এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাংলা ভাষার অভিধান এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৭-১৯৫৭) 

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ৬১২ বার পঠিত
  • অভিধানের আক্ষরিক অর্থ শব্দকোষ, যে বইতে ভাষার বিভিন্ন শব্দের উৎপত্তি, বিবর্তন, সঠিক উচ্চারণ, অর্থ, প্রয়োগ, গুরুত্ব ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করা থাকে তাকেই অভিধান বা শব্দকোষ বলা হয়। সেই ভাষার ব্যবহারকারীদের লিখতে, পড়তে বা বলতে শেখার কাজকে শাসন করে সেই ভাষার অভিধান। আমরা অবশ্য অভিধান বলতে সাধারণত বুঝি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরের কথা। ব্যবহারিক জীবনে আমাদের সেই অভিধানগুলোই বহুল পরিমাণে প্রয়োজন হয়। এই অভিধানগুলোকে বলে দ্বি-ভাষিক অভিধান, কোনোভাবেই শব্দকোষ নয়। যে কোনো ভাষাই তার উৎপত্তি, বিবর্তন, অতীত না জানলে, সংগঠিত না হলে, বাঁধন না থাকলে ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারেনা। পৃথিবীতে অনেক ভাষাই ছিল যেগুলো বর্তমানে লুপ্ত হয়ে গেছে এবং তার প্রধান কারণ হলো, অসংগঠিত ছিল সেইসব ভাষা।

    ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা বংশের একটি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা হলো বাংলা। আনুমানিক নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে (৯০০ খ্রিস্টাব্দ - ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে)  বাংলা ভাষার জন্ম হয়, (অন্য মতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে)। একটা সময় ছিল যখন বঙ্গদেশে শুধুমাত্র প্রাচীন অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস ছিল। আর্য জাতির মানুষ পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। বঙ্গদেশে আসার সময় আর্যরা কথা বলত প্রাকৃত ভাষায়। প্রাকৃত ভাষা প্রাচীন আর্য ভাষারই (অর্থাৎ সংস্কৃত ভাষা) একটি রূপান্তরিত চেহারা। এই প্রাকৃত ভাষা বিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় অপভ্রংশ ভাষায়। বঙ্গদেশে প্রচলিত অপভ্রংশ ভাষার নাম ছিল পূর্ব বা পূর্বী মাগধী অপভ্রংশ। এই পুর্বী মাগধী অপভ্রংশ আর বঙ্গদেশে আগে থেকে বসবাসকারী অনার্যদের ভাষার সংমিশ্রণে তৈরী হয় শুদ্ধ বাংলা ভাষা।

    প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা (সংস্কৃত) - মাগধী প্রাকৃত - মাগধী অপভ্রংশ। মাগধী অপভ্রংশ + বঙ্গদেশে প্রচলিত অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা = বাংলা ভাষা (শুদ্ধ)।

    এই শুদ্ধ বাংলা ভাষার পুনরায় বিবর্তন হয়ে তৈরী হয়েছে আধুনিক বা চলিত বাংলা ভাষা। এই বিবর্তনের তিনটি স্তর পাওয়া যায়।

    ১. প্রাচীন বাংলা ভাষা - এর একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। প্রাচীন বাংলা ভাষার সময়কাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী।
    ২. মধ্য বাংলা ভাষা - এর নিদর্শন মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্য যেমন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরাম দাসের মহাভারত, মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদি। মধ্য বাংলাকে দুটি উপস্তরে ভাগ করা হয়, আদি মধ্য ও অন্ত্য মধ্য। মধ্য বাংলা ভাষার সময়কাল ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অব্দি।
    ৩. আধুনিক বাংলা ভাষা - আধুনিক বাংলা ভাষার জন্ম অষ্টাদশ - ঊনবিংশ শতাব্দীতে। এই সময়কালে অজস্র উন্নতমানের সাহিত্য যথা, কাব্য, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ রচিত হয়েছে।

    জন্মবৃত্তান্ত থেকেই স্পষ্ট যে বাংলা ভাষা একটি মিশ্রিত ভাষা। বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে, ১. প্রাকৃত ও অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত সংস্কৃত শব্দ (তদ্ভব) ২. অপরিবর্তিত সংস্কৃত শব্দ বা তৎসম শব্দ ৩. কিছু বিকৃত সংস্কৃত শব্দ বা অর্ধতৎসম শব্দ ৪. অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষার শব্দ বা দেশী শব্দ। এই চার প্রকারের শব্দই বাংলা শব্দভান্ডারের আদি সম্পদ। এরপরে ঔপনিবেশিকতা, বিদেশি জাতির শাসন ইত্যাদির কারণে আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, পর্তুগিজ, উর্দু ইত্যাদি শব্দেরও মিশ্রণ ঘটেছে বাংলা ভাষার সাথে।

    ভাষার একটি সহজাত গুণ হল প্রবহমানতা। প্রবহমান ভাষার তাই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কালের প্রবহমান ধারায় এক ভাষা থেকে জন্ম হয়েছে অন্য ভাষার। এই পরিবর্তনের রূপরেখা নির্মাণের ও সংস্কার সাধনের প্রয়োজনে রূপায়িত হয় ব্যাকরণ এবং অভিধান গ্রন্থমালা। পরিবর্তনশীল বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সময়ে যেভাবে শব্দ সম্ভার বেড়েছে তা ধরা রয়েছে নির্মিত অভিধান গ্রন্থসমূহে।
    অভিধানের কাজ নানাবিধ। ভাষা ক্রমাগত বদলে চলেছে তার রূপ। ভাষার এই বিবর্তন দু-পাঁচ বছরে ধরা না গেলেও দু-পাঁচ দশকে বেশ ভালভাবেই বোঝা যায়। ভাষার এই বিবর্তনের ছবিটা ধরা থাকে অভিধানে। তাই কেউ কেউ অভিধানকে বলেন ভাষার দর্পণ। এই অভিধানই আবার হয়ে ওঠে ভাষার নিয়ন্তা, তার নির্দেশক। অভিধানহীন কোনো আধুনিক উন্নত ভাষা কল্পনাই করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পসল্প’-এর ‘অদ্ভুত-রত্নাকর’ সভার প্রধান পণ্ডিত বাচস্পতি মশাই বোধহয় তাই বলেছিলেন : “ভাষার শব্দগুলো চলে অভিধানের আঁচল ধরে। এই গোলামি ঘটেছে ভাষার কলিযুগে। সত্যযুগে শব্দগুলো আপনি উঠে পড়ত মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই মানে আনত টেনে”। ১. রবীন্দ্রনাথ নিজে যে এই অভিধানের গোলামির প্রয়োজনীয়তা বুঝতেন, তার প্রমাণ রয়েছে ৩০ মার্চ ১৯০৫-এ ক্লাসিক থিয়েটারে আয়োজিত বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে। ২. সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে সেই সভায় ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণে রবীন্দ্রনাথ তাদের ‘দেশি ভাষার ব্যাকরণ চর্চা’ ও ‘অভিধান সংকলন’ করতে আহ্বান জানান।
     
    প্রথম বাংলা ভাষার অভিধান লেখার চেষ্টা করেন পর্তুগিজ খ্রিস্টান পাদ্রী ফাদার মনোয়েল দ্য আসসুম্পসাঁউ। তাঁর রচিত বাংলা পর্তুগিজ ভাষার শব্দকোষ ১৭৪৩ সালে লিসবন থেকে প্রকাশিত হয়।

    সবচেয়ে পুরাতন অভিধান পাওয়া গেছে আকাডিয়ান সাম্রাজ্যের সময়কার দ্বিভাষিক সুমেরীয়-আকাডিয়ান শব্দমালার ওপর। আনুমানিক ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত এই অভিধান এবলা (বর্তমান সিরিয়া) এলাকাতে সন্ধান পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে জানা মতে, বিশ্বে প্রথম অভিধান লেখা হয় লাতিন ভাষায় ১২২৫ সালে, যার সংকলক ছিলেন জন গারল্যান্ড। তবে ইংরেজি ভাষায় প্রথম ইংরেজি অভিধান সংকলন করেন রিচার্ড হুলোয়েট, ১৫৫২ সালে। এর শব্দ সংখ্যা ছিল প্রায় ২৬,০০০ এবং এতে প্রথম ইংরেজি শব্দের ইংরেজি অর্থ, পরে তার লাতিন প্রতিশব্দ ছিল। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো অভিধান The Oxford English Dictionary যেটা ২০ খণ্ডে প্রকাশিত। বাংলা ভাষায় (বাংলা থেকে বাংলা) প্রথম অভিধান সংকলন করেন রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ; ১৮১৭ সালে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের সময়ে ব্যবলীয়ন অভিধান উর্রা=হুবুল্লু সুমেরীয় ভাষার আরেকটি পুরাতন অভিধান।

    বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে আধুনিকতার বিকাশ প্রথম দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায়। তাঁকে এককথায় আধুনিক বাংলা ভাষার জনক বলা যায়। ভাষার বিবর্তনের কারনে তিনি বাংলা ভাষার একটি অভিধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু সেই দ্বায়িত্ব দেওয়ার মত কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিকে পতিসরে জমিদারি পরিদর্শনে এসে রবীন্দ্রনাথ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্ঞানচর্চায় আগ্রহ লক্ষ করেন এবং সেই বছরের শেষেই তাঁকে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে সংস্কৃতের শিক্ষক নিযুক্ত করেন। এ স্কুলে তিনি তিরিশ বছর (১৩০৯-১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতায় নিষ্ঠা এবং বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতার কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিধান রচনায় অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর অভিপ্রায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি কোষগ্রন্থ রচনা শুরু করেন।

    হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৬৭-১৯৫৭) ছিলেন  শিক্ষাবিদ, পন্ডিত, অভিধান-প্রণেতা। জন্ম ১৮৬৭ সালে ২৩ জুন চবিবশ পরগনা জেলার রামনারায়ণপুর গ্রামে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল বসিরহাটের জামাইকাটিতে। তাঁর পিতা শিবচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় স্থানীয় এক জমিদারের কাছারিতে চাকরি করতেন। ছাত্রজীবনেই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি প্রবেশিকা ও এফএ পরীক্ষা পাস করার পর বৃত্তি নিয়ে বিএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ইতোমধ্যে পিতার মৃত্যু হলে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। বাংলা ১৩০৮ সনে কলকাতা টাউন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর প্রধান পন্ডিত নিযুক্ত হন। এ স্কুলের শিক্ষকতা ত্যাগ করে ১৩০৯ সনের শ্রাবণ মাসে তিনি রবীন্দ্রনাথের জমিদারির অন্তর্গত পতিসরের কাছারিতে সুপারিনটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন।
     
    শান্তিনিকেতনের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আহ্বানে যাঁরা বিদ্যালয়ের কাজে এসে যোগ দেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন— হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন, বিদ্যোৎসাহী মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রমুখ। প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘শান্তিনিকেতনের একযুগ’ গ্রন্থে এইসব মনীষীদের প্রসঙ্গে বলেছেন— “শান্তিনিকেতনকে এঁরা কী দিয়েছেন আর শান্তিনিকেতন এঁদেরকে কী দিয়েছে। এইটুকুই শুধু বলতে চেয়েছি।” সেই গ্রন্থ থেকেই উদ্ধৃত করে উল্লেখ করা যায় - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগ্রহে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে আসেন। তাঁরই নির্দেশে তিনি ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ' গ্রন্থ রচনায় হাত দেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু করে ১৩৩০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত তিনি একনাগাড়ে একাজ করে গিয়েছেন। রচনা শেষ হওয়ার পরপরই তা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়নি। তার জন্য আরও দশ বছর অপেক্ষা করতে হয়। বিশ্বভারতী এটিকে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত করতে অসমর্থ হওয়ায় নিজের ও তাঁর অনুগত ছাত্রদের অর্থানুকূল্যে খণ্ডকারে গ্রন্থটি মুদ্রন করেন। পাঁচ খন্ডে গ্রন্থটির মুদ্রণ শেষ হয় ১৩৫২ বঙ্গাব্দে। অবশ্য গ্রন্থের প্রেরণাদাতা রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ মুদ্রিত গ্রন্থ দেখে যেতে পারেননি। হরিচরণ তাঁর জীবনের চল্লিশটা বছর এই গ্রন্থ রচনায় ব্যয় করেছেন। একক প্রচেষ্টায় এত বড়ো কাজ সম্পন্ন করার অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর নেই। তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে ‘সংস্কৃত প্রবেশ’ নামে যে-গ্রন্থ রচনা করছিলেন, তা শেষ করার দায়িত্বও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর দিয়েছিলেন। এবং পরম যত্নে ও শ্রদ্ধায় তিনি সেই কাজটি শেষ করেন। বাঙালি জাতির সম্মুখে এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্তস্বরূপ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরানব্বই বছর বয়সে পরলোকে গমন করেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে। কারণ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঠাকুর পরিবারের জমিদারি সেরেস্তার কর্মচারী। রবীন্দ্রনাথ সেই সেরেস্তা থেকে তাঁকে আবিষ্কার করেন এবং শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়ে বাংলা ভাষার অভিধান ও অন্যান্য গ্রন্থ রচনা করিয়ে নেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন এবং ব্রম্মচর্যাশ্রমে সংস্কৃতের অধ্যপক হিসেবে নিযুক্ত করেন। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অভিধান রচনার কাজও সুসম্পন্ন করেন। এভাবেই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দিনের বেলা জমিদারির কাজকর্ম করার পর সন্ধেবেলায় সংস্কৃতির চর্চা করতেন। তাঁর বইয়ের পাণ্ডুলিপিও ছিল একখানা। ১৩১২ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৫২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত তিনি ওই অভিধানের জন্য জীবনের চল্লিশটি বছর মগ্ন থেকেছেন। গ্রন্থটি রচনার সূত্রপাত ঘটে ১৩১২ বঙ্গাব্দে আর শেষ হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। মুদ্রণের ব্যাপারে গ্রন্থকার সহায়তা পান মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর। কিন্তু মুদ্রণ কাজ শুরু হওয়ার আগেই মহারাজা মারা যান। এজন্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় আজীবন দুঃখিত ছিলেন, কারণ, কৃতজ্ঞতার অর্ঘ্যস্বরূপ তিনি এ গ্রন্থের একটি খণ্ডও তাঁর হাতে তুলে দিতে পারেননি। একইভাবে প্রেরণাদাতা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও তিনি বলেছেন যে, এ গ্রন্থের শেষ খণ্ড তিনি অর্পণ করার সুযোগ পাননি, কারণ মুদ্রণ শেষ হওয়ার আগেই রবীন্দ্রনাথ প্রয়াত হন। প্রকাশের ব্যাপারে বিশ্বভারতীর তেমন সামর্থ্য ছিল না। তবে গ্রন্থকার সামান্য সম্বল নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে তা ক্রমশ প্রকাশের আয়োজন করেন। পরে নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় এবং শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র ও অনুরাগীদের সহায়তায় বা আর্থিক আনুকূল্যে এই অভিধানটি প্রকাশিত হয়।

    বাংলা অভিধানের গুরুত্ব বিবেচনায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান দুটিই সর্বাপেক্ষা পরিচিত। তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান শব্দার্থের গভীর ও ব্যাপকতর অর্থ নির্ণয় করার ক্ষেত্রে অধিকতর উপযোগী। বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি প্রভৃতি ভাষার শব্দ ছাড়াও এ অভিধানে আছে ইংরেজি, পর্তুগিজ, হিন্দি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার শব্দ। তিনি শব্দার্থ স্পষ্ট করতে বাংলা সাহিত্য থেকে প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতির সাহায্য নিয়েছেন; আবার একটি শব্দের পূর্ণ পরিচিতির জন্য সংস্কৃত থেকেও আবশ্যকীয় উদ্ধৃতির সমাবেশ ঘটিয়েছেন। এ অভিধান প্রথমে পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয় (১৯৩২-১৯৫১), পরে দুখন্ডে। বঙ্গীয় শব্দকোষ ছাড়াও হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের কথা, সংস্কৃত-প্রবেশ, ব্যাকরণ-কৌমুদী, Hints on Sanskrit Composition & Translation, পালিপ্রবেশ, শব্দানুশাসন, কবিকথা, বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র, মঞ্জুষা প্রভৃতি গ্রন্থ। তারমধ্যে ‘বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র’, ‘কবিকথা’, ‘মঞ্জুষা' অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনূদিত। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক, ১৯৫৪ সালে শিশিরকুমার স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দেশিকোত্তম (ডিলিট) উপাধিতে ভূষিত করেন।
     
    এমন মানুষ ছিলেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ৭৫ বছর বয়সের পরেও অর্থাৎ, বিশ্বভারতী থেকে অবসর নেওয়ার পরও মাসমাইনের কথা না ভেবে আগের মতোই নিজের কাজে মগ্ন থাকতেন। অভিধান ছাড়াও তিনি রচনা করেন অন্যান্য গ্রন্থ। সকাল-সন্ধে ভ্রমণে বেরোতেন তিনি। চোখে কম দেখতেন তখন, কিন্তু কাউকে চিনতে পারলে কুশলাদি বিনিময় করতেন। ইংরেজ ঐতিহাসিক-সাহিত্যিক গিবনের মতো তিনি কখনও ভাবেননি যে, তাঁর সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। সবসময় তিনি ছিলেন হাসিখুশিতে পূর্ণ। সুখ-দুঃখে ছিলেন অবিচল।

    এই হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েরই জীবনী অবলম্বনে রাজা মিত্রের পরিচালনায় এবং বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও মাধবী মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে সমৃদ্ধ সিনেমা তৈরী হয়েছিল “একটি জীবন” ১৯৯০ সালে। সিনেমায় বাংলা অভিধান রচয়িতার চরিত্রের নাম যদিও গুরুদাস ভট্টাচার্য হিসেবে দেখানো হয়েছিল কিন্তু আসলে গল্পটি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী অবলম্বনেই লিখেছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু। তাঁর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত “একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু” গল্পগ্রন্থের একটি গল্প হল “একটি জীবন”। গল্পটিতে একদিকে যেমন অনুভব করা যায় দেশভাগের বেদনা তেমনি অন্যদিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য নিবেদিত একটি মানুষের ত্যাগ, ভিটেমাটি হারানো, স্বজন হারানোর দুঃসহ বেদনা। একটি শব্দকোষ প্রকাশের বাসনায় সারা জীবনের ত্যাগ, তিতিক্ষা, দুঃখ, বেদনা সহ্যের মর্মস্পর্শী দলিল যেমন গল্প ও সিনেমাটি তেমনি শ্রীযুক্ত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের জীবন।      
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন