এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কবি বিকাশকুমার সরকারের মৃত্যু এবং প্রাসঙ্গিক দু’একটি কথা

    Kajal Sen লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ এপ্রিল ২০২৩ | ৫৪৪ বার পঠিত
  • (এই প্রতিবেদনটি আমি লিখেছিলাম ২০১৮ সালে ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ৫২তম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে। আজ অনেকদিন পরে লেখাটি পড়ে মনে হলো, এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। আর তাই আমার ‘গুরুচন্ডা৯’র বন্ধুদের পড়ার জন্য পুনঃপ্রকাশ করলাম।)

    সদ্য প্রয়াত কবি বিকাশকুমার সরকারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয়ের কোনো  সুযোগ অতীতে হয়নি। আর তাঁর অকাল প্রয়াণের দরুণ ভবিষ্যতেও সেই সম্ভাবনা থাকল  না। তবে তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, কেননা তিনি কবিতা লিখতেন। দুঃখের কথা, তিনি একটি স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে যখন অন্যান্য আরও কয়েকজন কবির সঙ্গে মঞ্চে বসেছিলেন তাঁর নিজের কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণের অপেক্ষায়, ঠিক তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরই সঙ্গে মঞ্চে আসীন এক কবিবন্ধু শান্ত্বনু সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মঞ্চের বাইরে নিয়ে আসেন এবং শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় অবিলম্বে অনতিদূরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁর এই আন্তরিক তৎপরতা সত্ত্বেও বিকাশকুমার সরকারকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।  

    বিকাশকুমার সরকারের প্রয়াণসংবাদ যথাসময়ে কবিতা পাঠের আসরে পৌঁছেছিল  কিনা, সেদিন যাঁরা সেই আসরে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাই সঠিক বলতে পারবেন। কিন্তু বিকাশ যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে উপস্থিত সবাই অবগত ছিলেন। না, সেদিন বিকাশ তাঁর কবিতা সর্বসমক্ষে পাঠ করতে পারেননি। কবি শান্ত্বনুও কবিতা পাঠ করতে পারেননি। কিন্তু উপস্থিত অন্যান্য সব কবিরাই নিজেদের কবিতা পাঠ করেছিলেন। কেননা বিকাশ ও শান্ত্বনু কবিতা পাঠের মঞ্চ থেকে নেমে যাবার পরও কবিতা পাঠের আসরে কোনো বিরতি ঘোষণা হয়নি এবং উপস্থিত কবিরা তাঁদের কবিতা পাঠে নিমগ্ন ছিলেন।

    কবিতা পাঠের আসরের এই দুঃখজনক ঘটনাটির পাশাপাশি, সেদিন সেই আসরে  উপস্থিত কবি ও কবিতার শ্রোতাদের এবং একইসঙ্গে আসরের কর্মকর্তাদের আচার ও আচরণ সম্পর্কে ফেসবুকে অনেক আলোচনা-সমালোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে। নিন্দা-মন্দও করা হয়েছে। একটু আগেই যে কবি সশরীরে কবিতা পাঠের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, সামান্য কিছু পরেই তাঁর প্রয়াণসংবাদ এসে পৌঁছনো সত্ত্বেও কবিতাপাঠ কেন স্থগিত করা হলো না, কেন সদ্য প্রয়াত কবিকে দেখতে হাসপাতালে যাবার কেউ কোনো প্রয়োজন বোধ করলেন না, এটা ভাবলে সত্যিই  আশ্চর্য হতে হয়! এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত লজ্জাজনক অমানবিক ব্যাপার। এবং এজন্য যে তাঁরা নিতান্ত নিন্দনীয়, তাতেও কোনো সংশয় নেই।  

    কিন্তু এরপর এই ঘটনাটির প্রাসঙ্গিকতায় আরও কিছু অন্য প্রসঙ্গের কথা এসেই যায়। ফেসবুকে দেখলাম, কেউ কেউ সেদিনের উপস্থিত কবিদের নির্লিপ্ত আচরণের সমালোচনা করে লিখেছেন, কবিতা পাঠের জন্য কবিদের এত হ্যাংলামি কেন? কবিতা পাঠ করে কি তাঁরা কবি রূপে প্রতিষ্ঠালাভ করেন? বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট কবি মন্তব্য করেছেন যে, কোনো কবিতা পাঠের আসরে যখন কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত কবি বা কথা সাহিত্যিক আসেন, তখন তাঁরা তাঁদের আসা ও ব্যস্ত সময় ব্যয় করার জন্য অর্থসম্মান নিয়ে থাকেন। অথচ অন্যান্য সাধারণ কবিরা নিজ ব্যয়ে ছুটতে ছুটতে আসেন, যদিও এভাবে আসার জন্য কবি রূপে তাঁরা কখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করেন না। অর্থাৎ এটা নিতান্তই একটা হ্যাংলামির ব্যাপার। না, এটা তেমন অযৌক্তিক কথা নয়, কবিতা সভায় শুধু কবিতা পড়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করা সত্যিই যায় না। বস্তুত পক্ষে, বাংলা কবিতা নিয়ে দীর্ঘদিন যে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, যেভাবে প্রায় প্রতিদিন কবিতার বাঁকবদল হয়ে চলেছে, সেইসব কবিতা কবির মুখে একবার শুনে তা অনুধাবন করা আদৌ সম্ভব নয়, এবং সে চেষ্টাও কেউ করেন না। অর্থাৎ কবিতা শুধু পড়াই হয়, শোনা হয় না। বোঝা ও রসগ্রহণ করা তো অনেক দূরের কথা। কিন্তু তাসত্ত্বেও বলতে হয়, যেখানে সুপ্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকরা অর্থলাভের জন্য কবিতা বা সাহিত্যসভায় যোগদান করেন, তার বিপ্রতীপে কিন্তু অসংখ্য পরিচিত-অপরিচিত, সামান্য প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত, দক্ষ-শিক্ষানবিস কবিরা  নিজের পকেটের অর্থ খরচ করে দূর দূরান্ত থাকে অনেক কষ্ট সহ্য করে ছুটে ছুটে আসেন শুধুমাত্র কবিতা ও কথাসাহিত্যকে ভালোবেসে। এই ভালোবাসাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। হ্যাংলামির অপবাদ দিয়ে তাঁদের উপেক্ষা করাও ঠিক নয়।  তবে আমি মনে করি, সেদিন বিকাশের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুসংবাদ শোনার পর কবিতা পাঠের আসরের সঙ্গে সঙ্গে সমাপ্তি ঘোষণা করা উচিৎ ছিল এবং উপস্থিত কবিদের বিকাশের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতাপাঠে বিরত থাকা উচিৎ ছিল। আর  সেদিন কবিবন্ধু শান্ত্বনু ছাড়াও আরও দু’ তিনজন কবি হাসপাতালে গেছিলেন, কিন্তু  সেই সংখ্যাটা যদি আরও বেশি হতো, তাহলে তা শোভন হতো।

    একবিংশ শতাব্দী সতেরো বছর পূর্ণ করে আঠারোয় পা রাখল। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, একবিংশ শতাব্দী এতদিনে সাবালক হলো। কিন্তু খুব দুঃখ লাগে, যখন দেখি আমাদের মধ্যে অনেকেরই যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্ত্বেও অনেক ব্যাপারেই এখনও সাবালক হয়ে উঠতে পারিনি। বিকাশের অভাবিত মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে তা আবার প্রত্যক্ষ করে লজ্জিত হলাম।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন