এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মোঘল কাশ্মীর ন্যারেটিভ আর শাজাহানের বাগান

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ আগস্ট ২০২৩ | ২৩০ বার পঠিত
  • ষোলো শো চৌতিরিশে কয়েক মাসের যাত্রা শেষে লাহোর থেকে শ্রীনগরে ঢুকে বা তার আগেই বাদশাহ শাজাহান কাশ্মীর -ই জান্নাত নজির - স্বর্গীয় কাশ্মীরের অপূর্ব কোন জলপ্রপাতের ধারে ঘোড়া থামান। উপভোগ করেন ফুটে থাকা ফুলের খুশবু তখন সেই যাত্রা বিরতিতে পায়ে চলা নোকর-নকরানি আর সেপাই লস্কর হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তবে কাশ্মীরের ঠাণ্ডা হাওয়া আর ফুলের খুশবু সবার জন্যই। তাঁরাও বলে ওঠেন কাশ্মীর-ই বেনজির - অতুলনীয় কাশ্মীর।

    কাশ্মীর সম্পর্কিত স্বর্গীয় ন্যারেটিভ তৈরি করে চলে রাজা-প্রজা সবাই মিলে। পনেরোশো ছিয়াশিতে কাশ্মীর দখল করলেন আকবর। আর বাপ-ঠাকুরদার ঐতিহ্যে, আকবর-জাহাঙ্গীরের  ঐতিহ্যেই অপূর্ব সব গোলাপের চমন-বাগান তৈরি করেন শাজাহানও। ডাল লেকের ধারে অপূর্ব সেই সব বাগান তৈরি করে প্রকৃতিকে পোষ মানিয়ে, অধিকার করা চলতে থাকে। মোঘল বাগান তৈরির অনেকগুলো দিক আছে। বাগানের লেআউট, জলের উৎসের ব্যবহার, শাহী মঞ্জিলের উপস্থিতি, আমোদপ্রমোদ এমনকি কবরস্থান হিসেবে বাগানের ব্যবহার এই সমস্ত মাথায় রাখা হতো। কৃষিকাজ, ফলের বাগান, চারণভূমি, ফৌজি তাঁবু গাড়ার জায়গাও থাকত বাগানে। কেউ কেউ বাগানগুলোর সঙ্গে মোঘল বাদশাহদের শিকারগড় বা শিকারের জায়গার তুলনা করছেন প্রাকৃতিক স্পেসকে ব্যবহারের শাহী প্রকল্পের গুরুত্ত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে। তাঁরা বলছেন গ্রিক যোদ্ধা সেনোফোনের বর্ণনায় আর প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে  সাইরাস দ্য গ্রেটের রাজকীয় প্যারাডাইসস উদ্যানের ধারণা থেকেই আদি পারস্যে পাইরিডাইজা - বিশাল স্বর্গীয় উদ্যানের ধারণা এসেছে। পরে যার থেকে কোরান কথিত স্বর্গীয় উদ্যানের শাহী ধারণার নির্মাণ করা হয়। বাবরের সময় থেকে চার দিকে প্রবেশপথ থাকা , সম্পূর্ণ দেওয়াল ঘেরা বাগানের ধারণা এলো।এই বাগানে থাকে এপাশে থেকে ওপাশ  বিস্তরিত  লম্বা  লম্বা হাঁটার পথ যার মধ্যিখানে লম্বা লম্বা জল বেরোনোর পথ ।রাস্তা আর জল বেরোনোর পথ পরস্পরকে নব্বই ডিগ্রিতে ছেদ করে সামঞ্জস্য বিধান করে ।জল বেড়োনোর পথ যেখানে মেলে সেখানে থাকে জলাশয় ।পুরো বাগানের ঠিক মধ্যখানে চার কোনা  বড় জলাশয় ।এই মুঘোল বাগানের নকশা বিখ্যাত চাহার বাগ -চার বাগ নকশা  ।.পুরোটা মধ্যিখানে একটা ছোট বর্গক্ষেত্রকে রেখে একটা বড় বর্গক্ষেত্রকে আড়েবহরে ছটা সমান ভাগে ভাগ করলে যা দাঁড়ায় সেরকমই। যার চারদিকেই ঢোকা বেরোনোর পথ থাকবে। তবে কাশ্মীরের বাগানগুলোর বৈশিষ্ট্য হল সেগুলো পাহাড়ের ধাপে কেটে বানানো।
     
     মোঘল বাগানের আকার শুধু স্থান ব্যবহারের তরিকা নয় নান্দনিক, ধর্মীয়-পুরাণকল্পর নানা অনুষঙ্গও মোঘল বাগানের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাশ্মীরের ধাপ কাটা মোঘল বাগানগুলোও একদিকে কাশ্মীর সম্পর্কিত শাহী ন্যারেটিভ আর বাগান সম্পর্কিত মোঘল সাধারণ বোধের প্রতিফলন ঘটায়। আর এসবে শাজাহানের জুড়ি নেই ইতিহাসে। সালতানাতের প্রতীকমালা তৈরিতে নানান কাঠামো তৈরিতে তাঁর জামানা স্মরণীয়।

    বাদশাহ শাজাহানের আমলের সবসেরা মোঘল স্থাপত্য এখনো অতুল্য।  তার মধ্যে বাগানগুলো ছিল তাঁর খুবই প্রিয়। আগ্রা থেকে লাহোর হয়ে কাশ্মীর আসার পথেও অনেকগুলো বাগানের আশপাশে তাঁবু পড়ে বাদশাহের।  তার মধ্যে শিরহিন্দের বাগ-ই হাফিজ ৱাখনার নাম উল্লেখ্য। সেখানকার  ফৌজদার দিনায়েত খানকে নির্দেশ দেওয়া হল কিছু থাকার ঘর, একটা দরবার হল, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের জন্য  বারান্দা আর বাগানের বিশাল জলাশয়ের ধারে ঝারোখা বানাতে। পরের বছর ষোলোশো পঁয়তিরিশে  সেসব বানানো শেষ হলে তিনি নিজে এসে থেকে গেলেন কিছুদিন। এই বাগানটা আম খাস বাগ বলে পরিচিত। চার ভাগে ভাগ করা বাগানে ফুল, ফল আর সবজির তিনটে বাগান ছাড়াও আছে তিনতলা বাংলো টাইপ ছাদের অপূর্ব শাহী মঞ্জিলের জন্য চতুর্থ অংশটা।

    আকবর তাঁর কাশ্মীরের হরি পর্বত কেল্লায় বাগান তৈরি করেছিলেন। জাহাঙ্গীর, নূর জাহান আর আসফ খানও পাহাড়ি স্বাভাবিক ঝর্ণাকে পাথর বাঁধিয়ে গাছের সারি লাগিয়ে দৃষ্টিনন্দন বাগান তৈরি করেছিলেন। বাঁধানো ঝর্ণাগুলো বাগানের আড়ে বহরে কলকল করে ছুটে যায়। পাথরের ঢাল করা বাঁক থেকে জল ছুটে চলে ওপর থেকে নিচে বা ফোয়ারা হয়ে ছিটিয়ে দেয় আজও। নূর জাহানের তৈরি করা বাগ-ই নূর আফজা আর আসফ খানের তৈরি করা নিশাত বাগ শ্রীনগরের দুটো বাগানই খুব পছন্দের ছিল বাদশাহের। এদের সেরা হল শাজাহানের নিজের তৈরি করা বাগানগুলো। তার মধ্যে সবার সেরা হল শালিমার বাগ। ডাল লেকের ধারে পীর পাঞ্জালের অপূর্ব শোভা আরো বাড়িয়ে দেয়  এই শাহী নির্মাণ। শাজাহানের আমলে  সৌন্দর্যবোধের অনেক প্রতীকের মধ্যে অন্যতম এই বাগানের নির্মাণ কল্পনা। ক্যাথেরিন  অ্যাশারের গবেষণা বলছে  এই বাগান ছিল অনেকদিন আগে থেকেই। ষোলোশো কুড়িতে শাহাজাদা শাজাহানকে বাদশাহ জাহাঙ্গীর আদেশ দিলেন এটাকে কয়েক ধাপে বিভক্ত মোঘল শৈলীর বাগানে রূপান্তরিত করতে। শালিমার বাগের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা ঝর্ণায় দেওয়া হল বাঁধ। ষোলোশো চৌতিরিশে একে বাড়িয়ে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত নিয়ে  যাওয়ার আদেশ দিলেন শাজাহান। বানানো হল বেশ কিছু বসার জায়গা। পুরোনো শালিমার বাগও থেকে যায়। চৌতিরিশে পুরোনো অংশটার নামকরণ করা হচ্ছে ফারাহ বখশ - আনন্দধারা। একান্ত ব্যাক্তিগত শাহী ব্যবহারের জন্য পাহাড়ের ধারের উঁচু ধাপের নতুন  অংশটার নাম দেওয়া হচ্ছে বাগ-ই ফাইজ বখশ - ঐশ্বর্যধারা। ডাল লেকের দিক থেকে বাগানটায় ঢোকার ব্যবস্থা হল। ইতালিও পর্যটক বার্নিয়ের বলছেন আগে একটা গাছের সারি দেওয়া ছোট বাগানের ভেতর দিয়ে ঢুকতে হতো শালিমার বাগে। পাহাড়ি ঝর্ণার জলের স্বাভাবিক গতিকে নানা ভাবে বদলে জলস্রোতের বাহারের সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবে নানান ধাপে খোপ কেটে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে এই বাগানে, তাতে বোঝা যায় যে শুধু দিনে নয় শাহী রাত্রি বিলাসের জন্যও ব্যবহৃত হতো শালিমার বাগ।বাগানের উপর নিচ দুটো অংশেই কালো পাথরের ধাপকাটা ছাদ ঢাকা শাহী বসার জায়গাও আছে যেগুলো বাঁধানো ঝর্ণার ধারার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে না  মিলিয়ে তৈরি করা।তলার ধাপটায় জলের অবিরল ধারার মধ্যিখানে বেঁকানো থামের সুরক্ষায় কালো পাথরের সিংহাসনও রয়েছে। শাজাহান এখানে বসে ডাল লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন ধরেই নেওয়া যায়।

    তথ্য সূত্র :
     1) Architecture of Mughal India: Cambridge History of India,  Catherine B Asher
    2) Mughal Hunting Ground Landscape Manipulation and 'Garden' Association, Shaha Parpia, JSTOR Article

     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন