এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শিক্ষা-পর্যটনে রাজশাহী-দর্শন

    Santosh Kumar Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৩১০ বার পঠিত
  • শিক্ষা-পর্যটনে রাজশাহী-দর্শন

    গবেষণা-পত্র মূল‍্যায়নের শেষ ধাপে মৌখিক প‍রীক্ষার ব‌্যবস্থা থাকে। মূলত সেই প্রয়োজনেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার দ্বিতীয় বারের মতো দাওয়াত আসে। (আগে ২০১৮ তে একই উদ্দেশ্যে এসেছিলাম। অবশ্য মাঝে একদিনের বেশি না থাকতে পারায় শহরটারে ভালো কইর‍্যা দেখাই হয় নাই!) দেশের বাইরে যাওয়ার ঝক্কি অনেক। শুধু ভিসা করাতেই দু'দিন কলকাতায় যেতে হয়। তার আগে এ বাড়ি ও বাড়ি রাজবাড়ি ঘোরাঘুরি করতে হয় কর্তৃপক্ষের অনুমতির জন‍্য। কলকাতার কাজ এবার অবশ্য ছেলে করে দিয়েছে। এবং ইতিহাসের গবেষক রাজশাহীর বরেণ্দ্র মিউজিয়াম ও গ্রন্থাগারের আকর্ষণে সে আমার সঙ্গী হওয়ায় একটু সুবিধা হয়েছে।

    রাজশাহী ঢাকা থেকে দূরে হওয়ায় আগের বারের মতো স্থলবন্দর হয়ে সড়ক পথে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। আর একটা ভাবনা মাথায় ছিল: দেশ-দেখার জন‍্য, সেখানকার জন-জীবনের স্বাদ নেওয়ার জন‍্য বায়ুপথ উপযুক্ত নয়। এবার মালদার গৌড়-সীমান্ত পেরিয়ে সোনা মসজিদের ইমিগ্রেশন অফিস ঘুরে রাজশাহী। আগের বার অবশ্য গিয়েছিলাম গেদে-দর্শনা দিয়ে চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া-পাবনা-নাটোর হয়ে। সেটা ছিল প্রায় সাড়ে ছয় ঘন্টার কার-জার্ণি। এবার সড়ক যাত্রা কমাতে রেলের সাহায্য নেওয়া আর কি!

    আগের বারে গিয়েছিলাম ২০১৮ খৃষ্টাব্দের ৮ ই মার্চ। ফিরেছি ঢাকা হয়ে ১১ই মার্চ। ঠিক একই কাজে, সস্ত্রীক নিমন্ত্রণে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের জনৈক পিএইচডি গবেষকের ভাইভা নেওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেওয়াই ছিল সেবারের কর্মকাণ্ড। বিরাট কাম্পাস, সুন্দর সাজানো-গোছানো কত বিল্ডিং, সঙ্গে মুকুলের সুগন্ধসহ বিস্তৃত আমবাগান। সেদিন মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ যদি ভূবনডাঙ্গা দেখার আগে এই এলাকায় পদার্পণ করতেন তাহলে বিশ্বভারতী- শান্তিনিকেতন দেখার জন্য আমাদের ভিসার অফিসে ছোটাছুটি করতে হতো! সেবার সঙ্গী ছিল সহধর্মিনী, এবার অবশ্য পুত্র নীলকণ্ঠ। এবারের মতো সেবারও ছিল লেজেণ্ডারি হসপিটালিটি। আর একটি অনুষঙ্গ স্মৃতির মণিকোঠায় তোলা আছে: সেমিনারের শুরুতে দর্শনের অধ্যাপক, কবি-সাহিত্যিক-বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী হাসান আজিজুল হকের সঙ্গে "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি" জাতীয় সংগীতে গলা মেলানো এবং তা একেবারে (বটমূলে না হলেও) আম্রবৃক্ষ-মূলে। ফিনান্সিয়াল ইয়ার-এণ্ড হওয়ায় বিভিন্ন বিভাগে সেমিনার। তাই হল পাওয়া না যাওয়ায় আম্রকুঞ্জে ওপেন মঞ্চে আন্তর্জাতিক সেমিনার। সে ছিল অনন্য অনুভূতি। চট্টগ্রাম, ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন-বেত্তাদের সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করা। আর একটা গর্বের অনুষঙ্গ: আজিজুল সাহেব পূর্ব বর্ধমানের আমার গ্রামের কয়েক কিলোমিটার দূরে যবগ্রামের মানুষ (ছিলেন)। এ পার বাংলা থেকে যাঁরা ওপার বাংলায় চলে গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আজিজুল সাহেব এক পরিবার। দুঃখের কথা, 'আগুন পাখি'-র লেখক এই স‍্যার অবশ্য করোণা-কালে প্রয়াত হয়েছেন।

    সেবার রেলপথে ঢাকা হয়ে ফিরেছি। মাঝে জাহাঙ্গীরনগরে অধ্যাপক আনোয়ারুল্লা সাহেবের আতিথেয়তা গ্রহণ। ইচ্ছে ছিল ঢাকা ঘুরে দেখার। কিন্তু তখন শাহবাগ চত্বর ও শহীদ মিনার ছাড়া তেমন কিছু দেখা হয় নি। এমন কি, সাভার স্মারকস্থল সেবার দেখা হয় নি।

    অবশ্য গত বছরের অগাস্টে ঢাকায় দিন চারেক ছিলাম বাংলাদেশ দর্শন সমাজের আন্তর্জাতিক কন্ফারেন্স উপলক্ষ্যে। তখন পুরান ঢাকা সহ দ্রষ্টব্য অনেক কিছু দেখেছি। ছেলে নীলকণ্ঠ লাইব্রেরি-ওয়ার্কের কাজে আগে থেকেই ওখানে ছিল। তাই ওকে নিয়েই (পাক-দানবের গুলিতে রক্তক্ষরণের গভীর ক্ষতের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা) ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুলের সমাধি, আপামর হিন্দুর পবিত্র তীর্থস্থান ঢাকেশ্বরী মন্দির সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সংগ্রহশালার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তখনই। জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ সেরে, দর্শনের চেয়ারম্যান সাহেবের আতিথ‍্য নিয়ে সাভার স্মারকস্থলও দেখেছিলাম। সঙ্গে উপরিপাওনা সদ‍্য নির্মিত পদ্মা সেতু ভ্রমণ, অবশ্য বাসে করে। এই সময়েই মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় গিয়েছিলাম একদিন সকালে একাই, টাটকা ইলিশ খেয়ে হেঁটে পদ্মা সেতু পার হ'ব বলে। কিন্তু হাঁটার অনুমতি না থাকায় বাসে উঠতে হয়। তবে মাওয়ায় ইলিশ খাওয়া অনুমতি-সাপেক্ষ না হলেও সময়-গণনায় ভুল করায় রসনার তৃপ্তি হয় নি!

    তবে রাজশাহী আমাকে পদ্মার ইলিশ থেকে কখনই বঞ্চিত করে নাই। আগের বারের মতো ইলিশ সহ তিন রকমের মাছ তৃপ্তি করে খেয়েছি।তবে শহরে পা দিয়েই বুঝতে পারা যায় রাজশাহীকে কেন এশিয়ার সবচেয়ে পরিছন্ন ও সবুজ শহর বলা হয়। সবুজ, পরিচ্ছন্ন তো বটেই রাজশাহী, আরো উজ্জ্বল করেছে রাতের রাজশাহীকে 'প্রজাপতি' আলো। আমি মোটামুটি ভদ্রস্থ এলাকায় থাকি বর্ধমানে। সেখানেও ঘর থেকে বের হলে যে তিনটে জিনিস আপনি না চাইতেই পেয়ে যাবেন তা হল, দৃশ্য-দূষণ, নাকে রুমাল চাপার মতো নোংরা দুর্গন্ধ, আর উচুঁ-নিচু খানাখন্দে ভরা রাস্তা, যার নুড়ি-পাথরগুলি অহল‍্যার মতো তাদের মুক্তির জন্য আপনার পদস্পর্শ কামনা করছে! বিপরীতে রাজশাহী নগরীতে ময়লা তো দূরস্ত, কাগজ-পলিথিনের টুকরোও আপনাকে কষ্ট করে খুঁজে দেখতে হবে। এখানে শহরের মেয়র লিটন সাহেবের ঐকান্তিক উদ্যোগের কথা না বললে অন‍্যায় হয়। তারই পরিকল্পনা মাফিক রাতের অন্ধকারের মধ্যেই সব আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। রাত ৮ টা থেকে ১০ মধ্যে সব পরিষ্কার, আমাদের বর্ধমানে যেখানে সকাল ৮-তেও এ কাজ শুরু হয় না। ১০-১১ টার সময় যখন রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করছে, আপনি প‍্যান্টু-সার্টু পড়ে স্কুল-কলেজের দিকে রওনা হয়েছেন সাড়ে দশটার প্রথম ক্লাসটা ধরার জন্য, রাস্তা এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে বর্জ্য বোঝাই হচ্ছে সাধারণ ট্রাক বা লরিতে। আপনার ভাগ‍্য খারাপ হলে দু-এক ফোঁটা (অ)শান্তিজল বা কয়েক টুকরো জৈব পদার্থ আপনার দেহ অনায়াসে পেয়ে যেতে পারে! হোয়াট রাজশাহী থিঙ্কস টুডে, উইল বার্ডোয়ান থিঙ্ক টুমোরো? ওখানে প্রায় প্রতিটি রাস্তা ওয়েল-মেনন্টেইণ্ড, ডিভাইডারে মাঝে সবুজের সমারোহ। জানলাম এখানে অধিকাংশ যান হয় ব‍্যাটারি বা সি এন জি-তে চলে। ধুলোবালি খুব, খুবই কম। জ‍্যাম সেরকম চোখে পড়ে নি। ফেরার দিন ২৯ জানুয়ারি ভদ্রার মোড় থেকে দ্বিপ্রহরে যখন সপুত্র স্বদেশ-অভিমুখী তখন মনে হচ্ছিল বোধ হয় ইউরোপের কোনো দেশ দেখে ফিরছি!

    বলা প্রয়োজন, শহরটি তুলনায় খুব বড় নয়, কিন্তু বয়সে অনেক পূরানো, ব্রিটিশদের আসার অনেক আগে পর্তুগিজগের স্থাপত্য তার নিদর্শন। তথ্য জানান দিচ্ছে, ১৮৭৬ খৃষ্টাব্দে মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়েছিল; কর্পোরেশন হয়েছে ১৯৯২-এ। অধ্যাপক আবু বকর সাহেব জানালেন, পর্তুগিজদের তৈরি বড় কুঠিতেই রাজশাহী কলেজ (তখনকার দিনে প্রেসিডেন্সির পরেই যার স্থান ছিল।)ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস শুরু হয়।

    আমরা জানি, বেশির ভাগ শহর নদীর কাছাকাছি এলাকায় গড়ে ওঠে। রাজশাহীর ক্ষেত্রে সেটি ১০১ ভাগ সত্যি। আসলে পদ্মার একেবারে উত্তর তীর বরাবর মোটামুটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। সিটি কর্পোরেশন এলাকার জনসংখ্যা চার লক্ষের একটু কম। নদীর পাড় ভাঙার পাগলামি রাজশাহীকে সহ‍্য করতে হয়। মনে পড়ে যায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সেই বিখ্যাত গান: ''ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে।.... নদীর একূল তুমি গড়ো/ যার একূল-ওকূল দুকূল গেল তার লাগি কি করো!" হাঁ, বৈকালিক ভ্রমণ বা শহর দেখা, যাই বলুন না কেন, এখানে ত্রি-ধারার পদ্মার কথা বলতেই হয়।

    আর একটা কথা এই ফাঁকে বলে রাখি, কলেজ-শিক্ষক তথা রাবি-র গবেষক ভাইয়ের কথা-- যিনি এবারের রাজশাহী ভ্রমণের সব দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন-- তাঁর কথা না বললে কৃতঘ্নতা হবে। আমাদের প্রতিটি মুভমেন্টে তিনি আমাদের গাইড করেছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা নো-ম‍্যানস ল‍্যাণ্ডের ওপারে সোনা মসজিদের সামনে থেকেছেন সপুত্র আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার শেষ লগ্নে সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাদের মাহদীপুরে।

    উনিই আমাদের পদ্মায় নৌকা-বিহারের ব‍্যবস্থা করেন। যদিও এই সিজনে সেরকম টেউ নেই পদ্মার এদিকের প্রথম স্রোত-ধারায়, তবুও মনে পড়ে যায় শচীন-কত্তার সেই ব‍্যাকুল আহ্বান: "পদ্মার ঢেউ রে মোর শূন্য হৃদয়পদ্ম নিয়ে যা, যা রে!" এপার বাংলার সঙ্গে আমাদের মতো নিখাদ 'ঘটি'র বাহ‍্যিক আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। তবুও রাতের অন্ধকারে এক রফিকের দানবীয় উল্লাসে প্রাণ হাতে করে আর এক রফিক-ভাইয়ের সহৃদয় সহায়তায় দীপঙ্করদের মতো সব হারিয়ে যারা ওপার বাংলা থেকে কুপার্স ক‍্যাম্পের নাম জপতে জপতে এপারে এসেছে, তাদের অনেককেই হয়তো (হয়তো কেন, অবশ্যই!) এই নৌকাতেই রাতের অন্ধকারে সরীসৃপের মতো লুকিয়ে পরাণ-মাঝির লগিতে জীবন-সমুদ্র পার হতে হয়েছে! পরাণ-মাঝিরা ভেবেছিল তারা তো নিম্নবর্ণের, তাদের এদিকে থাকতে অসুবিধা হবে না। পরাণ-মাঝিদের সে বিশ্বাসও স্থায়ী হতে দেওয়া হয় নি। যাই হোক, এইসব গভীর-গোপন ব‍্যথার কথায় আপনাদের আর ভারাক্রান্ত করবো না।

    যে কথা বলছিলাম, দামাদামি করে মাথাপিছু ১০০ টাকার বিনিময়ে ওপারে যাওয়া, আবার ফিরে আসা। পদ্মাতীরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে নজর পড়তেই দেখি আমাদের BSNLবাবাজি উঁকি দিচ্ছে। গেস্ট হাউসে যে নব-নির্মিত তিনতলায় ছিলাম সেখানে ওয়াইফাই এর কোন ব‍্যবস্থা ছিল না। আমদের সকল ভার যে গবেষক নিয়েছেন তিনি ওখানকার একটি ডেটা সহ সিম দিলেও কারোর সঙ্গে আরাম করে কথা বলা যাচ্ছিল না। এখানে এসে প্রাণ খুলে কাছের মানুষদের সঙ্গে একপ্রস্থ গল্প করে নিলাম। ওপারে চরে দাঁড়িয়ে আমাদের নদীচর-গবেষক অধ‍্যাপিকা গোপা সামন্তকে ফোন। ছেলে ভিডিও ফোনালাপ করে গোপা-মাসিকে সব দেখালো, শোনাল। তবে ভাববেন না আমরা কয়েক পা হেঁটে গেলেই ডোমকল, রাণীনগর বা জঙ্গিপুরে পৌঁছে যাবো! আমরা ত্রিধারার প্রথমটি পার হয়েছি। এরপর চর বরাবর তিন-চার কিলোমিটার হাঁটলে বাংলা দেশের কয়েকটি গ্রাম পাবেন। (এ যেন "যার একূল ওকূল দু'কূল গেল তার লাগি" নো ম‍্যানস লাণ্ডে কিছু করা!) তার পর দ্বিতীয় জলধারা, সেটা পেরিয়ে বৃহত্তম জল-স্রোত পেরুলেই ইণ্ডিয়া। শোনা গেল, এসব জলধারার নীচে দিয়ে সুড়ঙ্গ পথ ছিল এক সময়!

    এদিকে নদী-চরে নৌকা আটকে যাওয়ায় গোধূলি বিদায় নিতে শুরু করেছে, 'শিশিরের শব্দের মতো' অন্ধকার এগিয়ে আসছে। ওদিকে আগে থেকে দাওয়াত দিয়ে রাখা বকর সাহেব এপারে লালন মঞ্চে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। উদ্বিগ্ন-চিত্তে আমাদের গাইড শিক্ষক-গবেষক ভাইকে সমানে বকুনি দিয়ে চলছেন: "তুমি জানো না সন্ধ‍্যে হয়ে গেলে অন্ধকারে কখনও কখনও গোলাগুলি চলে সীমান্তে!"

    বকর সাহেবদের আতিথেয়তার কথায় আসার আগে আর দুটি কথা বলে নিই। আগেই বলেছি রাজশাহীকে অক্ষত রাখতে নদীর পাড়ে বাঁধ দিতে হয়। টি-বাঁধ, আই-বাঁধ -নদীবাঁধের এই ধরনের নামকরণ বেশ কৌতূহল-উদ্দীপক। আঁটসাঁটো করে ইট, বালি, সিমেন্টের তৈরি বাঁধের আকৃতি-অবয়ব অনুযায়ী এই নামকরণ। তবে এই পাড় যেমন ভাঙে, তেমনি গড়েও কখনও কখনও। গড়ে ওঠা পাড়কে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে মঞ্চ ও পার্ক বানানো হয়েছে। সদ‍্য অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যাপক তথা প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী কোন এক চরের বেড়ে উঠা ও তার ভবিষ্যত ব‍্যবহার বিষয়ে বেশ মজাদার অথচ সিরিয়াস একটি বয়ান দিলেন: "জানেন কি, এই চরটি গজিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তড়িঘড়ি এখানে একটি মঞ্চ তৈরি করে দিই, যাতে কেউ অন‍্যরকম কিছু কাঠামো কিছু বানিয়ে না ফেলতে পারে বা অন্য ভাবে ব‍্যবহার করতে না পারে!" ধর্মান্ধতার বাইরে গিয়ে সুস্থ-চেতনা তথা শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি কতটা টান থাকলে এটা সম্ভব! নদীবাঁধ তথা তীর কী সুন্দর ভাবে সাজানো তা মুখে বলার নয়। সকালে প্রাত:ভ্রমণ বা বৈকালিক খেলা-বিনোদনের জন্য আদর্শ স্থান এই তিন-চার কিলোমিটার পাড়।

    বিশ্ববিদ্যালয় কাম্পাসের কথা আগেই তুলেছি, তবুও আরো দুটি কথা না বললেই নয়। কম-বেশি গোটা কুড়ি বড় মাপের বিল্ডিং, তার বেশিরভাগটা অবশ্যই ক্লাস-ল‍্যাব‍রেটরি। তবে বিরাট বিরাট খেলার মাঠ, উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, শহীদ স্তম্ভ, মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রহশালা, তৎকালীন প্রোক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহার স্বতন্ত্র স্মারক, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণিকা--এ সবকিছু বাংলাদেশের ইতিহাসকে জাগ‍রুক রাখার প্রচেষ্টা। একে সাধুবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর সহ শহরের নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে। আমার কানে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শহীদ শামসুজ্জোহা স‍্যারের এই উচ্চারণ:
    ''আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয় সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।''

    বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালার ভিতরে ঢুকে কেমন যেন আর এক অব‍্যক্ত অনুভূতি! হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক‍্যাম্প চোখে দেখি নি, তবে শুনেছি বার্লিনে "হলোকাস্ট মিউজিয়াম"-এর কথা। বিবমিষা-উদ্রেককারী "অপমানিত মানবতা"-র এসব ছবি দেখতে দেখতে, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই মনে এল এখনকার একটি গান "দেশ তোমার বাপের নাকি..মনে রেখো, যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে দেশ পেয়েছি! .." (যদিও প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র, তথাপি) কথাটির অর্থ আক্ষরিকভাবে আমার সামনে এনে দিল দেওয়ালে টাঙানো দৃশ্যগুলি। মনে পড়ে গেল আমাদের রবি ঠাকুরের সেই 'পৃথিবী' কবিতার এই লাইনগুলো:
    "... তবু তোমার বক্ষের পাতাল থেকে আধপোষা নাগদানব/ক্ষণে ক্ষণে উঠছে ফণা তুলে,/তার তাড়নায় তোমার আপন জীবকে করছ আঘাত,/
    ছারখার করছ আপন সৃষ্টিকে..."

    আমার মনে হয় সব জাতিরই নিজস্ব সংস্কৃতি-ইতিহাসকে চেতনায় জাগরুক রাখা কর্তব্য, যদিও সংকীর্ণতা পরিত‍্যাজ‍্য। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে 'সিলেক্টিভ' ইতিহাসচর্চা, বা পুরনো ইতিহাসের অগৌরবকে টেনে এনে আজ ৫০০ বছর পরে তার প্রতিশোধ নেওয়া-র পরিকল্পনাও প্রগতিশীলতার প্রকরণ নয়। প‍্যাণ্ডোরার বাক্স খোলার চেষ্টা বা অনেকটা পোস্ট-ট্রুথের কায়দায় পুরা-কাহিনীকে ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা আমাদের পিছনের দিকেই টানবে, ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করবে না। হাঁ, বাংলাদেশেও বাহান্নোর আগের ইতিহাসের প্রতি অবহেলা আমাকেও পীড়িত করে। তবে রাজশাহীর বরেণ্দ্র মিউজিয়ামে পাল ও সেন যুগ সহ গৌড়ীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ আমাকে স্বস্তি দিয়েছে।

    প্রসঙ্গক্রমে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে দুটি কথা: এবার বাংলায় ছেলে-মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার হিড়িক পড়েছে। ভারতে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার র‍্যাট-রেসে ইংরেজিকে প্রথম ভাষা করে দ্বিতীয় ভাষা হিন্দিও নিচ্ছে অনেকে। এর ফল আমরা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছি: কোন গল্প কবিতা রবি-নজরুল পড়তে পারছে না। উচ্চারণ করতে পারলেও মানে বুঝতে পারছে না। এম-এ পাশ করে স্বাতীরা 'জ্ঞাতার্থে' মানে বুঝতে জন্মদাত্রীর খোঁজ করছে! আর ওপার বাংলায় বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনকে বিবর্ণ করছে আরবি-উর্দুর অনুপ্রবেশ। সঙ্গে যোগ হয়েছে কানাডা সহ বিদেশে পারি দেওয়ার বাসনায় আপনাদের ছেলেমেয়েরাও ইংরেজি মাধ্যমকে প্রেফার করছে। পৃথিবীর মধুরতম এই ভাষা কি শেষে অনাদরে..আর ভাবতে পারছি না!

    রা বি-তে ফিরে আসি। বিরাট সেন্ট্রাল লাইব্রেরি বিল্ডিং, তার সামনে পুস্তকের উল্লম্ব সারির আদলে তৈরি ভাস্কর্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। জানি না এটি ইউরোপের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে করা হয়েছে কিনা। এরূপ মনে হওয়ার একটি কারণ, বিশ্ববিদ‍্যালয়ে সবথেকে সুন্দর রাস্তাটি দুই পাশে ফ্রান্সের এক বিশেষ প্রজাতির দীর্ঘ-কাণ্ডের শিরিশ গাছের সারির উপস্থিতি। ইউরোসেন্ট্রিকতা মনে হতে পারে এটা শুনে যে এই রাস্তাটির নাম সত্যিসত্যিই 'প‍্যারিস রোড'! এই রোডের একদিকে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলরদের বাংলো। প্রাচীর ঘেরা বিশাল বিশাল আবাসন। কি নেই সেখানে! পুকুর, বাগান সব কিছু আছে। বিরাট গেস্ট হাউস, টিচার্স লাউঞ্জ-- হাঁ,অধ্যাপক- অধ্যাপিকাদের জন্য এত বড় ক্লাব ঘর, মিটিং রুম-- আমরা এখানে ভাবতেই পারি না। সব কিছু যেন রাজকীয় মেজাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! পরিবহন-ব‍্যবস্থাও রাজকীয় রাবিতে। দু'তলা বাস সহ টাটা ও অশোক লে ল‍্যাণ্ডের পঞ্চাশটার মতো বাস ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষা-কর্মী ও আধিকারিকদের সেবায় নিয়োজিত। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনায় সার্বিক বিচারে আমি রাজশাহীকেই প্রথমে রাখবো। এর মানে এই নয় যে জাহাঙ্গীরনগরের সাড়ে সাতশো একরের বিশালতা বা চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহত্ত্ব ও প্রাণচাঞ্চল্যকে আমি অস্বীকার করছি।

    এবারে আসি (ওপার)বাঙালির লেজেণ্ডারি হসপিট‍্যালিটির কথায়। গেস্ট হাউস জুবেরী হলের তিনতলায় ৩১৭ ও ৩১৮ নং রুমে থাকার ব‍্যবস্থা।বেশ ভালো, পর্যাপ্ত বলেই আমার মনে হয়েছে। তবে হঠাৎ জলের পাইপ ফেটে যাওয়ার জন্য শেষ দিনে একটু সমস্যা হয়েছিল। পিতাপূত্র দু'জনে এক বালতি করে জল তিন তলায় নিয়ে কার্যোদ্ধার হয়। স্টাফেদের মধ্যে কাউকে অনুরোধ করলেই জলের ব‍্যবস্থা করে দিতেন। কিন্তু স্বীয় আত্মবিশ্বাস ও আমার গ্রাম‍্য অতীত আমাকে মনে করিয়ে দিল, ছোটখাটো প্রতিকূলতায় ব‍্যর্থ হলে সারভাইভ‍্যাল স্কেলে তুমি তো পিছিয়ে পড়বে!

    গেস্ট হাউসে রান্নার সেরকম ব‍্যবস্থা এখন নেই বলে মনে হল। তবে আমার এখানকার সহকর্মী তথা সেই শিক্ষক-গবেষকের আন্তরিকতা ও তৎপরতায় তেমন কোনো অসুবিধা হয় নি। মৌখিক পরীক্ষার দিন বিভাগে সকলের লাঞ্চের ব‍্যবস্থা ছিল। ডাল-ভাতের সঙ্গে মাংস, পদ্মার ইলিশ সহ তিন ধরনের মাছ, সবজি, দই, মিস্টি এবং সবশেষে ফল! আমার মতো স্বল্পাহারী পেট-রোগা মানুষের পক্ষে এরকম ব‍্যবস্থা কিছুটা ভয়েরও: ''আর একটু নিন!"--বললেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। পরের দিন সকালে ওখানকার ঐতিহ্যবাহী ''সিলসিলা'' রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট। দুপুরে সেমিনারে ঘন্টা দেড়েক ফলিত দর্শনের এক দৃষ্টান্তস্থল নারীবাদের বিচার-বিমর্শ হলো। আলাপে আমি খুশি, যদিও আমার আরও গোটাদশেক স্লাইড বাকি ছিল আলোচনায় তুলতে। সকলেই মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। অবশ্য দায়বদ্ধ প্রগতিশীল দর্শনের এইসব কথা সাবেক শিক্ষকদের সকলের চেতনায় সমানভাবে প্রভাব ফেলতে পারে নি। তাঁরা পারিবারিক তথা সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কায় এবং প্রাইভেট ডোমেইনে মেয়েদের ক্রিয়াকর্মের সার্থক স্বীকৃতি বলতে কি বোঝায় বা তার জন‍্য যা কৃত‍্য তা করতে প্রস্তুত না থাকায় নারীর প্রকৃত সমতার দাবিকে নিছক বাইবেল-জাত ও বিদেশি মতাদর্শ বলে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। একটি গত মাসের একটি হিসাব আমার নজরে এসেছে যেখানে একটি সংস্থা দেশে দেশে অনুসন্ধান করে বলছেন, মেয়েরা জন্মদান ও তৎসংশ্লিষ্ট কাজ সহ গৃহস্থালির যে শ্রম দেন তার মূল্য মাস প্রতি ৪৫,০০০ টাকা। (আমার কাছে অবশ্য পরিষ্কার হয়নি এটি ভারতীয় মূদ্রায় হিসাব, না কি আন্তর্জাতিক গড়।) ফলে ফলিত দর্শনের "the point is to change it!" এই পার্ট-টি কতটা গুরুত্ব পেলো তা বোঝা গেল না। তবে নতুন জেনারেশন আমার আলাপ অনুধাবন করতে পেরেছে-এটাই আনন্দের।

    সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে সহকর্মীদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। বকর সাহেব লালন মঞ্চে এসে ভদ্রার মোড় থেকে তাঁর নূতন ফ্ল্যাট বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাই-টি বা সাপারও বলতে পারেন। বকর সাহেবের ফ্ল্যাট যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু। কমও নয়, বেশিও না। পুরো ফ্ল্যাটজুড়ে সমৃদ্ধ মুক্তচিন্তার বাঙালিয়ানা ছড়িয়ে রয়েছে স‍্যারের বাড়িতে। সেই হারমোনিয়াম, সেই গীতবিতান। নাটকের মানুষ বলে আরো নানা যন্ত্র যেন এক বিশেষ তালে ধরে রেখেছে বাড়িটিকে। একুশ মাসের নাতি থেকে শুরু করে বাড়ির সকলের মধ্যে রাবীন্দ্রিক ভাবন যেন ফুটে উঠছে। নাতির "আলো আমার আলোর" আধো আধো বোলে আমরাও তাল মেলালাম। দুই বাংলা, তিন প্রজন্ম এক হয়ে গেল রবির কিরণে। আমার পুত্র নীল, স‍্যারের মেয়ে শেখ সেমন্তী (যিনি একাধারে বেতার-শিল্পী, দেশাত্মবোধক ও প্রগতিশীল গান সহ রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ সাধিকা) পরপর রবীন্দ্র-গান শোনাল। আমারও মনে মনে মিলিয়ে নিলাম ছন্দ। সেদিনের বিকেলে এই এক ঘন্টার আলাপের স্মরণিকা বহুকাল আমাদের চেতনায় অম্লান থাকবে। নীলকণ্ঠ এই প্রজন্মের একজন হয়েও রবীন্দ্র-ভাবনায় অবগাহন, রবীন্দ্র-সংগীতের চর্চা স‍্যার সহ বাড়ির সকলকে মুগ্ধ করেছে। এই আলাপ যে ওনাদের ভালো লেগেছে তা পরেও ফোন করে জানিয়েছেন।

    ফেরার পথে আরিফুল ইসলাম সাহেবের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা: নাস্তা টাইপের একটু কিছু না খাইয়ে ছাড়তে চাইছিল না। কোন রকমে জাল কেটে বেরিয়ে আসা আর কি! এবারের জন‍্য এক কাপ রং চা। অবশ্য কথা দিতে হয়েছে, পরের বার এলে এই আরিফ-প্রাসাদেই উঠতে হবে! শহুরে কোলাহলের বাইরে প্রকৃতির কোলে তিনকাঠার উপর বাড়ি। তিনতলার সবটুকু নিয়ে সংসার যাত্রা। দুটি বড় অথচ পরিশীলিত বেডরুম। মধ‍্যিখানে ড্রয়িং তথা ডাইনিং। আর একটি রুমে বাবা-মা থাকতেন। দুঃখের কথা, অল্প দিনের ব‍্যবধানে দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন।

    মামুন-ভাই সদ‍্য ডবল-ইঞ্জিন হওয়ায় সহধর্মিণীর কাছে সিলেটে। দুঃখ প্রকাশ করেছে না থাকতে পারায়। একরাম ভাই সময় করে উঠতে পারে নি আমাদের বিশেষ আপ্পায়নে। তাই সেদিনের ডীন'স লাউঞ্জে লাঞ্চে সাথে থেকে কিছুটা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা! আক্তার স‍্যার, সন্ধ্যা ও শরমিন ম‍্যামসহ অন‍্যান‍্য স‍্যার-ম‍্যামরা আলাপ করেছেন। চা, টিফিন ও ফল খাইয়েছেন বিভাগের চেয়ারপার্সন নীলুফার ম‍্যাম। উনাদের সকলকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

    জাহিদুল ভাই, জাহাঙ্গীর সাহেব বাড়িতে নিতে পারেন নি বলে পরের দিন ব্রাঞ্চের (ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চের সমন্বিত রূপ) ব‍্যবস্থা 'অতিথি' রেস্টুরেন্ট- কাম-হোটেলে। ওখান থেকেই আমরা সেই গবেষকের ব‍্যবস্থা করা চতুর্চক্র-যানে ভারত ফিরবো। গাড়িতে ওঠার সময় জাহাঙ্গীর ভাই এখানকার বিখ্যাত পেয়ারা ও কলার ফলের ব‍্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে 'আলবিদা' জানালেন। আরিফুল ও জাহিদুল ভাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিতে বললাম। মনে হল, আত্মীয় হওয়ার জন্য রক্তের সম্পর্ক বা সম-ধর্মী বা সম-দেশী হওয়ার প্রয়োজন হয় না!

    অধ্যাপক বকর স‍্যারের কথা আর একটু বলেই কথা শেষ করবো। এই স‍্যারের সঙ্গে পরিচয় সেই ২০১৭ সাল থেকেই। মাঝে মধ্যেই ফোনে কথা হয়। সাম‍্যবাদী ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ অখণ্ড বঙ্গসংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক, যাঁর "হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল"। আবুল কালাম আজাদ সাতচল্লিশের ভারত ভাগের পরও মনে করতেন সংস্কৃতিগতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ আলাদা হতে পারে না। অনুরূপ যুক্তিতে যাঁরা অখণ্ড বাংলার ভাবনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন, বকর সাহেবরা তাঁদের শেষ প্রজন্ম। অন্তত দুই বাংলা ভূগোলে এক থাক--ভারতভাগের সময় এরকমই ভাবতেন, এখনো আফসোস করেন, দুই বাংলা এক থাকলে পৃথিবী একটা নতুন সমৃদ্ধ দেশ পেতো! এখন অবশ্য দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মিলনের বাস্তবতা নেই, দুই বাংলার ভূগোলে এক হওয়া এখন আর সম্ভব নয়। তবে দুই বাংলার সংস্কৃতিগত যোগাযোগের কথা নিরন্তর ভাবেন। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা পেরিয়ে এক সময় আরো অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন এনারা। সেসব হয় নি বলেই এনারা এমন কিছু বলেন, করেন যার মানে অন্যদের কাছে বোধগম‍্য হয় না। নিছক নিজের জন্যে বাঁচা, ভোগবাদী জীবন পছন্দ নয় বলেই আজও নাটকের মাধ্যমেও মানুষের চেতনার স্থবিরতায় ধাক্কা দিতে চান নাট‍্যবেত্তা মলয় ভৌমিকদের সঙ্গে থেকে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক তথা ধর্ম-ব‍্যবসায়ীদের হাতের পুতুল না হতে চাওয়ায় আজ মেনস্ট্রিম থেকে এঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। যাই হোক, বিদায় নিচ্ছি অধ্যাপক আবু বকর উদ্দেশে বাংলার অন্য ঘরানার সংগীতকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের লিরিকস এখানে উদ্ধৃত করে:

    "আমি বাংলায় গান গাই,আমি বাংলার গান গাই
    আমি আমার আমিকে চিরদিন-এই বাংলায় খুঁজে পাই
    আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাঁধি সুর
    আমি এই বাংলার মায়া ভরা পথে, হেঁটেছি এতটা দূর
    বাংলা আমার জীবনানন্দ, বাংলা প্রাণের সুখ
    আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ॥"

    আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলার কথা কই
    আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই
    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখেশুনে খেপে গিয়ে-করি বাংলায় চিৎকার
    বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক
    আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ॥

    আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি
    আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর-মানুষের কাছে আসি
    আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়
    মিশে তেরো নদী, সাত সাগরের জল গঙ্গায়-পদ্মায়
    বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক
    আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ॥"

    -- সন্তোষ কুমার পাল, বর্ধমান ০৪/০২/২০২৪
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুকুমার মুখোপাধ্যায়, বর্ধমান | 2401:4900:16c7:91f1:a406:1fb2:34ba:c47d | ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৪৮528249
  • খুব ভালো লাগলো, এত সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায় লিখেছেন তা ভাবাই যায় না। 
    অনেক অনেক অভিনন্দন। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন