এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শেষবেলা

    Ajay Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ অক্টোবর ২০২১ | ৪০৭ বার পঠিত
  • "জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে"। ছোট থেকেই এই কথাগুলো টেক্সটবুকে পড়ে আসছি বা লোকের মুখে শুনে আসছি কিন্তু কখনো কি আমরা কথাগুলো নিয়ে আলাদাভাবে কিছু ভেবেছি? একটা প্রশ্ন আসতেই পারে, যে কথা অমোঘ সত্যি, যে ঘটনাটা একদিন ঘটবেই, সেটা নিয়ে আলাদা করে ভাবার কি প্রয়োজন আছে? আমিও এটাই ভাবতাম যদি না অবনী স্যার এর সাথে শেষ দেখাটা হতো।

    অবনী স্যার আমাদের টাউনশিপেই থাকতেন। ছোট থেকেই আমি ওনাকে মাস্টারমশাই বলতাম যদিও উনি কোনও স্কুলের শিক্ষক ছিলেন না। আমি ওনার কাছে প্রাইভেট টিউশন পড়তাম। উনি ছিলেন পোস্টমাস্টার তাই অনেকেই ওনাকে মাস্টারমশাই বলতেন। যখন পোস্টঅফিসে যেতেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন, কাঁধে থাকতো একটা ঝোলানো সুতির ব্যাগ। ওনার চোখে ছিল কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, যিনি ওনাকে চেনেন না তার কাছে ওনাকে দেখে কোনো স্কুলের শিক্ষক ভাবাই স্বাভাবিক ছিল।

    উনি যে আমাকে প্রাইভেট টিউশন দিতেন তার জন্য কোনোদিন কোনও পারিশ্রমিক নেননি উপরন্তু আমার স্কুলের বইয়ের বাইরে যদি কোনও রেফারেন্স বইয়ের দরকার হতো উনি কিনে দিতেন। প্রতি মাসে অন্তত একদিন ওনার স্ত্রী রেবা কাকিমা পায়েস রান্না করে খাওয়াতেন, আমি আর মাস্টারমশাই একসঙ্গে বসে পায়েস খেতাম, দুজনেই পায়েস খেতে খুব ভালোবাসতাম।

    একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে, আমি তখন অষ্টম ক্লাসে, স্কুল থেকে একটা ট্যুর হয়েছিলো হিস্টোরিক্যাল এট্রাকশন, রাঁচি-নালন্দা-বুদ্ধগয়া। আমার সব বন্ধুরা যাচ্ছিলো তাই আমিও নাম রেজিস্ট্রি করেছিলাম, কিন্তু অনেক টাকার ব্যাপার ছিল তাই ভয়ে বাড়ীতে মা কে বলতে পারিনি। টাকা জমা দেবার শেষ দিনের আগের দিন মাস্টারমশাই এর কাছে পড়তে গেছিলাম, টিউশনের শেষে কাকিমা আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন কাল বেড়াতে যাবার টাকাটা স্কুলে জমা করে দিস। অবাক হয়ে আমি তাকিয়েছিলাম, উনি বললেন তোর মাস্টারমশাই সব খবর রাখেন, টাকাটা উনিই আমাকে দিতে বলেছেন। বয়েস কম ছিল, বেড়াতে যাওয়া হবে এই আনন্দে সেদিন এতটাই মশগুল ছিলাম যে মাস্টারমশাইকে একবার ধন্যবাদ ও বলা হয়নি। অবশ্য সেই সময়কালে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা এমনি ছিল যে শিক্ষক মহাশয়কে ধন্যবাদ বলার সাহস ছাত্রদের ছিল না, তাই ব্যাপারটা আমার মাথায়ই আসেনি।

    শুধু আমায় নয়, আরো অনেককেই মাস্টারমশাই বিপদে আপদে সাহায্য করতেন। সমাজের সব স্তরের মানুষের সাথে ওনার যোগাযোগ ছিল, সবাই ওনাকে ভালবাসতেন, সম্মান করতেন। এককথায় উনি শিক্ষক না হয়েও অনেকেরই আদর্শ মাস্টারমশাই ছিলেন।

    সেকেন্ডারি স্কুল পাঠ শেষ হলে পড়াশুনোর জন্য আমি আমাদের ছোট্ট টাউনশিপ ছেড়ে দূরে চলে গেলাম, সেই যে চলে যাওয়া আর কোনোদিনই নিজের জায়গায় পাকাপাকিভাবে ফিরে আসা হলো না। মাস্টারমশাই এর সাথে যোগাযোগ, দেখা সাক্ষাৎ কমে গেল, গ্রামের বাড়িতে এক-দুদিনের জন্য এলে রাস্তা ঘাটে এক আধবার দেখা হয়েছিল। মাস্টারমশাই আমাকে কাকিমার সাথে দেখা করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আমার ব্যস্তবাগীশ মন তখন হিসেবে-নিকেশ করে কাকিমার সাথে দেখা করার মতো সময় আমার অমূল্য সময় থেকে ম্যানেজ করে উঠতে পারে নি। মাস্টারমশাই আর রেবাকাকিমা কিন্তু সবসময় আমার খবর নিতেন সেটা অবশ্য পরে আমার মায়ের কাছ থেকে জেনেছি।

    আমার ছোটবেলা গ্রামের পুকুরে সাঁতার কেটে, তাল-নারকেল গাছে চড়ে, সদ্য ফসল ওঠা ফাঁকা মাঠে ছুটে ছুটে ঘুড়ি উড়িয়ে, পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে কেটেছিল। যেদিন থেকে শহুরে জীবন শুরু হলো নিজের অজান্তেই নিজের চারিপাশে এক শিকলের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেলাম, সেই শিকল কেটে আজও বেরোতে পারি নি। জীবনটা একটা চলন্ত ঘড়ির মতো, শুধুই ঘুরে চলেছে, একবার ১ থেকে ১২ তারপর আবার ১২ থেকে ১, এই চলার যেন শেষ নেই। আজ যা করছি, কাল ও তাই করবো, পরশু ও তাই। সময়ের বয়ে চলার সাথে সাথে শুধু আমাদের কাজের ধরণটা পাল্টেছে, গতানুগতিকতা কিন্তু পাল্টায় নি। ঘড়ির সাথে আমাদের শুধু একটাই পার্থক্য, ওর কাঁটা থেমে গেলে নতুন ব্যাটারি দিলে ও হয়তো ইচ্ছা না থাকলেও ঠিক আগের মতো চলবে কিন্তু আমাদের জীবনের কাঁটা থামা মানেই আমাদের মৃত্যু, আসলে সত্যি কথা বললে বলতে হয় মৃত্যু নয় শাপমুক্তি, অনন্তকাল ছুটে চলা থেকে মুক্তি, ১ থেকে ১২ আবার ১২ থেকে ১ এ ফেরা থেকে মুক্তি, শিকলের বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে আসার মুক্তি।

    এইভাবে চলতে চলতে, পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন করতে করতে, দশটা বছর যে কিভাবে কেটে গেলো সেটা ভাবার অবকাশ ও পেলাম না, শুরু হলো কর্মজীবন। আমার কর্মজীবনের শুরুটা ছিল একদম ম্যারাথন রেস, ছোটার খেলা। আমি তখন খুব ছুটছি, আজ এক শহরে তো কাল অন্য শহরে। এমনি একসময় একটা প্রজেক্ট এর কাজে ব্যাঙ্গালোরে রয়েছি। সকাল সাতটার সময় হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতাম, ফেরার কোনও নির্দিষ্ট সময় ছিল না। সকালের মাউথওয়াস থেকে শুরু করে রাতের ডিনার পর্যন্ত সব অফিসেই হতো, রাত্রিতে শুধু একটু ঘুমোনোর জন্য হোটেলে ফেরা।

    এমনই একটা শুত্রুবার সকাল, প্রজেক্ট মিটিং এ ছিলাম, বার বার মোবাইল ফোন টা ভাইব্রেট করছিলো, আমার প্রাইভেট নম্বর খুব কম লোকের কাছেই ছিল, তাই শেষমেষ মিটিংরুমের বাইরে এসে ফোনটা ধরলাম। ফোনের ওপাশে এক মহিলার গলা, বললেন অপু তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? বললাম পাচ্ছি, আপনি কে কথা বলেছেন? উনি বললেন আমি তপু-দি মানে তপতী-দি বলছি। ইনস্টেন্টলি তপতী বলে কাউকে চিনি বলে মনে পড়লো না তাই বললাম আপনাকে চিনতে পারছি না, উনি বললেন আমি তোমার মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে তপু-দি। নিজের অবস্থা দেখে নিজেই খুব লজ্জা পেলাম, তপু-দি কে ভুলে গেলাম? ওপাশ থেকে তপু-দি বলে চলেছে, বাবা খুব অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ছিলেন, তিনদিন হলো বাড়িতে এসেছেন, তোমাকে আগামী রবিবার বিকাল চারটের সময় আমাদের বাড়ি আসতে বলছেন, অপু, তুমি না করো না। বাবা বলেছেন তুমি ঘন্টা দুয়েক সময় নিয়ে আসবে। আমার এখন অনেককে ফোন করার আছে তাই আমি রাখছি, তুমি কিন্তু অবশ্যই আসবে, বাবা নাহলে অনেক কষ্ট পাবেন। আমি হাঁ, না কিছু বলার আগেই তপু-দি ফোন টা রেখে দিলো।

    খুব চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম, ফ্লোরে তিন তিনটে প্রজেক্ট চলছে আমার আন্ডারে, তার ওপর সব কটাই বিদেশি ক্লায়েন্ট, ছুটি তো দূরের কথা দু ঘন্টার ব্রেক নিয়ে শপিং করতেও যেতে পারিনি। কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের ব্যাপারটাও সিরিয়াস লাগছে কারণ উনি এমনভাবে কোনোদিন ডেকে পাঠাননি, তার ওপর অসুস্থ। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, মাথার মধ্যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনই ফোনটা আবার রিং হলো, মা ফোন করেছিল। মা বললো অপু তোর যত অসুবিধাই হোক তুই রবিবার মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা করবি, উনি নিয়ম করে প্রত্যেক সপ্তাহে তোর খোঁজ নেন, উনি খুবই অসুস্থ। এরপর আর কোনো চিন্তা না করে ডেস্ক এ ফিরে, সানডে তে কলকাতা যেতে হবে, বাবা অসুস্থ বলে বস কে ইমেইল করে দিলাম। একটা ভালো কাজের জন্য একটু মিথ্যা বললাম, তার জন্য আমার কোনও অনুশোচনা হলো না।

    রবিবার সকাল সাড়ে সাতটার ব্যাঙ্গালোর থেকে ফ্লাইট ধরে কলকাতা পৌঁছলাম, এয়ারপোর্ট থেকে মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবো। এরপর মোবাইল ফোনটা একদম বন্ধ করে দিলাম। গত দুদিন ধরেই মাস্টারমশাইয়ের ব্যাপারটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা চাপ ছিল, অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা চলছিল কিন্তু অনেকদিন পরে নিজের জায়গায় ফিরে বেশ আনন্দ হচ্ছিলো। যতই গাড়ি ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো আমার মনের মধ্যে পুরোনো দিনের সব ছবিগুলো ভেসে ভেসে আসছিলো। মনে মনে মাস্টারমশাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম, উনি ওভাবে না ডাকলে তো এমন হটাৎ করে ছুটি নিয়ে নিজের জায়গায় আসা হতো না।

    অনেকদিন বাদে বাড়িতে ফিরে মা-বাবা, বোন সবাইকে দেখে খুব আনন্দ পেলাম। দুপুরে লাঞ্চে খাবার টেবিলেই মাস্টারমশাইয়ের কথা উঠলো। মা বললেন মাস্টারমশাই বেশ কিছুদিন হাসপাতাল এ ছিলেন, এক সপ্তাহ হলো বাড়ি ফিরেছেন। আমি জিগ্যেস করলাম মাস্টারমশাইয়ের অসুখ টা কি? মা নির্দিষ্ট ভাবে কোনো অসুখের নাম বলতে পারলেন না, শুধু বললেন ওনার চেহারাটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে, আগের থেকে বেশ রোগা হয়ে গেছেন। গল্প করতে করতে সাড়ে তিনটে বেজে গেলো। মা বললেন এবার উঠে রেডি হয়ে নে, চারটেতে তোকে যেতে হবে। আমার বাড়ি থেকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি পায়ে হেঁটে ১৫ মিনিটের পথ। ঠিক ৩.৪০ এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

    ঠিক চারটের সময় মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছলাম, বেল বাজলে, তোপু-দি দরজা খুলে বললেন, বাবা নিশ্চিত ছিলেন তুই আসবি, দোতলার বৈঠকখানায় বাবা তোর জন্য অপেখ্যা করছেন।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় প্রথম ঘরটাই বৈঠকখানা, ঘরে ঢুকে দেখলাম মাস্টারমশাই যথারীতি ঘরে রাখা সেই পুরনো কাঠের তক্তপোষ এর ওপর বসে আছেন। আমার দিকে তাকিয়ে উনি একটু হাঁসলেন, অনাবিল আনন্দময়, নিষ্পাপ এক হাসি, আজও আমি যা ভুলতে পারিনি।

    মাস্টারমশাই আমায় বসতে বললেন, আমি যথারীতি একটু দূরে চৌকিতে বসতে গেলাম, যখন টিউশন পড়তে আসতাম ওখানেই বসতাম। মাস্টারমশাই ওনার ঠিক সামনে রাখা চেয়ার এ আমায় বসতে বললেন। মাস্টারমশাই এর এতো সামনা-সামনি আগে কখনো বসিনি, বিব্রত বোধ করছিলাম দেখে মাস্টারমশাই উঠে এসে আমার হাত ধরে এনে সামনের চেয়ার এ বসালেন। মাস্টারমশাইকে খুব দুর্বল লাগছিলো, আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন বোঝা যাচ্ছিলো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো, চশমা পরেছিলেন তাও দু চোখের তলায় মোটা কালো দাগ বাইরে থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র আগের মতোই, শুধু দএকটা নতুন বুকশেলফ দেখলাম, পুরোটা বইয়ে ভর্তি। বুজতে পারলাম মাস্টারমশাই রাত জেগে বই পড়ছেন, যদিও এই অভ্যাসটা ওনার আগে থেকেই ছিল।

    আমি ভয় আর লজ্জা কাটিয়ে বলে ফেললাম আপনার চেহারাটা তো খুব খারাপ লাগছে মাস্টারমশাই, কি হয়েছে আপনার? মাস্টারমশাই নির্লিপ্ত ভাবে বললেন ক্যান্সার, আমার গোটা শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু ছড়িয়েছে অপু, প্রথমে শ্বাসযন্ত্র তারপর একে একে কিডনি, লিভার সবজায়গায় এই জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। আমি জিগ্যেস করলাম ট্রিটমেন্ট কোথায় হচ্ছে? মাস্টারমশাই বললেন গত একমাস হাসপাতাল এ ভর্তি ছিলাম, সবরকম টেস্ট হয়েছে, দেবু এসেছিলো, রিপোর্ট দেখে ও বললো আমার স্টেজ ৪ ক্যান্সার তাই কেমো, রেডিওথেরাপি বা অপারেশন এগুলোর কোনোটাই করে বিশেষ লাভ নেই, শুধু শরীরের কষ্ট।

    দেবুর পুরোনাম দেবব্রত দাস, আমার থেকে এক বছরের সিনিয়র, মাস্টারমশাই এর কাছে টিউশন পড়তো, শুধু টিউশন নয় দেবুর পড়াশুনোর সব খরচই মাস্টারমশাই দিতেন, দেবুর বাবা নিমাই-কাকুকে পোস্ট অফিসের পিওনের চাকরিটাও মাস্টারমশাই ই করে দিয়েছিলেন। দেবু আজ বড়ো ডাক্তার, SSKM থেকে MD করে এখন লন্ডনের কোনো হাসপাতালে কাজ আর তার সাথে গবেষণা করছে।

    এরপর মাস্টারমশাই বুকশেলফ থেকে বেশ কয়েকটি বই পেড়ে আনলেন, বিভিন্ন ধরণের বইয়ের সম্ভার, যেগুলো ওনার আগে পড়া হয়ে ওঠে নি, বা বার বার পড়তে ইচ্ছা করে সেগুলোর কথা বললেন, তার মধ্যে যেমন Che Guevara ছিল, ছিল ফ্রেঞ্চ রেভোলুশন বই সিটিজেনস, ছিল ভগৎ সিং আবার তার সাথে ছিল সঞ্চয়িতা আবার লাভ স্টোরি Enemies ইত্যাদি।
    বই দেখানোর পর্ব শেষ হলে,মাস্টারমশাই বললেন জানিস অপু, মৃত্যুর কাছাকাছি এসে এই প্রথম বুজতে পারলাম নিজের মধ্যে জীবনের জন্য এখনো অনেকটা ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আজ যখন জীবন আর মৃত্যুর ফলকটা লেখা হয়ে গেছে তখন যেন জীবনের প্রাণের স্পুলিঙ্গটা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো ছিটকে বেরিয়ে এসে আমায় বললো, এতদিন তো এই সমাজ জীবনের বিশাল কর্মকান্ডের মধ্যে জড়িয়ে তোর নিজের অস্তিত্বটাই ভুলে গেছিলি, অন্তত মৃত্যুর আগে একবার নিজেকে একটু চিনে যা, জেনে যা।

    মাস্টারমশাই বলে চলেছেন, ভাবলাম, সত্যিই তো, জন্ম আমার, জীবন আমার আবার মৃত্যু হলে সেটাও আমারি হবে, তাহলে আমি কেন কোনোদিন নিজের জীবনকে জানার বা বোঝার চেষ্টা করলাম না? যাই হোক যা হবার তো হয়ে গেছে, কিন্তু এখন যেটুকু সময় আছে সেটা আর নষ্ট করবো না, তাই দেবুকে বললাম বাবা একটা উপকার কর আমার জন্য, এটাকে তুই গুরুদক্ষিণা ও ভাবতে পারিস, আমায় এখুনি বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দে। দেবু ইতস্তত করলেও আমার কথা ফেলতে পারেনি অপু, তুই ও যেমন আমার কথা ফেলতে না পেরে সেই সুদূর বেঙ্গালুরু থেকে একলাফে এখানে চলে এলি। এটা কৰ্তব্য নয়, এটাকেই বলে ভালোবাসার টান, তোর প্রতিও আমার এই টান আছে, তাইতো আমি তোকে ডেকেছি জীবনের শেষ কয়েক ঘন্টা অমূল্য সময়ের মধ্যে দুটো ঘন্টা তোর সাথে কাটিয়ে আনন্দ করবো বলে।

    নিজের মনে মনে ভাবলাম মাস্টারমশাই ঠিক কথাই বলেছেন, আমি আজ কোনো কর্তব্য করার জন্য এখানে আসি নি, ছুটে এসেছি শুধু মাস্টারমশাইকে একবার দেখবো বলে। ভাবলাম, দেবু খুব ভালো কাজ করেছে, মাস্টারমশাইয়ের ইচ্ছাটা পূরণ করেছে।

    মাস্টারমশাই বলে চলেছেন অপু, আমি জানি না আমার হাতে কয়টা দিন আছে কিন্তু সেটা নিয়ে আমি একটুও ভাবছি না। আমি এখন প্রতিটা ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড জীবনকে উপভোগ করছি। সময়ের যে এতো দাম তা আগে কখনো উপলব্ধি করতে পারিনি।

    ছোটবেলা টা সবারই খুব ভালো কাটে, সেই সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত আমরা তখন উপভোগ করি, আমিও করেছি, আর্থিক অভাব অনটন খুবই ছিল কিন্তু তার জন্য জীবন টা উপভোগ করার কোনও কমতি ছিল না। কিন্তু ছোট বেলার ভালোলাগা গুলো মানুষ নামক বেক্তিসত্বার ভালোলাগার সাথে মেলে না। সমস্যাটা শুরু হয় যখন আমরা মানুষ পরিচয় নিয়ে সংসার নামক ঘরটির ভেতর গিয়ে ঢুকি। সংসারের হাল ধরার জন্য পড়াশুনো ইচ্ছা মতো শেষ না করে চাকরিতে ঢুকে গেলাম, তারপর বিয়ে। বিয়ের পর দায়িত্ব আর কর্তব্যর বেড়াজালে বন্ধ হয়ে নিজের কথা, নিজের আনন্দ, নিজের ভালোলাগা এসব গুলো ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ এই মরণ রোগ আমায় জন্ম-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ টা নিজের জন্য, নিজের মতো করে বেঁচে থাকার জন্য, সুযোগ করে দিলো। এর জন্য নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয়, আমি যদি আরো দশ-বিশ বছর বাঁচতাম তারপর একদিন হটাৎ টপ করে মরে যেতাম তাহলে তো নিজের জন্য বাঁচার এই সুযোগটা পেতাম না।অপু, আমার কাছে দশ-বিশ বছর বেশি বাঁচার থেকে দশ দিন নিজের জন্য বাঁচা বেশি আনন্দের।

    মাস্টারমশাইয়ের এই সব কথার মধ্যে কাকিমা ঘরের ঢুকে মাস্টারমশাইয়ের পাশে বসলেন, কাকিমার হাতে ট্রে তে দুটো বাটি, আমার বুজতে অসুবিধা হলো না বাটির মধ্যে কি আছে। মাস্টারমশাইয়ের কাছে যখন প্রাইভেট টিউশন নিতে আসতাম তখন কাকিমার হাতে বানানো এই অমৃত পায়েস মাসে একটা দিন নিয়ম করে আমি আর মাস্টারমশাই একসাথে এই ঘরে বসে খেয়েছি। আমি বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম, কাকিমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিলো, আমার মাথা নিচের দিকে ঝুকে পড়েছে দেখে কাকিমা বললেন বাবা অপু উঠে এসে আমাদের পাশে বসে একসাথে পায়েস টা খাও। তোমার সাথে মাস্টারমশাইয়ের কথা বলার সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কাকিমার কথা শুনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঠিক ই তো, মাস্টারমশাইয়ের কথা শুনতে শুনতে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় যে কিভাবে কেটে গেলো বুজতেই পারলাম না। আমাদের তো দু ঘন্টার জন্য বসার কথা ছিল।

    আমি উঠে গিয়ে তক্তবসের ওপর মাস্টারমশাইয়ের পাশে বসলাম। মাস্টারমশাই বললেন পায়েস খাবার আগে অপু তোকে একটা প্রশ্ন করি। আমি এটা জানতাম, মাস্টারমশাই শেষে ঠিক একটা প্রশ্ন করবেন, এটা ওনার চিরচারিত অভ্যাস। প্রাইভেট টিউশন যখন দিতেন তখন যেটা পড়াতেন সেই বিষয়বস্তু খুব ভালো করে বুঝিয়ে বলতেন তারপর শেষে জিগ্যেস করতেন সামারি করে বল কি বুঝলি।

    কিন্তু আজকের ডিসকাশন টা তো ঠিক সাবজেক্টিভ ছিল না, তাই অবাক হয়ে মাস্টারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম, বুঝতে পারছিলাম না, উনি কি জানতে চান। মাস্টারমশাইয়ের গোটা মুখে এক স্বর্গীয় দীপ্তি, ক্লান্ত কিন্তু উজ্জ্বল দুটি চোখ, মুখে এক নিষ্পাপ হাসি। কাকিমার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম মাস্টারমশাই আমায় কি জিজ্ঞাসা করবেন সেটা উনি ও জানেন।

    মাস্টারমশাই আর অপেক্ষা না করে বললেন অপু, তোর কি মনে হয় আমি শুধুই মনের আর প্রাণের ভালোবাসার টানে তোকে অতদূর থেকে এখানে আজ টেনে এনেছি?

    প্রশ্নটা শুনে আমি একদম থতমত হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম না উনি ঠিক কি বুঝতে চাইছেন । একটু ভেবে দেখলাম প্রথমের কিছুটা সময় ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই উনি জীবনের গভীরতা নিয়ে কথা বলেছেন। নিশ্চই ওনার প্রশ্ন ও ওই বিষয়বস্তুর ওপর ই হবে কিন্তু ঠিক কি উনি জানতে চাইছেন, তা আমার মাথায় এলো না।

    ভনিতা না করে আমি বললাম, মাস্টারমশাই, প্রাণ-মন এই সবের গভীরতা কতটা তা ঠিক করে বলতে পারবো না কিন্তু আমি এটা খুব ভালো করে জানি যে দুটো কারণে আজ আমি এখানে এসেছি। প্রথম, আমি আপনাকে একবার দেখবো বলে এখানে এসেছি আর দ্বিতীয় আপনার নিশ্চই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে যেটা আপনি আমায় বলতে চান, সেটা শুনতে এসেছি।
    আপনি আজ আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় উপলব্ধি আমার সাথে শেয়ার করলেন, জীবন মানে শুধু বাঁচা নয়, জীবন মানে শুধু বয়ে চলা নয়, জীবন মানে নিজেকে চেনা, নিজেকে জানা। আত্মা আর চেতনার মিলন ই আত্মপরিচয়, এই পরিচয় ঠিক মতো না জানলে আমাদের আত্ম উপলব্ধির বিকাশ হয় নাা, অনেক কিছু জানার মাঝে, নিজেকে জানার সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমি জানি না আপনার সাথে আর দেখা হবে কিনা, আমি আর কিছু বলতে পারলাম না, আমার দু চোখের বাঁধ ভেঙে গেলো।

    মাস্টারমশাই বললেন অপু আজ আমি পরিতৃপ্ত, আমার আর কিছুই তোকে বলার নেই, আমাদের আর যদি দেখা না-ও হয় আমি জানি তুই ঠিক পারবি, আমি যা পারিনি।

    কাকিমার দুটো হাত আমার বদ্ধ হাতের তালু দুটো খুলে পায়েসের বাটি ধরিয়ে বললো, খেয়ে নাও অপু, সব কিছুর শেষ টাও ভালো করে হতে হয় ।

    অজয় মিত্র
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন