এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • স্প্রিন্টার - ৭

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ জানুয়ারি ২০২২ | ৬৫৭ বার পঠিত
  • সুইডেনের অ্যাথলেটিক্স অ্যাকাডেমি জিএনএ-তে শুভর যোগদানের ব্যাপারটা আপাতত মুলতুবি রাখা হল। কারণ সুরিন্দরের সঙ্গে কথা বলে স্পন্দন জানতে পারল সিলেকশান কমিটি থেকে সানি ডিসুজার অপসারণ হয়েছে। নতুন করে কমিটি তৈরি হবে এবং তাতে সুরিন্দরের অন্তর্ভুক্তি প্রায় নিশ্চিত। নতুন করে ট্রায়াল হবে অলিম্পিক স্কোয়াডের জন্য। জামশেদপুরে যে মিটটা হবে সেটাই ফাইনাল ট্রায়াল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। সুরিন্দর পরামর্শ দিল ওই ইভেন্টটার ওপর মনোনিবেশ করতে। বাকিটা সে দেখে নেবে।

    দুপুর দুটো। মধ্যমগ্রামে তৃপ্তি হোটেল এখন মধ্যাহ্নভোজনের ব্যস্ততায় ভরভুর, জমজমাট। ব্রজেনবাবু মহাব্যস্ত কাউন্টার সামলাতে। তার মনে এখন মহাফূর্তি। কাল রাত্তিরে স্পন্দন এসে শুভকে রেখে গেছে এখানে জামশেদপুরে রওয়ানা দেবার আগে কদিনের জন্য।তার বাবা দেবেশ যথারীতি ভ্যান নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সকাল আটটা নাগাদ। প্যাসেঞ্জার নিয়ে চক্কর মারছে ক্রমাগত স্টেশনের রুটে।

    শুভকে নিয়ে একদিন ডায়েটিশিয়ানের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল স্পন্দনের। অ্যাথলিটের জন্য ডায়েট চার্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু পায়েল বলল, ‘দরকার নেই যাবার। তুমি তো ওগুলো জান। চার্টটা তুমিই বানিয়ে দাও না। অসুবিধে হবে না আশা করি’।

    শুভ কোন কাজ করতে গেলেই ব্রজেনবাবু রে রে করে ওঠেন — ‘তুই রাখ.... তুই রাখ ওসব .... দুদিন বাদে অলিম্পিকে যেতে চলেছিস..... আমার নাম ডোবাবি নাকি?’ । পেটচুক্তি ভাত ডাল তরকারি সাঁটাবার হাপুস হুপুস শব্দে গমগমে পরিবেশ। টেবিলের ওপর এক খদ্দেরের জলের গ্লাস উল্টে গেল কি করে। শুভ ছুটে যাচ্ছিল ন্যাতা হাতে। ব্রজেনবাবু আবার হৈ হৈ করে উঠলেন— ‘আরে তুই কোথায় যাচ্ছিস.... তুই থাম....গোবিন্দ ..... গোবিন্দ কোথায় গেলি ..... ও:’।

    সত্যেন্দ্রনাথ প্রবল উৎসাহে জামশেদপুরে যাবার তোড়জোড় করতে শুরু করলেন দুদিন আগে থেকে। ভিআইপি কোটা থেকে ট্রেনের রিজার্ভেশান করে ফেলেছেন। তিনি জানতে পেরেছেন যে ‘ওই ছেলেটা’ ওখানে হানড্রেড মিটারেও নামছে। হানড্রেড মিটার স্প্রিনটিং সত্যেনবাবুর কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজক ও রোমহর্ষক প্রতিযোগিতা।

    জামশেদপুর যাবার আগের দিন সন্ধেবেলা সত্যেন্দ্রনাথবাবুর মোবাইলে লাভলি রায়ের ফোন এল। অভ্র গোস্বামী তার বাড়িতে দুটো লোক পাঠিয়েছিল হুমকি দেবার জন্য। লোকদুটোকে দেখলেই ভয় লাগে। তারা লাভলির কাছে লকারের চাবি এবং এটিএম কার্ডগুলো চাইছে। তাদের কথা না শুনলে তার ছেলেকে তুলে নিয়ে যাবার হুমকি দিয়েছে।

    সব শুনে সত্যেনবাবু মাছি তাড়াবার ভঙ্গীতে বললেন, ‘ও: .... এ তো বড় জ্বালা হল .....কেন লোক্যাল থানা তোমায় প্রোটেকশন দিচ্ছে না? আমি তো বলে দিয়েছিলাম ..... আচ্ছা তুমি ফোন রাখ .... আমি দেখছি....’।

    সত্যেনবাবু কৌস্তভকে ফোনে ধরলেন। সে জানাল দুটো কনস্টেবল তো ডিপ্লয় করা হয়েছে।তাও কি করে এমন হল সে বুঝতে পারছে না। সে এক্ষুণি কেসটা ‘টেক আপ’ করছে বলে জানাল।

    সত্যেনবাবু বললেন, ‘সে তুমি যা করবার কর নিজের মতো কর। তুমি লোকদুটোকে ট্রেস করে আমাকে শুধু ওদের নাম আর হোয়্যারঅ্যাবাউটসটা জানাও’।

    সত্যেনবাবুর মতে ‘অপোনেন্ট কাউন্টার’ করার একটা সোজাসাপটা পদ্ধতি হল — যেমন কুকুর তেমন মুগুর। এতে কাজ না হলে বুঝতে হবে গভীর জলের মাছ। তখন অন্য রাস্তা ধরতে হবে।

    শুভর একশ মিটারের রেস দেখার জন্য তিনি ছটফট করছেন। ছবি দেখছেন এক দুর্নিবার সুনামি সব বাধা লন্ডভন্ড করে, সবকিছু উড়িয়ে গুঁড়িয়ে ধেয়ে চলেছে লক্ষ্যের দিকে।

    মোহিনীবাবুদের নিয়ে স্পন্দন, পায়েল আর তাদের বাচ্চা টাটানগরে পৌঁছল রাত্তিরবেলায়। হোটেল বুক করা ছিল। অসুবিধে হয় নি।

    সুরিন্দর এখানে আসেনি, তবে ফোনে যোগাযোগ রাখছে। দিল্লিতে কাল নির্বাচক কমিটির সদস্য মনোনয়ন হবে।

    এখানেও ডোপিং টেস্টের সিস্টেম জিএনএ-এর মতো। আগেই হয়ে যায়।

    শুভ যখন একশ মিটারের স্টার্টিং ব্লকে গিয়ে দাঁড়াল তার হঠাৎ মোহিনীমোহনবাবুর ভাইপো বিমলানন্দবাবুর কথা মনে পড়ল — ‘নেই কাজ তো খই ভাজ .... যত্ত সব ..... ’। তার দুপা দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে লাগল।

    সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জি সকাল নটার সময় স্টেডিয়ামে ঢুকেছেন। বিভিন্ন স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বা বসে নানা ইভেন্ট দেখতে লাগলেন। সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন একশ মিটার রেসের ঘোষণা হবে এবং ‘ওই ছেলেটা’ ট্র্যাকে নামবে। মোহিনীবাবু এবং নিরুপমাকে স্পন্দন একশ মিটার ট্র্যাকের পাশের গ্যালারিতে মাঝামাঝি জায়গায় বসিয়েছে।

    অবশেষে একশ মিটার স্প্রিন্টিং ফাইনালের ঘোষণা হল। হিট আগেই হয়ে গেছে। তাতে শুভ যথারীতি তার গ্রুপের সবাইকে অনেক পিছনে ফেলে ফিনিশ করেছে। সত্যেন্দ্রনাথ প্রবলভাবে আন্দোলিত হতে লাগলেন। গ্যালারিতে উন্মদ উত্তেজনার আলোড়ন উঠল একটু পরে যখন শুভর দুপায়ের বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল এবং নিমেষে তার বিষ্ময় দৌড় শেষ করল। কজন কর্মকর্ত্তা নির্বাকভাবে পরষ্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন স্তব্ধ চমকে আপ্লুত হয়ে।

    ......... .......... ...........

    ওদিক থেকে হাসতে হাসতে লাভলি বলল, ‘অভ্র তাকে ফোন করে ক্ষমা চেয়েছে কাল রাত্রে। সে জানিয়েছে তার বুদ্ধিভ্রম হয়েছিল, আর কখনও এমন হবে না। সে বলেছে, আবার আমাকে ফিরিয়ে নাও আগের মতো। জিটোর জন্য তার ভীষণ মন খারাপ।’

    সত্যেন্দ্রনাথ মনে মনে ভাবলেন, ভাল রে ভাল .... ওষুধের মাত্র একটা ডোজ পড়তেই রোগ সেরে গেল .... তা হলেই ভাল ...।

    শুভর দৌড়ের ঝড়ে সব উড়ে গেল নাকি !

    খবর পাওয়া গেল সুরিন্দর চিফ সিলেক্টর নির্বাচিত হয়েছে। এখন চোখের সামনে শুধু অলিম্পিকের স্বপ্ন।

    মোহিনীবাবু বললেন, ‘চল আমরা সবাই বাড়ি যাই’।

    কিন্তু প্রশ্ন হল কোন বাড়ি? মধ্যমগ্রাম না উল্টোডাঙা! শুভর তো এখন দুটো বাড়ি।

    কৌস্তভ বলল, ‘তালে আমাকে আর দরকার হচ্ছে না তো?’

    লাভলি হাসতে হাসতে বলল, ‘কি যে বলেন আপনাকে ছাড়া চলবে আমার .... সব ঋণ কি আর শোধ করা যায় ?’

    কৌস্তভ মনে মনে ভাবল, ‘তাই তো .... কে কার ঋণ শোধে! ভাগ্যিস অভ্র গোস্বামীর মতো স্কাউন্ড্রেল ছিল তাই তো ..... তা’লে কি অভ্রর ওপর ঋণী সে!’।

    মানবমনের গতি বড় বিচিত্র।

    ........... .......... ..........

    শুভ মধ্যমগ্রামে কিছুদিন থাকার পর আবার উল্টোডাঙার গৌরীবাড়িতে স্পন্দনের কাছে এসেছে।

    এখন এই ভোরবেলায় দেশবন্ধু পার্কে দুজনে মিলে গোল করে চক্কর মারছে। হাল্কা জগিং । মাঠ ঘিরে চারদিকের রাস্তা কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার ঝরা ফুলে ছাওয়া। বিশেষ করে পুকুরের দিকটায়। দুজনে মিলে চারটে চক্কর মারল।

    শুভর অলিম্পিকে যাওয়া একরকম নিশ্চিৎ। তবে জামশেদপুরের মিটটাই ফাইনাল টেস্ট বলে ধরে নিয়েছিল স্পন্দনরা সেটা বোধহয় হচ্ছে না। আর একটা চূড়ান্ত যোগ্যতানির্ধারক অ্যাথলেটিক মিট হবে সামনের মাসে কোজিকোড়ে। চূড়ান্ত বাছাই ওখানেই হবে। এতগুলো পাঁচিল পেরিয়ে এসে শুভকে আবার একবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। ক্ষুরধার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সন্দেহ নেই। শুভর যতই জন্মগত পারঙ্গমতা থাক প্রতিযোগিতার দিন শারীরিক ভারসাম্যের সামান্য এদিক ওদিক হয়ে গেলে দৌড়ের গতি কয়েক সেকেন্ড কমে যেতে পারে। প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে যেতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত লাগবে। প্রপার ফিজিক্যাল কন্ডিশানিং অ্যাথলেটিক্সে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

    পুলিশের প্রাক্তন আই জি সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জির মোবাইলে দুপুর দুটোর সময় লাভলি রায়ের ফোন এল।
    — ‘ স্যার আমি লাভলি রায় বলছি। আমি বাধ্য হয়ে আপনাকে ডিস্টার্ব করছি। আমার স্বামীকে আমি আমার ফ্ল্যাটে ফিরিয়ে নিয়ে বিরাট ভুল করেছি ।’
    — ‘ কিরকম ? ‘
    — ‘ কদিন ধরে প্রচন্ড হস্টাইল হয়ে উঠেছে। শুধু আমার গায়েই না আমার ছেলের গায়েও হাত তুলছে যখন তখন। বারবার লাইফ থ্রেট দিচ্ছে।সিজোফ্রেনিক ডিসঅর্ডার বলে মনে হচ্ছে মাঝে মাঝে। ছেলেটা ভীষণ ভয় পাচ্ছে। কান্নাকাটি করছে। আমারও খুব ভয় করছে স্যার .....’
    — ‘ তুমি কৌস্তভের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করেছিলে ? এরকম তো হবার কথা নয়। এত সাহস হচ্ছে কি করে ! আমি তো ওয়ার্নিং কল দিয়েছিলাম ওকে। ইন স্পাইট অফ দ্যাট ..... ইট অ্যাপিয়ারস কোয়াইট আনলাইকলি .... এনিওয়ে ... যদি মেন্টাল ডিসঅর্ডার থাকে দ্যাটস এ ডিফারেন্ট ইসু .... আদারওয়াইজ এরকম তো হবার কথা নয়। হ্যাঁ কৌস্তভকে একবার ..... ‘
    — ‘ হ্যাঁ স্যার .... ওনাকে ইনফর্ম করেছি । উনিই আপনাকে জানিয়ে রাখতে বললেন ....’
    — ‘ আচ্ছা ঠিক আছে । দেখছি আমি। প্রবলেম তেমন সিরিয়াস হলে আমার বাড়িতে চলে আসতে পার। আমার মুদিয়ালির অ্যাড্রেসটা আমি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এখান থেকে স্কাউনড্রেলটার সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে সুবিধে হবে। কোন চিন্তা কোর না, আই’ইল টি চ হিম এ গুড লেসন .....এত বড় সাহস .....’।

    দুপুর তিনটে নাগাদ একটা পুলিশের জিপ এসে থামল বিল্ডিংটার সামনে। পুলিশের পোশাকে চোখে সান গ্লাস পরা ভবানীপুর থানার যুবক ওসি কৌস্তভ লাহিড়ি নেমে এল। দুটো কনস্টেবল গাড়িতে বসে নির্বিকারভাবে খবরের কাগজ পড়তে লাল। কৌস্তভ উঠে গেল থার্ড ফ্লোরে।

    লাভলি নিজেই দরজা খুলল। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ জর্জরিত এবং বিধ্বস্ত লাভলি রায় চোখের সামনে কৌস্তভকে দেখে যেন হাতে স্বর্গ পেল।
    — ‘ আরে .... আসুন আসুন .... আমি তো অলমোস্ট ফিনিশড। আমার ছেলেটার কথা ভেবে আমি.... ’, কান্না চাপা গলায় কথাটা অর্ধসমাপ্ত থাকে।
    কৌস্তভ সোফায় বসে পড়ে।
    — ‘ বিচটা কি এখন বাড়িতে নেই ? ’।
    — ‘ সেই সকালে কোথায় বেরিয়ে গেছে ’।
    — ‘ যেটা অ্যাভয়েড করতে চাইছিলাম সেটাই করতে হবে দেখছি শেষ পর্যন্ত । লক আপে গ্যারাজ করে রগড়ানি দিতে হবে .... বাট ইট ইজ কোয়াইট সারপ্রাইজিং, ও এই সাহসটা পাচ্ছে কোথা থেকে .... আপনাদের ইনডাস্ট্রির ইনফ্লুয়েনশিয়াল কেউ বোলস্টার করছে না তো ! সত্যেন স্যার ইন্টারভেন করার পরেও .... ইটস আনডাউবটেডলি ভেরি অ্যাশটনিশিং আফটার অল.... ’।
    — ‘ অ্যাবসোলিউটলি নো আইডিয়া .... আয়্যাম কমপ্লিটলি ইন দা ডার্ক .... সত্যেন্দ্রনাথ স্যার বলছেন ওনার বাড়িতে চলে যেতে কিন্তু সেটা কি লজিক্যাল হবে ?’, লাভলির গলা অসহায়তা ও সঙ্কটময়তায় ঢাকা।
    — ‘ কেন তাতে অসুবিধের কি আছে ? সেটাই তো আপনার পক্ষে কনভিনিয়েন্ট হবে।তবে স্যার এখন অ্যাথলেটিক্স মিট নিয়ে খুব প্রিঅকুপায়েড ।দু সপ্তা বাদে কোজিকোড়ে অলিম্পিকের জন্য কোয়ালিফায়িং মিট আছে।ওই যে শুভ নামের ছেলেটা ওখানে কমপিট করবে টু গেট বার্থ ইন্টু দা ইন্ডিয়ান কনটিনজেন্ট। ওই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি খুব এনগ্রসড ’।
    — ‘শুভ.... মানে যুবভারতীতে সেদিন যাকে দৌড়তে দেখলাম ? ’।
    — ‘ হ্যাঁ ... ও-ই ’।
    — ‘ আমি স্পোর্টসের কিছু বুঝি না। কিন্তু সেদিন মাঠের প্রাণবন্ত পরিবেশ, ওই দুরন্ত গতির দৌড় দেখতে দারুন লাগছিল। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল ওই গতির সঙ্গে মিশে কোথাও হারিয়ে যাই। কিন্তু বাড়ি ফেরার পরই আবার ঢুকে পড়লাম আমার এই ট্রম্যাটিক, গ্লুমি ওয়ার্ল্ডে। মেন্টাল কন্ডিশান এত ডিসিপেটিং যে ছবির কাজও করতে পারছি না। জানেন হয়ত, আমাদের লাইনে বেশিদিন ডিসকানেক্টেড থাকলে কাজ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।’
    — ‘ হ্যাঁ ... শুনেছি সেরকম ’।
    — ‘ এই ছেলেটা, যে ফার্স্ট হল .... শুভ না কি নাম বললেন, ওর সঙ্গে একবার খুব দেখা করার ইচ্ছে আমার ....’।
    — ‘ নো প্রবলেম । আই ক্যান অ্যারেঞ্জ। সত্যেন স্যারও প্রেজেন্টলি শুভর চিন্তাতেই ডুবে আছেন’।
    — ‘ তাহলে এখন কি যাবেন ?’
    — ‘ কোথায় ?’
    — ‘ স্যারের বাড়িতে । ওখান থেকে শুভর কাছে যাবার ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করা যাবে।’
    লাভলি চুপ করে রইল। মৌনতা তো সম্মতিরই লক্ষ্মণ। লাভলির চার বছরের একরত্তি ছেলে জিটো ঘুমচোখে টলতে টলতে এসে মায়ের পাশ ঘেঁসে গায়ে মাথা হেলিয়ে বসল। ও বোধহয় ভিতরের ঘরে ঘুমোচ্ছিল।

    মোহিনীবাবু নিরুপমাকে দিয়ে ঘড়ি ঘড়ি শুভকে ডেকে পাঠাচ্ছেন। তার মনোজগৎ কদিন ধরে শুভকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এটা কিসের সিনড্রোম কে জানে। তার বহুবছর আগে মৃত পুত্রের মায়াবী ছায়াময় শূন্যতাপূরণ বোধহয়। ইলিউসরি সিনড্রোম।

    লাভলিরা যতই আগ্রহী হোক না কেন, স্পন্দন কিন্তু রীতিমতো বিরক্ত হল এইসব প্রস্তাবে। এতে অ্যাথলিটের মন:সংযোগ চিড় খায় বলে তার ধারণা। শুভ এমন কিছু সেলিব্রিটি হয়ে যায়নি যে এখান থেকে ওখান থেকে লোকে দেখা করতে আসবে। তাছাড়া লাভলি ফিল্মলাইনের লোক বলে স্পন্দনের বিরক্তির মাত্রা আরও বেশি হল। এক একজনের এক এক ব্যাপারে অনীহা বা বীতরাগ থাকে তা সে যে কারণেই হোক।কৌস্তভ লাহিড়ি বলছে লাভলির জন্য এটা নাকি একটা সাইকোলজিক্যাল থেরাপি। স্পন্দন ভাবল, ‘এটা কোন কথা হল। এ কি ধরণের থেরাপি কে জানে। তোরা পুলিশের লোক পুলিশি অ্যাকশান নে কালপ্রিটের এগেনস্টে। এটা আবার কি ধরণের সলিউশান ! কি চক্কর চলছে কে জানে। হাইলি ডিসটার্বিং .....’

    তবে কৌস্তভ লাহিড়ি একজন পুলিশ অফিসার। তাকে সরাসরি না বলা মুশ্কিল। স্পন্দন সবিনয়ে বলল, ‘ বুঝতেই তো পারছেন.... সামনে বড় পরীক্ষা।আমি এই পিরিয়ডটা ওকে ইনটেন্স আইসোলেশনে রাখতে চাইছি। একদমই ডিসট্র্যাক্ট করতে চাইছি না ওকে । ব্যাপারটা অন্যভাবে নেবেন না। আমি ব্যাপারটা বোঝাতে পারছি কিনা জানি না। ‘
    — ‘ না না আপনি এমব্যারাসড হবেন না। আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। শুভ যখন দৌড়বে দূর থেকে দেখলেও হবে। ওই গতিটার মধ্যে একটা পজিটিভ ভাইভ আছে। যেটা দেখে রিজুভেনেটেড হওয়া যায়, মেন্টাল ডিফিডেন্স ওভারকাম করা যায়। আর কিছু না, মিসেস লাভলি রায় মোস্ট প্রোব্যাবলি সেটাই চাইছে ফ্র্যানটিক্যালি।’
    একথা শুনে স্পন্দন ভীষণ দোটানায় পড়ে গেল।এত কথার পরেও না বললে সেটা খুব অভদ্রতা হয়ে যায়। বলল, ‘ আচ্ছা ঠি ক আছে যদি আপনাদের পক্ষে সম্ভব হয় কাল বা পরশু দেশবন্ধু পার্কে আসুন সকাল পাঁচটা থেকে সাতটার মধ্যে ।ওই সময়ে শুভর প্র্যাকটিস চলে।
    তবে আপনারা ওকে দেখতে এসেছেন সেটা যেন ও জানতে না পারে।’
    — ‘ আচ্ছা .... দেখা যাক কি করতে পারি । ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে দেখি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। অল দা বেস্ট ।’
    কৌস্তভ ফোন ছেড়ে দেয়।

    ভোর হয়েছে। হাওয়ায় হিমের পরশ। দেশবন্ধু পার্কের মূল মাঠ ঘিরে রাস্তার ওপরে লাল হলুদ ফুল ঝরে যাচ্ছে আপনমনে। একদল ছেলে ঢুকল কথাবার্তা বলতে বলতে ফুটবল ঢপঢপ করতে করতে। একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একটা লোক দাঁতন করছে লুঙ্গি পরে, গায়ে চাদর জড়িয়ে । কুয়াশা পড়েছে ভালোরকম। আকাশ এখনও ঘুম ঘুম। আলোর সার্সি খোলেনি ভাল করে। রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট দিয়ে হুড়হুড় করে দুটো ট্রাক ছুটে গেল শ্যামবাজারের দিকে। রাস্তার কোনে চায়ের দোকানে উনুনে আঁচ পড়ল।

    দেশবন্ধুর স্ট্যাচুর দিকে হাতে স্টপ ওয়াচ নিয়ে, ঠোঁটে হুইশল গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে স্পন্দন। পুব দিক থেকে স্টার্ট নিয়ে জঙ্গুলে চিতার মতো অপরূপ মনোহর গতিতে ছুটে আসছে শুভ নস্কর। স্টপ ওয়াচের কাঁটা নড়ছে চিক্ চিক্ চিক্ চিক্ ...... এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সেকেন্ড .....

    ( এরপর পরের পর্বে )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:81c:39c8:9f96:f636 | ১৭ জানুয়ারি ২০২২ ১৩:১১502726
  • পড়ছি। চলুক 
  • Anjan Banerjee | ১৭ জানুয়ারি ২০২২ ১৫:০০502727
  • ঠিক  ঠিক 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন