এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মন রে কৃষিকাজ জানোনা 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬৩১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • শ্রী অরিজিৎ সিং এর গাওয়া রামপ্রসাদী শুনলাম। এমনিতে কিছু বলার নেই, সুরেলা গলা, নড়েচড়েও খুবই ভাল, কিন্তু গান শুনে এবং দেখে মনে হল, রামপ্রসাদী নয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্থেম হচ্ছে। ভিডিওতে দেখা গেল, প্রথমেই সবুজ ধান্যক্ষেত্র, যেখানে চাষবাস হয়েছে। তারপর আলপথ দিয়ে হেঁটে এলেন নায়ক ও নায়িকা, যেমন সূর্যমুখী ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে একদা আসতেন শারুক্ষান। তবে পিছনে লারেলাপ্পা নয়, বাজছে সংস্কৃতিমনস্ক কৃষিকাজ-সম্পর্কিত গান, "মন রে কৃষিকাজ জানোনা"। অর্থাৎ, ক্ষেত সবুজ হলে কী হবে, অশিক্ষার ফলে চাষবাস কিন্তু মোটেও ভালো হচ্ছেনা। এই না-জানায় নায়ক-নায়িকা খুশিও একেবারেই না। বরং ব্যর্থ মাস্টারের মতোই খুবই তিতিবিরক্ত। চাষবাসের নামে হচ্ছে টা কী? সঙ্গে আছে আফশোষ, একটু ভালো করে পড়লিনা রে? ইশ, এমন মানব জনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা। কিন্তু, বিরক্ত হোন বা না হোন, কর্তব্যে কোনো অবহেলা নেই। তাঁরা শহরে ফেরার আগে, যথাসাধ্য লিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, চাষীভাই, বোন, এবং তাদের কাচ্চাবাচ্চাদের। কী শেখালেন, সে তো গানেই বলা আছে। শক্ত করে বেড়া দিতে হবে। বীজ দিতে হবে, ফসল কাটতে হবে, ইত্যাদি প্রভৃতি। এবং সর্বশেষে, যেটা আসল, রামপ্রসাদ, অর্থাৎ, মাস্টারকে ডেকে ফান্ডা নিতে হবে। এই হল ব্যাপার।  

    তা, এ খুব বড় ব্যাপার না। কারণ এর আগে আমরা একখানা বিশ্ববিখ্যাত বই পড়েছি, যেখানে বৌদ্ধ দর্শনকে মোটরসাইকেল পরিচর্যার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, ফলে, রামপ্রসাদকে কৃষিকাজের মানেবই হিসেবে ব্যবহার করলে, কী এসে যায়? তেমন কিছু না। নিরীক্ষা? তাতেও কোনো অনুপপত্তি নেই। এমনকি রোদ্দুর রায় রামপ্রসাদী গাইলেও নেই। লোকের বোঝাবুঝি তো বদলায়। সমস্যা হল, আকুতিতে। রামপ্রসাদের গানের আত্মা, যাকে আমরা প্রায় শতিনেক বছর ধরে লালন করেছি, তা কালী-টালি নয়, ঈশ্বর-টিশ্বরও বাহানা মাত্র, ও মূলত আকুতি। সঙ্গে আকাঁড়া অব্রাহ্ম অনাগরিক তীব্রতা এবং কাব্যসৌন্দর্য। এই আকুতির ধারেকাছে আসতে পারবেন একমাত্র অতুলপ্রসাদ, তিনি আবার আদ্যন্ত নাগরিক এবং শীলিত। ফলে রামপ্রসাদী ভাব, বাংলায় অতুলনীয়।  

    এই নিয়ে একটা ব্যক্তিগত গপ্পো আছে। "কত কী করার আছে বাকি" গানটা আমি প্রথম শুনেছিলাম, এক পূর্ণিমা রাতে, চাঁদের আলোয়, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের স্বকণ্ঠে। বিশেষ করে "কিছু তো হলনা এ জীবনে, বৃথা কালক্ষয়"টা শুনে ওখানেই আমি ফ্ল্যাট হয়ে যাই। অ্যালবামে শুনবেননা, ওখানে কিছুই নেই, শুধু কল্পনা করুন, একটা লোক নিঁখুত সুরে, গলাটা একটু আস্তে করে ভাঁজ দিয়ে বলছে, "কিছু তো হলনা এ জীবনে", তারপর ফুসফুসের সমস্ত জোর দিয়ে কোনো খাঁজ-টাজ ছাড়া তারস্বরে গাইছে "বৃথাআআআ কালক্ষয়", তাতে মিশে যাচ্ছে সমস্ত অপ্রাপ্তি, খেদ, না পারা, আরও কী কী কে জানে। গানটা ওই একবার শুনেই আমার মুখস্থ হয়ে যায়। এবং সেই রাতেই বন্ধুদের বলেছিলাম, এর আগে এরকম আকুতি একটা লাইনেই শুনেছি, "এমন মানব জনম রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।" সেই নিয়ে বিস্তর ঠাট্টাতামাশাও হয়, সঙ্গত কারণেই। বুদ্ধদেব বসু, যেমন বলেছিলেন, শঙ্খ ঘোষের কবিতা নিয়ে, যে, সব হাহাকারই কবিতা হয়না। তো, সে অনেক তর্কের ব্যাপার। কিন্তু স্রেফ আকুতির হিসেব করলে, আমি মনে করি, মোটের উপর ঠিকই বলেছিলাম।

    তা, সেই আকুতিটি, এখানে কৃষিকাজের মাঠে বেঘোরে মারা গেছে। সেও খুব বড় ব্যাপার না। কত কবিই তো মরে গেল, চুপি চুপি একা একা। কাটিয়ে দিলেই হয়। কিন্তু ওই আর কি, একদিকে শারুক্ষান, অন্যদিকে গোবাহিনী, আর এইদিকে পোষ-মানানো, গৃহপালিত শোভে-গৃহকোণ রামপ্রসাদ, সব মিলিয়ে অবস্থা তো "বল মা তারা দাঁড়াই কোথা"। সেটা একটু বলতে ইচ্ছে করল। এটাই আমার শ্যামাসঙ্গীত ধরে নিতে পারেন। কারণ, এতক্ষণ যা বললাম, সেটাই এই গানেও দেখতে পাবেন, যে, তারা-টারা সব ফালতু কথা, আসল কথা হল "দাঁড়াই কোথা"র আর্তনাদটা। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dc | 2401:4900:1cd1:fc4e:5814:ee91:a664:c754 | ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:৫১514801
  • অনেক সময়ে না দাঁড়াতে পারার আক্ষেপ হওয়াটা খুব একটা বিচিত্র না কিন্তু। 
  • &/ | 107.77.232.168 | ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:১৬514802
  • আর্কিমিডিস এটা গাইতেন,' বল মা তারা দাঁড়াই কোথা '
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন