এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ৬

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ অক্টোবর ২০২২ | ৪৪১ বার পঠিত
  • প্রসবের সময় স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে ডাক্তার কুসুমকে ঘুমের ইনজেকশন দেন, প্রসবের পরপরই। সকালবেলায় কুসুমের জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান একটা ফুটফুটে বাচ্চা পাশের খাটে শুয়ে আছে, পাশে একজন নার্স চেয়ারে বসে। নার্সটি একটি বালিশ পিছনে দিয়ে কুসুমকে বসতে সাহায্য করে, কোলে দেয় ফুটফুটে কন্যা সন্তানটিকে। কুসুম পান একটি মিষ্টি সুবাস। মন বিভোর করে দিচ্ছে যেন। মনে হচ্ছে যেন একটি জ্বলজ্বলে তারা তার কোল আলো করে শুয়ে আছে। তখনই কুসুম ঠিক করেন মেয়ের নাম রাখবেন, বকুল। দুই হাত মুঠি পাকিয়ে চুপটি করে শুয়ে আছে সে। নিষ্পাপ পবিত্র একটি মুখ। সমস্ত মানসিক কষ্ট দূর করে কুসুমের শরীরে মনে যেন একটি শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে। এতো সুখ এতো তৃপ্তি এর আগে কোনোদিন কুসুমের অনুভূতিতে তো আসেনি !  
    কিছুক্ষণ পর রাউন্ডে আসেন নাসিমা আপা।  কুসুমকে চেক-আপ করতে করতে বলেন, 'তোমার মা এবং বোন পুতুল এসেছে। বাইরে বসে আছে। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি ভিতরে।'
    মাকে দেখেই কুসুমের চোখে প্রায় জল চলে আসে। কতদিন পর মাকে দেখছে। কিন্তু মা ও পুতুল  আসলো কী করে এই যুদ্ধের সময় কেরানীগঞ্জ থেকে ! জানতে পারেন, যখন সকালের দিকে আর্মিদের গোলাগুলি বন্ধ হয় - ঐসময় বদরু চাচা কালীগঞ্জ ঘাট দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদী খেয়া পার করেন। বাবুবাজার কিংবা কেরানীগঞ্জ থানা ঘাট দিয়ে খেয়া পার করেননি। বদরু চাচা রোজ খেয়া পারাপার করায় কালীগঞ্জ ঘাট দিয়ে। ও এই বুদ্ধিটা মাকে দেয়। আর্মিদের গোলাগুলি বর্ষণ হয়েছে জিঞ্জিরা, কালিন্দী এবং কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা লক্ষ্য করে। কারণ খবর ছিল জিঞ্জিরা অঞ্চলে বাঙালিরা ওদের গোলাগুলি বন্দুক লুকিয়ে রেখেছিল। মা বলেন, সারারাত গোলাগুলি চলেছে। জানলা দরজা বন্ধ করে সবাই একটি ঘরে ঘাপটি মেরে ছিলেন। জানলার পাল্লার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝেই আগুনের গোলার ঝিলিক চমকিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো অন্ধকারে বসে থাকা সব থমথমে মুখগুলিকে। সকালের দিকে যখন গোলাগুলির আওয়াজ একটু কমে, 'যা হবে দেখা যাবে' ভেবে বেরিয়ে পড়েন মা এবং পুতুল বদরু চাচার বাড়ির উদ্দেশ্যে। বদরু চাচাকে আগে থেকে খবর দেওয়া ছিল।
    মাকে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করতেই, দেখতে পায় দরজার আবডালে দাঁড়িয়ে আছে একজন। পুতুল বলেই মনে হচ্ছে।  কিন্তু এটা কোন বেশে দাঁড়িয়ে আছে সে ! একটা ম্যাড়ম্যাড়ে নীল সরু পাড়ের সাদা শাড়ি পরনে। কুসুম আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে বলে ওঠেন, 'ওখানে কে দরজার আড়ালে ! পুতুল !' পুতুল আস্তে আস্তে ঘরের ভেতরে ঢোকে। কপালে গোল করে বড় সিঁদুরের টিপটি উধাও। হাতে কয়েকটি কাঁচের চুড়ি। মুখটি বেদনায় বিষণ্ণ। কুসুম থরথর করে কেঁপে ওঠেন পুতুলকে দেখে। যে মেয়েটা চিরকাল রংচঙে জামাকাপড় শাড়ি পরতে ভালোবাসতো, দুইহাত ভর্তি সোনা পরে থাকতে ভালোবাসতো, বড় করে সিঁদুরের টিপ্ পরতে ভালোবাসতো - আজ এ কী দশা হয়েছে ওর ! কুসুম চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারেন গলার ভিতর থেকে বাষ্পযুক্ত একদলা জড়ানো অবোধগম্য গো গো আওয়াজ  বেরিয়ে আসছে। পুতুল দেখতে পায় দিদিভাইয়ের চোখের মণিদুটো যেন চোখ ফেটে ঠিকরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। পুতুল ভয় পেয়ে ছুটে আসে দিদিভাইয়ের কাছে। জড়িয়ে ধরে দুইহাতে জাপটিয়ে। আর নিজেকে সামলাতে পারে না নিজেকে। ভাসিয়ে দেয় চোখের জলে দিদিভাইয়ের বুক, শাড়ি। এতো জল জমে ছিল চোখের ভিতরে ! এতো কান্না জমে ছিল বুকের ভিতরে ! যখন থেকে গুলবাগের বাড়ির উঠোনে পড়ে থাকতে  দেখেছে বিবেকের  মুন্ডবিহীন শরীর, সংজ্ঞাহীন হয়ে বাড়ির উঠোনে পড়ে গিয়েছিল -  তখন থেকেই চোখের জল যেন সব শুকিয়ে গিয়েছিল। গত পাঁচদিন ধরে কেউ পারেনি তাকে একফোঁটা কাঁদাতে, কথা বলাতে। ভাসুর মানিকদা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির পিছনে বাবা, খুড়োর  মৃতদেহ দেখে। খুড়িমা বোধহয় হার্টফেল করেই মারা গিয়েছিলেন। শরীরে কোনো আঘাত অথবা গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। বোন রানীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বেঁচে আছে কিনা সেটাও জানে না। গুলবাগে নিজের বাড়ি যাওয়ার পথেই মানিক বুঝতে পেরেছিলেন খবর বোধহয় ভালো পাওয়া যাবে না। কারণ রাস্তার দু'ধারে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিলো অর্ধদগ্ধ বাড়িগুলি, কান্নার রোল উঠে আসছিল চারিদিক থেকে। কিন্তু এরকম ভয়ানক, বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখতে হবে স্বপ্নেও কল্পনা করেননি।  মানিকদার সাথে একজন ওদের দলের সঙ্গী ছিল। পুতুলকে পাঠিয়ে দেন কেরানীগঞ্জে ওই সঙ্গীর সাথে তৎক্ষণাৎ। পুতুল আর এবার আপত্তি করতে পারেনি। করবে কী করে ? ওর তো গলা দিয়ে আর আওয়াজই বেরোচ্ছে না। পুতুলকে কেরানীগঞ্জে পৌঁছে দিয়েই মানিকের সঙ্গী চলে যায় গুলবাগে, মানিকের সাহায্যের জন্য। সব শুনে রতনকে কুসুমের মা পাঠিয়ে দেন গুলবাগে। পরদিন মানিক এবং রতন দুপুরের দিকে ফেরত আসেন কেরানীগঞ্জে। দুইদিন পরে শ্রাদ্ধের কাজ সম্পূর্ণ করে মানিক বেরিয়ে যান। কুসুমের মাকে বলে যান ঢাকাতে যেতে। মিটফোর্ড হাসপাতালে গিয়ে কুসুমের সাথে দেখা করতে।    ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন