শান্তিনিকেতন যাতায়াতের পথের জীবন দর্শন আর আমার শেষ হয় না। পাঁচ দশক অতিক্রান্ত। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নবাবহাটের মোড়ে রাজ্য সড়কে পড়লে উত্তরা বাসস্ট্যান্ডের পাশে দিয়ে গুসকরা, ভাতার, ভেদিয়া, বোলপুর, শান্তিনিকেতন আসার রাস্তা আজ অতি পরিচিত ও অতি ব্যবহৃত। অতিবৃষ্টিতে দুপাশের কিছু কিছু জমিতে জল দাঁড়িয়ে। পূর্ব বর্ধমান, দক্ষিণ বীরভূমের দিগন্ত সারা জীবন আমায় মুগ্ধ করেছে আজও করে। কিন্তু কর্মী মানুষের সম্মানের ব্যাপারে উদাসীনতা আমাদের দেশের প্রতি কোণায় এত ব্যাপক, এত পরিচিত, এত দৃশ্যমান আমরা এতই অভ্যস্ত তাতে আমাদের বেদনা, ক্রোধ, লজ্জা, ন্যূনতম অসোয়াস্তি জেগে ওঠাটাই আশ্চর্যের। একের পর এক মোটর চালিত ভ্যানে মাঠে ধান লাগানোর কাজ করে ক্ষেতমজুররা বাড়ি ফিরছেন, একেকটা খোলা ভ্যানে অসংখ্য মানুষ। ভেজা জামাকাপড়ে ফিরছেন। পশুদেরও এর থেকে যাতায়াতে বোধহয় বেশি আরাম দেওয়া হয়। সম্ভবতঃ তরকারি বাজারে নিয়ে যাওয়া হয় আরও যত্নে। শুধু সঙ্গের লোকটির কোনো যত্ন হয় না। বড় বড় নির্মাণ কার্যের জায়গায় শ্রমিকদের ও এই ভাবে গাদাগাদি করে নিয়ে যাওয়াটাই রীতি। এটা কি কারো চোখে কখনো পড়ে না। মানুষ যাতায়াতের গাড়ি ছাড়া আর কোনো ভাবেই কোনো শ্রমিকদের নিয়ে যাতায়াত করা যাবে না এরকম কোনো আইন হতে পারে না? গ্রামীন ক্ষেত্রে ভ্যানগুলিকে ঢাকা লাগানোতে, নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ নিতে বাধ্য করা যায় না, সরকার বাস বাড়াতে পারে না শুধু বপন বা ফসল কাটার মরশুমে? খুব দূরে তো মানুষ যান না, পরিযায়ীদের সমস্যাটা আলাদা মাত্রায় তার ব্যাপক পরিকল্পনা আলাদা মন্ত্রক জরুরি। স্বনিযুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও তো এই বিপজ্জনক ভাবে যাতায়াতের বিকল্প চাইতে পারেন।
আমাদের আর কিছুতেই আশ্চর্য লাগে না, তাকেই প্র্যাগমাটিজম বলে। কিন্তু যাঁরা প্রতিদিন অসম্মানিত হন এমনকি কর্মস্থলে যাতায়াতের সময়েও, হাস্যকর মজুরির জন্য তাঁরা তো প্রতিবাদ করতে পারেন। মানুষের কি আশ্চর্য দুর্ভাগ্য এবং সহ্যশক্তি যে জনতা রাষ্ট্র এবং সমাজ থেকে কি চাইতে পারেন তার মাপ কমানোর রাজনীতিটাকেই নতুন ৮-৯ এর দশক পরবর্তী অর্থনীতির এই তূরীয় আমলে 'রিলিফ', এমনকি 'জনকল্যাণ' ও বলা হচ্ছে।
৬ অগাস্ট, ২০২১, শান্তিনিকেতন