এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ৮

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ২০২ বার পঠিত
  • ঠাম্মা আর কুট্টিপিসি তখন বাইরের বারান্দায় বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। হঠাৎ ধুপ করে একটা আওয়াজ শুনে ঘরে এসে দেখেন আমি মেঝেতে পড়ে আছি, প্রায় সেন্সলেস। ঠাম্মা তখনই আমার কাকুমণির অফিসে লোক পাঠিয়ে খবর পাঠান। হাসপাতালে এক্সরে করে জানা গেল, ডান হাত ভেঙ্গে গেছে। প্লাস্টার করিয়ে কাকুমণি আমাকে নিয়ে চলে আসেন দমদমে, আমার মা-বাবার কাছে।
    একদিন মা এবং ফুলমাসি দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন বাইরের খাবার ঘরে, আর আমি তখন ভিতরের ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিলাম। যেটা বাইরের খাবার ঘর থেকে সোজাসুজি দেখা যায় না। আমি শুয়ে শুয়ে অস্থির বোধ করছি, এবং ভাবছি কী করা যায়। পাশের টেবিলে দেখি বাবার একটা লেক্স সিগারেটের প্যাকেট রাখা আছে। আস্তে আস্তে চুপিচুপি নেমে এক হাতে অনেক কসরৎ করে একটা সিগারেট বের করি প্যাকেট থেকে, দেশলাই বাক্সটা তুলে নিই। তারপর একটা সংবাদপত্রের ভাজ করা কাগজ আড়াআড়ি পেঁচিয়ে   রাখি বিছানার উপর। সিগারেটটা রাখি গোল করে মোড়া কাগজের উপর, সিগারেটের একটা প্রান্ত বিছানার উপর আর একটা প্রান্ত কাগজটার উপর - যাতে আগুন ধরাতে সুবিধা হয়। এক হাতে প্লাস্টার। প্লাস্টার দেওয়া হাতে ধরি দেশলাইয়ের বাক্সটা আর বাম হাত দিয়েই ম্যাচস্টিক ঘষে জ্বালানোর চেষ্টা করি সিগারেট। ম্যাচস্টিক পড়ে গিয়ে কাগজ ও বিছানায় আগুন লেগে যায়। পোড়ার গন্ধ পেয়ে মা ও ফুলমাসি ঘরে ছুটে আসেন এবং দেখতে পান আমাকে জ্বলন্ত বিছানায় বসে থাকতে। মায়ের তাৎক্ষণিক বুদ্ধির প্রয়োগে বেঁচে যাই সে যাত্রা। মা বিছানায় বালতি বালতি জল ফেলে আগুন নিভিয়েছিলেন। বাথরুমে সবসময় ধরা থাকতো দুই-তিন বালতি জল সেইসময়।
    আমি আমার দাদুভাইয়ের একতরফা ভালোবাসা, স্নেহের অধীনে বেড়ে উঠছিলাম এবং সেই কারণে আমি বেশ জেদি হয়ে উঠছিলাম। ঠাম্মা, কাকা, পিসিদের অবাধ্য হতে শুরু করেছিলাম। আমার মধ্যে একটা দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে যে দাদুভাই আমাকে অন্যদের থেকে রক্ষা করার জন্য সর্বদা আমার পাশে আছেন। আমার বয়স যখন সাড়ে-পাঁচ বছর, দাদুভাই আমাকে একটি পাঠশালায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন পরের বছর প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেবেন। আমি পাঠশালাতে যেতে শুরু করি, আমার পছন্দের জায়গা। যা করতে দিতেন গুরুমশাই, সবার আগে আমি স্লেটে লিখে গুরুমশাইয়ের কাছে নিয়ে যেতাম। দাদুভাই এবং ফুলপিসির দেওয়া শিক্ষায় আমার কাছে যোগ-বিয়োগ, নামতা, বাক্য গঠন জল-ভাত ছিল। পাঠশালায় সবাই আমার দিকে একটা সম্ভ্রমের সমীহের চোখে তাকাতো, আর আমার সেটা উপভোগ করতে খুব ভালো লাগত। একদিন আমি পাঠশালায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে খাওয়ার বারান্দায় একটা পিঁড়ি নিয়ে বসে ঠাম্মাকে খাবার দিতে বলেছিলাম। দাদুভাই কোনো কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। কাকুমণিও তখন অফিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছেন। উনুনে তখন বসানো কড়াই, মাছের ঝোল টগবগ করে ফুটছে। ঠাম্মা তখন আমাকে বলেন, একটু অপেক্ষা করতে। কাকুমণিকে খাবার বেড়ে আমাকে তারপর দেবেন। কাকুমণির অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি শুরু করে দিই তর্ক। আমারও তো পাঠশালার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তখন যেই ঠাম্মা বলেন, তোর আবার পাঠশালার দেরি কী, একদিন একটু পরে গেলে কী তুই মুখ্যু হয়ে থাকবি ? যেই বলা, আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আমি পিঁড়ির থেকে উঠে, না খেয়ে বেরিয়ে পড়ি পাঠশালার অভিমুখে। ঠাম্মার শত ডাকেও আর পিছনে ফিরি না।        
    দাদুভাই যখন এই ঘটনাটি জানতে পারেন একটু পরে বাড়ি ফিরে, তিনি আমার ঠাম্মাকে প্রচন্ড  বকাঝকা করেন এবং আমাকে ফিরিয়ে আনতে পাঠশালায় পৌঁছে যান। আমার আজও সেই দিনটি মনে আছে, দাদুভাই যখন পাঠশালায় আসেন। দেখে মনে হয় স্নান করেননি। ক্লান্ত দেখতে লাগছে  কিন্তু মুখ গম্ভীর। চিন্তিত বোধহয়, নাতিটা এতক্ষুণ কিছু না খেয়ে আছে কী করে ! গুরুমশাই একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, হঠাৎ আপনি জ্যাঠামশাই ! আপনার নাতি তো প্রচন্ড বুদ্ধিমান। আমাকে কিছু শেখাতে হয় না, ও নিজে নিজেই সব পারে। গুরুমশাই বোধহয় একটু ভয় পেয়েছিলেন, ভেবেছিলেন আমি বোধহয় ওনার নামে নালিশ করেছি দাদুভাইয়ের কাছে।  
    সেই দিন ঠাম্মা বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি আমার দাদুভাইয়ের একতরফা ভালবাসা এবং স্নেহের সাথে জেদি, রাগী হয়ে যাচ্ছি এবং বুঝতে পেরেছিলেন যে এবার আমার বাবা-মায়ের দ্বারা আমাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। ঠাম্মা অবিলম্বে কাকুমণির মাধ্যমে চিঠি দিয়ে বাবাকে জানান, ‘ছেলেকে যদি মানুষ করতে চাস অবিলম্বে এসে নিয়ে যা।‘ তখন বাবার পোস্টিং ছিল দুর্গাপুরে। আজও আমি কৃতজ্ঞ ঠাম্মার দূরদর্শিতার জন্য, সঠিক সময়ে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। তখন প্রয়োজন ছিল আমার জন্য বাবা-মায়ের শাসন এবং একটি উন্নত স্কুলের পরিমণ্ডল। তা নাহলে হয়তো আমি আজকের 'আমি' হতে পারতাম না।

    ****
    আমি যখন দুর্গাপুরে পৌঁছলাম তখন যেন মনে হল অবতরণ করেছি এক স্বপ্নের রাজ্যে। এক সারিতে একই ধরণের দেখতে বাড়িগুলো সারি ধরে, চওড়া রাস্তা, প্রত্যেক পাড়াতেই খেলার মাঠ, সুন্দর পার্ক, স্টেডিয়াম, বাজার সহ এত সুন্দর শহর ! অবাক হওয়ার কারণ, এতদিন ছিলাম গাছ-গাছালি ঘেরা পুকুরসহ একটি খোলামেলা বাড়িতে, বাড়ি থেকে গেটের বাইরে বেরোলেই ইট বাঁধানো রাস্তা - যার দুধারে খোলা নর্দমা। বৃষ্টির সময় নর্দমা ছাপিয়ে নোংরা জলে ছয়লাপ, পিছনের মাঠে কাদা। আর এখানে মসৃণ পিচের রাস্তা, যার উপর দিয়ে চলেছে একটু পরপরেই বাস। রাস্তার দু'ধারে গাছ, ল্যাম্পপোস্ট। কোনোকোনো জায়গায় রাস্তা নেমে গেছে ঢালু হয়ে নীচের দিকে, রাত্রে ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলোকে লাগত তখন একটা মালার মতন। বাড়ির সামনে সুন্দর বিরাট বড় খেলার মাঠ, প্রতি কোয়ার্টারের সামনে একটি বাগান, বসার জায়গা এবং ঘেরা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে। পিছনের উঠোন পেরিয়ে বাড়িটি ঘেরা প্রাচীর দিয়ে। আধা শহর আধা গ্রাম পাড়াগাঁয় থাকা একটি ছোটোছেলের এইরকম সাজানোগুছানো শহর দেখলে প্রথমে চোখ  তো একটু ছানাবড়া হবেই !     ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন