এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  ইতিহাস

  • ভূস্বর্গ শাসিকা : কাশ্মীরের রানিদের সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান : শেষ পর্ব

    Suchetana Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | ইতিহাস | ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ৩৩৬ বার পঠিত
  • 1 | 2 | 3 | 4
    কোটা রানি 
    (১৩৩৮ -১৩৩৯ সাধারণ অব্দ)

    কাশ্মীরের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ শাসিকা কোটা রানি সম্পর্কে বিশদ তথ্য জানা যায়, কালপঞ্জীকার জোনরাজের দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থ থেকে। মহাশক্তিধর দিল্লি সুলতানির ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের মুখে ধ্বস্ত হতে থাকা রাজ্যের এক কঠিন সময়ে কোটা রানি কাশ্মীরের সিংহাসনে বসেছিলেন। তাঁর শাসনকাল (১৩৩৮-১৩৩৯ সাধারণ অব্দ) সংক্ষিপ্ত হলেও তাঁকে আধুনিক ইতিহাস মূলত মনে রেখেছে কাশ্মীরের শেষ হিন্দু শাসক হিসেবে।

    প্রথম লোহারা রাজবংশের শেষ রাজা হর্ষকে (১০৮৯ -১১০১ সাধারণ অব্দ) পরাজিত করে রাজা উচ্চল (১১০১ -১১১১ সাধারণ অব্দ) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দ্বিতীয় লোহারা রাজবংশ। লোহারা রাজারা তাঁদের সুদক্ষ প্রধানমন্ত্রী ও আমলাদের সহায়তায় কাশ্মীর উপত্যকা থেকে উত্তর আফগানিস্তান পর্যন্ত এক সুবিশাল অঞ্চলে দীর্ঘ দুই শতক জুড়ে রাজত্ব করে আসছিলেন। লোহারা রাজা সুহদেবের ( ১৩০০ - ১৩১৯/২০ সাধারণ অব্দ) এমনই এক প্রাজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্রের কন্যা ছিলেন কোটা। কৈশোর থেকেই রাজনীতি ও প্রশাসনের কাজে আগ্রহী কোটা রামচন্দ্রকে নানাভাবে সাহায্য করতেন। রাজা সুহদেবের আমলে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা কাশ্মীর আক্রমণ করেছিল। মধ্য এশিয়ার ত্রাস তাতার নেতা দুলচার আক্রমণও ঘটেছিল তাঁর সময়কালেই। কথিত আছে, এই দুঃসময়ে রাজা সুহদেব কিস্তওয়ারে আত্মগোপন করলে কন্যা কোটার কূটনৈতিক বুদ্ধির বলে বিদেশি আক্রমণ রুখে কাশ্মীরকে রক্ষা করেছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী রামচন্দ্র। কাশ্মীর রক্ষার কাজে এসময় কোটা ছাড়াও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কাশ্মীরে আশ্রিত পশ্চিম তিব্বতের (মতান্তরে লাদাখের) পলাতক রাজপুত্র রিঞ্চেন এবং লোহারা প্রশাসনের উচ্চপদে কর্মরত শাহ মীর নামক এক ভাগ্যান্বেষী পর্যটক। রিঞ্চেন এবং শাহ মীরের সহায়তায় এরপর রাজা সুহদেবকে হত্যা করে রামচন্দ্র কাশ্মীরের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই রামচন্দ্রকে হত্যা করে এবং  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সুলতান সদর-উদ-দিন নামে কাশ্মীরের রাজসিংহাসনে বসেন রিঞ্চেন। রামচন্দ্রের কন্যা কোটাকে তিনি বিবাহও করেন। নতুন রাজার সঙ্গে বিবাহের সূত্রে মন্ত্রী কন্যা কোটা হয়ে ওঠেন কাশ্মীরের রানি। তবে মাত্র তিন বছরের মধ্যে খুন হয়ে যান দক্ষ শাসক রিঞ্চেনও। এরপর থেকেই কাশ্মীরের প্রধান শাসিকা হিসেবে রানি কোটার মূল উত্থান শুরু হয়েছিল। 

    রিঞ্চেন ও তাঁর শিশু সন্তান হায়দারের অভিভাবিকা হিসেবে তিনি দক্ষতার সঙ্গে সুবৃহৎ কাশ্মীর রাজ্যের প্রশাসন পরিচালনা করতে শুরু করলেও শান্তি স্থায়ী হয়নি বেশিদিন। পুরোনো রাজা সুহদেবের ভাই উদয়নদেব কাশ্মীর আক্রমণ করলেন। যুগপৎ রাজ্যের নিরাপত্তা এবং নিজের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য শাহ মীরের পরামর্শে তিনি উদয়নদেবকে বিবাহ করেন। তবে উদয়নদেবের রাজত্বকালের ( ১৩২৩ - ১৩৩৮ সাধারণ অব্দ) আগাগোড়া রাজ্যের প্রধান প্রশাসিকার দায়িত্বভার সামলেছিলেন কোটাই, কারণ উদয়নদেবও তাঁর বড়ো ভাইয়ের মতো অযোগ্য ছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহ থেকে জাত কোটার দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল জাটলা (মতান্তরে বোলারতন)। এসময় অচল নামে এক দুর্ধর্ষ তুর্ক-মোঙ্গল নেতা কাশ্মীর আক্রমণ করে। প্রত্যাশিতভাবেই উদয়নদেব প্রাণভয়ে পালিয়ে যান দুর্গম তিব্বতে। জোনরাজ লিখেছেন, রাজ্যের এই দুঃসময়ে কোটা রানি কাশ্মীরের জনগণ তথা প্রতিবেশী রাজ্যগুলির রাজাদেরকে কয়েকবছর আগেকার মোঙ্গল আক্রমনের ভয়াবহতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ও সর্বশক্তি দিয়ে মোঙ্গল বিরোধী সম্মিলিত সংগ্রামে এগিয়ে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। রানির নেতৃত্বে কাশ্মীরি জনতার জীবনপণ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পরাজিত হয়েছিল অচল। কোটা রানি পরাজিত অচলকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। এদিকে ১৩৩৮ এ মারা গেলেন উদয়নদেবও। এবার আর বড়ো ছেলে অনভিজ্ঞ হায়দারকে সিংহাসনে বসার সুযোগ না দিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য কাশ্মীরের একচ্ছত্র কর্ত্রী হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করলেন কোটা স্বয়ং। তবে তাঁর দ্বিতীয় পর্বের রাজত্বকালটি একেবারেই নির্বিঘ্ন হয়নি। একদিকে তিনি কাশ্মীরি জনতার সমর্থন যেমন হারাচ্ছিলেন, পাশাপাশি তেমনই ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠছিলেন নিজের দীর্ঘদিনের পরামর্শদাতা তথা হায়দারের অভিভাবক শাহ মীরের জনপ্রিয়তাতেও। সমকালীন কাশ্মীরি রাজনীতিতে তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শাহ মীরের মর্যাদাকে খাটো করার উদ্দেশ্যে এবার রানি তিনটি পদক্ষেপ নিলেন। প্রথমত, ভট্ট ভীক্ষণ নামক এক ব্যক্তিকে তাঁর যুগপৎ তাঁর প্রধানমন্ত্রী আর দ্বিতীয় পুত্র জাটলার অভিভাবক রূপে নিযুক্ত করলেন। দ্বিতীয়ত, শাহ মীরের অভিভাবকত্বে বড়ো হয়ে ওঠা হায়দারকে সকল উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার কথা জনসমক্ষে ঘোষণা করলেন। তৃতীয়ত, প্রশাসনের অন্যান্য মন্ত্রীদের উৎকোচ দিয়ে তো বটেই, জনতার মধ্যেও বিপুল অর্থ ছড়িয়ে নিজের হারানো প্রতিপত্তি ফেরত পেতে চেয়েছিলেন কোটা। কিন্তু শাহ মীর অচিরেই তাঁর অপমানের বদলা নিলেন। কৌশলে ভট্ট ভীক্ষণকে হত্যা করার পর তিনি কোটাকেও বলপূর্বক ক্ষমতা চ্যুত করলেন এবং ১৩৩৯ সাধারণ অব্দে সুলতান শামস-উদ-দিন উপাধি গ্রহণ করে কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক হিসেবে সিংহাসনে বসলেন শাহ মীর (১৩৩৯ - ১৩৪২ সাধারণ অব্দ)। কোটা রানির শেষ পরিণতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও নানা মত প্ৰচলিত রয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃত সমসাময়িক দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিনীতে জোনরাজ লিখেছেন, রানি তাঁর হৃত ক্ষমতা ফেরত পাওয়া তথা নিজের দুই সন্তানকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টায় শাহ মীরকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরের সকালেই তাঁকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করা হয়েছিল। কারাগারে তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন এবং নিজের ক্ষতবিক্ষত অন্ত্র শাহ মীরকে তাঁদের বিবাহের উপহার হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। রানির মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্রকেও শাহ মীর দ্রুত হত্যা করেন। 

    জোনরাজ থেকে শুরু করে পি.এন.কে বামজাই পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ধ্রুপদী কাশ্মীরি ঐতিহাসিক যশোমতী, সুগন্ধা, দিদ্দার মতো রানি কোটাকেও  নিষ্ঠুর, ক্ষমতালোভী, নীতিহীন এক নারী হিসেবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। মুসলমান 
    রিঞ্চেন এবং শাহ মীরকে বিবাহ করে কাশ্মীরে হিন্দু রাজশাহির বিলোপ ঘটানোর জন্যও কিছু ঐতিহাসিক কোটাকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু এই ধারাবাহিক নেতিবাচক পরিচায়নগুলির বাইরে অস্পষ্ট হয়ে থেকে যায়, কাশ্মীরি রাজনীতির এক উত্তাল সময়ে রাজ্যের হাল ধরে থাকা এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিচক্ষণতার বাকি সকল উজ্জ্বল দিকগুলি। পর পর দুবার কোটা রানির কূটনীতিতেই কাশ্মীর মোঙ্গল আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল। রাজধানী শ্রীনগরকে ঝিলাম নদীর বিধ্বংসী বন্যা থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি একটি সুবিশাল।খাল খনন করিয়েছিলেন, যেটি আজও 'কুটে কোল' নামে পরিচিত। ক্ষমতাবৃত্তে থাকার জন্য তিনি নির্দ্বিধায় তিনবার প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। স্পষ্টতই, কোটা  ছিলেন আদ্যোপান্ত এমন এক ব্যতিক্রমী রাজনীতিক নারী, যাঁর কাছে প্রতিপক্ষের ধর্মীয় পরিচয় বা মাতৃত্বের আবেগে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপেক্ষা জটিল রাজনীতির ময়দানে নিজ সর্বময় প্রভাব অক্ষুন্ন রেখে নিজ রাজ্যের মর্যাদা বৃদ্ধির মূল লক্ষ্যটি ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

    কেবল উপরোক্ত চার অবিস্মরণীয় মহারাজ্ঞীই নন, বিতস্তার পাড়ের রাজনীতিতে পুরাণের সময়কাল থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত বারবার আপন কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে গেছেন আরও কত তেজস্বিনী প্রশাসিকা! রানি সুগন্ধা, দিদ্দা বা কোটার প্রশ্নাতীত ঔজ্জ্বল্যের সামনে কিছুটা আবছা হয়ে থাকা সেই সকল সফল নারীদের কাহিনীও সংক্ষেপে ধরা রইল এই লেখাটির মধ্যে….।

    নীলমতপুরাণে পাওয়া যায় রাজা জলৌকর রানি ঈশানদেবী এবং রাজা তুঞ্জিনের রানি বাকপুষ্ট'র উল্লেখ। রাজ প্রশাসনে সহায়তা করার পাশাপাশি কাশ্মীরের বন্যা ও খরা নিয়ন্ত্রণে এবং জনকল্যাণে এঁরা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। 

    অনঙ্গলেখা : কারকোটা রাজবংশের(৬২৫ - ৮৫৫ সাধারণ অব্দ) প্রতিষ্ঠাতা দুর্লভক প্রতাপাদিত্যের'র মা অনঙ্গলেখা প্রশাসন ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালিনী ছিলেন। 

    শ্রীলেখা : লোহারা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সংগ্রামরাজের (১০০৩ - ১০২৮ সাধারণ অব্দ) মৃত্যুর পর তাঁর নাবালক পুত্র হরিরাজ মাত্র ২২দিনের জন্য সিংহাসনে বসেন। কিন্তু সংগ্রামরাজের রানি ও হরিরাজের মা শ্রীলেখা নিজেই ছেলেকে সরিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু একনাগ নামক রাজকীয় দেহরক্ষী একনাগ গোষ্ঠী এবং সেনার অসহযোগিতার কারনে তাঁকে রাজপদ দিয়ে দিতে হয় তাঁর নাবালক পুত্র অনন্তকে। পরবর্তীকালে তিনি অনন্ত'র সাবালকত্ব পর্যন্ত তাঁর অভিভাবিকা হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেছিলেন।

    সূর্যমতী : সূর্যমতী ছিলেন রাজা অনন্তদেবের (১০২৮ - ১০৬৮ সাধারণ অব্দ) প্রধানা মহিষী। সূর্যমতীর পরামর্শে রাজা অনন্তদেব কাশ্মীরের প্রথম বেতনভোগী স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের নেশা এবং ভোগ বিলাসের খরচ মেটানোর জন্য কাশ্মীরি প্রজাদের ওপর বিপুল হারে কর বসিয়েছিলেন। রানি সূর্যমতী তাঁর প্রখর বুদ্ধিবলে তাঁর রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি  করে তোলেন এবং প্রজাদের অভাব অভিযোগ দূর করে রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। শিবের উপাসিকা রানী সূর্যমতীর পৃষ্ঠপোষকতায় কাশ্মীরে বহু মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু স্বামী অনন্তদেব ও অযোগ্য পুত্র কলশ'র মধ্যে নিয়ত দ্বন্দ্বের কারনে রানীর ব্যক্তিগত জীবন ছিল চরম অশান্তিময়। ১০৬৮-তে রাজা অনন্তদেব আত্মহত্যা করলে রানি সূর্যমতী সহমরণে গমন করেন।

    জয়মতী : কাশ্মীরের মহারানির পদে এক অনাম্নী নর্তকীর কন্যা জয়মতীর উত্থান ছিল সত্যি অর্থেই গল্পের মতো। নৃত্য ও সংগীতে পারঙ্গমা জয়মতী প্রথম জীবনে ছিলেন কাশ্মীরের চরম অত্যাচারী শাসক হর্ষের সভাসদ মন্ডলেশ নামক এক মন্ত্রীর রক্ষিতা। ১১০১ সাধারণ অব্দে রাজা হর্ষকে বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে উৎখাত করেন অতীতের উৎপল রাজবংশের প্রতিনিধি তথা দ্বিতীয় লোহারা রাজবংশের স্থপতি বচ্ছল(১১০১ - ১১১১ সাধারণ অব্দ)। এরপর জয়মতী বচ্ছলকে বিবাহ করেন এবং রাজা বচ্ছলের এক দশকব্যাপী সুশাসনের প্রধান সহায়িকা হয়ে ওঠেন। হর্ষের নিপীড়নে বিধ্বস্ত কাশ্মীরে শান্তি ফিরে এসেছিল জয়মতীর দিশানির্দেশে। তাঁর পরামর্শেই বচ্ছল প্রজাদের ওপর থেকে হর্ষের আমলের অতিরিক্ত করের বোঝা সরিয়ে নেওয়া, দরিদ্র জনতার জন্য হাসপাতাল স্থাপন, দুর্নীতি দূর করে প্রশাসনকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করে তোলা তথা রাজ্যব্যাপী সুদক্ষ শাসন ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করার মতো মানবিক পদক্ষেপগুলি নিয়েছিলেন। দিদ্দার সমালোচনায় নির্মম হলেও জয়মতী একক যোগ্যতায় যেভাবে এক অন্ধকার জীবন থেকে বেরিয়ে এসে কাশ্মীরের জনকল্যাণকামী মহারানির সর্বোচ্চ পদে আরোহণ করেছিলেন, সেই কৃতিত্বের প্রশংসা করেছেন কল্হণ স্বয়ং।

    রাদ্দাদেবী : দ্বিতীয় লোহারা বংশের রাজা জয়সিংহের (১১২৭ - ১১৫৪ সাধারণ অব্দ) প্রধানা মহিষী রাদ্দাদেবী ছিলেন এক আদ্যন্ত ধর্মপ্রাণ চরিত্র। জয়সিংহ তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর শিশুপুত্র গুলহনের রাজ্যাভিষেক সম্পন্ন করেছিলেন। শ্রীনগরে রাদ্দাদেবীর একক অভিভাবকত্বে এই অভিষেক নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছিল। রানির নিখুঁত কূটনীতি এবং রাজকীয় ব্যক্তিত্বের কাছে সমস্ত বিরোধী জোট নতি শিকার করতে বাধ্য হয়েছিল। রানি রাদ্দা তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীর কারনে রাজতরঙ্গিনীতে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। 

    কলহনিকা : কলহনিকা জয়সিংহের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রানি হলেও সমকালীন কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যাগুলি সমাধানের ক্ষেত্রে রাজার প্রধানতম সহযোগী হয়ে উঠেছিলেন। সুভাষিনী ও সুরুচিসম্পন্না এই নারী ছিলেন যেমন তুখড় কূটনীতিক, তেমনই ছিলেন কুশল যোদ্ধাও। ধর্ম ও আর্থসামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সকল প্রজাকে কঠোর ন্যায়বিচার দানের জন্য কলহনিকা তাঁর সমকালে অত্যন্ত সম্মানিতা ছিলেন। 

    বিবি হাউরা : কোটা রানির মৃত্যুর পর কাশ্মীরে শাহ মীরের অধীনে ইসলামী শাসন শুরু হয়েছিল। এই সময়কালে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সুলতানী পরিবারের নারীদের স্বাধীনতা বহুলাংশে ক্ষুন্ন হলেও সুলতান কুতুব-উদ-দিনের (১৩৭৩ -১৩৭৯ সাধারণ অব্দ) স্ত্রী বিবি হাউরা ছিলেন সর্বতোভাবে এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। পুত্র সিকন্দরের মাত্র আট বছর বয়সে বিধবা হওয়ার পর তিনি বালক সুলতান সিকন্দরের অভিভাবিকা হিসেবে দীর্ঘ এক দশক(১৩৭৯ - ১৩৮৯ সাধারণ অব্দ) কাশ্মীরের শান্তি শৃঙ্খলা ও সুশাসন বজায় রেখেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, ন্যায়বোধসম্পন্ন এবং দানশীল ব্যক্তিত্ব হলেও পুত্র সিকন্দরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনি দুই প্রভাবশালী অভিজাত, এমনকি নিজের কন্যা ও জামাতাকেও মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন এবং বাকি সকল প্রতিদ্বন্দ্বীর আঘাত থেকে পুত্রকে রক্ষা করেছিলেন। পরে যদিও বিবি হাউরা তাঁর অত্যাচারী পুত্র সিকন্দরের দ্বারাই নির্মমভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন।

    গুল খাতুন : কাশ্মীরের শ্রেষ্ঠ সুলতান জয়নুল আবেদিনের পুত্র সুলতান হায়দার শাহ (১৪৭০ - ১৪৭২ সাধারণ অব্দ) চরম দুশ্চরিত্র ও অযোগ্য শাসক ছিলেন। ফলে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কাশ্মীরে শাহ মীর বংশের নিশান রক্ষা করতে হয়েছিল তাঁর স্ত্রী তথা সুদক্ষ প্রশাসিকা গুল খাতুনকেই। রাজ্য শাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি গুল কাশ্মীরময় বহু মসজিদ ও মাদ্রাসা,খানকা ইত্যাদির স্থাপনা সহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়ত নিয়োজিত থাকতেন। গুল খাতুনকে এই কারণে ঐতিহাসিক শ্রীবর হিন্দু রানি দিদ্দার মুসলিম সমকক্ষ বলে অভিহিত করেছিলেন। কাশ্মীরের নিজস্ব সংস্কৃতির এক উৎসাহী সমর্থক গুল খাতুন সমন্বয়বাদী সুফি এবং ভক্তি আন্দোলননের প্রতিও গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা কালীন গুল খাতুনের অকালমৃত্যু কাশ্মীরি শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ছিল এক অপূরণীয় ক্ষতি। 
    ………
    সেই কোন মহাকাব্যিক কল্পকথার যুগে কৃষ্ণের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল কাশ্মীরের রাজপদে নারীর ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নাতীত সমর্থন। তবে কৃষ্ণের বকলমে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুমোদনের শক্তিতে কেবল নয়, আদতে কাশ্মীরের একান্ত নিজস্ব দর্শন ও সংস্কৃতির মুক্তধারায় পুষ্ট হয়ে উঠেছিল কাশ্মীরি নারীর সামাজিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক সমানাধিকার লাভের বিষয় দুটি। কিন্তু চিরকাল কাশ্মীরে নারী প্ৰশাসকদের নেতৃত্বদানের পরাক্রমী ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তাঁদের দৃপ্ত ব্যক্তিত্বকে রাজনীতির তথাকথিত পুরুষালি আঙিনায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেওয়া পুরুষতন্ত্রের পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। তাই তো প্রায় সমকালীন কল্হণ বা জোনরাজ হোন বা একালের অরেলস্টাইন থেকে পৃথ্বীনাথ বামজাই; অধিকাংশ পুরুষ ইতিহাসবেত্তার কলমে কুৎসিতভাবে নিন্দিত কিংবা অন্যায়ভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন
    মহাকাব্যিক যশোবতী থেকে আদিমধ্য যুগের তিন অসামান্যা রাজ্ঞী সুগন্ধা, দিদ্দা বা কোটারানী হয়ে কয়েক শতক পরের গুল খাতুন কিংবা বিবি হাউরা পর্যন্ত এই লেখায় উল্লিখিত রানীদের প্রায় প্রত্যেকেই। তবুও আপন যোগ্যতায় এঁরা ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন, জয় করেছেন তাঁদের সমকালকে আর অনপনেয় হয়ে রয়ে গেছেন পুণ্যবারি বিতস্তার, সুরম্য হ্রদসমূহের, তুষারশুভ্র হিমাদ্রির, দীর্ঘদেহী বৃক্ষরাজির, অনিবার উপত্যকার, উর্বর কৃষিক্ষেত্রের, অপরূপ পুষ্পপত্রের ভূস্বর্গ কাশ্মীরের বহুবর্ণময় কালপ্রবাহের প্রায় সবখানে।

    চিত্রঋণ : 
    প্রথম চিত্রটির শিল্পী : Sumairha Mumtaz
    চিত্র সূত্র : Scroll. in
    রানী সুগন্ধা এবং রানী দিদ্দার নামাঙ্কিত মুদ্রাগুলির ছবি ইন্টারনেটে সহজলভ্য

    অন্যতম তথ্যসূত্র : 
    ১) নীলমতপুরাণম্ : ডঃ বেদ কুমারী অনূদিত
    ২) রাজতরঙ্গিনী : কহ্লণ
    ৩) দ্বিতীয় রাজতরঙ্গিনী : জোনরাজ 
    ৪) Yoshovati : The Neglected Queen : Asif Raina, 2020 https://www.researchgate.net/publication/339295642_Yasovati_the_neglected_queen
    ৫) Queen Didda : Between Facts And Fantasy : Khawar Khan Azkhwai,
    https://freepresskashmir.news/2021/01/18/queen-didda-between-facts-and-fantasy/
    ৬) Queens Of Kashmir, A Glimpse Of Kashmir's Women Rulers : Ajay Vaid and Samta Sharma
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    1 | 2 | 3 | 4
  • আলোচনা | ১২ অক্টোবর ২০২৩ | ৩৩৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রশ্ন  | 165.225.8.74 | ১২ অক্টোবর ২০২৩ ২১:৩৫524501
  • ঐতিহাসিকভাব কাশ্মীরে কি উপমহাদেশের অন্যত্রর তুলনায় নারী প্রশাসক বেশি দেখা গেছে?
  • Suchetana Mukhopadhyay | ১৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:১৬524515
  • পড়াশুনো যেটুকু করেছি, তাতে সেটাই মনে হয়েছে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন