশে দাদুর মৃত্যুর দিনক্ষণ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মাঝখানে এই অপ্রত্যাশিত যবনিকার অমোঘ বিস্ময় এবং সম্পত্তি টাকাপয়সার ভাগবাঁটোয়ারার চিন্তাভাবনার খেই হারিয়ে নোঙর খোঁজার পরিস্হিতিতে পরিবারের সবার যখন হাবুডুবু খাওয়ার মতো অবস্হা তখন এইসব পার্থিব হিসেবনিকেশের চিন্তার উর্দ্ধে অবস্হান করা তাতানের
    মনে দেখা দিল এক তোলপাড় করা কৌতূহল। দাদুর শরীর আরোগ্যলাভ করাতে তাতান যারপরনাই খুশি হলেও প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে গিয়ে দাদুর এই অপার্থিব পরিবর্তনে তাতান ভীষণভাবে এক কূহেলী আচ্ছন্ন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে যা তাকে উদঘাটন করতেই হবে। বন্ধ ঘরের ভিতরে, জগতের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সেই অলীক দুনিয়ার পর্দা সরিয়ে দেখার কৌতূহলটা ক্রমে তাতানের ভিতরে একেবারে গোঁজ হয়ে চেপে বসল। সে বুঝতে পারল এটা সহজ কাজ নয়। কারণ দাদু নিজের সেই ঘরখানার দরজা এবং জানলার মধ্যে কোনোরকম ফাঁকফোকরটাও উন্মুক্ত রাখবার পক্ষপাতী নন। অতএব এই রহস্য উদঘাটন করতে যদি হয় তাহলে তাতানকে একেবারে সবসময় মনযোগ দিয়ে তক্কে তক্কে থাকতে হবে সময় অথবা সুযোগের অপেক্ষায়। অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দাদুকে সে যত চোখের সামনে দেখছে, তার সমস্ত চেনা হিসেবনিকেশ নিমেষে গুলিয়ে যাচ্ছে। সে সারারাত বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে বিস্তর পড়াশোনা করল। কিছু কোনোকিছুর কোনো কূলকিনারা করতে পারল না। সে বুঝল, রহস্য উদঘাটন করতে হলে তাকে আরো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। সেইমতো পরিকল্পনা করে সে পরদিন সকাল সকালই বেরিয়ে গেল মেসের উদ্দেশ্যে আরো কয়েকদিন বাড়িতে থাকবার জন্য পর্যাপ্ত আরো কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসবার জন্য। মেসে পৌঁছে জিনিসপত্র গোছগাছ করে, রুমমেটদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতা সেরেটেরে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরীই হয়ে গেল তাতানের। বাড়িতে ফিরে তাতান একটা অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ শুনে একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। দাদু আজ সকালেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। অলীক আরোগ্যপ্রাপ্ত দাদুর এই অকস্মাৎ মৃত্যুতে একেবারে শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ল তাতান। সেই সাথে দাদুর এই অপার্থিব পরিবর্তনের রহস্য শুধু রহস্য হয়েই অধরা রয়ে যাবার আপশোষে তাতান ভীষণরকম মুষড়ে পড়ল।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন