এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১৫

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ৩৬১ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • টিফিনের সময় অন্যান্য সহপাঠী সুনীল, সুবীর, তাপস, প্রণব'দের সাথে একসঙ্গে ক্যাম্পাসে ঘুরতাম। কোনো কোনো দিন আমরা গাছপালা ঘেরা প্রিন্সিপালের বাড়িতে যেতাম। ওখানে গেলেই খুব ভয় লাগত। এত গাছ এবং অন্ধকার, সূর্যের আলো গাছ ভেদ করে  ভিতরে ঢোকার সুযোগই পেত না। আমাদের ক্লাসে প্রায় জনা-আটেক মেয়ে পড়ত। আমার তিনজনের নাম মনে আছে। কবিতা, সুপর্ণা ছাড়া আরেকজন মীনাক্ষী ছিল। মীনাক্ষীর নাম মনে আছে কারণ ও আমাদের সাথে ঘুরতে, টিফিন শেয়ার করতে, খেলতে পছন্দ করত। এমনকি, পিটি স্যারকে জোরাজুরি করে আমাদের সাথে ক্রিকেট পর্যন্ত খেলত। বেশ ডানপিটে টাইপের ছিল। বেশ লম্বা এবং সবল চেহারার ছিল। কবিতার সাথে আমাদের জমতো না বলে, ও আরও বেশি করে আমাদের সাথে মিশত। ধীরে ধীরে ও সুপর্ণাকেও আমাদের দলে নিয়ে আসে। সুপর্ণা শান্ত-শিষ্ট ছোটোখাটো দেখতে। পড়াশুনাই ছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান। দু'জনেই আমাদের জন্য মাঝেমাঝেই বাড়ি থেকে আলাদা করে বেশি টিফিন নিয়ে আসত, যাতে আমাদের সাথে শেয়ার করতে পারে। আমরা মাঠে গোল হয়ে বসে কাড়াকাড়ি করে একসাথে টিফিন খেতাম। 
    দশম এবং একাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রী'দের জন্য স্কুল একটি ভ্রমণের আয়োজন করেছিল, ঠিক হয়েছিল বাসে করে রাঁচিতে যাবে। আমার দিদি যেহেতু দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিল, তাই আমাকেও অনুমতি দেওয়া হয়। এটি ছিল স্কুলের দ্বারা সংগঠিত আমার প্রথম দুই দিনের বাইরে ভ্রমণ। প্রচন্ড উপভোগ করেছিলাম সেইবার আমার সিনিয়র দাদা অসিতাভ-দা, সুনীল-দা প্রমুখের সাথে হুন্দ্রু এবং জোনা জলপ্রপাত ঘুরে।
    ১৯৭০-৭১ সালে, বেশিরভাগ কলেজ এবং স্কুলে নকশাল আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার কারণে, আমাদের স্কুলেও তার প্রভাব এসে পড়েছিল এবং বেশ কয়েকবার স্কুল বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালে যখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি, একটি  অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায় আমাদের স্কুলে। পরে অনেক বড় হয়ে জানতে পেরেছিলাম, ঐ সালে অগাস্ট মাসে ঘটে যায় কলকাতার কাশীপুর-বরানগর এলাকাতে একটি গণহত্যা। এই ঘটনার কয়েক মাস পর, বোধহয় নভেম্বর মাস (তখন সেরকম ভাবে ওয়াকিবহাল ছিলাম না কাশীপুর-বরানগর ঘটনার ব্যাপারে), আমরা দাঁড়িয়ে আছি স্কুল ছুটির পর বাসস্ট্যান্ডে। হঠাৎ দেখতে পাই আমাদের স্কুলের দশম শ্রেণীর একটি ছাত্রকে সাইকেলে সামনে বসিয়ে আরেকটি ছাত্র নিয়ে যাচ্ছে। সামনে বসা ছাত্রটির পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। গায়ে মনে হচ্ছিল অনেক পোড়া দাগ। আমাদের ক্যাম্পাসের হাসপাতাল অভিমুখে বোধহয় যাচ্ছে। আমি আর দিদি একটু চিন্তিত মুখে বাড়ি চলে আসি। পরেরদিন স্কুলে গিয়ে দেখি নোটিশ ঝোলানো, স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। ধীরে ধীরে জানতে পারি, ঐ ছাত্রদুটি আর একটি স্কুলে (স্কুলের নাম দিলাম না এখানে) গিয়েছিল হেডস্যারের গায়ে আগুন দিতে। ক্লাস চলাকালীন গায়ে কেরোসিন ছড়িয়ে আগুন দিয়ে দেয়। একটি মেয়ে বাঁচাতে আসে, তারও গায়ে আগুন লেগে যায়। হেডস্যার জড়িয়ে ধরেছিলেন ছেলেটিকে যে কেরোসিন ছড়িয়ে দিয়েছিল। ছেলেটির গায়েও আগুন লেগে যায়। পরে জানা যায় - হেডস্যার, বাঁচাতে আসা ছাত্রীটি এবং ছাত্রটি মারা যায়। দীর্ঘকালীন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে, আমাদের নিয়মিত বার্ষিক পরীক্ষা রদ করে দেওয়া হয়। শুধু তিনটি সাবজেক্ট - বাংলা, ইংরেজি, অংক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেটাও ৫০ মার্কসের এবং একদিনে। একমাত্র একাদশ শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা পরে নেওয়া হয়, কারণ বোর্ডের পরীক্ষা দেবে তারা। আমার দিদি তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ত।        
    ****
    ১৯৭০-৭১ সালে দুর্গাপুরে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি এলাকাতেও কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। রাতে সব রাস্তাই জনশূন্য হয়ে যেত,  রাতে কেউ কারও বাড়িতে যেত না। আমার মাও তখন একটু চিন্তিত থাকতেন, কারণ আমার বাবা আইবি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। আমার মা অবশ্য মানসিকভাবে খুব শক্তিশালী এবং একজন সাহসী মহিলা ছিলেন, যে কোনও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার মানসিক শক্তি ছিল। আমাদের সংসার চালানোর সমস্ত দায়িত্ব উনি নিতেন।
    একদিন সন্ধ্যায়  আমাদের বাড়িতে কেউ কড়া নাড়ে। একটু ইতস্তত করে মা দরজা খোলেন, কিন্তু দরজার পাশে দুই হাত দিয়ে প্রবেশদ্বার আটকে রাখেন এমনভাবে যাতে মা'কে ধাক্কা না দিয়ে কেউ ভিতরে ঢুকতে পারবে না। বাবা ভিতরের ঘরে। একটি যুবক দাঁড়িয়ে। ঠিকানা জানিয়ে একটি বাড়ির খোঁজ চায়, যেটি আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২ ব্লক দূরে ছিল। যুবকটি মায়ের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে, মনে হলো একটু ঘাবড়ে গেছে বোধহয়। যুবকটি এক গ্লাস জল চায়, মায়ের সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। কারণ ঐসময় এইরকম অজুহাত দেখিয়ে বাইরের লোকেরা ঘরে প্রবেশ করত। মা দরজা ছাড়েন না, দিদিকে বলেন এক গ্লাস জল আনতে। সেই সময় লোকটি সত্যিই ঘাবড়ে যায়  এবং জল খেয়ে চলে যায়। যুবকটি এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, সে যে বাড়ির খোঁজ করেছিল  সেখানে না গিয়ে রাস্তা ধরে হনহন করে চলে যায়। মা বাইরে বেরিয়ে দেখতে পান এটা। মা তখন একটু ঘাবড়ে গিয়ে, তাড়াতাড়ি করে খাওয়াদাওয়া সেরে লাইট অফ করে শুয়ে পড়েন। ঐ বাড়িটি মায়ের পরিচিত একজন মহিলা সমিতির বান্ধবীর ছিল। পরের দিন মা জানতে পারেন, যুবকটি প্রকৃত পক্ষেই একজন সজ্জন ব্যক্তি এবং ওনাদের আত্মীয়। মায়ের ভঙ্গি দেখে যুবকটি এত ঘাবড়ে যায়, অনেক পরে এদিক ওদিক ঘুরে তারপর মায়ের বান্ধবীর বাড়িতে আসে। 
    অনেক ঘটনা ঘটেছিল সেইসময় দুর্গাপুরে, আমি মনে করতে চাই না সেইসব এবং আমার স্মৃতি থেকে মুছে দিতে চাই। সেই দিনগুলি খুব ভয়ঙ্কর এবং ভীতিকর ছিল।
    তবে এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না যেটা আমাদের বারাসাতের বাড়িতে ঘটেছিল।
    আমার কাকুমণির বিয়ে হয় ১৯৭১ সালের জুন মাসে। বারাসাতে অবস্থা তখন খুব খারাপ। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল যাওয়া হবে না। দাদুভাই এবং বাকি সবাই না করেছিলেন বারাসাত যেতে। কিন্তু শেষে আমাদের সবার পীড়াপীড়িতে বাবা রাজি হয়ে যান। এর আগে ১৯৬৯ সালে ফুলপিসির বিয়ে হয়, ঐসময় আমাদের স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা থাকার জন্য আমরা কেউ যেতে পারিনি। আমরা ভাই-বোনরা কেউ চাচ্ছিলাম না কাকুমণির বিয়ে মিস করতে।       ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • AS | 103.56.239.51 | ২২ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:১৩514779
  • আগের পর্ব গুলোর লিঙ্ক দিন
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন