এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অণুগল্প মৌলিক 

    Biman Kumar Maitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ মার্চ ২০২৩ | ৩১৯ বার পঠিত
  • অণুগল্প 
    বিমান কুমার মৈত্র 

    কোকিলের বায়স বাস

    হারমোনিয়ামের গলা শুনলেই ব্যারাকপুর স্টেশনের টু-এ প্লাটফর্মের আনন্দী ভিখারিণীর কথা মনে পড়ে। তার একান্ত হারমোনিয়ামটি যে বাদামি ফিতেটি পরেছিল, সময় তার ওপর এক ময়লা, পিচ্ছিল মসৃণতা তৈরি করেছিল। আনন্দীর পাশে থাকতো তার মরদ, আরও এক জন্মান্ধ। মুখে গুটি বসন্তের দাগ, সামনে একটি পোড়ামাটির উল্টানো হাঁড়ি। হাতের তালুর সোহাগে সোহাগে তার পিঠের এক জায়গায় গাঢ় কালচে লাল বর্ণ হয়ে যায়। সবাই তাকে খগেন হাঁড়ি বলেই চিনতো। হারমোনিয়াম গাইতো আর হাঁড়ি তাল দিত। 

    স্টেশনের টু-এ প্ল্যাটফর্মটি ব্যারাকপুর লোকালের জন্যই বরাদ্দ ছিল। শিয়ালদা থেকে আসা লোকালটি যাত্রী খালাস করে প্রায় কুড়ি মিনিট বিরতি দিত। সকাল বিকেল মিলিয়ে এই দশ বারোটি ট্রেন ক্রমে যাত্রীদের খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। গাড়ী প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে না ঢুকতেই  নিত্যযাত্রীদের ব্যাগ সব সিট দখল করে নিত আর তার মালিকেরা ওই দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়তো। হারমোনিয়াম অবশ্য তার আগেই  গান শুরু করে দিত আর জমায়েত বাড়লেই খগেন হাঁড়ি তার। অমন বাজনা এ তল্লাটে আর কখনো শোনা যায় নি। ভেতরে খুচরো পয়সা থাকায় অনুষ্ঠানটি বেশ একটা কনসার্টে পরিনত হত। 

    ব্যারাকপুর লোকালে হলুদ বাতির গুঞ্জনের সাথে গানের লাল বাতিও জ্বলে ওঠার তোড়জোড় শুরু হত। অর্থাৎ, সামনের কাপড়ে ছড়িয়ে থাকা খুচরো পয়সা গোনার কাজ। তখন কেউ উপস্থিত থাকলে সে খগেন হাঁড়ির বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে দুটো চোখ অবশ্যই দেখতে পেত। একগাড়ি অনুষ্ঠানের শেষে আনন্দী বিড়ি ধরিয়ে বলতো, ঠিক মতো কাউন্ট করিস। উড়িয়ে দেয়া ধোঁয়ার গন্ধ কাউন্টেসের বেশ মিষ্টি লাগতো। 

    ইতিমধ্যে একদিন ওদের পাশে আর একটি কমবয়সী অন্ধকে করতাল নিয়ে গানের সাথে গলা সংগত করতে দেখা গেল। মোটা এবং খাটো। রসকলি সমৃদ্ধ মুখের সাথে চেহারাটা বেশ গতর গতর। পড়নের শাড়ির রঙ হলুদ। নাম জিজ্ঞাসা করলে শুধু হাসতো। সবাই তাকে হলুদশাড়ি নামে ডাকতে শুরু করলো মনে হয়, করতাল-মালকিনেরও এমন বর্ণজ নাম  যারপরনাই পছন্দই হল। 

    ভীড়ের তাপমাত্রা উর্ধ্বমুখী, সাথে রোজগারও। ভূপেন-চা এবং নাড়ু-গরমগজার ফিতেরাও বসল। জানা গেল, সন্ধ্যের বয়স্ক লোকেরা চার নাম্বার প্ল্যাটফর্মের মশা ছেড়ে টু-এতে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। 

    প্রায় এক বছর হয়ে গেল। দিব্যি রোজগার হওয়ায় আকাউন্টেন্ট আনন্দীর মুখেও হাসি। এই ফ্যাসফ্যাসে হারমোনিয়ামকে এবার সে বিদায় জানাবে।  বদলে নতুন একটা কিনবে। সেটা কেমন গাইবে, ভাবতে ভাবতে আনন্দী প্রায়ই উদাস হয়ে যেত। অনেক না-তোলা গান সে তার নতুন হারমোনিয়ামকে দিয়ে গাওয়াবে।

    উদাসী কথাটা আসতেই আর একটি তথ্য জানানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কারণ, 'দিব্যি রোজগারের' সাথে উল্লিখিত শব্দটির একটি সম্পর্ক ছিল। এগারো বছরের ওপর বিয়ে টিকে আছে, কিন্তু ---- বিয়ের বছর দুয়েক পর থেকেই এই 'কিন্ত' নাম্নী জোঁকটির লবন ওরা যোগার করতে পারলো না। এর মধ্যে কখন যে জোঁকটি বংশ বৃদ্ধি করে ফেলেছ, আনন্দী হারমোনিয়াম সেটা টের পায় নি। টের পাওয়ার পর দেখা গেল হলুদ শাড়ি গলা সংগত না করে বিমর্ষ মুখে কেবল করতালই বাজাচ্ছে। 

    এক্ষেত্রে যেমন হয়, তারচেয়ে আলাদা কিছু হলনা। জানা গেল সকালে গান আর রাতে করতাল-হারমোনিয়ামের মধ্যে হাঁড়ি দখল নিয়ে রিতীমতো দাঙ্গা চলছে। লোকাল ট্রেনের নিত্যযাত্রী মাত্রই এ ধরনের খবরের সাথে অল্প বিস্তার পরিচিত। করতাল সাইড হয়ে যাওয়ার একশ্রেণীর শ্রোতাদের একটু কষ্ট হলেও হারমোনিয়ামের স্থান যে করতালের চেয়ে অনেক উঁচুতে, একথা কে না জানে। কিন্তু --- এই 'কিন্ত' শব্দটি ভয়ানক ছোঁয়াচে। আপনার জীবনে একবার ঢুকলে আর রেহাই নেই। এক্ষেত্রে আনন্দীর 'কিন্তু'টি বয়স-দর্শনীর জোরেই টিকে গেল।
         
    একদিন হঠাৎ আনন্দীর হারমোনিয়ামকে একাই গান করতে দেখা গেল। পুরনো হারমোনিয়ামটকেও আর পাওয়া যাচ্ছে না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন