এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কুকুরের নাম কালীচরণ 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ | ৫৭৩ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  •  
    ইন্দ্রাণীর গল্পে পোষা কুকুরের নাম কালীচরণ। ঠিক পোষা না, পোষ্যপ্রতিম। পড়ে আমার অলম্বুশের কথা মনে পড়ল। অলম্বুশ আমার খরগোশ ছিল। কদিন আগে মারা গেছে। কবে ঠিক জানিনা। শীত পড়ে গেছে, পিছনের বাগানে কে আর যায়। বাড়িতে কেউ ছিলওনা, একদিন দরজা খুলে দেখি, অলম্বুশ পাশ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে না। মৃত্যুর একটা ভঙ্গী আছে, যা দেখলেই বোঝা যায়, ঘুম নয়, নিয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা, সেইভাবে। কবে থেকে কে জানে। সেদিনও হতে পারে, আগেরদিনও, বা এক সপ্তাহ। ঠান্ডায় শরীর পচেনা এখানে।
    অলম্বুশ অবশ্য পোষা না। এমনকি প্রিয় কেউও না। বরং জ্বালিয়েছে প্রচুর। পিছনের বাগানে গরমকালে সব্জি-টব্জি ফলানো হত। টমেটো, কুমড়ো, আর কী-কীসব। আমি ঠিক জানিনা। আমার ডিপার্টমেন্ট ছিল জমি ঠিক করে বেড়া দেওয়া। জালের বেড়া ছিল। কিন্তু একদিন দেখা গেল, কোন এক গাছের ছিন্ন শির। এক ধুমসো খরগোশের কীর্তি। আর কোনো কাজ নেই, কোথা থেকে এসে বেড়া টপকে গাছ খেয়ে গেছে চুপচাপ। সেই থেকে ওর নাম অলম্বুশ।
    তারপর থেকে অলম্বুশের সঙ্গে আমার যুদ্ধ শুরু। বেড়া একটু করে উঁচু হয়। অলম্বুশ দুদিন থমকে থাকে। তারপর খুঁজে বার করে কোনো এক ফাঁক। ফাঁক বোজানো হয়। অলম্বুশ এবার একটা উঁচু জায়গা আবিষ্কার করে ফেলে। যেখান থেকে লাফ মেরে টপকানো যায় বেড়া। এইভাবে যুদ্ধবিগ্রহ চলতে থাকে। অলম্বুশ আমার খুব চেনা পরমাত্মীয় হয়ে যায়, কুরুক্ষেত্রের মাঠের ধারে,সূর্যাস্তের পরে যেমন অর্জুন আর দ্রোণ। পরের দিকে অলম্বুশ আর পালাতোও না আমায় দেখে। জুলজুল করে তাকাতো, অর্থাৎ কিনা চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্টেড। আমি বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে ঢুকে যেতাম ঘরে।
    সেই দরজা খুলেই সেদিন দেখি অলম্বুশ শুয়ে আছে। হেমন্ত শেষ হয়ে গেছে। বাগানে শুকনো খড়ের মতো সব্জির শরীর। আর বেড়ার বাইরে অলম্বুশ। শেষবার আর টপকাতে পারেনি।
    আমি ঘর থেকে নিয়ে আসি ময়লা ফেলার ব্যাগ। অলম্বুশকে তুলতে গিয়ে দেখি খড়মড় করছে শরীর। শক্ত। ঠেলে ঢোকাই ব্যাগে। তারপর বন্ধ করার আগে, কী ভেবে কে জানে, বাগান থেকে কটা খড়কুটো নিয়ে এসে ভরে দিই ব্যাগে। শেষযাত্রায় এরাও সঙ্গে যাক। পরদিন, ময়লা ফেলার গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যায় কফিন। দূর থেকে দেখি। ধপ করে শব্দ হয় গাড়িতে তোলার। আমার দুঃখ পাবার কথা থাকে, কম্পোজিশনের স্বার্থে, এই খানে। একটু পাইও। কিন্তু তারপর বেমালুম ভুলে যাই।
    তারপর অলম্বুশের কথা মনে পড়ল আজ, ইন্দ্রাণীর গল্পের কালীচরণের কথা পড়ে। সেও মরে যায় দুম করে। কিন্তু সেজন্য না। আমার অলম্বুশের কথা, কালীচরণ যার পোষ্য, সেই মেয়েটির মায়ের কথা পড়ে, যিনি, মনে করতেন, — নিজের মা-বাবা-ভাই-বোন, স্বামী, রবীন্দ্রনাথ, আর নিজের দেশকে যেন ভালোবাসতেই হয়, নইলে সবাই খারাপ বলে। মেয়ে বড়জেঠিমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বলায়, ভর্ত্সনা করেছিলেন, "মাকে সব থেকে ভালোবাসতে হয়, জানো না? অসভ্য মেয়ে কোথাকার!"
    তারপর মেয়ের বিয়ে হয় একদিন। ফুলশয্যার ঠিক আগে সানাই, রজনীগন্ধা, লোকজন পান মুখে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে, ডেকরেটরের লোক বালতি গামলা গোছাচ্ছে — তখন মেয়ে ভাবতে থাকে, মা ঝাঁঝিয়ে বলছে: "অসভ্য মেয়ে, বিয়ে করা বরকে ভালোবাসতে হয়, জানোনা?" এই জ্যান্ত লাইনটা পড়েই আমিও দেখতে পাই সেই মহিলাকে। ঠিক যেন আমার দিকে ফিরে ধমকে বলে উঠছেন, "পোষ্যকে ভালোবাসতে হয়, তার জন্য দু-দন্ড দুঃখ করতে হয়, জানোনা?"
    এত কিছু লিখে ফেললাম, ইন্দ্রাণীর নতুন বই নিয়ে দুকলম লিখব বলে, যেটা আমরা প্রকাশ করছি সামনের বুধবার। কালীচরণের যে গল্পটা লিখলাম, সেটা এই বইয়ে নেই। ওটা পুরোনো, কিন্তু নাড়াচাড়া করতে গিয়ে ওটা নিয়েই লিখে ফেললাম। এই বইটা আদৌ গল্পই না, আস্ত একটা উপন্যাস। ইন্দ্রাণীর প্রথম।
    কিন্তু অন্য জিনিস নিয়ে লিখে ফেলায় ক্ষতি কিছু হয়নি। এই উপন্যাসও উপাখ্যান হিসেবে আলাদা কিছু না। একই রকম জ্যান্ত। সিরিয়ালের গপ্পো একেবারেই না। কিন্তু অন্তর্ঘাতী। পড়তে গিয়ে বিপদে পড়তে হয়। কখন কোথায় নিজের সঙ্গে জুড়ে যাবে বোঝা মুশকিল। এই যেমন আমার হল। কাজেই পড়তে হলে সাবধানে পড়ুন।
    পুঃ বইটি প্রকাশ আজ । সল্টলেকের শ্রাবণী আবাসনের সমাজকেন্দ্রে। থাকছেন জয় গোস্বামী এবং অমর মিত্র। গুরু এবং বাংলা লেখালিখি, এই নিয়ে আলোচনা হবে। আশা করা যাচ্ছে, এটাই একমাত্র না। এর পরেও হবে। পারলে অবশ্যই আসুন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রাণী | ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:৪৫514894
  • বই প্রকাশের অনুষ্ঠান সুসম্পন্ন হয়েছে গরম চা ও অতি উৎকৃষ্ট সিঙাড়া সহযোগে। গতকালের সন্ধ্যা আমার কাছে নানা কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে-সম্ভবত আমৃত্যু।
    যাঁরা উপস্থিত ছিলেন সকলকে আমার তরফে অশেষ কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ। শহরে নেই অথবা আরো বিবিধ কারণে অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না-অপারগতা জানিয়ে অনেকেই মেসেজ করেছেন গতকাল সকালেই। হাফলঙের জোড়াগির্জার অসম্ভব সুন্দর ছবি সহ মেসেজ করেছিলেন দময়ন্তী অতি প্রত্যূষে-অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। সবাইকে ধন্যবাদ।
    গুরুচণ্ডা৯কে আলাদা করে কী বলব! লেখকের মর্যাদা গুরুচণ্ডা৯-ই আমাকে প্রথম দিয়েছে- সে কথা কখনও যেন না ভুলি।
    এই বইয়ের দত্তক যাঁরা নিলেন, তাঁদের সবাইকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। প্রুফ, প্রচ্ছদ, মুদ্রণ- এসবের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ।
    আর আমার সমস্ত পাঠকদের, -যাঁরা পড়েছেন, ভালোবেসেছেন, সমলোচনা করেছেন, সবাইকে আমার নমস্কার।
    আমার গুরু গাভাসকারের মতো হেলমেট খুলে ব্যাট তুললাম গ্যালারির দিকে, এবার নজর পিচে, কাঁকর খুঁটে ফেলে নতুন করে স্টান্স নিচ্ছি। পরের বলটা খেলব।
    আপনাদের শুভকামনায় যেন লিখে যেতে পারি।
  • বিপ্লব রহমান | ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:৪১515523
  • ব্রাভো ইন্দ্রাণী দি! ঢাকা থেকে শুভেচ্ছা!
    ~
    সৈকত দা, দারুণ লিখেছেন yes
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন