এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ক‌ওশর

    Swati Chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ অক্টোবর ২০২১ | ৫৭৬ বার পঠিত
  • গরমের ছুটি পড়েছে স্কুলে, কিন্তু মামাবাড়ি যাবার কোনো আলোচনা শুনছি না এবার মা-বাবার মুখে। কি ব্যাপার! রুক্ষ গরমের ছুটিতে বন্ধুদেরও পাওয়া যাবে না। উদ্বিগ্ন হয়ে মায়ের কাছে জানতে চাওয়ায় খবর পেলাম আমাদের নতুন ঘর হবে, বলতে গেলে বাড়ি। এক‌ই জমিতে পাশাপাশি বাড়ি। তখন ক্লাস এইট কি নাইন। আজ প্রায় ২৪ বছর বাদে সেই স্মৃতি রোমন্থন করে বুকের ভেতরের পুকুরে সেদিন কতখানি ঢেউ উঠেছিল তা বোঝাতে পারব কিনা জানি না। শৈশবের নির্মল স্মৃতি লিখতে যে নির্মল হৃদয় লাগে এই দূষণের কালে তা বড়‌ই দুষ্প্রাপ্য।

    চিপস্, বালি,‌‌‌‌‌ ইঁট পড়তে শুরু করল বাড়ির সামনে। আমার নিরবিচ্ছিন্ন পাহারায় এসব কাজ চলত। যতদিনে ‌‌‌‌‌‌‌‌ইঁট আসা শুরু হল ততদিনে আমাদের তিন বোনের জানলা দরজার রঙ, গ্ৰীলের ডিজাইন ঠিক করা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কাজ এগোচ্ছে, যদিও আমাদের কল্পনার সাথে গতি রাখা তার পক্ষে অসম্ভব। মনে আছে ভিত তৈরির জন্য মাটি কাটার দৃশ্য। মাটি যত গভীর ভিত তত মজবুত। মাটি কাটার মিতা হাসতে হাসতে বলেছিল যা ভিত করে দিলাম খুকি তোমরা চারতলাও তুলে ফেলতে পারবে। জীবনের ভিতটাও এরকমই মজবুত ভাবে তৈরি করতে হয়। তা না হলে ঝড়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে। জীবন ভিতের মিতা তো মা-বাবা।

    দুপুরে খেয়ে উঠে ছুটে চলে যেতাম মিতাদের বিশ্রাম দেখতে। চল কোদাল চালাই ভুলে মানের বালাই।...  আমার তাই দেখে মনে হত। নিম গাছের আলতো ছায়ায় আঁচল পেতে শুয়ে চলছে দেশোয়ালি গান। স্ত্রী, পুরুষ নির্বিশেষে। কি নিশ্চিন্ত বিশ্রাম। কিছু দিনের মধ্যেই বাড়ির সামনের উঠোনে মানুষ সমান গর্ত। দুপুর বেলা চুপ করে গিয়ে বসে থাকতাম শীতল আশ্রয়ে। ভূগর্ভস্থ ভাবতাম নিজেকে। গরমের ছুটি, কোথায় বাড়ির কাজ, কোথায় স্কুলের কাজ। আমি সেসব থেকে পালিয়েছি। যে প্রকান্ড ল্যাবরেটরিতে আমার পড়ার ঘর তৈরি হচ্ছে আমি সেখানে দিবারাত্রি ব্যস্ত। চা দেওয়া, কখন কি লাগবে সেসব বাবা-মাকে জানানো, কিভাবে ভাঁড়া বেঁধে তার ওপর টপাটপ উঠে পড়া যায় সেসব শেখা। হরেকরকম কিছুতে ব্যস্ত আমি। এসব কিছুর মধ্যে একদিন বাড়িতে এল মুর্শিদাবাদের এক রাজমিস্ত্রি। সে যে আসবে এবং মুর্শিদাবাদ থেকেই আসবে সেটা বাড়ির আর সকলেই আগে থেকেই জানত। বিভিন্ন কাজের দায়িত্বভারে আমারই জানা হয় নি। তার আসার দাপট মিস্ত্রিদের মধ্যে টের পেলাম। রাজার মতই প্রবেশ করল রাজমিস্ত্রি। চোখের এক দৃষ্টিতে মাপের উঁচু নীচু দেখা হয়ে যাচ্ছে। মশলা মাখার কাছে এসে দাঁড়াতেই ধরা পড়ছে বালি সিমেন্টর মিশেলের গড়মিল। আমি সমীহ ভরে দেখলাম ক‌ওশর চাচাকে। একেবার স্কুলের হেড স্যার। টাকভরা মাথা। বেশ খানিকটা লম্বা, অস্হি দৃশ্যমান পরিশ্রমী চেহারা। সামনের দাঁতের পাটি নাকের আগে থাকে। কথা বলার সময় একটু বেখেয়ালে শুনলে শুধু হ এর উচ্চারণ বোঝা যায়। চাচার মুর্শিদাবাদের বাড়ি নিয়ে ছিল ভারী গর্ব। সে বাড়ি নাকি আটলান্টিকে বাণ এলেও ডুববে না। ভূকম্পে পৃথিবী গুঁড়িয়ে গেলেও সেই বাড়ি অক্ষত‌ই থাকবে। চাচা সেখানে মশলার এমন কম্বিনেশন ব্যবহার করেছে। ওঁর বলার ভঙ্গি কোনোভাবেই সন্দেহের কোনো অবকাশই রাখত না। হাঁ করে শুনতাম আমি।

    দুপুরের পর দুপুর দেখে যেতাম কেমন ইঁটের সজ্জায় তৈরি হয়ে যাচ্ছিল আমাদের নতুন শোবার ঘর, নতুন রান্নাঘর, ঠিক আমার খাতায় আঁকা বাড়ি যেমন। একতলা, দোতলা। সব‌ই ক‌ওশর চাচার দক্ষ ইশারায়। মাঝেমধ্যেই আমার পড়াশোনার খোঁজ খবর নিত। মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়ারও কথা দিয়েছিল। কতরকম ডিজাইনের নিত্যনতুন আইডিয়া দিত ক‌ওশর চাচা। কিন্তু হিসেবের খাতায় সেসব বাদ পড়ে যেত। আমার এবং চাচার আফসোসের সীমা থাকত না। মধ্যবিত্তের বাড়ি বানাতে লক্ষ্মীর ঘট‌ও লাগে। সেই লক্ষ্মীর ঘট‌ই বাড়ির সম্মুখে ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছা ছিল ক‌ওশর চাচার। পাঞ্জাবী আর পাতলুন পরিহিত ক‌ওশর চাচা রোজ এসে তার ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ইঁট এর তৈরি সিংহাসনে বসত। যেদিন শেষ ইঁট গাঁথা হয়েছিল ক‌ওশর চাচা বাবার হাত ধরে বলেছিল নাতি নাতনি নিয়ে থাকবেন। তা অবশ্য থাকা হয় নি। আমার সেই পড়ার ঘর, মায়ের সেই পছন্দের টাইলস বসানো রান্নাঘর সব‌ই গুঁড়িয়ে গেছে। জীবনে নাকি সব‌ই অনিত্য। তাই কি হয়? আমার যেটুকু সেই বয়সে সেইসময় ছিল সেই মূহুর্তগুলো থেকে আমার আমিকে তো আনতে পারি নি। সেসব সেখানেই স্হির হয়ে আছে। বাকিটা নিয়ে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেছি। ক‌ওশর চাচা তেমনই এক সময়ের ফিরে দেখার এক চরিত্র। যার  নির্দেশনায় আমার প্রথম বাড়ি তৈরি হয়েছিল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ২৮ অক্টোবর ২০২১ ০৬:১৫500306
  • জীবনের প্রথম বাড়ি! অপূর্ব লেখা, ভাঙনের সুরটি আরেক নতুন লেখার চাহিদা তৈরি করে। 
     
    আরও লিখুন 
  • Swati Chakraborty | ২৮ অক্টোবর ২০২১ ২০:৫৩500359
  • :-)
  • Mousumi Banerjee | ২৮ অক্টোবর ২০২১ ২৩:০৯500366
  • আমারও প্রথম বাড়ি নিয়ে সব স্মৃতি ই হয়ে রয়েছে। বাড়িটা আর নেই।
  • Swati Chakraborty | ২৯ অক্টোবর ২০২১ ১১:২২500380
  • :'(
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন