এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ইস্কনীয় কীর্তি, একেশ্বরবাদ ও ইউভাল নোয়া হারারি

    সূর্যদীপ্ত নাগ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৪ জুলাই ২০২৩ | ৬৫৯ বার পঠিত
  • অমোঘ লীলা দাস নামে এক ইস্কনীয় সাধু শ্রোতাদের হাততালিতে উত্তেজিত হয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি সহযোগে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সম্পর্কে নানারকম আজেবাজে কথা বলে ফেলেছেন। এরপর পাবলিক আউটরেজের ঠ্যালায়, এবং অবস্থাটা ক্রমশ হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, ইসকন ক্ষমা চেয়েছে এবং উক্ত সাধুর বিরুদ্ধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নাকি নিয়েছে। তবে তীর ততক্ষণে ধনুক ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ফলে ইসকনের ফাউন্ডার ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ওরফে অভয়চরণ দে মহাশয়ের মতামতও হওয়ায় ভেসে বেড়াতে শুরু করেছে। এবং দেখা যাচ্ছে যে, একই টাইপের কথা সংস্থার ফাউন্ডার স্বয়ং বিভিন্ন সময়ে বলে বসে আছেন!
     
    প্রথমে ভেবেছিলাম এই নিয়ে কিছু বলবো না। এসব ধর্মীয় প্যাচালের মধ্যে আমাদের মত নাস্তিকদের আর কি ভূমিকা থাকতে পারে? কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম যে, ধর্ম বলতে শুধুমাত্র আধ্যাত্বিক বিষয়টাকেই বোঝায় না। সমাজতত্ত্ব, এনথ্রপলজি, ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব এবং আরো বিভিন্ন চশমা দিয়ে ধর্মকে দেখা যায় এবং তার কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা যায়। এবং এক্ষেত্রে যেহেতু আমার নিজের একটা বক্তব্য আছে তাই বরং সেটা লিখে ফেলাই ভালো।
     
     আমার বক্তব্য মূলত ইউভাল নোয়া হারারির সেপিয়েন্স গ্রন্থের ১২ নম্বর অধ্যায়ে লিখিত বিশ্লেষণকে অনুসরণ করে হবে। এখানে হারারি মনোথিইজম এবং পলিথিইজম প্রসঙ্গে বলছেন যে, বহুঈশ্বরবাদও ছোট-বড় নানারকম দেবদেবীর ঊর্ধ্বে একটি 'supreme power governing the world' এর অস্তিত্বে যে অবিশ্বাস করে এমন নয়। গ্রীক প্যান্থিয়নে সব দেবদেবীর উর্ধ্বে আছে ফেট, নর্ডিক মিথলজিতেও দেবতারা শেষ পর্যন্ত নিয়তির অধীন, আর হিন্দুদের ক্ষেত্রে সমস্ত দেবদেবী এসে শেষ হয় আত্মনে (বোঝা যাচ্ছে যে হারারি এখানে নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলেছেন)। কিন্তু একেশ্বরবাদীদের সাথে বহু ঈশ্বরবাদীদের প্রধান পার্থক্য এই সর্বোচ্চ শক্তি/দেবতার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। পলিথিইজমের সর্বোচ্চ শক্তি যেহেতু সবকিছুর ঊর্ধ্বে তাই তার কোন পক্ষপাত বা ইন্টারেস্ট থাকতে পারেনা। মানুষের কামনা, বাসনা, ভয় ইত্যাদির বিষয়ে সে নিরপেক্ষ হতে বাধ্য। এবং, ভালো এবং মন্দ দুটোই যেহেতু প্রকৃতিতে আছে তাই সেই শক্তি অবশ্যই ভালো মন্দেরও উর্ধ্বে হবে। তার কাছ থেকে সেইজন্য যুদ্ধের জয় চাওয়া যায় না, সুস্বাস্থ্য কামনা করা যায় না, বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করা যায় না। 
     
    তবে এই নির্গুণ ঈশ্বরের নিচে থাকা দেবদেবীদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত। আর এই সীমাবদ্ধতার কারণেই তাদের পক্ষপাতও থাকতে পারে। এই ধরনের ঈশ্বরেরা ভক্তকে কৃপা করতে পারে, আবার দরকারে পরস্পর বিরোধীও হতে পারেন। মানুষ তাই তাদেরকে পুজো করে তুষ্ট করার চেষ্টা করতে পারে, বা তাদের কাছ থেকে এটা সেটা চাইতে পারে। কিন্তু সর্বোচ্চ শক্তির কাছে পারেনা। গ্রীকরা তাই ফেট এর উদ্দেশ্যে কোনো বলি দেয়নি, বা হিন্দুরাও আত্মনের পুজোর জন্য মন্দির তৈরি করেনি। 
     
    তাহলে মনোথিইজম এলো কোথা থেকে? পলিথিইস্টিক সমাজেও দেবতাদের মধ্যে এক ধরনের কম্পিটিশন চলে (অর্থাৎ দেবতার ফলোয়ারদের মধ্যে চলে)। নৃসিংহ, শরভ, গন্ডভেরুন্ড এবং দেবী প্রত্যংগীরার কাহিনীর কথা ভাবুন। নৃসিংহর মূল কাহিনীটি তো নিশ্চয়ই জানেন। এর সাথে সাথে শিব পুরাণে আরো কিছু জিনিস যোগ করা হয়। হিরণ্যকশিপু বধের পরও নৃসিংহের রাগ থামছিল না। তাকে আর সামলানো যাচ্ছে না বলে শেষে শিব শরভ অবতার রূপে অবতীর্ণ হন। এর ফলে বিষ্ণু শেষ পর্যন্ত শিবের ভক্ত হয়ে যান। এর আবার একটি অন্য সংস্করণও আছে। শরভ যখন নৃসিংহকে নখে বিঁধে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তখন নৃসিংহ গন্ডভেরুন্ড রূপ ধারণ করে শরভকে আচ্ছন্ন করে ফেলেন। তখন আবার শরভের মাথা থেকে শক্তি প্রত্যঙ্গীরার রূপে বেরিয়ে এসে এনাদের সকলকে সামলান। 
     
    এই মিথগুলোর উপর একবার চোখ বুলালেই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষির ভাবটা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে। বিষ্ণু, শিব এবং দেবী - এই তিনজনের মধ্যে কার শক্তি বেশি সেই বার্তাটাও দিব্যি দিয়ে দেওয়া হলো গল্প বলার সুযোগে। অর্থাৎ, পলিথিইজমের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেবতাদের ফলোয়ারদের মধ্যে একটা রেষারেষি চলে। এইরকম রেষারেষি করতে করতে একদল একটু বাড়াবাড়ি রকমের গোঁড়া হয়ে যেতে পারে। এবার, এরা যদি কোনো কারনে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ বা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন তারা নিজেদের দেবতাকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়। আর এই ভাবেই জন্ম হয় একেশ্বরবাদের। সেই জন্য একেশ্বরবাদীদের ইশ্বর হয় এক অদ্ভুত ধরনের জগাখিচুড়ি। সে একইসঙ্গে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, নিয়ন্তা এবং আরো সবকিছু - কিন্তু তার আবার নিজের ভক্তদের প্রতি পক্ষপাত আছে। কে তাকে পূজা করছে তার ভিত্তিতে এই দেবতা একজন মানুষকে হয় অনন্ত নরকে পাঠায়, নয় পুরস্কার হিসেবে অনন্ত স্বর্গ দান করে। এই কারণেই আইডিয়া হিসেবে একেশ্বরবাদ অনেক বেশি কুৎসিত।
     
    এই সবকিছুর সাথে ইসকনের সম্পর্ক কি? আমার মতে হারারি বর্ণিত একেশ্বরবাদ এর উদ্ভবের কাছাকাছি একটা কান্ড আমরা ইস্কনীয় কীর্তি অবজার্ভ করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি। ভক্তিবেদান্ত প্রভুপাদের ব্যাপারে আমার এর আগে খুব বেশি কিছু জানা ছিল না। কিন্তু তার সম্পর্কে যেসব পোস্টগুলো দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে মানুষটা ছিলেন একইসঙ্গে শিক্ষিত, জেদী, সংকীর্ণমনা, গোঁড়া, অবসেসড এবং মনোমেনিয়াক। এই ধরনের লোকেদের একটা আলাদা শক্তি থাকে যে সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। নিজের পূজ্য দেবতাকে অন্য দেবদেবীর উপর চাপিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার একটা প্রবল বাসনা ছিল তার মনে। এর উপর আবার বৈষ্ণব ধর্মের যে ধারাটিকে অনুসরণ করতেন বলে বুঝতে পারলাম সেটি নিজেই যথেষ্ট গোঁড়া এবং সংকীর্ণ প্রকৃতির। অর্থাৎ, সবকিছু যেন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। 
     
    যাইহোক, অনেকটা বেশি বয়সে আমেরিকায় ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে প্রচুর ফলোয়ার পান ভদ্রলোক। এবং, সাথে হাতে আসে আমেরিকান ডলারও। অর্থের সাথে সাথে যে ক্ষমতা আসে সে কথা ভুলে গেলে চলবে না। এবং আরেকটি জিনিসও লক্ষ্য করার মত আছে। এই সংগৃহীত অর্থ ইসকন সমাজ কল্যাণে ব্যয় করেনি (ভারত সেবাশ্রম সংঘ বা রামকৃষ্ণ মিশনের মত)। একমাত্র ধর্ম প্রচার ছাড়া আর কোন দিকে তারা নজর দেয়নি। এবং তাদের প্রচারের ফোকাসে থেকেছে ভারত নয় - বিদেশ। স্বাভাবিকভাবেই ইসকনের অর্থ এবং আন্তর্জাতিক ইনফ্লুয়েন্স - দুটোই প্রচুর। অন্যদিকে তাদের প্রচার ক্ষেত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খ্রিস্টান দেশগুলো হওয়ায় এই শুধুমাত্র কৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোন ভগবানের ওপর ফোকাস না করা তাদের সাহায্য করেছে বলে মনে হয়। কারণ ছোটবেলা থেকেই একটি একেশ্বরবাদী ধর্মের স্ট্রাকচারে বড় হওয়া মানুষের আরেকটা প্রায় একেশ্বরবাদী ধর্মকে একসেপ্ট করাটা সহজ। হরেকৃষ্ণ মুভমেন্টকে গ্রহণ করাটা তাই খ্রিস্টানদের পক্ষে বোধ হয় সহজ হয়েছে। 
     
    ক্ষমতা, অর্থ, ভক্তকুলের সমর্থন এবং গোড়ামী মিলে গেলে জন্ম নেয় এক ধরনের বিষাক্ত ওভারকনফিডেন্সের। ইস্কনীয় সাধুদের এর আগেও কৃষ্ণ ব্যতীত অন্যান্য দেবদেবী সম্পর্কে নানারকম আজেবাজে কথা বলতে দেখা গেছে। এগুলো প্রত্যেকটাই আমার মতে কিছু দিকে নির্দেশ করে। বহুঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদে তো আর একলাফে যাওয়া যায় না। হয়তো এমনই কিছু মুভমেন্টকে কেন্দ্র করে জন্ম নেয় মনোথিইজমের।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ জুলাই ২০২৩ | ৬৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পলিটিশিয়ান | 2603:8001:b102:14fa:92ee:922d:481e:c1fc | ১৪ জুলাই ২০২৩ ০৮:১৯521215
  • গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা বোধহয় কৃষ্ণকেই সুপ্রিম গড বলে মানেন। তাদের মতে এমমকি নারায়ণ বা বিষ্ণুও কৃষ্ণের অবতার, উলটো নয়। কাজেই যত মত তত পথের তত্ত্বের সাথে তাদের মিশ খাওয়া মুশকিল।
  • দীপ | 42.110.144.189 | ১৪ জুলাই ২০২৩ ১৩:৪৭521224
  • ইসকন সাধুর মছলি-বার্তা
    ==================

    একজন সিদ্ধপুরুষ কি মছলি খা সাকতা হ্যায়? সিগারেট টানে মাছলি খায় সে কি আবার 'আধ্যাত্মিক' মানুষ হতে পারে? আর ওনার গুরু বলে দিচ্ছেন 'যত মত তত পথ'। বলুন তো দেখি, অস্ট্রেলিয়া কি যে কোন রাস্তা দিয়ে গেলেই পৌঁছাবেন? এইসব  বলে হাত-পা নেড়ে ভুরু নাচিয়ে তিলক কাঁপিয়ে কমেডি করার মত ভঙ্গিমায় ভক্তদের বিনোদন দিচ্ছেন দেখলাম ইসকনের এক সাধু। 

    ইসকনের সাধুদের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে। কয়েক বছর আগে মায়াপুরের মন্দিরে গিয়েছি, বন্ধুদের সঙ্গে ইতস্তত ঘুরছি, এক সাধু হঠাৎ ক্যাপচার করলেন। নরম মাটি ভেবে খুব কোপাতে লাগলেন প্রথাসিদ্ধ কয়েকটা কোদাল খুন্তি নিয়ে। জগৎ ও জীবন আসার, একমাত্র কৃষ্ণনাম সার, সুতরাং নাকে তিলক কেটে দুই বাহু তুলে নৃত্য করতে করতে বেরিয়ে আসা উচিত আমাদের--এই ছিল তার মূল বক্তব্য। তারপর আমরা প্রসঙ্গক্রমে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের কথা তুললাম। তখন উনি এতটা কটুকথা বলেন নি অবশ্য। তবে আচরণে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আমরা ইগনোরেন্ট পিপিল। তাই রামকৃষ্ণ নামক ফালতু লোকের পাল্লায় পড়ে জীবন নষ্ট করছি। আমারা অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলাম যে কারোর পদাশ্রয়ে মস্তক বিক্রয় করার বাসনা আপাতত জন্মায় নি। দরবিগলিত অশ্রুধারায় উন্মত্ত হয়ে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা জীবন কাটানোর সৌভাগ্যও আপাতত আমরা চাইছি না। তখন হতাশ হয়ে অন্য কারোর দিকে ধাবিত হয়েছিলেন সেই সাধু-প্রচারক।

    এখানেই পার্থক্য অন্য সংগঠনের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের। পাঁচ বছর মিশনে থেকেছি, তারপর আরো দশ বছর কেটে গেছে, কেউ কখনো বলেনি দীক্ষা নাও। কেউ বলেনি রামকৃষ্ণ মিশনে সাধু হয়ে জীবন উৎসর্গ কর, না হলে তোমার জীবন ব্যর্থ হবে। মগজ ধোলাই-এর  টেকনোলজিতে বিশ্বাস করেন এমন কোন সন্ন্যাসীর ত্রি-সীমানায় যাইনি। এমন কাউকে দেখিওনি। কেউ বড়জোর বলেছেন স্বামীজীর বই পড়ো, ঠাকুরের কথামৃত পড়ে দেখো। উপর থেকে কোন বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, যুক্তিবিচারকে সরিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়নি। যুক্তিহীন ফাঁপা পলকা ভাবাবেগকে ভক্তি কিংবা আধ্যাত্মিকতা হিসেবে দেখানো হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেদের সংগঠন বৃদ্ধির জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতি কটাক্ষপাতের কালচার  কখনো দেখিনি সেখানে।

    বিবেকানন্দ যুক্তিহীন ভাবাবেগের চাইতে নাস্তিকতা বেশি পছন্দ করতেন। যুক্তি বিচারের সব সীমানা পেরোনোর পর মানুষ যেখানে পৌঁছায়, সেখানেই বিবেকানন্দের সূচনা। যুক্তি দিয়ে শুরু। যুক্তির সিঁড়ি দিয়ে মুক্তির মিনারে উঠতে হয়।খাদ্যাভ্যাস মানুষের শরীরে মনে প্রভাব ফেলে ঠিকই, কিন্তু সেসবই অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে। চারাগাছকে বেড়া দিয়ে রাখতে হয় ছাগলের ভয়ে। গাছ মহীরুহ হলে আর সেই ভয় থাকে না। বিবেকানন্দ যে মহীরুহ ছিলেন সেটা তাঁর ৩৯ বছর ৫ মাসের কর্মকান্ড দেখেও যে বোঝে না বা বুঝতে চায় না তার কথার সমালোচনা করতে যাওয়াও সময়ের অপচয়।

    মাস্টারদা কিংবা নেতাজির মতো মানুষ শক্তি পেয়েছিলেন যে লোকটির পত্রাবলী ও অন্যান্য সাহিত্য থেকে, সামান্য মছলি আর সিগারেট যে তার বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি করতে পারবে না, ঈর্ষাকাতর আহাম্মক ছাড়া  সবাই  বুঝবে সেই সত্য।

    সিদ্ধপুরুষ না দরকচাপুরুষ না কাঁচাপুরুষ সে বিতর্কে না হয় নাই গেলাম। সমকালীন সমাজ জীবনে রাজনৈতিক জীবনে বিবেকানন্দের প্রভাব দেখুন। স্বামীজীর দেশাত্মবোধ দেখুন, সমাজসেবার উদ্যম দেখুন। ভেতরটা দেখার মত চোখ অনেকেরই থাকে না। বাইরে থেকে দৃষ্টিপাত করেই দেখুন না হয়। জেনে নিন মহাত্মা গান্ধী কিংবা রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য।

     আপনি মাছের কষ্ট বোঝেন কিন্তু মানুষের কষ্ট বোঝেন না। বিবেকানন্দ বলছেন অহিংসা করতে গিয়ে নির্বীর্য হয়ে পড়লে চলবে না। পিঁপড়েকে চিনি খাওয়াবো আর এদিকে ধর্মের নামে মানুষকে কচুকাটা করবো দুটো একসঙ্গে চলতে পারেনা। শাকপাতা খেয়েও যদি কেউ অপরের ক্ষতি করে, বিষয় চিন্তায় নিমগ্ন থাকে তাহলে সে ধার্মিক নয়। খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ শরীরের ব্যাপার ,বড়জোর মনের। সিদ্ধপুরুষ নামক যে ব্যাপারটা, সেখানে শরীর মনের চেয়েও গভীর কোন অস্তিত্বের কথা বলা হয়। মছলি কিংবা সিগারেট এত গভীর পর্যন্ত যেতে পারে না।

    আর মছলির কষ্টের কথা বলছেন? পুঁই গাছের প্রাণ নেই? ছোলা মুগ মটরদানা ধান গম এরাও কি সুপ্ত প্রাণ নয়? তাদের অস্তিত্বের অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার আছে? আমাদের (এবং  আপনার) কথার শব্দতরঙ্গে প্রতিনিয়ত অসংখ্য জীবাণুর প্রাণহানি ঘটছে, তাদের কষ্ট হচ্ছে না? অসংখ্য মৃত্যুর উপরেই কি আমাদের বেঁচে থাকা নির্ভরশীল নয়? 

    খাদ্যাখাদ্য বিচার সম্পর্কে অনেক বড় বড় কেতাবি আলোচনা আছে হিন্দু দর্শনে। সেসব প্রসঙ্গে না গিয়ে শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলা স্বামীজীর এই কথাগুলো পড়ুন মন দিয়ে--

    শরচ্চন্দ্র-- স্বামীজী, খদ্যাখাদ্যের সহিত ধর্মাচরণের কিছু সম্বন্ধ আছে কি?

    স্বামীজী-- অল্পবিস্তর আছে বই কি। 

    শরচ্চন্দ্র-- মাছ-মাংস খাওয়া উচিত এবং আবশ্যক কি?

    স্বামীজী-- খুব খাবি বাবা। তাতে যা পাপ হবে তা আমার। তোদের দেশের লোক গুলোর দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি-- মুখে মলিনতার ছায়া--বুকে সাহস ও উদ্যমশূন্যতা,পেটটি বড়, হাতে পায়ে বল নেই, ভীরু ও কাপুরুষ।.... ঘাস পাতা খেয়ে যত পেট রোগা বাবাজির দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে। ওসব সত্ত্বগুণের চিহ্ন নয়, মহা তমোগুণের ছায়া-- মৃত্যুর ছায়া। সত্ত্বগুণের চিহ্ন হচ্ছে মুখে উজ্জ্বলতা, হৃদয়ে অদম্য সাহস, ট্রিমেন্ডাস অ্যাক্টিভিটি; আর তমোগুণের লক্ষণ হচ্ছে--আলস্য জড়তা মোহ নিদ্রা এইসব। তারপর স্বামীজি বলছেন সত্ত্বগুণের যখন খুব বিকাশ হয় তখন মাছমাংসে রুচি থাকে না। কিন্তু সত্ত্বগুণের এইসব লক্ষণ জানবি-- পরের জন্য সর্বস্বপণ ইত্যাদি। যেখানে দেখবি মনে ওই সব গুণের স্ফূর্তি নেই অথচ অহিংসার দলে নাম লিখিয়েছে, সেখানে জানবি হয় ভন্ডামী না হয় লোক দেখানো ধর্ম।

    স্বামীজীর মধ্যে সত্ত্বগুণ ও রজোগুণের চূড়ান্ত বিকাশ দেখা যায়। স্বামীজীর যে কর্মকাণ্ড তার জন্য এই দুটোই দরকার ছিল। একই সঙ্গে তিনি তপস্বী ও কর্মী। তিনি অল্পবিস্তর মাংসাহরী হয়েও ধ্যানমগ্ন ও প্রেমিক। তিনি কান্ডজ্ঞান বর্জিত সিদ্ধপুরুষ নন। বনের বেদান্তকে ঘরে আনা তাঁর ব্রত। তাই তিনি জানতেন মানুষের প্রাণরক্ষা আগে, তারপর সময় ও সক্ষমতা থাকলে গরুদের জন্য ভাবনা। তারপর সাধ্য থাকলে মছলির জন্য ভাবনা, পুঁইগাছের জন্য ভাবনা। স্টেপজাম্প করে চলে গেলে হবে না। যে নিজের ভাইকে ভালোবাসে না, প্রতিবেশীকে ভালোবাসে না, সে দেশকে কি ভালবাসবে? সে বিশ্বজনীন প্রেমের ভাষণ দিলে কে শুনবে? ভাবের ঘরে চুরি তিনি পছন্দ করতেন না। প্রচন্ড ডাইনামিক চরিত্র স্বামীজি, তাকে বোঝার জন্য একটু অধ্যবসায় দরকার। মছলি আর সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে তাঁকে দেখলে সেই দেখা আরও বেশি ধোঁয়াটে হয়ে যাবে। যাইহোক।

    যত মত তত পথ নিয়ে আর কি বলব। সম্পূর্ণ অন্য সংস্কৃতির মানুষ হয়েও সৈয়দ মুজতবা আলী বুঝেছিলেন রামকৃষ্ণকে। রামকৃষ্ণের এমন উদারতা ছিল যে ইসকনের এই সাধুকেও তিনি প্রেমালিঙ্গন দিতেন। কাছে টেনে নিতেন। হয়তো বলতেন একনিষ্ঠভাবে তোমার ভাবে সাধনা করে যাও। ব্যাকুল হয়ে অকপট হয়ে এগিয়ে গেলে নিশ্চয়ই তুমি সত্যের সন্ধান পাবে। হয়তো স্মরণ করিয়ে দিতেন ঈর্ষা আর কপটতা খুব আত্মঘাতী ব্যারাম। প্রতিটা মানুষ জেনে বা না জেনে নিজ পথে নিজস্ব গতিতে একই সত্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইসকনের এই সাধুও অগ্রসর হচ্ছেন হয়তো। 

    রামকৃষ্ণের এই বার্তা অতলস্পর্শী। অত্যন্ত গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকে "যত মত তত পথ" এর মত একটা  সূত্রের জন্ম হয়। কোন নির্বোধ কমেডিয়ানের পক্ষে এই বাক্যের মর্ম বোঝা সহজ নয়।  সব পথ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া যায় কিংবা ইসকন মন্দিরের চূড়ায় পৌঁছানো যায়--একথা বোঝানোর মতলব রামকৃষ্ণের ছিল না।

    যাইহোক, ইসকনের সাধুকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তিনি এইসব আবোল তাবোল বকলেন বলে মানুষ রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের চিন্তাভাবনার কথা নতুন করে চর্চা  করবে আরও কয়েকদিন। তাতে আল্টিমেট উপকারই হল।

    ©️ অপূর্ব সৎপতি
  • Sushmita Datta | ১৪ জুলাই ২০২৩ ১৮:২১521231
  • বেশ লাগলো । এর এক বিশাল ব‍্যবসায়িক দিক ও পরিকাঠামো আছে। অন‍্যকে ভাঙচি দিয়ে দলে টানার প্রচেষ্টাও কম নয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন