এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মুমতাজ মহলের মৃত্যু 

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ জুলাই ২০২৩ | ২৮৯ বার পঠিত
  • ষোলোশো একতিরিশের সতেরোই জুন চোদ্দতম সন্তান প্রসবের সময় মুমতাজের শরীর মারাত্মক বিগড়য়। মেয়ের জন্ম দিলেন তিনি - সে বেঁচে যায়, নাম রাখা হচ্ছে গৌহারা বা হীরে জড়ানো মেয়ে। কিন্তু মুমতাজের রক্তপাত হতেই থাকে। বড় বড় হেকিমরা ইউনানির দাওয়াই নিয়ে উপস্থিত। তাতে কাজ হচ্ছে না। চিকিৎসায় কাজ না হলে গ্যালেনের মতাবলম্বী হেকিমরা শরীরের চার মূল উপাদানের বা হিউমরের ঘনঘোর ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করলেন, মোদ্দা কথা সবকিছুই বিগড়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের পরিভাষায় মুমতাজের গর্ভ পরবর্তী রক্তপাত বা পোস্টপার্টাম হেমারেজ হচ্ছে। তা থামান না গেলে মৃত্যু হয়। মুমতাজের মৃত্যু হল, কেউ রুখতে পারল না। মৃত্যু হচ্ছে বুঝতে পেরে বেগম বড় মেয়ে জাহানারাকে বলেন শাজাহানকে ডাকতে।বাদশাহ তাঁর মাথার পাশে,মুমতাজ তাঁকে কিছু বলেন যার মধ্যে তাজ মহল বানানোর গল্প ঢুকে যায়। কিন্তু এভাবে কি তাজ মহল বানানো যায় ? সেরা নির্মাতা আর স্থপতিদের তালমিল ছাড়া কোন ঘ্যাম স্থাপত্য অসম্ভব। মুমতাজের মৃত্যু সজ্জায় শাজাহান ছাড়া অন্য শাহাজাদাদের উপস্থিতিও হারেমের কঠোর আদব কায়দায় অসম্ভব। শাজাহান খুবই ভেঙে পড়লেন। গল্প হল - এরপরই রাতারাতি তাঁর মাথার সব চুল আর দাড়ি সাদা হয়ে যায়। এর কোন প্রমাণ ছবি টবিতে নেই বরং পরবর্তী কিছু ছবিতে সেসব দিব্বি কালো দেখাচ্ছে। তবে শাজাহানের খুব ভেঙে পড়ার কথাটার পাথুরে প্রমাণ ছাড়াও বেশ কিছু তত্ত্বগত ভিত্তিও আছে।

    এব্বা কচ সেই আশির শেষে ষোলোশো আটচল্লিশে তৈরি শাহজাহানের সিংহাসন জরোখা ই খাস উ আমের পেছনের দেওয়ালে ফ্লোরেন্সের কমদামী মোজেইক পাথরে খোদাই (pietra dura) অর্ফিয়ুসের ছবি খুঁজে পেলেন। সেই থেকে এই সিংহাসনকে রাজা সলোমনের সিংহাসনের প্রতিরূপে হিসেবে দেখা হয়। ছ মিটারের বেশি উঁচু সিংহাসনের থাম্বাগুলো যেন খেঁজুর গাছের প্রতীক যেমন সব ইহুদি আর আরবীয় সূত্রে বলা আছে। অর্ফিয়ুসের ছবির তলাতেই পশু পাখির মোজেইক খোদাইও আছে। ওই ছবিটার গুরুত্ব অশেষ, ওটা কোরান কথিত আদর্শ রাজা সলোমনের দিকে ইঙ্গিত করে। এমন ন্যায়ের রাজা যাঁর কথায় বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় আর সুখশান্তি বিরাজ করে। এরপর শিল্প ইতিহাসের গবেষণায় দেখা গেল মোঘল বাদশাহরা বিশেষ করে জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান প্রেমের রাজা মজনু, সলোমন ও গ্রীক পুরাণের শান্তি আনয়নকারী বীনবাদক -কবি অর্ফিয়ুসের নানা প্রতিরূপে নিজেদের কল্পনা করে গেছেন। সেসব অসংখ্য ছবি হাতে আঁকা, ছবি সাঁটানো অপূর্ব চিত্রিত এ্যালবামে রয়েছে যাদের বলা হত মুরাক্কা। দুঃখের বিষয় এই সব ছবি লুটপাটের ফলে হয় ইরান নয় ইউরোপ আমেরিকায় রয়েছে।এখন প্রশ্ন হল এর মধ্যে মজনু আসছে কোথা থেকে বেদুইন লোকগাথায় লায়লা মজনু গল্পের প্রেমে পাগল মজনুকে নিয়ে অমর কাব্য রচনা করেন ইরানী কবি নিজামি ত্রয়োদশ শতকে । একশো বছর পর চতুর্দশ শতকে আমির খুসরুও ওই লোকগাথা অবলম্বনে লিখছেন পরিবর্তিত “মজনু লায়লা” কাব্য যেখানে মজনুর নামটা আগে চলে গেছে। দেখা যাচ্ছে মূল গল্পটা নানাভাবে পরিবর্তন হয়ে চলেছে। নিজামিও পাগল মজনুতে রাজা রাজা ভাব আরোপ করেছিলেন- তার বন্য পশুদের অক্লেশে পোষ মানানোর ক্ষমতার জন্য। ইরানের গুলিস্থান প্যালেস মিউজিয়ামে জাহাঙ্গীরের মুরাক্কা ই গুলশান এলবামে শিল্পী বাসায়ানের আর তাঁর ছেলে মনোহরের আঁকা দুটো লায়লা -মজনুর ছবি আছে দুটোতেই পোষ মানানো বন্য  পশুদের চারপাশে দেখা যায়। অক্সফোর্ডের বুডলেয়েন লাইব্রেরিতে ষোলোশো চল্লিশ -পঞ্চাশে শাজাহানের আমলে অজানা শিল্পীর আঁকা লায়লা -মজনুর ছবি আছে  চার পাশে নিশ্চিন্তে শুয়ে একই সঙ্গে হরিণ ও শ্বাপদ। মজনুর রাজকীয় উপস্থিতিতে বিরাজ করে শান্তি। সব কটা ছবিতেই মজনুর উপসস্থাপনা বিরহ কাতর, না খেয়েদেয়ে কাঠিপানা - বিরহী অথচ রাজকীয়। জাহাঙ্গীর আর শাহজাহান এরকমই এক রাজাসুলভ মজনুর রূপক –এ নিজেদেরও কল্পনা করেছিলেন। করেছিলেন। 

    মুমতাজের সঙ্গে শাহজাহানের প্রায় একপত্নীক সম্পর্ক আর পরবর্তীতে মুমতাজের অকাল মৃত্যুতে বাদশাহের শোকগ্রস্থ দশা, তাঁর এই প্রেমিক রাজা মজনু সুলভ ভাবমূর্তির সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ। এর অন্তিম পরিণতি হল তাজমহলের নির্মাণ । বোঝাই যায় সালতানাতের সেক্রেড সভরিনিটি- স্বর্গীয় আশীর্বাদের মতাদর্শে পুষ্ট হয়ে, বাদশাহের ব্যক্তিগত শোকবিহ্বলতা, সলোমন-অর্ফিয়ুস-মজনুর আদর্শে, এক শাহী প্রকল্পে রূপায়িত হয়েছিল সফল ভাবে। একই সঙ্গে নির্মাণ করা হয় বিরহ গাথার ধারণা ও তাজমহল সৌধ, দুটোই ব্যাপক লোকমান্যতাও পেয়েছিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন