এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বর্বরিক ওরফে খাটু শ্যামের উপাখ্যান (প্রথম পর্ব)

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ মার্চ ২০২৩ | ৬৫১ বার পঠিত
  • পুরাণ এবং ইতিহাসকে পরস্পরের বিরোধী বলতে পারেন অনেকেই, কিন্তু পুরাণের বা মহাকাব্যের অনেক চরিত্রের এই পৃথিবীতে বসবাস ছিল এটার সত্যতা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। আবার সময়ের হিসেবেও পুরাণ এবং ইতিহাস বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই একই ফলাফল দেয়, যা বড়ই আশ্চর্য্যের। স্থানীয় লোকেদের কাছে সেইসব চরিত্রের যেসব কাহিনী জানা যায় বা স্থানীয় যেসব নিদর্শন পাওয়া যায় তা পুরাণের বর্ণনার সাথে বেশীরভাগই মিলে যায়। লোককাহিনী মিলে যাওয়ার কারণ হয়তো তারাও সেই পুরাণের কথাই বলছেন কিন্তু নিদর্শনগুলো মিথ্যা বলতে পারে না কোনোভাবেই। পৌরাণিক নাম হয়তো বা পাল্টে গেছে, অবক্ষয় হয়েও থাকতে পারে। আবার যুক্তি দিয়ে বিচার করলে সেইসমস্ত স্থান এই পৃথিবীর কোথায় হতে পারে তার হিসেবেও পাওয়া যায়। 

    পুরাণে বর্ণিত ইলাবৃতবর্ষ কোথায় হতে পারে সেই তর্কে না গিয়ে এই নামকে অস্বীকার করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। যেমন বারণাবত কোথায় জানতে চাইলে বর্তমান ভারতবর্ষের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দিল্লীর খুব কাছে উত্তরপ্রদেশের বাগপথ জেলায় অবস্থিত একটি গ্রামের নাম বারণাভা। জায়গাটি মিরাটের কাছে সারধানা এবং বীণৌলির মধ্যে অবস্থিত। এটি বীণৌলি থেকে প্রায় ৩ কিমি এবং মিরাট থেকে ৩৭ কিমি দূরে। হস্তিনাপুর থেকে পাণ্ডবদের জতুগৃহতে পাঠানোর কথা ভাবলে বলতে হয় যে, যেখানে জতুগৃহটি বানানো হয়েছিল সেটা নিশ্চয়ই হস্তিনাপুর থেকে বেশী দূরে হবে না। সুতরাং এই বারণাভা নামটি বারনাবত থেকে অপভ্রংশ হয়ে এসেছে বলেই মনে হয়। কিন্তু এখানে কোনো জতুগৃহের নিদর্শন পাওয়া যায় না যদিও স্থানীয় মানুষেরা আজও বিশ্বাস করে যে সেখানে জতুগৃহ আছে। এই জতুগৃহের কথা বলতে গেলে আর একটি নাম চলে আসে আমাদের মনে, তিনিও একটি পৌরাণিক চরিত্র, হিড়িম্বা। মহাভারতে এই হিড়িম্বা ছিলেন পাণ্ডবপুত্র ভীমের স্ত্রী। কিন্তু হিমালয়ের পাদদেশে মানালি শহরে গেলে সেখানে পাইন-দেবদারু ঘেরা প্যাগোডা স্টাইলে নির্মিত এক মন্দির দেখতে পাওয়া যায় যেখানে উপাস্য দেবতা এক ‘রাক্ষসী’। নাম তাঁর হিড়িম্বা। ইতিহাস তাঁকে রাক্ষসী বলে চিনলেও স্থানীয়দের কাছে তিনি মা। তিনি ‘মানালির মা হিড়িম্বা’। মানালির হিড়িম্বা মন্দিরটি সম্ভবত তৈরি হয়েছিল ১৫৩৩ সালে। মন্দিরের ভিতর রয়েছে বিরাট এক কালো রঙের পাথর। লোকের বিশ্বাস ওই কালো পাথরের নিচেই ধ্যানে বসতেন মা হিড়িম্বা। গোটা মন্দির জুড়েই অসাধারণ কাঠের কাজ। গোটা মন্দির সাজানো রয়েছে বিভিন্ন পশুর শিঙ দিয়ে। রয়েছে এক বিশাল আয়তনের পায়ের ছাপ। স্থানীয়দের বিশ্বাস সেই পায়ের ছাপ নাকি স্বয়ং মা হিড়িম্বার। চারিদিকে পাইন আর দেবদারু গাছের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ঠিকরে পড়া আলো সৃষ্টি করে এক মায়াবী আলো-আঁধারি পরিবেশ। নবমী বা নবরাত্রির দিনে যখন সারা দেশ মা দুর্গার পুজো করেন তখন মানালি মেতে ওঠে এক ‘রাক্ষসী’র আর মাতা হিড়িম্বার পূজায়। আবার হিড়িম্বা মন্দির থেকে খানিক এগোলেই চোখে পড়বে আরও এক মন্দির, যা আকৃতিতে তুলনামূলক ছোট। সেটি হিড়িম্বা এবং ভীমের সন্তান ঘটোৎকচের মন্দির। সেই ঘটোৎকচ মহাভারত অনুযায়ী যিনি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় পাণ্ডব পক্ষে যোগ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস আজও হিড়িম্বা মা আপদে বিপদে রক্ষা করে চলেছেন তাঁদের। রক্ষা করছেন গোটা অঞ্চলকে। ফলে এখানে রহস্য, ইতিহাস আর পুরাণ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। এইরকম উদাহরণ শত শত দেওয়া যায়। পুরাণ এবং ইতিহাসের বিরোধকে তাই শিকেয় তুলে বরং ইতিহাসের পাতায় পুরাণের খোঁজ করাটাই শ্রেয় বলে মনে হয়।

    রামায়ণ বা মহাভারত এখনও তাদের জাদু বজায় রেখেছে আপামর ভারতবাসীর মনে। তবে আমাকে প্রশ্ন করলে বলবো, মহাভারত আমাকে অনেক বেশী আকর্ষণ করে। সেই ইলাবৃতবর্ষ থেকে শ্রীলঙ্কা অব্দি অনেক নিদর্শন পাওয়া যায় আজও মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের। তুলনায় রামায়ণ অনেক বেশী সরল এবং ধর্মীয়। মহাভারতের রাজনীতি, জটিলতা, ধর্মীয় মোড়কে কুটিলতা আমাকে অনেক বেশী টানে। মন ঘুরে বেড়াতে চায় সেই সময়ে, সেই সময়ের জম্মুদ্বীপে, আকর্ষণীয় চরিত্রগুলোর সাথে। বারণাবত আর বারনাভা যদি এক না হয় তাহলে হিড়িম্বার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে হয়, মানালির সেই মন্দির মিথ্যা হয়ে যায়। আবার বারনাভা না হয়ে অন্য কোনো নামেও বারণাবত থাকতে পারে আজকের দিনে তাহলে ধরতে হবে নামের আরও বেশীরকমের অপভ্রংশ হয়েছে, অবক্ষয় হয়েছে। 

    গরুড়পুরাণের বর্ণনায় দেখিতে পাই,-“জম্বুদ্বীপের মধ্যভাগে ইলাবৃতবর্ষ। এই বর্ষেই সুমেরু-পৰ্ব্বত অবস্থিত আছে। সুমেরুর পুৰ্ব্বভাগে ভদ্রাশ্ব বর্ষ, পূৰ্ব্ব-দক্ষিণ ভাগে হিরন্ধান বর্ষ, দক্ষিণে কিম্পূরুষ বর্ষ ও ভারতবর্ষ, দক্ষিণ-পশ্চিমে হরিবর্ষ, পশ্চিমে কেতুমাল বর্ষ, পশ্চিমোত্তরে রম্যক বর্ষ ও উত্তরে কুরু বর্ষ"। আবার বায়ুপুরাণ অনুযায়ী জম্বুদ্বীপের প্রাচীন অধিপতি, মহারাজ অগ্নীধ্র এর ৯টি পুত্র ছিল। নাভি, কিম্পুরুষ, হরিবর্ষ, ইলাবৃত, রম্যক, হিরন্ময়, কুরু, ভদ্রাশ্ব এবং কেতুমাল। রাজা অগ্নীধ্র জম্বুদ্বীপকে ৯টি খন্ডে খন্ডিত করে নয় পুত্রকে ৯টি খন্ডের রাজা চয়ন করেন। রাজা নাভির নামে একটি বর্ষ বা খন্ডের নামকরণ করা হয়, যার নাম হয় – অজনাভ বর্ষ। রাজা নাভি এবং তাঁর পত্নী মেরুদেবীর এক পুত্র ছিলেন যার নাম ছিল ঋষভদেব। ঋষভদেব-এর সবচেয়ে বড় পুত্রের নাম ছিল ভরত। তাই অজনাভ বর্ষ বা খণ্ডের নাম হয় – ভারতবর্ষ। বর্ষ অর্থে দ্বীপ, প্রাচীনকালে নামের পরে দ্বীপ জুড়ে দিয়েই এলাকার নামকরণ হতো। কারণ আজকের মত সাম্রাজ্যগুলো এত বহুধাবিভক্ত ছিল না। পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী এইসমস্ত সাম্রাজ্যগুলোর তিনদিকেই সমুদ্র ছিল, তাই দ্বীপ হিসেবেই পরিচিত ছিল।

    এই হিসেবে ধরলে বর্তমানে যে স্থানে পামির মালভূমি, সেই স্থানেরই পূর্ব নাম ইলাবৃতবর্ষ। এই ইলাবৃতবর্ষেই আদিকালে দেবতাদের বসবাস ছিল। কিন্তু দেবভূমিতে না গিয়ে বরং আদি ভারতবর্ষেই ফিরে যেতে চাইছে মন। দেবতারা তাঁদের জায়গায় থাকুন, ঋষিদের বাসস্থানের নাম অপভ্রংশ হয়ে যতই রাশিয়া হোক না কেনো, মন ছুটে চলেছে অজনাভবর্ষের দিকে। রাজা অগ্নীধ্রের পুত্র নাভির রাজ্য, তস্যপুত্র ঋষভদেবের জ্যেষ্ঠপুত্র ভরতের রাজ্যে। দিনকাল, সময়ের হিসেবে আজ থেকে পাঁচ হাজার একশ বছর আগের ভারতবর্ষে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সন্তোষ কুমার রায় | 2409:4060:11f:4057:d081:b3f:ed6:42ca | ০৪ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:১৩518254
  • তুমি তো এক্কেবারে গবেষনা পত্র তৈরী করে ফেললে গো। চালিয়ে যাও। বেশ আকর্ষক 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন