এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জয়গুরু ট্রেডার্স

    Swati Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ মে ২০২২ | ৩৬৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • আজ আঠাশ দিন হল বাংলা নতুন বছরে পড়েছে। চলে গেছে অক্ষয় তৃতীয়া ও। বাংলার তারিখ গুলো আর মনে নেই। কেউ জিজ্ঞেস করলে লজ্জায় পড়ি। ক্যালেন্ডার ও আসে না বাড়িতে। ফোনে আ্যপ আছে। দারুন একটা পরিবর্তন। তবে সেটা নিদারুণ মনে হল এই সেদিন। বাড়িতে পুরোনো ব‌ইএর তাক ঘাঁটতে বসেছি। জঞ্জাল সাফাই হবে। ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ দেখলাম রবি ঠাকুর উ‍ঁকি দিচ্ছেন‌ অপ্রয়োজনীয় ব‌ই এর ভিড় থেকে। বার করতেই নজরে এল ১৯৯৯এর ভৌত বিজ্ঞানের ব‌ই। ক্লাস দশম। নাম ......। তৎক্ষনাৎ স্হির পুকুরে যেন ঢিল পড়ল। ঢেউ এর তরঙ্গ টলটল করে উঠল। একরাশ প্রজাপতি ঝিলমিল করে উড়ে গেল। আমি হারিয়ে গেলাম ২৩বছর আগে। মনে পড়ল ব‌ই এর মলাটটা ছিল পয়লা বৈশাখে পাওয়া এক ক্যালেন্ডারের। ২৩বছর আগের একটা ক্যালেন্ডার। সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে বসে আছে  বাতিল হ‌ওয়া এই ব‌ইটি। হ্যাঁ, পয়লা বৈশাখ আর ক্যালেন্ডারের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বরাবরের। অন্তত বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে । তবে এ ক্যালেন্ডার ডাব্বু রতনানির ক্যালেন্ডার নয়। এ নেহাত বাঙালির ব্যাবসা আর সংস্কৃতির এক মেলবন্ধন এর সাক্ষ্য। ব্যাবসায়ী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা আর তার সাথে চারপাশে ব্যবসায়ী পরিবেশ, তার ফলস্বরূপ পয়লা বৈশাখে নববর্ষের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি হালখাতার জাঁকজমক ও দেখেছিলাম ছোটো থেকে। সেখানেই লক্ষ্য করেছি কিভাবে সামান্য একটা ক্যালেন্ডারকে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার সময় দোকানের মালিক তার স্বার্থে তাতে জুড়ে দিল সৌন্দর্য ও রুচিশীলতার আভরণ। ক্যালেন্ডার হয়ে উঠল তার ব্যাবসার টি.আর.পি। ব্যাস হালখাতা করতে আসা খদ্দের মিষ্টির প্যাকেট আর রসনার গ্লাসের পাশাপাশি হামলে পড়ল ক্যালেন্ডার সংগ্ৰহে। ফ্রিতে ওয়াল হ্যাংগিং। হোম ডেকর আর কি।

    আমাদের বাড়িতেও আসত বিভিন্ন রকমের ক্যালেন্ডার। তাতে তারিখের জায়গাটা হয়ে যেত গৌন মুখ্য হত রকমারি ছবি। কোনো ব্যাবসায়ী হয়তো পরম্পরা অনুযায়ী শুধু কালি ঠাকুরের ছবি করেন। এবং অবাক ব্যাপার ছবির কখনো পুনরাবৃত্তি হয় না। আবার কেউ হয়ত শ্রীকৃষ্ণ। কেউবা মহাপুরুষের বানী। ছবি যাচাই করে সেসব চলে যেত বিভিন্ন ঘরে। কোনোটা ঠাকুর ঘরে, কোনোটা বা  পড়ার ঘরে। আর মনীষী দের ছবি যুক্ত। সেসব অপরিহার্য ভাবে ব‌ইএর মলাট। না মলাট দেওয়ার স্পেশাল ব্রাউন পেপার কখনো কিনিনি। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল থেকে লাস্ট গার্ল সবার‌ই ক্যালেন্ডার ই ছিল ব্রাউন পেপার। সুন্দর রি ইউজ। তা যাই হোক। রবি ঠাকুর মলাটে জ্বলজ্বল করছে। আর স্যার ব‌ই চাইতে না চাইতেই সেই ব‌ই চলে যাবে স্যারের টেবিলে সবার আগে,যদিও বছরের শেষে রবি ঠাকুরের নাকে নথ, চোখে কাজল‌ও থাকবে ।

    বাড়িতে ক্যালেন্ডার আসার কিছু দিনের মধ্যেই তারিখ গুলো আরও বিশেষ হয়ে উঠত। কোনোটার পাশে দুধ‌ওলার টাকা দেওয়ার তারিখ, কোনোটার পাশে গ্যাসের তারিখ। কোথাও পিসিমার নাতির পৈতের তারিখ। তিথি নক্ষত্র, একাদশী, পূর্ণিমা, অমাবস্যা দেখার জন্য একখানি ক্যালেন্ডার ছিল সব বাড়িতে অপরিহার্য। পুরোনো বাড়িতে গেলে দর্জার মাথায় যদি বড় করে বাঁধানো দুর্গা, কিংবা কালি বা মহাদেবের ছবি  দেখা যায় তবে তা নির্ঘাত ক্যালেন্ডার থেকে প্রাপ্ত বুঝতে হবে।

    ক্যালেন্ডারটা দেওয়ালের যেখানে একটা পেরেক থেকে সারা বছর ঝুলে থাকত ওর একটা একটা করে ফুরিয়ে যাওয়া তারিখ গুলো নিয়ে সেখানে ও তৈরি করত একবছরের  একটা জীবন চক্র। তার দাগ আঁকা থাকত দেওয়ালে। ঠিক কম্পাস দিয়ে তৈরি মনে হত। পরের বছর আবার নতুন ক্যালেন্ডারের সংযোজন হবে সেখানে। আবার চলবে বৃত্ত আঁকা। পয়লা বৈশাখ ছাড়া আলাদা করে যে ক্যালেন্ডার কিনতে পাওয়া যায় সেটাই অনেক বুড়ো বয়সে অবধি জানতামনা। একবারের একটা ঘটনা  বেশ স্পষ্ট মনে আছে। মায়ের সাথে গেছি হালখাতা করতে। প্রচুর মানুষের ভিড় । তার‌ প্রায় ২৫ বছর বাদে পৃথিবীতে আক্রমন করবে নভেল করোনা ভাইরাস। তাই সবাই বেশ নিশ্চিন্ত মনেই চুমুক দিচ্ছি রসনার গ্লাসে। এইসময় সেই দোকানেই এল এক বাবা এবং তার মেয়ে। বেশ তাড়া আছে দেখে বোঝা গেল। দুজনের মুখেই নববর্ষের হাসি নেই। হাতে একটা বড় ব্যাগ। তাতে ক্যালেন্ডার ঠাসা। আমার সন্দেহ হল পথচলতি দূর্বল মানুষদের ক্যালেন্ডার‌ও ওখানে আছে। তারা এসে মিষ্টির প্যাকেট নেওয়ার সাথে সাথে দুজনের ভাগের দুটো ক্যালেন্ডার‌ও দাবী করে বসল। দোকানি ও গাঁইগুঁই করছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দোকানের সুনামের স্বার্থে তাই করল। তবু তাদের মুখে হাসি ফোটাতে পারলনা। শেষ পর্যন্ত বাবা আর মেয়ে ওই সংগ্ৰহশালার কোনো একটা বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক করতে করতে চলে গেল। রসনা পর্যন্ত খেলনা। আমি আজ অবধি সেই রহস্যের সমাধান করতে পারিনি। এতে করে বাঙালীর ক্যালেন্ডার প্রীতি আমি কিছুটা হয়তো বোঝাতে পেরেছি।

    অথচ সময়ের কি খেলা। আজ পট্টি করানো মসৃন দেওয়ালে ক্যালেনডার ঝোলানোর জায়গা নেই। শ্বশুর মশাইকে পূর্ণিমা,অমাবস্যা বলে দিই আ্যপ দেখে। একাদশী তে ফোনে আ্যলার্ম সেট করা থাকে। দেওয়ালের গোলদাগ ঢেকে গেছে টেক্সচার আর্ট এ। সেখানে আ্যমাজনের  সত্যি কারের সুদৃশ্য ওয়াল হ্যাংগিং। ক্যালেন্ডার এখন চুপটি করে লক্ষী ছেলের মত ফোনের দেওয়ালের এককোনে পড়ে থাকে। তার ফড়ফড়ানি বন্ধ হয়েছে। জয়গুরু ট্রেডার্স, মুখার্জী ব্রাদার্স,ডলি ফ্যাসন এদের ক্যালেন্ডার গুলো কি হল জানতে ইচ্ছে করে। সেগুলো কি ই-ক্যালেন্ডার হয়ে গেছে? ফ্লিপকার্ট, আ্যমাজন, রিল্যায়ান্স ফ্রেস, মোর এসবের থেকে স্মার্ট বাঙালি যে কেনাকাটা করে তারা কোনো হালখাতা করে না। এভাবেই আস্তে আস্তে মুছে যায় এক একটা ধারা। এক একটা সংস্কৃতি। এক একটা পরিচিত ছবি। ক্যানভাস এক‌ই থাকে। শুধু শিল্পী আঁকতে থাকে নতুন নতুন ছবি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন