এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১৩ 

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৪৬ বার পঠিত
  • সেই দিনগুলিতে, স্কুল ছুটির সময় মেজোপিসি ওনার মেয়ে ঝুমঝুম এবং ভজুকে এবং মাঝেমাঝে শান্তুকে নিয়ে শান্তিনিকেতন থেকে ঘন ঘন আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং আমরাও প্রায়ই শান্তিনিকেতনে যেতাম। ঝুমঝুম আর আমার মধ্যে সেই সময় থেকেই ভাইবোন সম্পর্ক ছাড়াও একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয় । ঝুমঝুম আর আমি প্রায় সমবয়সী। ঝুমঝুম খুব শান্ত ছিল, আর পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। তার শান্ত স্বভাবের কারণে আমার সমস্ত দুষ্টুমি কান্ডকারখানা সহ্য করত। যদিও আমি সেই সময় একটু দুষ্টু ছিলাম, কিন্তু আমাদের দুজনের স্বভাবের অনেক মিল ছিল। অন্তর্মুখী, পড়াশোনার ব্যাপারে সিরিয়াস, লোকজনের কোলাহলের থেকে দূরে থাকা, গল্পের বই পড়া।
    এক সন্ধ্যায়, ঝুমঝুম আর আমি বাইরের বারান্দায় একটা মাদুরে বসে পড়ছিলাম আর আমার মা এবং মেজোপিসি ভেতরে রান্না করছিলেন। কিছুক্ষণ পর ঝুমঝুম ঘুমিয়ে পড়ে। রান্না হয়ে গেলে খাওয়ার ডাক আসে ভিতর থেকে। আমি ঝুমঝুমকে জাগানোর জন্য, বাড়ির সামনের রাস্তায় পড়ে থাকা ছোট ছোট পাথর ওর কানের ভিতর ঢুকিয়ে দিই। ঝুমঝুমের কান্না শুনে আমার মা আর মেজোপিসি বাইরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করতে স্বীকার করি কী করেছি। কারণ আমিও তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ঝোকের মাথায় অপকর্মটা করে ফেলেছিলাম। মায়ের দুম্দুম্ করে কিল পিঠের উপর। আর মেজপিসি শান্ত ভাবে ধীরে ধীরে একটা একটা করে পাথর বের করেন সেফটিপিন দিয়ে।  
    সন্ধ্যেবেলায় বাইরের উঠোনে খাটিয়ার উপর বসে মেজপিসি বলতেন দাদুভাইয়ের গল্প, আমাদের বাবার গল্প। বাবা আর মেজপিসির মধ্যে একটা গাঢ় নিবিড় সম্পর্ক ছিল ছোটবেলা থেকে। বাবা খুব দুষ্টু ছিলেন এবং মেজপিসিকে খুব ঠকাতেন, উক্তত্য করতেন ছোটবেলায়। বাবা মেজপিসিকে ঠকিয়ে ওনার ভাগের পয়সা নিয়ে নিতেন। 
    ঝুমঝুম এবং আমি দু'জনেই কাঁচা আম দিয়ে টকের পাতলা মুসুর ডাল খেতে খুব পছন্দ করতাম, সাথে যদি পাওয়া যেত মাংসের একটা বড় আলু - সোনায় সোহাগা। থালায় অল্প ভাতের সঙ্গে পাতলা টকের ডাল অনেকটা, একদম সমুদ্র করে।       
    গ্রীষ্মের ছুটিতে ঝুমঝুম তার গ্রীষ্মের স্কুলের কাজগুলি সম্পন্ন করার জন্য একটি স্কুল ব্যাগ ভর্তি বই এবং একটি মোটা খাতা নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসত। আর ঠিক বিপরীত ছিল রত্না-দি, ঝুমঝুমের বড়দিদি - আমার দিদির সমবয়সী। রত্না-দি কোনসময় বই নিয়ে আসত না, ছুটি পুরো চুটিয়ে উপভোগ করতে আসত। রত্না-দির প্রিয় খাবার  ছিল মায়ের হাতের রান্না করা মাছের ডিমের ডালনা,  প্রচুর পেঁয়াজ এবং তেল সহযোগে। আমাদেরও খুব প্রিয় ছিল এই খাবারটি। আমাদের বাড়ি পৌঁছে বাবাকে প্রথমেই বলতো রত্না-দি, ‘বড়মামু,কাল মাছের ডিম আনতে ভুলবে না’। আর আমি দেখেছি যে রাতে এই মাছের ডিমের ডালনা তৈরী করা হত, রত্না-দি থালা ধুয়ে আসন পেতে সবাইকে ডাকত খাওয়ার জন্য।
    একবার মেজপিসি হঠাৎ করে একটি গাড়ি নিয়ে চলে আসেন দুর্গাপুর। সাথে রত্না-দি, ঝুমঝুম, কুট্টিপিসি। কুট্টিপিসি শান্তিনিকেতন বেড়াতে এসেছেন। তাই কুট্টিপিসিকে দুর্গাপুর ঘোরাতে নিয়ে আসে। পরেরদিন কুট্টিপিসি পরিকল্পনা করেন চিত্রালয়ে সিনেমা দেখতে যাবেন। কুট্টিপিসি তখন সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসতেন, কোনো নতুন সিনেমা বেরোলেই দেখা চাই। সাথে দিদি, রত্না-দি তো যাবেই। ঝুমঝুমও  মেজপিসির অনুমতি আদায় করে নেয়। কিন্তু তার আগের দিন রাতে ঝুমঝুমের কানে পাথর ঢোকানোর অপকর্মটি করেছিলাম। মা তখনও প্রচন্ড রেগে আছেন। আমার অনুমতি কিছুতেই মেলে না। দুপুরে  খাওয়া-দাওয়া'র পর সবাই তৈরী হচ্ছে সিনেমা যাওয়ার জন্য, আর আমি বিমর্ষ মুখে বাইরের বারান্দায় বসে আছি। তখন মেজপিসি এসে আমাকে চুপিচুপি বলেন, তুই ওদের সাথে চলে যা। আমি তোর মা'কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ম্যানেজ করে নেব। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাইরে দাঁড়ানো গাড়িতে গিয়ে বসে পড়ি। কুট্টিপিসিরা গাড়িতে বসতে এসে অবাক হয়ে যান। আমি জানাই, গাড়ি তো ফেরত আসবে তোমাদের সিনেমাহলে নামিয়ে দিয়ে। আমি ড্রাইভার আঙ্কেলের সাথে ফেরত এসে যাব। তখন জানাই না, মেজপিসির সাথে আমার কী কথা হয়েছে। যদি কোনো কারণে আমার মায়ের ভয়ে না নেয় আমাকে। সিনেমা হলে পৌঁছে আমি জানাই, মেজপিসি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু তখন কুট্টিপিসি বলেন, 'তুই কী করে যাবি পলাশ ? তুই তো গেঞ্জি পড়ে আছিস।' তাড়াহুড়োর মাথায় আনন্দের আতিশয্যে, আমার খেয়ালই ছিল  না আমি গেঞ্জি পড়ে আছি। ঝুমঝুম'এর মুখটা একদম শুকিয়ে যায়, লক্ষ্য করি। প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে বাড়ি ফিরি সেদিন।        
    ****
    হঠাৎ একদিন বাবা আমাদের বাড়িতে একটি গরু কিনে আনেন। পিছনের উঠানের এক কোণে একটি গোয়ালঘর তৈরি করা হয়। আমরা তার নাম রেখেছিলাম ‘টেপি’। টেপি খুব শান্ত প্রকৃতির ছিল  এবং আমরা সবাই তাকে ভালোবাসতে শুরু করি। তার বাছুরটির জন্ম দেওয়ার পরে, যখন সে দুধ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল, প্রাথমিকভাবে একজন গোয়ালাকে দুধ দোয়ানোর জন্য ডাকা হত। তখন আমার মা দুধ দোয়ানোর প্রক্রিয়াটি শেখেন এবং তারপর থেকে উনি দুধ দোয়াতেন। সকালে দুধ দোয়ানোর কিছুক্ষণ পর টেপি'কে ছেড়ে দেওয়া হতো পিছনের মাঠে ঘাস ইত্যাদি চড়ে খাওয়ার জন্য। অনেকবার অন্যের বাগান থেকেও গাছ-পালা খাওয়ার চেষ্টা করত। পড়ন্ত বিকেলে যখন টেপি'র ফেরার সময় হয়েছে, আমরা অনেক দূর থেকেও টেপি বলে ডাকলেই কান উঁচু করে শুনে ধীরে ধীরে চলে আসতো আমাদের কাছে। বাড়ি ফেরার সময় আমরা অনেকসময় পল্লব'কে টেপি'র পিঠে বসিয়ে নিয়ে আসতাম। যেদিন টেপি'কে বিক্রি করে দেওয়া হলো, টেপি'র চোখে জল দেখে আমরা ভাই-বোনেরা সেদিন কান্না সামলাতে পারিনি।   
    পরে আমার বাবা একটা ছাগলও কিনে আনেন, তার নাম রাখা হয় ‘কমলী’। কিন্তু সে খুব দুষ্টু ছিল এবং তার শিং দিয়ে আমাদের সবাইকে তাড়া করত। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও প্রচুর অভিযোগ আসতে শুরু করে এবং আমরা তাকে বিক্রি করতে বাধ্য হই।
    আমাদের কোয়ার্টারের সামনে মেইন রোডের একটু পরেই একটা বড় খেলার মাঠ ছিল। আমি ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম এখানে। রোজ ভোরবেলায় উঠে দৌঁড়ে কয়েক পাক দিতাম মাঠের।      ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন