এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ওটিটি ও সিনেমায় মিথ্যে ঐতিহাসিক ন্যারেটিভের চাষ

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ মে ২০২৩ | ৫৫৭ বার পঠিত
  • টেকনোসেন্ট্রিক সমাজে হিউম্যানিটিজ পড়লে চাকরি মেলে না। ভারতীয় সমাজের চালিকা শক্তি হল পরিষেবা প্রদান বাবদ আয়ের ক্রমবৃদ্ধি। উৎপাদন ও উৎপাদক এ সমাজে ব্রাত্য। এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বাস্তব উৎপাদন সম্পৃক্ত কোর ব্রাঞ্চগুলোর ছেলেমেয়েরাও পরিষেবা ক্ষেত্রের সাপ্লাই চেনের অনেক বেশি মাইনের কাজে বেশি উৎসাহী। এই ইন্সুরেন্স-আইটি-এন্টারটেনমেট সেক্টরের  যোগে আইস মডেল বা তার  আগে রিয়েল এস্টেটকে রেখে রাইস মডেলই নবতর সমৃদ্ধির সমার্থক। এর ফলে যে নলেজ সিস্টেম গড়ে উঠছে তা মুখস্থ বিদ্যে নির্ভর ও একঘেঁয়ে । সেই জ্ঞানচর্চার পরিসরে সমালোচনামূলক মানববিদ্যার চিরন্তন শাস্ত্র ইতিহাস সবচেয়ে অবহেলিত। ডায়নামিক প্রকল্পগুলোর বদলে একগুচ্ছ বাইনারি আর পচা চালু অতিকল্পদোষদুষ্ট ন্যারেটিভ দিয়ে ঔপনিবেশিক যুগ থেকে ইতিহাসের প্রাণসত্ত্বাকে মেরে ফেলার চেষ্টা চলেছে। কিন্ত এত করেও হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা এখনও এই ভারতের সর্বত্র ব্যাপ্ত নয়। তাই ওটিটি আর সিনেমাগুলো দিয়ে অডিওভিস্যুয়ালি নানা নবতর ন্যারেটিভ নির্মাণকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি যে তাজ নামক আকবরের  সময়কালে জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে  ওটিটি বানানো হয়েছে যাতে মোঘল শাহজাদাদের ঘরে বাইরের জীবনই প্রধান। শাহজাদাদের দৃষ্টিতে মোঘল সাম্রাজ্যকে দেখাটা আধুনিক ইতিহাস শাস্ত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। প্রখ্যাত ইতিহাসকার মুনিস ডি ফারুকির প্রিন্সেস অফ মোঘল এম্পায়ার বইটা এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য । বইটায় শাহাজাদাদের বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে মোঘল সাম্রাজ্যের আঁতাতকামী ভূমিকা ও বিদ্রোহের রক্তস্নাত  জমিতে  নতুন নতুন প্রভাবক্ষেত্রে সামাজ্যের বিস্তারের গবেষণা যুগান্তকারী। ইতিহাসে আনারকলি বলে কেউ ছিলেন এর কোন প্রমাণ নেই। নতুন তাজ ওটিটিতে এই প্রোজেক্টের রূপায়নের নামে সেলিম তথা জাহাঙ্গীরের মিথ্যে প্রেমের ন্যারেটিভটাকে শাহজাদাদের নিজেদের বা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সংঘাতের কেন্দ্রীয় বিষয় করা হল। পুরনো বলিউডি মোঘল এ আজমের গাঁজাখুরি সেলিম-আনারকলি মহব্বতের  গল্পটার একটা ব্যয়বহুল রিমেক ছাড়াও আর কিছু নির্লজ্জ মিথ্যা পরিবেশনও করা হয়েছে তাজ ওটিটিতে। 

    *গুরুত্বপূর্ণ মোঘল তারিখ রচনাকারী বাদাউনি ও পৃথিবীর প্রথম গেজেটিয়ার আবুল ফজলেকে কুচক্রী শয়তান হিসেবে পরিবেশন করে নতুন ন্যারেটিভ রচনা করা হল । স্মৃতি নির্ভর তারিখ কখনই ইতিহাসের সব গ্রন্থিগুলো জুড়েও আরো কিছু প্রশ্ন অবিষ্কারের ওপেন এন্ডেড ঐতিহাসিক  প্রকল্প নয়। তবে বাদউনির মন্তখাব উত তাওয়ারিখ আকবরের শাসনকালের এক সমালোচনামূলক বিবরণ যা সম্রাটের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীরের আমলে প্রকাশিত হয়। বইটা অনেকাংশে নির্ভরযোগ্য বলে ইতিহাসবিদরা মানেন। কিঞ্চিৎ গোঁড়া বাদাউনি আকবরের ধর্মীয়  প্রকল্পের সমালোচক ছিলেন বটে। তবে তাঁকে যেভাবে ডিমনাইজ করা হয়ে এমনকি সেলিমের হাতে তাঁর মুন্ডু কাটার গল্প তৈরি হয়েছে তা ইতিহাসের পরিকল্পিত ইসলামোফোবিক বিকৃতি। এই বাদাউনিই কিন্তু গোপনে আকবরের রাজত্বের সমালোচনামূলক ইতিহাস  রচনার সঙ্গে সঙ্গে রামায়ন, মহভারতেরও ফার্সিতে অনুবাদ করেছিলেন সে কথা বেমালুম চেপে যাওয়া হল নতুন ন্যারেটিভে। আসলে জহাঙ্গীরের বিদ্রোহ চলা কালীন আবুল ফজলেরই ওইভাবে মুন্ডু কাটা যায় আর জাহাঙ্গীরের নির্দেশে  সে কম্মটা করে ওরচা রাজা বীর সিং বুন্দেলার ফৌজ। 

    আবুল ফজলকেও এক ষড়যন্ত্রকারী ও নিজের ইচ্ছেমতো আকবরনামা রচনাকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে তাজ ওটিটিতে। অথচ আকবরনামার তৃতীয় খণ্ড আইন ই আকবরি এক অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য  পলিটিক্যাল ইকোনমির বই যার দেওয়া বিস্তারিত তথ্য যাচাই করে  তবেই তার ভিত্তিতে শিরিন মুসভির যুগান্তকারী বই ইকোনমি অফ মোঘল এম্পায়ার রচিত হয়েছে। এই বইটা সারা পৃথিবীর পণ্ডিত মহল রেফার করেন। 

    মোঘল ক্রনিকলারদের লেখাই না সিলেবাস থেকে বাদ গেল! সে জন্যই কি নয়া ন্যারেটিভের আড়ালে এই ডিমনাইজ করা?

    *এক নতুন বাইনারির জন্ম দিয়েছে এই তাজ ওটিটি। সেটা হল আকবর- জাহাঙ্গীর বাইনারি। মুঘল এ আজমের প্রেম ও প্রতিহিংসা  প্রকল্পকেও ছাড়িয়ে গেছে এই মিথ্যেচার । যার উদ্দেশ্য হল আকবরের বিপরীতে জাহাঙ্গীরের সব ভালো প্রমাণ করা ছাড়াও কিছু কাজ আড়াল করা। যেমন সবাই জানে বিদ্রোহের পর ধরা পড়লে প্রথম সন্তান খুসরুকে প্রায়ান্ধ করে দেয় মহবত খানের ফৌজ। সমস্তটা ঘটে বাদশাহ  জাহাঙ্গীরের আদেশে। এই ওটিটি দেখাচ্ছে আকবরের সময়েই ছোট খুররাম বা শাজাহান খেলার ছলে কাঠির খোঁচা মারছেন ছোট খুসরুর এক চোখে।  অপারেশন করে বাদ দেওয়া হচ্ছে ওই চোখ। অর্থাৎ ছেলেকে প্রায়ান্ধ করায় জাহাঙ্গীরের আর দায় থাকবে না। তাজ ওটিটিটা এখনও পুরো শেষ হয়নি।  আরো নানা গুল-গল্প প্রচার করে চলবে কি ? আপাতত যা হয়েছে তাতেই চোখ ছানাবড়া!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন