এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ফরাসী সাহিত্যের স্রোতধারায়

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ আগস্ট ২০২৩ | ১৮৪ বার পঠিত


  • “উচ্চভ্রূ নয়, সাধারণ পাঠকের জন্য বিভিন্ন সময়ে রচিত এই নির্বাচিত প্রবন্ধগুলি একসঙ্গে প্রকাশিত হলে সেটা কারুর কাজে লাগতে পারে মনে করেই এই বইয়ের পরিকল্পনা। চুরমার হতে থাকা আজকের এই পৃথিবীতে এগুলির মধ্যে কোনও গোপন অন্তঃসূত্র পাওয়া যাবে ভাবতে চাই।”

    শ্রীযুক্ত চিন্ময় গুহের কাছে আপামর বাঙালী পাঠকসমাজের কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এই নিয়ে আমি ওনার তৃতীয় বইটি পড়লাম। বই না বলে ‘ছাত্রবন্ধু’ বলা ভাল। ফরাসী সাহিত্যের যত দিকপাল আছেন তাদের অধিকাংশই তার হৃদয়ের আতশকাঁচে যেভাবে ধরা পড়েছে, তাকেই নিজের আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে আমাদের কাছে মেলে ধরেছেন।

    ‘ছাত্রবন্ধু’ই বটে। না হলে তো আমি জানতেই পারতাম না, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলী’ ফরাসীতে অনুবাদ করেন স্বয়ং আদ্রে জিঁদে! আমি জানতে পারতাম না রম্যাঁ রল্যাঁ শুধু তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ফরাসী সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে কী অসামান্য প্রভাব রেখেছিলেন, শুধু তাই না, তিনি ভারত প্রেমিকও ছিলেন। আমি জানতে পারতাম না, সার্ত্রে শুধুমাত্র অস্তিত্ববাদের জনক নয়, সমগ্র ফরাসী ইন্টালেকচুয়াল তথা বিশ্বদর্শনের নবরূপকার আক্ষরিক অর্থে তার জীবদ্দশাতেই মহান পথিকৃৎ হয়ে পড়েছিলেন।

    চিলেকোঠার উন্মাদিনী’র এই লিখন পর্যায়টিকে বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। যার প্রথম শুরুই হয়েছে ‘আত্মহত্যা’ বিষয়টাকে কেন্দ্র করে। এই আত্মহত্যা পর্যায়ক্রমে ভিভিয়েন এলিয়ট হয়ে কখন যেন ঢুকে পরে টি এস এলিয়টে। পরের পর প্রবন্ধ টি এস এলিয়টকে ঘিরে। কিন্তু, এখানে ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ কিম্বা ‘হে অনন্ত নক্ষত্রবিথী’-র সেই লিখন মাধুর্যতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। উক্ত দুটো গ্রন্থে পাঠকের সাথে সংযোগ স্থাপনের যে দায় নিয়ে লিখেছিলেন, এ পর্যায়ে কোথাও তার লেখা নিষ্প্রাণ লাগে। তথ্যে ভরপুর এই লেখাগুলো যে কোন কলেজ স্টুডেন্টদের নোট্‌সের মতো মনে হয়। যদিও তার লেখার গভীরতা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।

    লা রোশফুকো, গুস্তভ ফ্লবের কিম্বা ওগ্যুস্ত্যাঁ ওসাঁ পেরিয়ে যখন জর্জ সাঁদে-তে এসে ঢুকলেন, তখন মনে হল যেন তার পুরোনো সত্ত্বাটা আবার ফিরে আসছে। এবং মলার্মে থেকে সেই যে নিজের ফর্মে ফিরলেন, আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। এর মাঝে ‘স্বপ্নের কারিগর’ এক অসামান্য লেখা। জাঁ আনুই-এর নামই শুনিনি, অথচ ফরাসী সাহিত্যে তার কি মহাসাগরীয় অবদান!

    আমি সত্যি অর্থে গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলাম যখন ‘সার্ত্রে’ পর্ব শুরু হল। ‘আয়না ভাঙতে ভাঙতে’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে সার্ত্র এবং তৎপরবর্তী রম্যাঁ রল্যাঁ সম্পর্কিত চারটি প্রবন্ধ। সেই সাথে তিনি যুক্ত করেছেন পরিশিষ্টে দুটো গুরুত্বপূর্ণ চিঠি। আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি এনাদের নাম শুনেছি, কিন্তু কাউকেই আমার পড়া হয়ে ওঠে নি। চিন্ময় গুহ কৌতুহল তৈরী করতে পারেন। কৌতুহল থেকে প্রবল কৌতুহল তৈরী করে সার্ত্রে এবং রম্যাঁ রল্যাঁ-র লেখা খুঁজতে বাধ্য করছেন আমাকে। আমি চাইছি লক্ষ্মী মেয়ের মতো বইগুলো জোগাড় করে পড়ে ফেলতে। এমনটা করানোর ক্ষমতা চিন্ময় গুহের লেখায় আছে। কিন্তু, জানি না, কতটা আমি কতদূর এগোতে পারব। আমাদের এখানে বইয়ের এবং যথার্থ অনুবাদের বড়ো অভাব, শুধু তাই নয়, দিগ্‌দর্শী পাঠকও অপ্রতুল।

    অনুবাদ বলতে মনে পড়ল, এখনকার লেখক-প্রকাশকেরা তার এই পর্যায়ের ‘বাংলা অনুবাদের সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়েছেন কি? সলমন রুশদীর ‘মিডনাইটস্‌ চিলড্রেন’ পড়তে পড়তে আমি যে কি অসহায়তা বোধ করছিলাম তা উক্ত বইটির রিভিউতে বলেছি। আজ একই কথা পড়লাম চিন্ময় গুহের লেখায়। বাংলা সাহিত্যকে অন্ধকার থেকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার দায় থেকে আজকের অনুবাদক-প্রকাশকেরা পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বইতে পারবেন তো? জানি একথা তারা বলতে পারেন যে, মরে গেলে আর কে কার, কিম্বা বর্তমানের কত না কত সমস্যার জটাজাল! কিন্তু যে শ্রদ্ধায় চিন্ময় গুহ সত্যজিৎ রায়ের সাথে রদ্যাঁ-র ভাস্কর্যে মিল খুঁজে পাচ্ছেন এত বছর পেরিয়ে এসে, সেই একই অ-শ্রদ্ধায় যখন ভবিষ্যতের অসাড়চিন্তাকীটদ্রষ্ট বাঙালী যুবক-যুবতী তাদের মুণ্ডপাত করবেন, সেটার কথা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারবেন কি? উক্ত প্রবন্ধটি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে, আলোচনা করার সময় এসেছে। চিন্ময় গুহ এর আগেও অনুবাদ নিয়ে লিখেছেন ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’ প্রবন্ধে। জানি না, ওনার আর কোন গ্রন্থে অনুবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন কি না, তবে, আমার ইচ্ছা আছে এই পর্যায়টিকে নিয়ে আলাদা করে লেখার। কারণ, চিন্ময় গুহের এই প্রবন্ধটা আমার কাছে সমালোচনা কম, সাবধানবাণী বেশি মনে হল।

    চিন্ময় গুহ, বাস্তবিকই, ফরাসী সাহিত্যের ধারাটিকে যেভাবে আমাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তা কি সার্থক হয়েছে? আমি জানি না। কোন যথার্থ প্রকাশক, কিম্বা অনুবাদকের চোখে কি পড়েছে? পড়লে এতদিনে কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ২০০৬-এ এই লেখাগুলো সংকলন হয়েছে। আজ আমি পড়ে তার রিভিউ লিখছি। তার মানে কমপক্ষে ২৫ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। কিছু কি কাজ হয়েছে? চোখে তো পড়ে না! ফরাসী সাহিত্যের কটা লেখা অনুবাদ হয়েছে এই সময়ে? হয় নি, তা বলা যায় না অবশ্যই। কোথাও না কোথাও তো কেউ না কেউ অনুবাদ করেইছে। কিন্তু ঢিমে তেতালায় পা ফেলাকে এগোনো বলা যায় না, আবার পিছোনোও বলা যায় না। এ এক অদ্ভুত অবস্থা! কিন্তু, আসলেই, এভাবে ফাঁকির পথটা চওড়া হয়, আমরা বঞ্চিত হই। আর আপামর বাঙালী সমাজ স্কুলে বাঙলা ভাষাকে আবশ্যিক করার আনন্দে নেচে মরছে দেখে লজ্জায় মরে যাই। তারা ভাবছে, এভাবে বাংলা ভাষা তার প্রাপ্য সন্মান পেল! তা কি পাওয়া যায়? না হয়েছে? কসমোপলিটান না হয়ে বেঁচে থাকা যায় না? বাইরের চিন্তাধারাকে আমাদের ভাষায় না ভাবাতে শিখলে নতুন কোনো চিন্তা সম্ভব নয়। সেরকম বেঁচে থাকাটা বর্তমানের সিরিয়ালের চরিত্রগুলোর মতো বেঁচে থাকা হবে। বেঁচে থাকবে, যেভাবে কোমায় বছরের পর বছর ধরে মানুষ বেঁচে থাকে। অবশ্য তাকে যদি বেঁচে থাকা বলে। চিন্ময় গুহের লেখা কথাগুলো মনে পড়ে যায়...

    “আমরা সবাই জানি জানলা বন্ধ হয়ে গেলে কী ভয়ংকর হয়ে ওঠে আলোবাতাসহীন জীবন, আর ‘অনুবাদ’ ও ‘জানলা’ কথা দুটো যখন ভাষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে সমার্থ, তখন দেখা দরকার জানলা খোলে না কেন, বা খুললেও এত কম কেন! জানলা না খুলে বেশ আছি ভাবলে সেটা আত্মহননের সামিল। তা ছাড়া সতেরো শতকের জীবনদ্রষ্টা লা রোশফুকো তো মনে করিয়েই দিয়েছেনঃ ‘বোকা বনে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল নিজেকে অন্যদের চেয়ে চালাক ভাবা।’... মনে রাখতে হবে, অনুবাদ সম্পর্কে এই অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধার দিকটি অনুবাদ ও অনুবাদকের একটি বৃহত্তর মৌলিক সংকটের রূপরেখাকে তুলে ধরে।”

    ==================================

    চিলেকোঠার উন্মাদিনী
    চিন্ময় গুহ
    আনন্দ পাবলিশার্স
    মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০ টাকা
    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন