এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • হোটেল ম্যানেজার - ১৪

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ৩৫২ বার পঠিত
  • অমিতাভর ফোন কিন্তু আজকে আর বেজে উঠল না। দিগ্বলয়ে সূর্যাস্তের শোভা দেখতে দেখতে  একাকী বসে থাকতে থাকতে অমিতাভর মনে হল সেও তো মনীষাকে একটা কল দিতে পারে। এতে দোষের কি আছে। মনীষা পাল তো মানসিকভাবে ভীষণভাবে ভেঙে পড়ার মুহুর্তে তাকে অনেকটাই মানসিক শক্তি জুগিয়েছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। সে অকারণেই নিজের মনের কাছে জবাবদিহি করতে লাগল যে, কৃতজ্ঞতা হিসেবেও তার অন্তত একটা ফোন করার কর্ত্তব্য থেকেই যায়। শুভঙ্কর পালের সঙ্গে তো সে কোন মাখামাখি করতে যাচ্ছে না। তাছাড়া তার কোম্পানিতে ভিআর এস হয়ে যাবার পর মনীষা তাকে কি ধরণের সাহায্য করতে পারে সেটাও জানা দরকার। এইভাবে গভীর অন্তর্মুখী অমিতাভ খোলামেলা জটিলতাহীন, এক ছেলের মা সাদাসিধে মনীষা পালকে সামান্য একটা ফোন কল দিতে আগডুম বাগডুম হাজারো অঙ্ক কষতে লাগল। এত দ্বিধা দ্বন্দ্বের কারণটা তার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়। দোলাচলটা কিসের ? মনীষা তো তার অপরিচিত লোক নয়। আর সে কাউকে কোন প্রস্তাবও দিতে যাচ্ছে না। মনীষা নিজেই তো বলেছিল.... । তারপর আবার ভাবল, বলেছিল তো এই সবে দুদিন আগে। এর মধ্যে খোঁজ নেবার কি আছে !  তারপর ভাবল কোন উদ্দেশ্য ছাড়া কি পরিচিত কাউকে ফোন করা যায় না ? এইসব অবান্তর কথা ভাবতে ভাবতে তার নিজের বৌ ঋতুপর্ণার কথা আর ছেলে চিরাগের কথা মনে পড়ল। কেন কে জানে। আরও খানিকক্ষণ কেটে গেল চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে। বেলা ছোট হয়ে গেছে অন্ধকার নেমে আসছে তাড়াতাড়ি। 
    অমিতাভর আবার মনে হতে লাগল, মনীষাকে একটা কল দিয়েই দেখি কি বলে ....
    কনট্যাক্ট লিস্ট বার করে ‘মনীষা পাল’ নামে আঙুল ছোঁয়াল। 
    মোবাইলে রিং হতে শুরু করলে কোন অজ্ঞাত কারণে তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। মোবাইল ফোনে পুরণো একটা হিন্দী ফিল্মের গান বেজে যেতে লাগল প্রায় তিরিশ সেকেন্ড ধরে। অমিতাভর মনে হল লাইন কেটে দেয়। লাইন কেটে দিলেই হয় .... সেটাই ভাল .... কি দরকার ....
    ঠিক সেই সময়ে মনীষার আওয়াজ জেগে উঠল ওদিক থেকে একইরকম প্রাণবন্ত স্বরক্ষেপে — ‘ হ্যাঁ .... হ্যালো ... বলুন.... এখন কোথায় ? লজে না অফিসে ? অ্যা..ই বান্টি ... এদিকে আয়.... আয় বলছি... উ: আর পারি না.... নছ্ছার কোথাকার ....হ্যাঁ বলুন বলুন ... হ্যালো .... হ্যালো ....’
    — ‘ না .... এই রাস্তায় আছি একটু .... মানে, ভাবলাম আপনার একটা খবর নিই.... তাই ... আপনি বোধহয় ব্যস্ত আছেন .... ডিসটার্ব করলাম ....’
    — ‘ হা: হা: হা : হা : .... কি যে বলেন ! আমি আবার একটা মানুষ , তাকে আবার ডিসটার্ব ! আমি কোন সময়েই ব্যস্ত থাকি না, ঘুমোবার সময় ছাড়া। ঘুমোতে আমার খুব ভাল লাগে। ওটাই আমার সবচেয়ে ফেভারিট কাজ।হ্যাঁ ব্যস্ত যদি বলেন তো আমার কর্তা । তার কোন সময়ে নিশ্বাস ফেলবার ফুরসৎ নেই। যাক , আপনার খবর বলুন । ওখানে আর কদিন ? ‘
    এইভাবে একতরফা অনর্গল আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে থাকে মনীষা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে।
    অমিতাভ এই বাক্যপ্রবাহের মধ্যে একটু ফাঁক পেয়ে বলল, ‘ আর ... এই তো হয়েই এল ... আর কটা দিন ।’ বলে একটু শিথিল প্রশ্বাস নেবার চেষ্টায় কথাটা একটু অন্যদিকে নিয়ে যেতে চাইল । আর কোন কথা না পেয়ে একটা বস্তাপচা বোকা বোকা কথা বলল—- ‘ আপনি কেমন আছেন ? ‘
    তক্ষুণি জবাব এল— ‘ আমি সবসময়ে ভালই থাকি। কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামাই না। ভালভাবে একটু ঘুমোতে পেলেই হল। এই ... ছেলেটা বড্ড জ্বালায় ... এছাড়া আর কোন জ্বালা নেই.... আমার দুই জা কিন্তু মোটেই এরকম নয়। তারা কতরকম যে চিন্তা ভাবনা করছে দিনরাত তার ঠি ক নেই। আরে বাবা অত চিন্তা করে হবেটা কি ? যা কপালে লেখা আছে তাই তো হবে ।’
    অমিতাভ মৃদুকন্ঠে বলে , ‘ হ্যাঁ, সে তো ঠি কই ।’ তারপর কি বলবে ভেবে পায় না। 
    মনীষাই আবার কথা বলে, মানে একটা দরকারি প্রস্তাবে ঢোকে। 
    বলে , ‘ আপনি কোন চিন্তা করবেন না । আপনার কথা আমি চন্ডীবাবুকে বলে রেখেছি । আপনার অফিসের আরও কে একজন অছে না ? অলোক না , কি যেন নাম ? ‘
    কোন গোপন রহস্যময় কারণে, মনীষার মুখে অলোকের নাম শুনে কেমন একটা অপছন্দের অনুভূতি বুকের ভেতর বয়ে গেল। মানুষের মনের সব অনুভূতি তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
    অমিতাভ একইরকম মৃদু এবং পরিশীলিত কন্ঠে বলল, ‘ হ্যাঁ একজন আছে । কিন্তু চন্ডীবাবু কে ... ঠিক বুঝলাম না .... ‘
    — ‘ ও আপনি চিনবেন না । চন্ডীকাপ্রসাদ পতিতুন্ডী । হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের বড় কন্ট্র্যাকটার। এই মেচেদাতেই বাড়ি। ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের খুব ভাল রিলেশান।ওর হাতে অনেক কাজ। আপনাদের একটা কিছু হবে বলে আমার মনে খুব আশা।’
      ‘ আপনার’ জায়গায় মনীষার মুখে দ্বিবচন ‘আপনাদের’ শুনে আবার একবার ঈর্ষার ঠান্ডা স্রোত হিলহিলিয়ে বয়ে গেল অমিতাভর স্নায়ু বেয়ে।
    মনুষ্য স্নায়ুতন্ত্র বড় জটিল বস্তু !
    অমিতাভ শান্ত উত্তর দিল, ‘ আচ্ছা.... ঠিক আছে .... দেখুন , আর কি বলব .... বলার তো কিছুই নেই .... ‘
    — না না কিছুই বলতে হবে না.... আমি... আমি এই সামনের সপ্তাহে কাঁথি যাব। তখন সব কথা হবে। আশা করি তার মধ্যে একটা কিছু খবর হবে। রাখছি এখন কেমন.... আমার একটা কল আসছে.... ভাল থাকবেন ..’
    — ঠিক আছে , আপনিও ভাল থাকবেন। ‘ অমিতাভ বলে।
    ফোন কেটে যায়।
    মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে অমিতাভ  সন্ধের নিঝুম আঁধারে কাঁথি বাইপাস ধরে হাঁটতে লাগল তিলোত্তমা লজে ফেরার জন্য।হাঁটার পরিশ্রমে তার কোন শ্বাসের ঘাটতি হয়নি। কিন্তু নির্জন অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে নিজের অজান্তেই তার  নিজের ভিতর থেকে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস উৎসারিত হল। 

      ওদিকে বীরভূমের আটঘরা গ্রামে অন্ধকারে জোনাকিরা চুমকি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মানব হেমব্রমের ঘরের বাইরে সামনের দিকে একটা পাতকুয়ো আছে । অনেকদিনের পুরণো কুয়ো। তার ওপর উড়ছে এক ঝাঁক জোনাকি। উঠোনে একটা খাটিয়ায় বসে নিখিল নানা কথা বলছিল মানবের সঙ্গে। বলল, কাল তোকে বোলপুরে নিয়ে যাব ডাক্তার দেখাতে। উনি খুব ভাল ডাক্তার। তুই কোন চিন্তা করিসনি ..... তোর সঙ্গে আমার আজকের চেনা ! সেই সেবারে .... ওই যে শিলাবৃষ্টি হল.... মনে আছে তোর ? ‘
    মানব হাসতে হাসতে বলে, ‘ তা আর মনে নেই ... সে কি কেলেঙ্কারি ....’ মানব হেমব্রম আরও কিছু স্মৃতিচারণা করতে যাচ্ছিল ....
    এই সময়ে নিখিলের মোবাইলের স্ক্রীনে একটা মেসেজ নোটিফিকেশান ঝিলিক দিয়ে উঠল। নিখিল ঝট করে মোবাইল তুলে মেসেজ আইটেম খুলল। বিভাস ঘোষদস্তিদার মেসেজ টেক্সট করেছে। 
       “ হেড অফিস থেকে তোমার ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে বীরভূমের শিউড়িতে। তিরিশ তারিখে রিলিজ “
    অন্ধকারে চুমকি ছড়াচ্ছে ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি।
     
        নিখিল খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে রইল। তারপর আপনমনে বলল, ‘ভালই হল ,  আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না .... তিলোত্তমার পাট চুকল ‘। 
    মানব হেমব্রম বলল, ‘ আজ্ঞে, কি বললেন দাদাভাই ? ‘
    নিখিল বলে, ‘ না কিছু না।’ একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘ভালই হল রে মানব , তোর সঙ্গে এবার থেকে ঘনঘন দেখা হবে।’
    মানব কিছু বুঝতে না পেরে নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিখিল বলে, ‘ আমার ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছে শিউড়িতে ।’
    কথাটা শুনে মানব রীতিমতো উৎফুল্ল হয়ে ওঠে — ‘ তাই নাকি ! বাহ্ বাহ্ ... এ তো খুব ভাল খবর।কবে হচ্ছে দাদা ? ‘
    — ‘ এই তো আর কদিন । এ মাসেই শেষ ‘
    অন্ধকারেও বোঝা গেল মানব হেমব্রমের মুখে উচ্ছ্বাসের আলো খেলা করছে। বোধহয় খুশি উদযাপন করার জন্য পকেটে যে চারটে বিড়ি ছিল তার থেকে একটা ধরাল।
    পরদিন সকাল দশটা নাগাদ নিখিল বোলপুরে গিয়ে ডাক্তার দেখাল মানবকে এবং একমাসের ওষুধ কিনে দিল। ডাক্তারবাবু এখন কোন কিছু পরীক্ষা করতে বলেননি। দরকার হলে পরে ওসব করতে হতে পারে। মানবকে আটঘরায় পাঠিয়ে দিয়ে নিখিল বোলপুর স্টেশনে চলে গেল ট্রেন ধরার জন্য।  

        বেলা প্রায় তিনটের সময় কাঁথি পৌঁছল নিখিল। তিলোত্তমার ভাতের হোটেলে তখনও দুচারজন খাচ্ছে। অর্ণাশ্রী এবং পিনাকপাণিও খাচ্ছিল। ডাল, আলুর চোখা, উচ্ছে ভাজা আর পাঁপড় ভাজা। আর একটু টক দই। দইটা বাইরে থেকে আনিয়ে দিয়েছে দুলাল। দুলাল লক্ষ্য করে বাপি এদের খুব ন্যাওটা। আন্দাজ করে বখশিসের লোভে বাপি ফাইফরমাশ খাটে। ওরা কেন তিলোত্তমায় আছে, কবে এখান থেকে যাবে দুলাল সরাসরি জানতে চায়নি এখনও। এরা দৈনিক হিসেবে নিয়মিত পেমেন্ট করে যাচ্ছে প্রত্যেকদিন। দুজনেরই আচার ব্যবহার বেশ আকর্ষণীয়।
    দুলাল ভাবছে ওদের সঙ্গে আলাপ জমাবে। জমিয়ে জিজ্ঞেস করবে ওদের কাজটা কি। কে যে কি উপকারে লেগে যায় কে বলতে পারে। বলা যায় না কিছুই। 
        সে যাই হোক, নিখিলকে হঠাৎ আবির্ভূত হতে দেখে দুলাল বলল, ‘ আরে কি খবর তোর ? চলে এলি হঠাৎ ? ‘ 
    — ‘ আরে .... আর বল কেন । 
    বিভাস... বিভাস ঘোষদস্তিদার টেক্সট করেছে আমার নাকি ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। তিরিশ তারিখে রিলিজ।’ নিখিল ভাবলেশহীন ভঙ্গীতে বলে।
    —- ‘ অ্যাঁ .... বলিস কিরে ! ট্রান্সফার ! কেন ? কোথায় ট্রান্সফার ! হঠাৎ কি ব্যাপার ?
    — ‘ শিউড়ি । বীরভূমে। ‘
    — ‘ এ: হে .... তুই তিলোত্তমা লজে নেই এটা ভাবতেই পারছি না। আগেই তোকে বারবার বলেছিলাম, সাবধান হ সাবধান হ .... তোর কুকর্মের ফল এসব। ওদের কাছে সব খবর থাকে .... ইশশ্ এখন বোঝ ঠেলা ..... ‘
    —- ‘ আরে দুলাল দা কিসব বলছ .... সেসব কোন ব্যাপার নয় এটা । এটা একটা রুটিন ট্রান্সফার । আমাদের ডিপার্টমেন্টে রেগুলারলি হয়ে থাকে।’ 
    — ‘ যাই বলিস, আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কি আর করা যাবে  ... এটাই তো জীবন’
    — ‘ সে তো আমারও মন ভীষণ খারাপ হয়ে আছে খবরটা শোনার পর থেকে।’ নিখিলের স্বরে বিষণ্ণতার ছোঁয়া। একটু চুপ করে থাকে সে। তারপর বলে , ‘অনিন্দিতা এসেছিল নাকি এর মধ্যে আমাকে খুঁজতে  ? ‘
    দুলাল বলে, ‘ না: এর মধ্যে আর আসেনি। ও...ই এক উটকো ঝামেলা। দোষ তো তোরই । খাল কেটে কুমীর ডেকে এনেছিস। ‘
    নিখিল এ কথার কোন উত্তর দেয় না।
    দুলাল আবার বলল, ‘ যা তুই খেয়ে আয় নীচে থেকে। এর পরে আর কিছু পাবি না ।’
    নিখিল নীচে চলে যায় ভাত খেতে। খেতে খেতে ভাবল উকিল সৌম্য দিন্দাকে একবার ফোন করে মামলাটার হাল হকিকতের হদিশ নেবে কিনা। তারপর ভাবল দরকার কি খোঁচাখুঁচি করে। চাপা আছে চাপা থাক না। দিন্দাই তো তাকে যোগাযোগ করতে বারণ করেছিল। আর কটা দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই তো সে এখান থেকে হাওয়া। কিন্তু এসব কথা ভাবলে কি হবে, টাকা পয়সার ব্যাপারটা অনিন্দিতা কি ভাবে সামলাচ্ছে সে ব্যাপারে তার চিন্তা হতে লাগল। অবশ্য এটাও ভাবল যে, অনিন্দিতা নানা ঘাটের জল খাওয়া করিতকর্মা মেয়ে। নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে নেই। একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে নিয়েছে এতদিনে। ঈষৎ মানসিক সংকোচের সঙ্গে ভাবল, হয়ত উকিলবাবুর সঙ্গেই সেটিং করে নিয়েছে এর মধ্যে। তা নিতে পারলে তো ভালই। নিজের ব্যবস্থা তো নিজেই করে নিতে হয় সবাইকে। শুধুমুধু  নিখিল দাসের ঘাড়ে চেপে বসে থাকাটা কোন কাজের কথা নয়। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে তার এক বিচিত্র ভাবোদ্রেক হল। সৌম্যশেখর দিন্দার সঙ্গে অনিন্দিতার জোটবন্ধন কল্পনা করে বুকের বাঁ পাশে একটা তীক্ষ্ণ জ্বালা অনুভব করল। সে ঠি ক করল যে কোন উপায়েই হোক অনিন্দিতার একটা খোঁজ নেওয়া দরকার। তাছাড়া ওর স্বামী যদি নির্দোষ হয় তারও তো ছাড়া পাওয়া অবশ্যই উচিৎ। নিখিল 
    ঠি ক করে, আজকেই নয়, আরও দু একদিন যাক তারপর দেখা যাবে। কাল অফিসে জয়েন করে ব্যাপার স্যাপার সব জানতে হবে।

        দুলাল এখনও সূর্যকান্ত স্যারের কাছ থেকে কোন খবর পেল না। তার কথা কি আর স্যারের মনে আছে ! ব্যস্ত মানুষ তিনি। দুলালের মনে পড়ল, স্যার অবশ্য তাকেই একবার মনে করিয়ে দেবার কথা বলেছিলেন। এক সপ্তাহ হয়ে গেছে এবার বোধহয় তাকে একটা ফোন করা যেতে পারে। দুলালের মনে হল, কাজ কি ওসব তাঁবেদারিতে । এই তো বেশ আছে সে। যদি সূর্যকান্তবাবু সত্যি সত্যি কোন ভদ্রস্থ কাজের ব্যবস্থা করতে পারেন তাহলে তো তাকে তিলোত্তমা লজকে বিদায় জানাতে হবে। এইসব মানুষ ননী, সুরেশ, বাপি, নিখিল,শরৎ, মদন বেরা,শঙ্করীবাবা, আয়ুর্বেদিক ওষুধের কারবারি সুভাষ ঘোষ, প্যারামেডিক্যাল চিকিৎসক আশিস সামন্ত..... আরও কতলোক যারা তার বুকের এক একখানা পাঁজর হয়ে গেছে এই দশ বছর ধরে প্রতি দন্ডের ওঠাবসার দিনলিপিতে তাদের ছেড়ে চলে যেতে হবে। নিখিলের তো হয়েই এল ..... । তার বুকের ভিতরটা হেমন্তের বিকেলে বিষণ্ণ শস্যক্ষেত্রের মতো উদাস হয়ে যায়। দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেল। নিখিল কুড়ি নম্বরে ঢুকে গেছে। দুলাল দেখল, অমিতাভ ভট্টাচার্য অফিস থেকে ফিরছে। মাথা নীচু করে কি যেন ভাবতে ভাবতে আসছে। ওর অফিসে কি সব নাকি গন্ডগোল চলছে। তাই নিয়ে বোধহয় চিন্তিত।
     আশিস সামন্তর পসার ইদানীং একটু মন্দা যাচ্ছে। ঠান্ডাটা পড়লে হয়ত আবার চাঙ্গা হবে। ঠান্ডায় মানুষের শরীরে ব্যথা বেদনা বাড়লে আশিসের পসার জমে ভাল। আশিস পাশের দোকানের বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল।শেষ চুমুকটা মেরে গ্লাসটা ধোবার জায়গায় নীচে নামিয়ে দিয়ে দুলালের কাছে এসে দাঁড়াল।
    — ‘ কি দুলালদা কেমন আছ ? তোমার সঙ্গে তো আজকাল দেখাই হয় না।তোমার মাইগ্রেন এখন কেমন আছে ? ‘
    — ‘ এখন একটু ভাল। তোর
     টোটকায় ভালই কাজ হয়েছে মনে হচ্ছে। তোর পসার কেমন চলছে ? ভালই তো কামাচ্ছিস । এবার একটা বিয়ে থা কর ।’
    —- ‘ হ্যাঁ , ওটাই বাকি আছে। কি দরকার ওসব চক্করে গিয়ে ? এই তো দিব্বি আছি। ‘ আশিস হেসে উড়িয়ে দেয় দুলালের প্রস্তাব।
    — ‘ এখন কথা কানে নিচ্ছিস না, বুঝবি... বুঝবি একদিন .... গরীবের কথা বাসি হলে ফলে । সময় থাকতে থাকতে সব কিছু ..... ‘
    — ‘ সে দেখা যাবেখন । এখন ছাড় তো ওসব। চল আজকে আর একটা সিটিং দাও .... তোমার মাইগ্রেনের জন্য। ‘
    —- ‘ আজ ছেড়ে দে। আজ হবে না রে ... কাল দুপুরের দিকে কর।’
    — ‘ ঠিক আছে । আচ্ছা দুলালদা... ওই একুশ নম্বর আর সাত নম্বরে যে দুজন আছে ওরা কি কাজে এসেছে এখানে ? কাল আমি দুজনকে থানা থেকে বেরোতে দেখলাম বড়বাবুর সঙ্গে।ওই যে .... এখানে আসে মাঝে মাঝে .... কি যেন নাম ?’
    — ‘ কমলেশ্বর হাজরা ‘
    —- ‘ হ্যাঁ ... ওই কমলেশ্বর হাজরার সঙ্গে বেরিয়ে পুলিশের জিপে উঠল দুজন। আমাকে ওরা দেখতে পায়নি অবশ্য।’
    —- ‘ তাই নাকি ? খোঁজ নিতে হবে তো । ইনফর্মার  ফিনফর্মার নাতো ? আমি তো লজে মেয়ে তোলা একদম বন্ধ করে দিয়েছি। মাখনবাবু যাই বলুক। সব হ্যাপা তো আমাকেই পোয়াতে হবে। উনি তো পয়সার জোরে জাল কেটে বেরিয়ে যাবেন। ফাঁসব তো আমি । কি ঠি ক কিনা ?’ দুলাল বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ে । 
    আশিস বলে, ‘ সে তো বটেই ..।তবে আমার মনে হয় .....’
    কথাটা শেষ হল না, কোথা থেকে ঝট করে বাপি এসে হাজির হল ।আশিস সামন্তর হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল খানিকটা দূরে।বলল, ‘ আমার এই ডান হাতটা না... কদিন ধরে খুব ব্যথা করছে.... তোমার মেশিনটা একটু লাগাও না আজকে .... ‘।

        খানিক বাদে দুলালের মোবাইলে একটা কল এল। পরম বিস্ময়ের সঙ্গে দুলাল দেখতে পেল যে সূর্যকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে ফোন করেছেন। আশা নিরাশার দোলায় দুলতে দুলতে শ্রদ্ধাবিজড়িত কন্ঠে দুলাল বলল, ‘ হ্যাঁ , হ্যালো স্যার .... ‘
    — ‘ হ্যাঁ দুলালবাবু বলছেন তো ?’
    — ‘ হ্যাঁ ... স্যার দুলাল বলছি। আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না স্যার।’ 
    — ‘ আচ্ছা বেশ । শোন তুমি একবার সময় করে সামনের সোমবার আমার বাড়িতে আসতে পারবে ? তোমার জন্য আমার এখানেই তোমার উপযুক্ত একটা কাজের কথা ভেবেছি আমি । ওই ব্যাপারেই একটু কথা বলতে চাই। তোমার কনসেন্ট পেলে আমি আমি এ ব্যাপারে এগোতে পারি। কাজটা বেশ ইনোভেটিভ । আমার মনে হয় তোমার ভাল লাগবে । তুমি কাজটা একসেপ্ট করতে রাজি হলে রেমুনারেশানের ব্যাপারে কথা বলা যেতে পারে....হ্যালো .... হ্যালো .....’
    শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায়, বিস্ময়ে দুলালের মাথা নুয়ে গেল।চোখে জল এসে গেল। বাবার মুখে ছোটবেলায় শোনা একটা কথা মাথা চাড়া দিয়ে দাঁড়াল তার মনের ভিতর — বিদ্যা দদাতি বিনয়ং ।
    — ‘ .... হ্যালো .... হ্যালো .... শোনা যাচ্ছে ?’
    দুলালের রুদ্ধকন্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এল — ‘ হ্যাঁ স্যার.... হ্যাঁ স্যার .... শুনছি .... বলুন স্যার ‘।
    ( ক্রমশ : )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন