এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জীবনখাতার কয়েকটি এলোমেলো পাতা

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৫ জুলাই ২০২২ | ৬১৪ বার পঠিত
  • পাতা ৬২ : প্রতিদিন বিছানায় শরীরটা রাখলেই, অনিলবাবুকে গান শোনাতে মরিয়া হয়ে ওঠে সে। বার বার দেয় চুম্বন হাতে, গলায়, কপালে, এমনকি পায়েও। ছাড়ে না দেহের কোনো অংশ। দেহের যে অংশ উন্মুক্ত, সেখানেই চুম্বন। মাঝে মাঝে রক্ত বের করে দেয়। প্রতিরাতে খাওয়ার পর অনিলবাবুর নেশা একটু টিভি দেখার। টিভি দেখতে দেখতে যতই হাত দিয়ে তাকে সরাবার চেষ্টা করেন, ঠিক সময় সুযোগ বুঝে আবার বসায় তার ভালোবাসার দংশন। শান্তিদেবী এই এলেন বলে। বাইরের চোকরি’তে এঁটো বাসনপত্রের নামানোর আওয়াজ পেয়েছেন। নার্ভের ওষুধটা খেয়ে এবার ঘরে ঢুকবেন। শান্তিদেবীর আসার আগেই যা করার করতে হবে অনিলবাবুকে। ওনার কানে গানের গুনগুন আওয়াজ গেলেই তাকাবেন অনিলবাবুর দিকে অভিমানভরা মুখটি ফুলিয়ে। কেন অনিলবাবু এতক্ষুণ কোনো ব্যবস্থা নেননি গান বন্ধ করার ! অনিলবাবু চান নিস্তার এই গাইয়ে আলির থেকে। আর কালক্ষয় না করে অনিলবাবু বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে এগিয়ে যান তার দিকে। পুরো ঘরে ছড়িয়ে দেন বিষাক্ত গ্যাস। বাইরে থেকে আস্তে করে দরজাটা ভেজিয়ে চলে যান অন্য ঘরে।
    আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ পরে ঢোকেন ঘরে। দেখতে পান মেঝেতে পড়ে আছে তার নিথর দেহ। একটা নয়, অনেকগুলো দেহ। কী আনন্দ আর স্বস্তি, মেঝেতে কালো কালো দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে। আর একটাও মশা নেই ঘরে।

    পাতা ৬৪ : অনিলবাবু আজ এসেছেন ব্যাংকে। বেসরকারি কোম্পানির একদা উচ্চপদে আসীন জাঁদরেল দাপুটে অফিসার অনিলবাবু আজ অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ। সংসার চলে ব্যাংকে রাখা টাকার সুদে। নেই কোনো পেনশনের ব্যবস্থা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের মতন। পেনশনের অঙ্কটা মাঝে মাঝে বাড়ে। কিন্তু অনিলবাবুদের মতন লোকেদের ক্ষেত্রে ব্যাংকের সুদের পরিমাণটা যে কমেই যাচ্ছে প্রতিমাসে গত কয়েকবছর ধরে।  ব্যাংকে মাসের প্রথমে টাকা তুলতে গিয়ে পান গতমাসের চেয়েও কম পরিমাণ টাকা। ক্যাশিয়ার সঞ্জীবকে জিজ্ঞেস করতে উত্তর পান - 'মেসোমশাই, সুদ যে আরও কমে গেল। কী করবো বলুন। সিনিয়র সিটিজেন প্রকল্পে যেখানে আপনি আর মাসিমা পনেরো পনেরো করে তিরিশ লাখ রেখেছেন, শুনছি এই মাসে ওটারও সুদ কমে যাবে। আপনাদের দু'জনের ডিপোজিট'দুটো আবার পরের মাসে ম্যাচিওর করবে দেখছি।'
    অনিলবাবু চিন্তিত মুখে বেরিয়ে আসেন ব্যাংক থেকে। প্রতিমাসেই টাকার পরিমাণটা যে কমে যাচ্ছে ! কী করে চলবে দুই বুড়ো-বুড়ির সংসার এখন ! সারাজীবন কারুর কাছে হাত পাতেননি, কারুর মুখাপেক্ষী হননি। থেকেছেন রাজকীয় চালে। আজও চাইবেন না কিছু, ছেলে মানসের থেকে। যদিও সে আর বৌমা সবসময় জিজ্ঞেস করে কিছু পাঠিয়ে দেবে কীনা। অনিলবাবু আর শান্তিদেবী দু'জনেই না করেন। বলেন, 'আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি। আমাদের আর কী খরচ ! তোমরা সুখে-শান্তিতে থাকো, সেটাই সবসময় প্রার্থনা করি রাধামাধবের কাছে।' 
    এদিকে বেড়ে চলেছে সব জিনিসের দাম।  গ্যাস, পেট্রল, ডিজেল। বাজারে সব জিনিস আক্রা এখন। সবাই দিচ্ছে দোহাই পেট্রল, ডিজেলের উর্ধমুখী দামের। এদিকে আবার বেড়ে গেছে ওষুধের দামও। আজ মানসের মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। এখন থেকে একবেলাই হোম ডেলিভারি থেকে খাবার নেবেন। রাত্তিরবেলায় না নিলেও চলবে, দুই বুড়ো-বুড়ি দুধ মুড়ি খেয়ে নেবেন। হোম ডেলিভারিও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গাড়ি কবেই বিক্রি করে দিয়েছেন। আর কোথায় খরচা কমাবেন ! ওষুধে তো কোনো কার্পণ্য করা চলবে না। নিজেকে খেতে হয় প্রেসারের ওষুধ, আর মানসের মায়ের সুগার ছাড়াও আছে নার্ভের ওষুধ। এছাড়া দু'জনকেই খেতে হয় ভিটামিনের ট্যাবলেট। আর নিজের আর শান্তিদেবীর জন্য রাখেন সংবাদপত্র আর দেশ পত্রিকা। এটা বন্ধ করা যাবে না। এই একটাই নেশা দু'জনের - বই পড়া। এটা ছাড়তে পারবেন না। আগে ঘনঘন চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল, ভালো চা-পাতার। চা-পাতাটা বজায় আছে, কিন্তু খান এখন মাত্র দু'বার। 

    পাতা ৭৪ : কয়েকমাস পরের ঘটনা। অনিলবাবু বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছেন, 'কে আছিস বাবা, একটু দয়া কর আমাদের প্রতি। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দিচ্ছি। এই বিষাক্ত গ্যাস'টা  ছড়িয়ে দে বাবা একটু ঘরের মধ্যে। মরে পড়ে থাকি ঘরের মধ্যে, যেমন মশা পড়ে থাকে মরে ঘরের মধ্যে। কোনো চিন্তা নেই তোদের, সুইসাইড নোট'টা পুলিশ ঘরের মধ্যে টেবিলের উপর পাবে।'
    রাস্তার লোক আসা-যাওয়ার পথে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন অনিলবাবুকে। হঠাৎ ওনার কী হলো ? অনেকেই কালকে দেখেছে অনিলবাবুকে ব্যাংকে টাকা তুলতে। কুশল-বিনিময়ও হয়েছে। তবে মনে হচ্ছিলো, উনি একটু মনমরা ছিলেন। ভালো আছি, হ্যাঁ, হু --- করেই দায়সারা গোছের উত্তর দিচ্ছিলেন।

    পাতা ৭৫ : অনিলবাবুর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনেন ঘরের মধ্যে, শান্তিদেবী। 'তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? লোক হাসাতে বাইরে দাঁড়িয়ে কীসব বলে যাচ্ছ তখন থেকে। আর এই মশা মারার গ্যাস দিয়ে কী মানুষ মরে ?'
    দুই'হাত মুখে চেপে অনিলবাবু বসে পড়েন ধপ করে সোফার উপর। একটু ধাতস্থ হলে দেখা যায় ওনার দু'চোখ বেয়ে জলের ধারা। 'কী করবো তুমি বলো শান্তি। গতকাল আমি তোমার হাতে ৮০০ টাকা কম ধরিয়েছি, গতমাসের চেয়ে। কী করে তুমি সংসার চালাবে এই টাকায় ? গতমাসেই আমরা দুধ এক প্যাকেট কমিয়ে দিয়েছি। লিকার চা খাচ্ছি এখন। তুমি দুপুরে ভাতের সাথে একটু দই খেতে ভালোবাসো। সেটা বন্ধ করে দিয়েছো।'
    'তুমি এইসব নিয়ে চিন্তা বন্ধ করো। সংসার আমি ঠিক চালিয়ে নেবো। একটু ধৈর্য্য ধরো, আশা রাখো নিজের উপর। তুমি ভুলে গেলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা "মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।" এই সুন্দর পৃথিবীকে দেখার সাধ চিরন্তন। এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থেকে জীবনের স্বপ্নগুলোকে পূরণ করাই তো জীবনের মানে। যখন বৃষ্টি পড়ে, তুমি জানালা বন্ধ না করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিতে থাকো মাটির সোঁদা সোঁদা সুগন্ধ। জানালার বাইরে হাত পেতে উপভোগ করো বৃষ্টির ফোঁটা। শরৎকালে ভোরবেলায় উঠে বাচ্চা ছেলের মতো আজও কুড়িয়ে আনো বাগানের উঠোন থেকে শিউলি ফুল। বারান্দায় বসে বিকেলের চা খেতে খেতে দেখতে থাকো পাখিদের ঘরে ফেরা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উপভোগ করো এই সুন্দর ভুবনের স্বাদ, গন্ধ, বাতাস। এতেই আসবে জীবনের সপূর্ণতা, হবে মোক্ষলাভ।'  

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 121.200.237.26 | ০৫ জুলাই ২০২২ ১২:৫০509662
  • একটা খুব প্রাকটিক্যাল , বার্নিং সমস্যা নিয়ে চমৎকার সাবলীল লেখা।
     
    কুডোস। 
     
  • Supriya Debroy | ০৫ জুলাই ২০২২ ১৩:১৯509663
  • ধন্যবাদ অমিত। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন