এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গলসি গিন্নির ঘর 

    Aditi Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ নভেম্বর ২০২৩ | ৪৮০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • গলসি গিন্নিকে আমরা কেউই দেখিনি। মা বুঝি দেখেছিলো সেই ছোটবেলায়। কিন্তু তার ঘরটি আছে। রাড় দেশের শক্ত মাটি, সহজে টলেনা। সে ঘর একলা দাঁড়িয়ে আছে শ্রীক্ষেত্র-র উল্টো দিকে। শ্রীক্ষেত্র-র ফটক পেরিয়ে উঠান, উঠান পেরিয়ে খড়ের চাল, দুতলা কোঠা ঘর। এক তলায় গৌর নিতাই, ধূপ ধুনো, পুরোনো ফটো --- ছেলেপুলেদের, জোয়ান আর বয়স্ক পুরুষ মানুষদের। সদ্য বিয়ে করে আসা বা অকালে মরে যাওয়া সিঁদুর থাবড়ানো লক্ষ্মীমন্ত বৌও – দু এক খান। বাঁধানো পায়ের ছাপ কিছু বা। উপরে থাকার ঘর, খাট, বিছানা, তোরঙ্গ। উঠানের ডান দিকে তুলসী মঞ্চ আর নীলমাধবের মন্দিরটি। তুলসী মঞ্চ আর মন্দিরের মাঝের ছায়াতে একটি শীল পাটা। না, মশলা কেউ বাটে না। নতুন বৌরা এসে দাঁড়ায়, সে কত কত বছর ধরে, সেই শীলের উপর! শীলের বুকে তার ছাপ পড়েছে। উঠান ঘিরে এপাশ ওপাশ আরও বসত। পিছনে মাটির রান্নাশাল, তার পিছে পুকুর। বিভিন্ন তরফের হেঁসেল তিন চারখানা। আমিষ, নিরামিষ আছে, বৌ ঝি দের গালগল্প আর হাসি আছে, আছে একসাথে বসে চাট্টি মুড়ি খাওয়া। আছে গোয়াল গরু, পাড়াপড়শী, নাপিত নাপতেনি, বেস্পতিবার নখ কেটে আলতা পরতে পরতে এ পাড়া ও পাড়ার খবর জানা।

    পালপার্বন, হাসি কাঁদন, বাগাল-বাখান, কাঁথা-কাপড়, আদা-মৌরি, হিং-পাঁচফোড়ন নিয়ে জ্যান্ত কথামালা। সন্ধ্যা বেলা দাওয়ার লণ্ঠন, ভেসে আসা কথাবার্তা সাহস যোগায় দূর থেকে খেলা শেষে ফিরে আসা ছেলেপুলেদের। সরস্বতী পাটের পেছনের গলি এক ছুটে পেরিয়ে এসে খোলা চত্তরে পড়েও তো শান্তি নেই! শ্রীক্ষেত্রে ঢুকতে গেলেই আবার বাঁ দিকে যে গলসি গিন্নির খোড়ো ঘর, নিঝুম, নিথর! আঁধার দরজা জানলায় ক্যাঁচকঁচ!
    --- কে ছিলো মা গলসি গিন্নি?
    --- সে এক গিন্নি, গলসি গ্রামের মেয়ে, এখানের বৌ।
    --- তা তার শ্বশুরবাড়িটা তার নামেই হয়ে গেল? বাহ্!বাহ্!
    --- শ্বশুরবাড়ি তো নয় এটা।
    --- তাহলে?
    --- এখানে সে একাই থাকতো।
    --- কেন, বাকি লোক?
    --- তারা আসল বসত বাড়িতে। আসলে কোলের খুকী মরে যেতে তার মাথার ঠিক ছিলোনা তো, বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে চলে গিয়েছিল। তাই তাকে আর ঘরে তোলা হয়নি। আলাদা এই ঘর তার জন্যই তোলা।
    --- সে একলা থাকতো! কী করতো সারাদিন?
    --- পাড়ার মেয়েরা মাথার পড়ে যাওয়া চুল চিরুনি থেকে ছাড়িয়ে তাকে দিয়ে আসতো, সে তা দিয়ে চুল বাঁধার বিনুনি দড়ি তৈরি করতো।

    আর কি করতো কে জানে! হয়তো রান্না একটু খানি। সে কী রান্না করতো একলা একলা? করতো কি আদৌ উনুন টুনুন ধরিয়ে? কেমন করে সে খেত? রাতে সে ঘুমোতো? সে কি অন্যদের মত আলতা পরতো, সিঁদুর পরতো? কে এনে দিত? সে কী ভাবতো তখন? আচ্ছা, তাকে গিন্নিই বা বলা হতো কেন? সেতো তা ছিলো না? উত্তর আসে না। মা যেন হটাৎ ই বাসন কোসন, ঝাঁটা বালতি, বালিশ তোষকের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে চায়।

    তাই, তারপর আর কোনো গল্প নেই। সেই গিন্নি না হতে পারা গলসি গিন্নি নিজের সাথে, ঘরের দেওয়াল আর চালের সাথে, টিকটিকি, মাটি ফুঁড়ে ওঠা পিঁপড়ে আর ইঁদুরদের সাথে, মাঝে মধ্যে অতিথি বিছে আর সাপ টাপের সাথে কথা বলতে বলতে রেনু রেনু হয়ে কবেই বা মিশে গেল মাটির সাথে --- তার খবর কে রাখে! তারপর কবে যেন বাড়িটাই হয়ে গেল গলসি গিন্নি! ফাটা ফাটা মাটির এবড়ো খেবড়ো গা, সারা গায়ে মেশানো খলম কুচি --- মাটির বাড়ি র গা যাতে শক্ত হয়, বিবর্ণ খসখসে মাথার খোড়ো চাল, অন্ধকার চোখের দুটো জানলা নিয়ে ঠিক শ্রীক্ষেত্রের উল্টো দিকে সে দাঁড়িয়ে রইলো। গরমের খর রোদে জ্বলতে জ্বলতে, ভিজে বর্ষায় কাঁদতে কাঁদতে, শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে দেখতে লাগলো উল্টো দিকের বিয়ে- শাদী ছেলে পুলে, ভোজনা আইবুড়ো ভাত, চেনা মুখগুলি চারপাশে নিয়ে মরণ। আর উল্টোদিকের রাজপাট যেন তাকে কতকটা ভয় ই পেতে শুরু করলে। অমীমাংসিত প্রশ্নকে, কে না ভয় পায়? সংসারের ভোজসভায় বসে ক্ষুধার্ত বঞ্চিতর চোখ কোন মানুষই বা সহ্য করতে পারে? কবেকার মরে যাওয়া গলসি গিন্নির ঘর তাই ভয় দেখিয়ে চলে গাছকৌটো, বরণডালা, আল্পনা, লক্ষ্মী পাঁচালি, নীলমাধবের আরতি, সন্ধ্যের শাঁখ ----সব কিছুকে! যা চেনাজানা জীবন থেকে অন্যরকম, যা নিয়ে বড়রা অশান্তিতে, তাকে ছোটরাও কখন জানি ভয় পেতে শুরু করে, না বুঝেই! কিংবা তারাও হয়তো বা বুঝে যায় সবচেয়ে ‘কাছের ‘ও ‘নিরাপদ’ জায়গাতেই ঘাপটি মেরে থাকে আলোয় না নিয়ে আসতে পারা নিষ্ঠুরতাগুলো, কষ্টগুলো। তাই বুঝি তারা ‘ভুতুড়ে’ রূপ ধরে ঘোরা ফেরা করে জ্যান্তর আসে পাশে!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুশান্ত | 43.251.91.17 | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১২:২০525959
  • নাতিদীর্ঘ, স্বচ্ছন্দ ও ছুটির সকালে বেশ উপভোগ্য।
  • Kakali Bandyopadhyay | 223.223.150.86 | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৮525960
  • কষ্ট পেলাম ....এমন  আরো কত  গিন্নীরা ছিলেন / আছেন  কে জানে... 
  • Kakali sen | 2409:4088:9dc4:1497::83ca:310c | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:০০525962
  • ভালো লাগলো 
  • Debjani kar | 2409:40e0:48:de99:8000:: | ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩১525965
  • এই রকম কতো গিন্নী ই আছে আমাদের আশেপাশে প্রকাশ্যে -অপ্রকাশ্যে।
  • kk | 2607:fb90:ea0c:cd31:7a6a:9d53:7567:cde4 | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ০০:১৫525972
  • ভালো লাগলো লেখাটা। মাটির কাছাকাছি, মায়াময়, বিষন্ন।
  • যোষিতা | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:১১525974
  • মনখারাপ হয়ে যায় এমন গল্প পড়লে।
  • | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১১:২৩525985
  • এমন থেকেও নেই হয়ে যাওয়া গিন্নিরা মেয়েরা আমাদের আশেপাশেই থাকে। আমরা কখনো দেখি কখনো দেখি না। 
    চমৎকার লাগছে আপনার লেখাগুলো।
  • লুনা মিত্র | 2409:4060:2e1e:f1b8:3294:8b76:8988:15ba | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১১:২৩525986
  • কি অদ্ভুত বিষন্নতা মাখা মায়াময় কাব্যকথা! গ্রাম বাংলার পাঁচালী। স্বপ্নময় হয়ে ওঠে মন এই লেখা পড়ে। যেন গলসি গিন্নির কুঁড়ে ঘরের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। রাঢ় বাংলার ছবি আমার চোখে যে আঁকা আছে!
  • সুমিতা | 103.251.82.238 | ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ২২:১০526020
  • কেমন জানি এক মিশ্র অভিজ্ঞতা, এক তো গল্পের ছবির সাথে এক সন্ধ্যার খানিক দেখা ছবি মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, আর পড়তে পড়তে ফিরে যাওয়া সেই সময়ে যখন একদিকে চলছে এক সচল কাব্য রচনা আর অপরদিকে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গল্প যার অপলক দৃষ্টিতে বোধহয় আছে কাব্য অনুধাবনের চেষ্টা........
  • Sreemoyee chakraborty | 2402:3a80:1967:4eff:6480:f071:4740:f65c | ১৪ নভেম্বর ২০২৩ ০০:০৬526025
  • 'কাছের 'ও 'নিরাপদ ' ...
    এই  বাক্য টি  যে কী ম্যাডাম  তা বলে বোঝানো যাবে না।
    অনবদ্য ....
    প্রনাম জানবেন ম্যাডাম।
  • সুপর্ণা চক্রবর্তী | 2409:4060:20d:1e36:d80e:d87e:afed:e09c | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৪২527263
  • লেখাটি চমৎকার। আরও সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ার, অপেক্ষায় রইলাম। 
  • Sara Man | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:৩৭527272
  • বাঃ, খুব সুন্দর লাগলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন