এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১০

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৩৩ বার পঠিত
  • ফলস্বরূপ খুবই বাজে করি ক্লাস পরীক্ষায় এবং মাত্র চার নম্বর পাই দশে। যখন আমি আমার বাবার স্বাক্ষরের প্রয়োজনে খাতাটি দেখাই, বাবা মা'কে বলেন ওকে তাড়াহুড়ো করে বয়স বাড়িয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করাটা হয়ত উচিৎ হয়নি। কিন্তু আমার মা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আমি পরের পরীক্ষায় ভাল ফল করব, এবং আমি তাই করেছিলাম।
    পরের দিন স্কুলে, ক্লাস টিচার যখন আমাকে বাবার সাইন করা ক্লাস টেষ্টের খাতাটি জমা দিতে বললেন   – আমার ঠোঁট ফুলে চোখে জল এসে গিয়েছিল। কারণ এর আগে আমি কোনোদিন এত বাজে নম্বর পাইনি, সেটা পাঠশালা হোক অথবা প্রাক-প্রাইমারি স্কুল হোক। আমার চোখে জল দেখে, ক্লাস টিচার ঘাবড়ে যান এবং আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বলতে থাকেন - তুমি খুব ভালো নম্বর পেয়েছো, এখনও তো তোমার এক সপ্তাহ হয়নি ক্লাসে। আমি জানি তুমি পরের পরীক্ষায় ফুল মার্কস পাবে। ঐসময় বকুলদি ক্লাসের মনিটর ছিল। উনি বকুলদিকে ডেকে আমার পরিচয় সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে করিয়ে দিতে বলেন এবং আমার দিকে একটু খেয়াল রাখতে বলেন। এভাবেই বকুল-দির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়।
    দুই বোন, বকুল-দি এবং কাজল আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ত। বকুল-দি তার বোনের সাথে একই ক্লাসে পড়ার কারণ আমি জানি না, কারণ আমি তাদের কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি। যেহেতু আমি স্কুলে নতুন ছিলাম, বকুল-দি আমাকে সব সহপাঠীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমাকে তার ভাইয়ের মতন দেখাশোনা করতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে আমি স্কুলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করি। আমি এর আগে এত বড় স্কুল, সামনে বিরাট খেলার মাঠ, গেটে দারোয়ান দেখিনি। সেইজন্য প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপর কাউকেই চিনতাম না, আমার সাথেও কেউ এসে আলাপ করত না, আমি টিফিনের সময় একা ক্লাসে বসে স্কুলের দেওয়া টিফিন খেতাম। তারপর প্রথম ক্লাস টেস্টেই প্রচন্ড খারাপ ফলাফল। স্কুলে প্রথমে সপ্তাহটা খুব খারাপ কেটেছিল। তারপর প্ৰথম বাসে আসা-যাওয়া করে স্কুল করছি, একটা ভয় থাকত যদি বাড়ি ফিরতে না পারি। তারপর বকুল-দি এবং কাজল আমার এত সুন্দর বন্ধু হয়ে গেল, আমার কষ্ট হত ওদের ছেড়ে বাড়ি ফিরতে।      
    বকুল-দি এবং কাজল থাকত তানসেন বাজারের নিকট, আমাদের স্কুল বাস স্টপের আগের স্টপেজ।  এরপর থেকে আমি স্কুলে পৌঁছানোর জন্য আগের বাসে আসতে শুরু করি, তারপর তানসেন বাজারে নেমে চলে যেতাম দুই'বোনের বাড়ি। আমার আজও মনে আছে  আমি যখনই দরজা ঠেলে ওদের বাসাতে ঢুকতাম, দেখতে পেতাম একই দৃশ্য। ওদের মা মেঝেতে বসে একই থালা থেকে ভাত, ডাল দিয়ে মেখে খাওয়াচ্ছেন দুই বোনকে। এরপর ওদের সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যেতাম স্কুলে। আমি প্রায়ই ওদের বাড়িতে পৌঁছে বলতাম, 'জানো বকুল-দি, জানিস কাজল - গতকাল সন্ধ্যায় যখন আমি বাইরের বারান্দায় মেঝেতে বসে পড়ছি, তাকাচ্ছি বারবার আমাদের গেটের দিকে। মনে হচ্ছে তোমরা দু’জন গেট খুলে আমাদের বাড়িতে ঢুকছো। একবার এসো না আমাদের বাড়িতে।'  ওদের মা বলতেন, 'এই ছেলে, যাবো একদিন তোদের বাড়িতে। তুই এত ভালোবাসিস বকুল-কাজল'কে !' বর্ষা থেমে গেলেও যেমন অনেকক্ষণ ধরে গাছের পাতায় সে জল লেগে থাকে, ধীরে ধীরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে টুপ টুপ করে পড়তে থাকে, তেমনই বকুল-দি, কাজলের সাথে স্কুলে দেখা হওয়ার রেশ আমার মনে লেগে থাকত বাড়ি ফিরে আসার পরেও। এই দুই বোনের সাথে আমার একটি খুব সংক্ষিপ্ত স্মরণীয় সংযুক্তি হয়েছিল, যা আমি আজ পর্যন্ত আমার মনে লালন করি।
    একদিন আমার মা আমাকে বাস ভাড়ার জন্য দুটি ১০ ​​পয়সার কয়েন দিতে ভুলে যান। বাসে ওঠার পরে আমি বুঝতে পারি পকেটে হাত দিয়ে। স্কুলে নিয়মিত যাতায়াতের কারণে সব বাস কন্ডাক্টর আমার পরিচিত ছিল। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে কন্ডাক্টর বোধহয় বুঝতে পারে, ভাড়া চায় না। আমি ভাবতে থাকি  কীভাবে বাসায় ফিরবো। আর আমি বকুল-দির বাড়ি যখন গিয়েছিলাম লজ্জায় কিছু বলিনি, সহজেই ওর মায়ের থেকে দশ পয়সা চেয়ে নিতে পারতাম। ক্লাসে আমাকে অমনোযোগী দেখে কাজলের কিছু সন্দেহ হয়। জিজ্ঞেস করতে আমি বলি কী ব্যাপার। ঠিক হয় ফেরার সময় আমি ওদের বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে বাসে উঠবো। এরমধ্যে বকুল-দি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারে তৃতীয় শ্রেণীর একটি ছেলে তপন আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে এবং রোজ বাড়ি থেকে স্কুল হেঁটে যাওয়া-আসা করে। আমি এটা শুনে ঠিক করি তপনের সাথে ফিরবো। কাজল যদিও বারবার বলছিল, 'হেঁটে যাস না তুই। আমাদের বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে বাসে করে যা।' কিন্তু আমার লাজুকতা বাধা দিচ্ছিল ওদের মা'র থেকে পয়সা চাইতে। আর এডভেঞ্চারেরও একটু ইচ্ছা হচ্ছিল, পথে বিশাল বয়েজ স্কুল, সেটা হাঁটতে হাঁটতে ধীরে-সুস্থে দেখা যাবে। রোজ বাস থেকে দেখি, হুস করে বেরিয়ে যায়। তপনের সাথে ৫/৬ কিমি হেঁটে লাল মুখ নিয়ে বাসায় পৌঁছে দেখি মা চিন্তিত মুখে বাইরের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে আছেন। আমি গেট থেকে দৌড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ভ্যা করে কেঁদে বলি, তুমি আমাকে বাসের ভাড়া দিতে ভুলে গেলে কীভাবে ?
    সেই ঘটনার পর, একদিন রাতে মা স্বপ্নে আমাকে আমাদের স্কুল বাস স্টপে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিলেন। আমি শুয়ে আছি একটি গাছের তলায় আর আমার মাথার কাছে একটি সাপ (আমি অবশ্য পরে এটা জানতে পারি)। তারপরে আমার বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আমাকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে কাছের নিউটন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য ফিরিয়ে আনবেন।
    ****
    পরের শিক্ষাবর্ষে আমি নিউটন প্রাথমিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হই। পল্লবও ঐ বছর নিউটন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। সেই সময় দিদিও বারাসত থেকে দুর্গাপুর আসে এবং আর ই কলেজ মডেল স্কুলের সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। আর ই কলেজ মডেল স্কুল আমাদের বাড়ি থেকে অনেকদূর ছিল, দিদিও পাবলিক বাসে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করে।    ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন