এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  পড়াবই  প্রথম পাঠ

  • চতুর্দশ অশ্বারোহী -- প্রথম পাঠ

    চয়ন সমাদ্দার
    পড়াবই | প্রথম পাঠ | ২৮ নভেম্বর ২০২১ | ১৭৭৪ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • যে বইটি নিয়ে লিখতে চলেছি, তার কথা আমার দু'বছর আগেই বলা উচিত ছিল। আমি ভাগ্যবান, এই বইয়ের সব কটা গল্প প্রকাশিত হওয়ার আগেই পড়তে পেরেছি। অবাক হয়েছি। খুশি হয়েছি। তাই, সামনের বইমেলায় যে বই আপনি হাতে পাবেন, তার সম্বন্ধে স্পয়লার না দিয়েও কয়েকটা কথা বলে, আপনার সঙ্গে আমার আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই।
    দেখুন, আপনি আমি এমন একটা দেশের মানুষ, যেখানে ভাববাদী, ধর্মভীরুতার পাশাপাশি, কম বেশি হাজার আড়াই বছর ধরে আরেকটা দর্শনও নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এই দর্শন কোনও রকম ধর্মাচরণ, অবিনশ্বর আত্মার অস্তিত্ব, পরলোক বা পুনর্জন্ম কিছুরই অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ বা প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমান, এই দর্শনের বিশ্বাসের ভিত্তি। যেহেতু, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই, তাই বাঁচাটাকে সম্পূর্ণভাবে - তার সব রঙ-রস-গন্ধ নিয়ে, কিন্তু, শীলিতভাবে, রুচিসম্মত উপায়ে- উপভোগ করতে বলে এই দর্শন।

    যাবজ্ জীবং সুখং জীবেৎ।
    নাস্তি মৃত্যোর্ অগোচরঃ।।
    চেনা চেনা ঠেকছে? হ্যাঁ, সায়ণ-মাধব এই শ্লোকেরই দ্বিতীয় পংক্তি অম্লানবদনে পালটে দিয়ে, লিখেছিলেন : ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
    মানে, স্রেফ মিথ্যে বলে প্রমাণ করে দেওয়া হলো ইহবাদী বা বস্তুবাদী দর্শন নাস্তিক, ধর্মদ্রোহী এবং বেলাগাম, উচ্ছৃঙ্খল, ইন্দ্রিয়সুখভোগের প্রচারক। আসলে, মেধা-যুক্তি-বিতর্কের সঙ্গে কায়েমি স্বার্থ কোনওদিনই পেরে ওঠে না। তখন, সব কালে, একটি পথই অনুসৃত হয়। চরিত্রহনন আর কুৎসা রটনা।

    একেবারে এক জিনিস ঘটেছিল খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরিয়াসের সঙ্গে। মূলতঃ লুক্রেশিয়াসের রচনা থেকে তাঁর দর্শন রেনেসাঁসের সময় ইওরোপ জানতে পারে। এবং পরম শক্তিশালী, জ্ঞানবিপণির চাবিকাঠির রক্ষক চার্চ, তাঁর দর্শন - যার সঙ্গে যাবজ্ জীবং সুখং জীবেৎ - এর আশ্চর্য মিল - কে অসংযত বেলেল্লাপনার সমার্থক বলে দেগে দেয়। ইংরিজিতে এপিকিউরিয়ান বলতে লাগামছাড়া ইহসুখবাদী (হেডনিস্ট) এক মানুষকে বোঝানো হয় আজও।

    তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশে দেশে, কালে কালে, চিন্তার মুক্তির দিশারী আর প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থবুদ্ধির একটা সংঘাত বেঁধেছে। ঠিক এখান থেকেই আলোচ্য বইটির দিকে চাইতে পারি আমরা।
    সুজন ভট্টাচার্য তাঁর 'চতুর্দশ অশ্বারোহী' বইতে চোদ্দটা উত্তেজনায় টান টান ইতিহাস আশ্রিত গল্প লিখেছেন। গল্পগুলো, যাকে বলে, ক্র‍্যাকিং গুড রীড এবং আনপুটডাউনেবল্ - একবার ধরলে ছাড়া যায় না। কিন্তু, গল্পগুলো বস্তুবাদী দর্শনের সুতোয় বাঁধা। ভারতীয় বস্তুবাদের জনক অজিত কেশকম্বলী, গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস ও দিওগোরাস, কমেডির জনক আরিস্তোফেনিস, ইসলামিয় বৃত্তে নাস্তিক্যবাদের প্রবক্তা আবু আল-হাসান আহমদ ইবন ইয়াহিয়া ইবন ইশক আল রাওয়ান্দি (৮২৭-৯১১), রোমান কবি-দার্শনিক তিতাস লুক্রেতসিস ক্যারাস, ইরানি বিজ্ঞানসাধক, এবং ইওরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর বিপুল প্রভাব নিস্তারকারী আবু বকর মুহম্মদ ইবন জাকারিয়াহ আল রাজি (৮৫৪-৯২৫), আমাদের ভারতভূমির মখ্খল গোসাল, স্বয়ং ওমর খৈয়াম, যাঁকে হত্যা করায় পেপাল ক্রুসেড আরম্ভ হয়, সেই চার্চের সংস্কারকামী ইয়ান হুস, গুরু বান্দা সিং বাহাদুর - সবাই একটা কথাই বলে চলেন এই বইতে : মুক্ত জ্ঞান, স্বচ্ছ দৃষ্টি, স্পষ্ট কথা - এসব খুব কম লোকেরই আয়ত্তাধীন হয় এবং যাঁরা এই গুণগুলো পান, তাঁদের দেশ কালের সীমায় বাঁধা যায় না। তাঁদের বাসভূমির নাম মানুষের দুনিয়া। সব রকম মতলববাজি, ভণ্ডামি আর অবিচারের তাঁরা ঘোষিত শত্রু।

    লেখক শেষ গল্পটি লিখেছেন তাঁকে নিয়ে, যাঁকে বাঙালি না করে, ভুলক্রমে মানুষ হিসেবে গড়ে ফেলেছিলেন বিধাতা। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এতটাই জীবন্ত এই বইতে, যে তাকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় বলে মনে হয়।

    বইঘরের স্বজনরা, যে কালবেলার মধ্যে আপনি আমি দিনাতিপাত করছি এই মুহূর্তে, সেখানে ভরসা করার মতো গল্প বলা ক্রমশঃ কঠিন হয়ে উঠছে। বাস্তব এতটাই নিষ্করুণ যে দিনযাপন-প্রাণধারণের গ্লানি আমাদের চেতনাকে অবসন্ন করছে। ফলে, আমরা গল্প শোনার সময়, এই বাস্তব থেকে ছুটি চাইছি এবং অতিলৌকিক বা রহস্য রোমাঞ্চকে আপন করছি। তবু, মনের একটা কোণায় এমন গল্প শোনার আকাঙ্ক্ষা থেকেই যায়, যা আনন্দ দেবে, আবার ভাবাবেও। তাৎক্ষণিক উত্তেজনা কাটার পরও যে গল্প আবার শুনতে ইচ্ছে করবে।
    চতুর্দশ অশ্বারোহী আপনাদের সেরকম গল্পই শোনাবে।
    যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন, তবে পড়বেন বইটা।

    হতাশ হবেন না। কথা দিচ্ছি।





    চতুর্দশ অশ্বারোহী
    সুজন ভট্টাচার্য
    প্রকাশক: অভিযান


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • পড়াবই | ২৮ নভেম্বর ২০২১ | ১৭৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শুদ্ধসত্ত্ব দাস | ২৮ নভেম্বর ২০২১ ০৮:৫২501496
  • বইয়ের পর্যালোনাটা ভালো ভালো লাগলো আর পড়ারও আগ্রহ তৈরি হলো। তবে নিবন্ধটার প্রায় অর্ধেক জুড়ে নানান রকমের দর্শন বা ভাবধারার নাম করা হয়েছে পরপর বিনা ভূমিকায় , সাধারণ পাঠকের মাথায় ঢোকার কথা নয়। "ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রত্যক্ষ প্রমাণ ..." থেকে শুরু করে "...অবিচারের তাঁরা ঘোষিত শত্রু।" অবধি পরপর যেই নাম আর অভিধায়গুলির উল্লেখ হয়েছে,তাদের মধ্যে কোনো রকমের যোগসূত্র পেলাম না। 
  • P pial | ২৮ নভেম্বর ২০২১ ১২:৫৩501501
  • অল্প কথায় বইটির প্রাসঙ্গিকতা ও বিষয়বস্তু বোঝা গেলো আপনার লেখাটি পড়ে। বইটি পড়ার জন্য তৈরি হওয়া আগ্রহ পুষে রাখলাম। 
    ধন্যবাদ। 
  • | ২৮ নভেম্বর ২০২১ ১৪:৪২501503
  • ইন্ট্রো হিসেবে চমৎকার লেখা। এঁর কোন গল্প পড়ি নি বলেই মনে হচ্ছে।  দেখি একটু খুঁজে।
  • পঞ্চদশ অশ্বারোহী | 2405:201:9002:305a:b9e4:77dc:829d:cd0e | ২৮ নভেম্বর ২০২১ ২১:৪৩501513
  • চোদ্দো কপি বিক্রি হয়েছে জানতে পারলে ভালো লাগবে !!!
  • স্বপন সেনগুপ্ত ( ঝানকু সেনগুপ্ত ) | 43.252.248.92 | ২৯ নভেম্বর ২০২১ ০৮:৫০501520
  • খুব ভালো লাগলো! পড়ার ইচ্ছে রইল ! কী ভাবে সংগ্রহ করা যাবে, জানালে ভালো হয় !
  • হীরেন সিংহরায় | ০১ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:৫৪501582
  • বিশ্ব দর্শনের আয়না পাওয়া যাচ্ছে জমানোর জন্য অশেষ ধন্যবাদ  ! এবার কলকাতা গিয়েই সংগ্রহ করব। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন