এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জাপান ৩

    Rumjhum Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ এপ্রিল ২০২২ | ৪৭৪ বার পঠিত
  • 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে, অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে.....' কখনও কখনও বাইরের দেখাতেই যেন অন্তরের দেখা মেলে। গাড়ি করে আমরা যখন নিশিকাশাই থেকে শিঞ্জুকু জিওন ন্যাশানাল গার্ডেনে পৌঁছলাম দুপুরের রোদ কিছুটা নরম হয়ে এসেছে। বিকেলের আলোয় শিঞ্জুকু গিওন (Shinjuku Gyoen) ন্যাশানাল গার্ডেন দেখে আমারো বাইরের দেখা যেন অন্তরের দেখার সঙ্গে মিলে গেল। অন্তরের অন্ত:স্থলে দোলা দিয়ে গেল হরেক রঙের বাহার। মন আপনি আনন্দে নেচে উঠল।

    সবুজ ঘাসে ঢাকা অতি যত্ন ভরে সাজানো বাগান দেখে জাপানের মানুষের আদত চরিত্রের পরিচয় পেতে অসুবিধা হল না। প্রচুর মানুষ এসেছেন চেরি ফুলের শোভা দেখতে। কয়েক জায়গায় টেবিল চেয়ার পেতে চা পানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চেরি গাছের নীচে চেরি উন্মাদনায় মাতাল মানুষের জমায়েত দেখে উপলব্ধি করলাম টেকনোলজি মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার ইচ্ছাটাকে আজও গ্রাস করতে পারে নি। হয়তো সেল্ফি তোলার হিড়িক আছে ঠিকই। কিন্তু চেরি ফুলের মোহময়ী সৌন্দর্য তাতে ম্লান হতে পারে নি। প্রচুর বিদেশি এসেছেন বাগান দেখতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল এতটুকু বিশৃঙ্খলা নজরে পড়ল না কোথাও। বিশেষ কোলাহলও না। যেন সাজানো বাগানের কোলে ভ্রাম্যমান মানুষগুলিও এই ল্যান্ডস্কেপেরই অংশ। আমরাও সেই সোনালি বিকেলে কোন এক চিত্রকরের আঁকা এক চিরন্তন ছবির অংশ হয়ে উঠলাম। গোধুলির লালচে আলোয় সময়ের ও স্থিতির সীমারেখা মুছে গিয়ে আমার দেখা সব শ্রেষ্ঠ গোধুলির সঙ্গে জায়গা করে নিল এই মুহুর্তটিও। 

    জাপানের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের উপাদান। এই বাগানও তার ব্যতিক্রম নয়। জিওন অর্থাৎ কিনা রাজার বাগান প্রায় চারশো বছর আগে স্থানীয় সামন্ত রাজা কিওনারি নাইতোর ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীকালে এদো (Edo period 1603-1868)জমানায় এই বাগান হস্তান্তরিত হয় তদানীন্তন মিলিটারি শাসকদের হাতে। ইতিহাস তার বুকে ধারণ করে আছে কত নতুন রাজনৈতিক শক্তির পতন ও অভ্যুত্থানের কাহিনী। মেজি শক্তির পুনরোত্থানে শেষ হল এদো যুগের। রাজার প্রাসাদ আর বাগান নিয়ে বানানো হল কৃষিবিজ্ঞানের পরীক্ষাগার। চলতে লাগল বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাজকর্ম। অবশেষে ১৯০৬ সালে তৈরি হল ইম্পেরিয়াল গার্ডেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাগান ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাগানকে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে আম জনতার বিনোদনের জন্য খুলে দেওয়া হল ১৯৪৯ সালে। 

    আমরা ঘুরে দেখতে লাগলাম বাগানের চারপাশ। তিন রকমের আদলে পুরো বাগানখানা সাজানো। উত্তরের দিকে ফ্রেঞ্চ আর ইংলিশ বাগান আর দক্ষিণে প্রথাগত জাপানী কায়দার বাগান। জাপানের বাগানখানায় পৌঁছে এক কোণে চোখে পড়ল সনাতনী চা ঘর। চা খাওয়ার সনাতনী ব্যবস্থা সম্বন্ধে পরের দিকে আলোচনা করব। প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছে হানামীর আনন্দ নিতে। বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠের মাঝে মাঝে আকাশ ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেবদারু গাছ।  মোটা মোটা গুঁড়ি দেখেই বোঝা যায় গাছগুলো প্রাচীন। হাঁটতে হাঁটতে পার্কের পুবদিকে পৌঁছে মোহিত হয়ে যেতে হল। তামামো নামের দীঘিখানার চারধারে ঝুঁকে পড়া চেরি ফুলের গাছ, বড় বড় গাছের ঘেরাটোপ আর দীঘির ওপর একটা ছোট্ট সাঁকো সেই অপরাহ্নের দৃশ্যপটখানাকে মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে দিল। যেটা আমার কাছে সব থেকে আকর্ষনীয় লাগল তা হল বিভিন্ন রঙের চেরি ফুলের সমারোহে প্রকৃতির আঁকা ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে ভিন্ন ভিন্ন রঙের ছোঁয়া সমস্ত প্রেক্ষাপটে এক অন্য মাত্রা যোগ করেছে। মনে প্রশ্ন জাগল চেরি ফুলের রঙ আলাদা আলাদা কেন? জানলাম  বাগানের প্রায় পনেরশো চেরি গাছের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির চেরি গাছ আছে। তাদের ফুলের রঙ আলাদা, ফোটার সময়েরও কিছু তারতম্য আছে, গাছগুলির উচ্চতারও তফাৎ আছে ফলতঃ বাগান জুড়ে সাদায়, হাল্কা গোলাপিতে, গাঢ় গোলাপি রঙে এক অন্য দৃশ্যকল্প তৈরি করেছে। 

    অনেকটা সময় বাগানে কাটিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম। সাকুরা উৎসব জাপানের ইতিবাচক জীবনীশক্তির প্রতীক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল তা ভোলে নি জাপান। নতুন আশা আর উদ্দ্যম নিয়ে উন্নত জাতি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বের দরবারে। প্রতিটি শীতের পরে বসন্তে নতুন আশার সঞ্চার করতেই যেন চেরি ফুলের শোভায় সেজে ওঠে জাপান। আর সিঞ্জুকু জিওন, যেন দ্রুতগামী জীবনশৈলীর ট্র‍্যাকে দৌড়তে থাকা জাপানের মানুষের কাছে কংক্রিটের জঙ্গল টোকিওর বুকে গজিয়ে ওঠা একবিন্দু মরুদ্যানের মতো .....
    মনের শান্তি, প্রাণের আরাম।
     
     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন