এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বন্ধন 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ মার্চ ২০২২ | ৪৮৮ বার পঠিত
  • জামিল রেললাইনের পাশ দিয়ে প্রাণপণে ছুটছিল। তিনজন তাড়া করেছে তাকে। পাশের রেলিং-এর তলা দিয়ে একটা কাঠবিড়ালির মতো শরীর গলিয়ে ওপাশে চলে গিয়ে  অ্যাঁকাব্যাঁকা গলি গুঁজির জালে মুহুর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। ওরা রেলিং পেরোনোর ঝুঁকি নিল না। অন্য এলাকায় ঢোকায় ঝুঁকি আছে। একটা ছেলে ছুটন্ত জামিলকে লক্ষ্য করে ওয়ান শর্টার থেকে একটা গুলি ছুঁড়ল। গুলিটা গিয়ে গেঁথে গেল একটা ঝোপড়ার দেয়ালে।

    ছেলে তিনটের কুড়ি বাইশ বছর বয়স। অরূপ ঘোষের হয়ে কাজ করে। তিনদিন আগে জামিলের ওয়ান শর্টারে অরূপ ঘোষের একটা ছেলে জখম হয়েছিল। জামিলের মনে হল, গুলিটা পায়ে লেগেছিল। 

    দলের আর একটা ছেলের  নাম তুফান। খুব ছোটবেলায় দুজনে একসঙ্গে নৃপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যানিকেতনে যেত। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত গিয়েছিল। তারপরে আর যাওয়া হল না। টাকা রোজগার করতে নেমে গেল দুজনে। দুজনে একসময়ে স্টেশনের টিকিট  কাউন্টারের পিছনে আপনমনে গুলি খেলত। বৈঁচির মাঠে ফুটবল ম্যাচও দেখতে যেত। এদিকে দুজনেরই সংসার ছেঁড়া খোঁড়া ফুটিফাটা। দুজনকেই রোজগারে নেমে পড়তে হল চোদ্দ ছুঁতে না ছুঁতে। তুফানকে টেনে নিল অরূপ ঘোষ আর জামিলকে তুলল অনিল চৌধুরি।

    বৈষ্ণবতলার মন্দিরে কাঁসরঘন্টা বাজছে ঢং ঢং করে। পেসাদের লোভে কটা কচি ছোঁড়া মন্দিরের সামনে ঘুরঘুর করছে। জামিল মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। দেখতে পেল ভোলানাথ পাল মন্দিরের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। ভক্তিতে গদগদ, আশপাশে কোন খেয়াল নেই। মনে মনে ঠাকুরের কাছে কি চাইছে কে জানে। ঠাকুরের যদি উপযুক্ত নেটওয়ার্ক থাকে তার জানা থাকা উচিৎ ভোলাবাবুর কাজ কারবার। অনেকের দেখাদেখি জামিল একদিন এরকম হাতজোড় করে ওখানে দাঁড়িয়ে মনে মনে খুব মিনতি করে বলল, ‘ মা .... আমার বোনটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে। ওর কষ্টটা এট্টু কমিয়ে দাও না ....’

    বলতে বলতে জামিল দেখে তার চোখের পাতা ভিজে গেছে। ওমা, সে দেখল তার স্বামীর ফেলে দিয়ে যাওয়া বোনের হাঁফানির কষ্ট সেদিন রাত থেকেই ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে গেল। তারপর তিনদিন বাদে স্টেট জেনারেল হাসপাতালে বোনটা মারা গেল। এই গ্যাঁড়াকলটা ঠাকুর করল কিনা ঠিক বোঝা গেল না, তবে তারপর থেকে ঠাকুরের গতি ডপ্রকৃতির ব্যাপারে জামিল খুব সন্দিহান হয়ে উঠল। মাননীয়কে আর কিছু বলার ‘রিস্ক’ সে নিতে পারে নি। তার খুব ইচ্ছে আছে ভোলানাথবাবুর সঙ্গে ‘মা’ - এর সম্পর্ক কেমন সেটা জেনে নিতে। তাহলে তার মাধ্যমে ওনাকে কিছু বক্তব্য পেশ করা যেত। আজকাল তো রেফারেন্স ছাড়া কোন কাজ হয় না। ভোলানাথবাবু হাই লেভেলের মানুষ। তাকে এসব কথা বলা সহজ নয়। জামিল তবু তক্কে তক্কে সুযোগের সন্ধানে আছে।

      অবিনাশ হালদার যেন অন্য জগতে থাকে। ভোরবেলা থেকে সাইকেল নিয়ে চক্কর মারতে থাকে। তার সবচেয়ে প্রিয়জন হল এই সাইকেলটা। ভোরের বকের পালকের মতো নরম কোমল আলো যখন ভৈরবীর তানের মতো শর্ষে ক্ষেতের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যায় অবিনাশের সাইকেলের চাকা রাস্তার অমলিন ধুলো মেখে গড়িয়ে যেতে থাকে .... গড়িয়েই যেতে থাকে। সারা গায়ে আবীরের মতো সূর্যের আলো মেখে এপাড়া সেপাড়া, বটতলায়, বকুলতলায়, বৈষ্ণবপাড়ায়, নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে মনোরম ভ্রমণ করে সে প্রতিদিন। অবিনাশ হালদার নাকি বাংলার বাইরে অনেক দূর দূর দেশেও ঘুরে এসেছে শুধু সাইকেলটা নিয়ে। জামিলও ভাবে সেও তার সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। অনেক দূর দূর দেশে যাবে যেখানে কোন অনিল চৌধুরী নেই। সে চোখ বুজে দিবাস্বপ্ন দেখে একটা নীল সমুদ্রের পাশ দিয়ে একটানা সাইকেল চালিয়ে চলেছে সে সারা গায়ে রোদ্দুর মেখে।

    তুফান কি এই মন্দিরে এসে ঠাকুরের কাছে কিছু চেয়েছে? তুফানের একটা দাদা ছিল। মাস ছয়েক আগে মার্ডার হয়ে গেল। রেললাইনের ধারে বডি পড়ে ছিল। এখনও কেউ অ্যারেস্ট হয়নি। মার্ডার কি সুইসাইড পুলিশ ধন্দে আছে। অরূপ ঘোষের কাজই করত। তার দাদা মরবার পর অরূপবাবু তুফানকে দলে টেনে নিল। তুফান কিছুদিনের মধ্যে পিস্তল চালাতেও শিখে গেল।ছোটবেলায় জামিলের সঙ্গে একটু জায়গা পেলেই গুলি খেলত। খেলা শেষ হলে দুজন দুজনের সঙ্গে গলায় গলা জড়িয়ে বাড়ি ফিরত। পকেটে কুলকুল করে বাজত কাঁচের গুলি। এখনও তুফান আর জামিলের কাছে গুলি আছে। সেটা পিস্তলে ঠুসে মানুষের শরীরে ভরে দেবার জন্য। না মারলেও অন্তত ঠনঠনাঠন..... চমকানোর জন্য।

    সূর্য ডুবতে চলেছে পশ্চিম দিকে আকাশ লাল করে। বেলা ঝিম মেরে গেছে। মাথাভাঙার ওদিক থেকে সাইকেল চালিয়ে অবিনাশ হালদার আসছে। থেকে থেকে ধুলো উড়ছে রাস্তায়। জামিলের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল অবিনাশ। এই সাইকেলটাই তার জীবনের একমাত্র সাথী। সে ঠিক করেছে পরের মাসে ইন্দোনেশিয়া আর মালয়েশিয়ায় যাবে সাইকেল চালিয়ে।

    ভোলানাথ পালকে ধরেছে বর্ডার পারমিট এবং আইনকানুনের ব্যাপারটা দেখে দেওয়ার জন্য। ভোলাবাবু অনেক কিছুই ‘দেখে  দিতে’ পারেন। তিনি অনেককে অনেক কিছু দেখে দেন। বিনিময়ে কিছু চান না। শুধু মুচকি হেসে বলেন, ‘ সঙ্গে থেকো কিন্তু ...’।

    তাই অবিনাশকেও মাঝে মাঝে সঙ্গে থাকতে হয়। সে কি আর রোজ। মিটিং মিছিল থাকলে টাকলে। এটুকু করতেই হয় টিকে থাকতে গেলে। অবিনাশ যতই ভ্রমণপিপাসু সাইকেলপ্রেমিক বাউন্ডুলে হোক সে বোকা নয়, এটুকু কান্ডজ্ঞান তার আছে। ভোলাবাবু হল অনিল চৌধুরির ডান হাত।
      
    শনিবার ভোলাবাবু ফের হাত জোড় করে চোখ বুজে মন্দিরের ঠাকুরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। জামিল ভাবল, এই সুযোগ।সে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল যাতে মায়ের সাথে ভোলানাথবাবুর ‘কানেকশান’-এর ব্যাঘাত না ঘটে। সে যাই হোক, মিনিট পাঁচ সাত পরেই ভোলাবাবু ফিরে এলেন। জামিল এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ ভোলাদা ভাল আছেন। অনেকদিন পরে .....’

    এটা বলার কোন মানে হয় না। ভোলাবাবুকে জামিল প্রায় রোজই দেখছে। সে ভাবল ভোলাবাবুকে একবার বলে দেখা যাক না। 

    — ‘ খুব প্রবলেম যাচ্ছে ক’মাস ধরে । আপনি যদি একটু বলে দেন। আমরা তো লো ক্লাসের .... আমাদের কথা ঠিক জায়গায় যাবে না।’ 
    জামিল ওই ‘কানেকশান’ সম্পর্কিত ব্যাপার বলতে চাইল আর কি। মা নিশ্চয়ই ভোলাবাবুর কথা শোনেন। নইলে তার এত বাড় বাড়ন্ত হল কি করে।
    — ‘ না না ....আমার বলার কোন দরকার নেই। তুই বললেই হবে।’
    জামিল বলল,  ‘আমি বললেই হবে ? কিন্তু ..... ’
    ‘ হ্যাঁ  হ্যাঁ ..... তুই বললেই হবে। অনিলদা  সকালের দিকে আটটা থেকে নটা ফ্রি থাকে শুক্রবার ছাড়া। ওইদিন ওনার বিপদহারিণী ব্রত থাকে। ....এক্সট্রা মেশিনের দরকার থাকলে কথা বলে নে .....’। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ দুটো ছঘরা আনানো হয়েছে মুঙ্গের থেকে। যদি দরকার লাগে .... ঠিক আছে .... কথা বল ...কথা বল।’

    জামিল বুঝতে পারল  কানেকশানটা বরাবর লাগল না। আপাতত আর না ঘাঁটানোই ভাল।   

    মন্দিরের পুজো শুরু হয়ে গেল ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে।অবিনাশ হালদারের সাইকেল .... শর্ষে ক্ষেতে ঋজু মালিন্যহীন রোদ্দুর ভেঙে ভেঙে গড়িয়ে যেতে লাগল কাঁঠালিতলার জঙ্গলের দিকে। ওখানে সাইকেল থামিয়ে অবিনাশ রাস্তার ধারে জলবিয়োগ করছে জঙ্গলের বুনো গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে। এতে যে কি সুখ শুধু সেই
    জানে।

    মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশান পরের সপ্তাহে। শতরূপা বিদ্যামন্দির এরিয়ায় ডিউটি পড়ল জামিলের। কানাঘুষায় শুনেছে অরূপবাবু  ক্যাম্প ফেলবে বিল্ডিং-এর পাশের দিকটায়। তুফান নাকি লিড দেবে। 

    শুক্রবারে অনিল চৌধুরির বিপদহারিণী ব্রত থাকে। সারাদিন সরবৎ ছাড়া আর কিছু খান না। সন্ধের পর একটু লুচি তরকারি ....। 

    শনিবারে জামিল এবং আরও দুজনকে ডেকে পাঠালেন অনিলবাবু। বললেন, ‘পোলিং টাইমে কোন প্রবলেম হবার কথা নয়। ছটার পরে হতে পারে। রেললাইনের পাশে গার্ডরেলের দুটো দিকই ডেঞ্জারাস। তোরা তোদের এরিয়াটা ধরে রাখবি। ফাইট যদি হয় এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়বি না। জামিলের কাছে মেশিন থাকবে। ও সামলে নেবে।’

    একবার, বর্ষাকাল — দুটো ছোট ছেলে গলাগলি করে বিলের পুকুরে  দুটো ছোট ছোট ছিপ নিয়ে গেল ট্যাংরা আর কই মাছ ধরতে। ছড়িয়ে থাকা বিশাল জলরাশি। পুব দিকে জলের কিনারা ঘেঁসে জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে নিজের ছায়া দেখছে একটা লম্বাটে খেজুর গাছ। ওই গাছটার পাশে বসল দশ বছর বয়সী তুফান আর জামিল। কুচো চিংড়ির চার যোগাড় করেছিল বকুলতলার বাজারের মাছওয়ালা পরিতোষকে ধরে। পরিতোষ বড় ভাল লোক। সবসময়ে হেসে হেসে কথা বলে। এখন আর বেঁচে নেই পরিতোষ। গতবছরে মারা গেছে।

    দুজনে জলে বঁড়শি ফেলল  লম্বাটে খেজুর গাছটার তলায় বসে। চারদিক নি:ঝুম। বাতাস বওয়ার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। তিরতিরে সরল হাওয়া জলে যাচ্ছে মিশে।

    বড্ড ধার ঘেঁসে বসেছে জামিল। পায়ের তলায় ঝুরঝুরে শুকনো মাটি। ফাতনা নড়ছে ফিরফির করে। ট্যাংরা মাছে ঠোকরাচ্ছে বুঝি। উত্তেজনায় ধড়ফড় করে উঠল জামিল ..... ‘ওই .. ওই ... শশ্  .... শশ্  ... ’

    জামিলের উত্তেজিত পায়ের চাপে ঝুরো মাটি সরসর করে নেমে গেল বিলের ঢালে জলের দিকে। জামিল হাঁচোড় পাঁচোড় করে মাটি খামচে ধরে জলের দিকে তার পতন আটকাবার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ হল না। জামিলের শরীর পাড়ের ধারে কোল ছড়িয়ে বসে থাকা জলের কোলে গিয়ে পড়ল। জামিল সাঁতার জানত না তখন। প্রবল প্রাণভয়ের তাড়নায় বাঁচার জন্য আবোল তাবোল  হাত পা ঝটপট করতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় তুফান ভয়ে পাথর হয়ে গেল। অসহায় বিপন্ন  বিষ্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে রইল ডুবন্ত জামিলের দিকে। সে নিজেও সাঁতার জানে না। ভাগ্য ভাল ঝাপটাঝাপটি করতে করতে পাড়ের কিনারে একতাল কাদায় গিয়ে পড়ল জামিলের একটা হাত। যান্ত্রিক প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় নরম কাদার তালটা খামচে ধরল তার ডানহাত। কয়েক মুহুর্তের জন্য আটকে গেল তার অবশ্যম্ভাবী নিমজ্জন। সেই ক্ষণিকের সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাড়ের ঢালে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল তুফান।তারপর জলের মধ্যে নিজের ছিটকে পড়ে তলিয়ে যাওয়ার ভীতি নস্যাৎ করে জামিলের হাত ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান। ওই টানেই উঠে এল জামিলের হাল্কা শরীর। কাদায় মাখামাখি হয়ে দুটো শরীর যেন লেপটালেপটি হয়ে মিশে গেল। দুটো প্রাণই টিকে রইল কালের স্রোতে ভেসে ভবিষ্যতে দুই যুযুধান দু পক্ষের দায়বদ্ধ রক্তপিপাসু সেনানী হয়ে।

    শতরূপা বিদ্যামন্দিরের পিছনের জমিতে অকারণে দুপক্ষের ক্ষিপ্ত বচসা শুরু হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। অবিনাশ হালদার পাশের রাস্তা দিয়ে কাঁঠালিতলার জঙ্গলের দিকে যাচ্ছিল নানা জাতের পাখি দেখার জন্য। ওখানে ফি বছরে এই সময়ে রাজ্যির পাখি এসে জুড়ে বসে। সারা দিনমান ওদের কত রকমের কথাবার্তা পাতায় পাতায় ডালে ডালে। রাত হলে চুপচাপ... নি:ঝুম। পাতাপত্তরের মধ্যে দিয়ে উদাস হাওয়ার মর্মর লাগে ক্ষণে ক্ষণে ঝরঝর ঝরঝর করে।

    অবিনাশ দেখল দুটো ছেলে মোটা ডান্ডা দিয়ে অরূপ ঘোষের বাইকে দমাদ্দম পেটাই করতে লাগল। কি কারণে তা বোঝা অবিনাশের মতো ন্যালাক্ষ্যাপা লোকের সাধ্যি না। সে যাই হোক, এতে বিষ্ফোরণের সলতেতে আগুন লাগল। একটু ঢেকেঢুকে রাখা দাঁত নখগুলো দিনের আলোয় প্রকাশ্যে বেরিয়ে এল। দেখা গেল দু পক্ষের সৈন্যরাই অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত। অবিনাশ কাঁঠালিতলার জঙ্গলের পাখির ঝাঁকের কলকাকলির কথা ভুলে গেল। এক পা মাটিতে রেখে সাইকেলের সিটে বসে রইল স্থানু হয়ে। 

    বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি চলল। সাধারণ সাতে পাঁচে না থাকা লোকজন পড়ি কি মরি করে ওখান থেকে হাওয়া হয়ে গেল দু মিনিটের মধ্যে — তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সংক্রান্ত কর্ত্তব্যকর্ম ফেলে দিয়ে। 

    জামিল দেখতে পেল তার দলের দুটো ছেলে হাতে খোলা পিস্তল নিয়ে তুফানকে তাড়া করেছে। তুফানের হাতের পিস্তলের মনে হয় গুলি সব খরচ হয়ে গেছে। সে রেললাইনের রেলিং-এর দিকে প্রাণপণে ছুটছে কোন তাড়া খাওয়া ভয়ার্ত জন্তুর মতো। রেললাইন পেরিয়ে ওপারে যেতে পারলে সে এ যাত্রা বেঁচে যাবে। ওটা ওর এলাকা। পেছন পেছন ছুটছে জামিলের দলের, মানে অনিল চৌধুরীর দলের দুটো ছেলে। জামিল ওদিকে তাকিয়েই বুঝে নিল তুফান রেললাইন পর্যন্ত যেতে পারবে না। এখনও প্রায় একশ গজ বাকি। তার মনে হঠাৎ দুলে উঠল সেই বিশাল বিলের পুকুরের অগাধ উদাস জলরাশি এবং সে কোনক্রমে নিজেকে আটকে রেখেছে গভীর অতল জলের গ্রাস থেকে — জীবন ও মৃত্যুর পলকা সীমারেখায়। কোনরকমে কাদা পাকড়ে ধরা ডানহাতে লাগল তুফানের হ্যাঁচকা টান। সে স্বপ্নের ঘোরের মতো উঠে এল জীবনের এ পারে।

    তুফান ছুটছে হাতের মুঠোয় জীবন ধরে রেখে। বোঝাই যাচ্ছে তার দম ফুরিয়ে আসছে। এখনও প্রায় পঞ্চাশ গজ বাকি। তুফান কিসে যেন হোঁচট খেল এবং মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। অনিল চৌধুরির ছেলে দুটো পিস্তল তাক করেছে। ওদের পিছন থেকে দুটো ফায়ারিং শটের শব্দ হল। ছেলে দুটো পিস্তল হাতে ধরা অবস্থাতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। দুজনই জামিলের গুলি খেল পায়ে।

    জামিল এগিয়ে গিয়ে দুপা দিয়ে চেপে ধরল পিস্তল ধরা দুটো হাতের কব্জি। পিস্তল দুটো ছাড়িয়ে  নিল দুহাতের মুঠো থেকে। এক দৌড়ে ছুটে গেল হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা তুফানের দিকে  
    ঠিক যেভাবে  বিলের পুকুরের ঢালে, জলের ওপর হেলে থাকা লম্বাটে খেজুর গাছের নীচে কাদার কিনারে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল ভয়ে দিশাহারা ডুবন্ত জামিলের দিকে একটা ছোট হাত বাড়িয়ে দিয়ে। 
        
    জামিলের হাতে তিন তিনটে পিস্তল। তিনটে পিস্তলই পকেটে আর কোমরে গুঁজে রাখল। 

    এক হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে মাটির ওপর আধশোয়া হয়ে জামিলের দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে তুফান কোন বিষাক্ত আক্রমণের প্রতীক্ষা করছে। 

    জামিল তুফানের শরীরের একেবারে ধারে গিয়ে দাঁড়াল। ওর চোখের ওপর দুটি মগ্ন চোখ রেখে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল ধুলোয় পড়ে থাকা মানুষটার দিকে। এক হ্যাঁচকা টানে তুফান গিয়ে পড়ল জামিলের বুকের ওপর।

    চুনচুন চুনচুন করে ঘুরে যাচ্ছে অবিনাশ হালদারের সাইকেলের চাকা। বুনো কাঁঠালিতলার গাছপালায় এখন অগুন্তি কূলায় ফেরা পাখির কল কাকলি।

    শেষ বেলার রাঙা আলো আকাশ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে একনাগাড়ে প্যাডেল মেরে যাওয়া অবিনাশ হালদারের শরীরে। 

    ....................    ‌‌..............    ..............
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন