এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • পুরুষার্থ (৩)

    সুদীপ্ত পাল
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১০ জুলাই ২০২১ | ১৭৫৮ বার পঠিত
  • || পর্ব ৩ ||

    এখন শীতকালে ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরপ্রান্তে দিনের দৈর্ঘ্য কম​- ঋষভ দেখল আর ব​ড়জোর দু`ঘণ্টা আছে রোদ পোয়ানোর জন্য​। তারপর নিজেকে নিজেই তিরস্কার করল এইসব অহেতুক হিসাব​-নিকাশ করার জন্য​। কাউন্সেলর বলেইছেন​, জীবনের বেশির ভাগ জিনিস যার হিসাব আমরা করি, তার হিসাবগুলো না করলেও চলে!

    তবু ভাবনা থামার জিনিস নয়। ঋষভ চা বানাতে বানাতে সাতপাঁচ ভেবেই যাচ্ছে- সবকিছুর অর্থ খোঁজাটা কি জরুরি? সবকিছুর অর্থ থাকাটা কি জরুরি? শরীরের আর মনের ভেতরকার প্রত্যেকটা অনুভূতি আর দোলাচলের কার্য​-কারণ এবং অর্থ খুঁজে বার করতে থাকলে মানুষের পাগলের মতো অবস্থা হ​য়- ঋষভেরও হয়েছে- আর সেটা ও জানেও। একটা সময় ছিল যখন ঋষভ এই ছোট ছোট অনুভূতির কোন অর্থ খোঁজার চেষ্টা করত না, বা এই অনুভূতিগুলো আদৌ হত না। কিন্তু সেই সময়ের কথা মনে করতে ঋষভের খুব ইচ্ছে হ​য় না। মনে করতে বসলে অনেক স্মৃতিই বেরিয়ে আসে! কিছু ভাল, কিছু হতভম্বকর, কিছু হাস্যকর​, আর কিছু যেগুলো অসম্পূর্ণ বা আদৌ হ​য় নি!

    রেশমীর অনুপস্থিতিটা ঋষভ বেশি করে টের পায় বিছানার দিকে তাকালে। আজকের ওষুধের ডোজটা খেয়ে চা বানিয়ে সে বারান্দায় এসে বসল। আমেরিকায় কফির চল বেশি, তবে ঋষভ মাঝে মাঝে সম​য় সুযোগ করে চা বানিয়ে খায়​। ক​ড়া দুধ​-চা। সঙ্গে বিস্কুট​। এই নিয়ে উঠোনে রোদে এসে বসল ঋষভ। বিস্কুটটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল, অল্প হাসল, তারপর চায়ে ডুবাল।

    ঋষভকে কে যেন একটা বেঁধে রেখেছে। হাম্পির কোন একটা ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তূপে যেখানে দিনের আলো ভালো করে ঢোকে না। কষে বেঁধেছে। দ​ড়ি দিয়ে। কীভাবে এখানে এসে পৌঁছল সেটাই তো মনে পড়ছে না। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে একটা মন্দিরের মত দেখতে পেয়েছিল। মন্দির তো না- গুহা। গুহাও না- সুড়ঙ্গের মত কী একটা। ঢুকে দেখে একেবারে পাণ্ডববর্জিত জায়গাও নয়। পুজোয় যে ধূপ ধুনো দেয়া হয়- ওরকমই একটা ধোঁয়া ভেসে আসছে। মিষ্টি মনভোলানো গন্ধ। সত্যি মনভোলানো- কারণ কিছুই মনে পড়ছে না। খালি এখন সে বন্দি এইটুকুনি বোঝার মত হুঁশ তার রয়েছে। হাত বাঁধা, পায়েও শিকল লাগানো। দেখে সেই সেদিনকার স্বর্গলোকের মতই লাগছে, কিন্তু অনুভূতিটা মোটেই স্বর্গসুখের নয়।

    একটা ছুরি কে যেন ওর গলা, বুক​, পেটের উপর দিয়ে হাল্কা করে বুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছুরির স্পর্শে কাঁপুনি হচ্ছে। কাঁপুনিটা ভয়ের না উত্তেজনার ঋষভ বুঝতে পারছে না। কিন্তু ছুরিটা তার শরীর বেয়ে বেয়ে পথ খুঁজে খুঁজে এগোচ্ছে। এক একবার থামছে আর ঋষভের উত্তেজনাটাও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ছুরি হাতে মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না, খালি শোনা যাচ্ছে- সে বলছে "টাকা ফেলো, ছাড়া পেয়ে যাবে। ভ​য়ের কিচ্ছু নেই!"

    জেট ল্যাগ হলে, বা জ্বরজারি হলে, মাঝরাতে অনেক সম​য় এরকম বাজে ভাবে ঘুম ভাঙে। এরকম বাজে একটা স্বপ্ন আসে, ঘাম দেয়​। ঘুম ভাঙারপর মানুষ টের পায় না সে কোথায় আছে। ঋষভ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না যেখানে ওর ঘুম ভাঙল জায়গাটা কোথায়​? ওর কলকাতার বাড়ি, না আমেরিকার বাড়ি, না কি হাম্পির হোটেল​। হোটেলের খাট থেকে তো বাঁ দিক দিয়ে নামার কথা, এখানে তো মনে হচ্ছে উল্টোটা। স্বপ্ন শেষ হ​য়ে যাবার পরেও যেন হাত​-পা বাঁধা! ঋষভ শুনেছিল স্লিপ প্যারালাইসিস বলে একটা কিছু হয়- মানুষ ভাবে সে জেগে আছে- কিন্তু হাত-পা ঘুমন্ত মানুষের মত অচল! কিছুক্ষণ পর কোনোভাবে আলোটালো জ্বালিয়ে বুঝতে পারল হোটেলেই আছে। রেশমীও পাশেই শুয়ে আছে। রেশমীর চুলে অল্প হাত বুলিয়ে ঋষভ আবার শুয়ে প​ড়লো।

    কাল রাতে একটা ভাবনা মাথায় নিয়ে সে ঘুমিয়েছে। সারথি দেহব্যবসাকরে, কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো টাকা চায়নি! অথচ কিছু সুখ সে ঋষভকে দিয়েছে- ঋষভের কাছ থেকে নিয়েছেও- তবে টাকা তো চায়নি। যদি অন্যভাবে চায়? ব্ল্যাকমেল করে? সারথি কারণে অকারণে মিথ্যা বলে, নিপুণ ভাবে অভিন​য় করে। দুমদাম করে তার আত্মপরিচয় বদলে যায়। চেষ্টা করেও সারথির ব্যাপারে এই ভয়গুলো ঋষভ কাটাতে পারে না।

    আজ চায়ের দোকানের পাশে রেশমী যখন ভেড়ার ছবি তুলতে ব্যস্ত​, টুপ করে সারথি এসে একটা বিস্কুট নিয়ে ঋষভের চায়ে ডুবিয়ে খেয়ে নিল। বলল, বিস্কুট সবসম​য় চায়ে ডুবিয়েই খায়​, নিজের চা ফুরিয়ে গেছে, তাই অন্যের চায়ে। ঋষভ বেশ মজাই পেয়েছিল, তাও মনে হল ক্যামেরায় ব্যস্ত রেশমী যেন ব্যপারটা দেখতে শুনতে পেয়েছে।

    রেশমী লক্ষ্ করছে এই কদিন ঋষভ তাকে খুব আদর করছে, সেই এক বছর আগে যখন ওদের প্রথম দেখা হ​য়​, তখনকার মত! কারণে অকারণে আদর করছে, সব আব্দার শুনছে!

    সারথি আবার আজকে দুঃখ করছিল​, "প্রচণ্ড বাজে মার্কেট এখানে, এতো বিদেশি টুরিস্ট আসা সত্ত্বেও। কিছু লোকজন, এই কলেজ স্টুডেন্ট​, বেকার ছেলেরা ৫০০-৮০০ টাকার বিনিম​য়ে শরীর দিয়ে দিয়ে মার্কেটটাকে ডোবাচ্ছে। আর কিছু হ্যাংলা কাস্টোমারও সেইরকম​, যারা ভাল শরীর আর খারাপ শরীরের পার্থক্য বোঝে না। ভালো জিনিসের দাম দাও আর ভালো দাম দাও, তা না!"

    ঋষভ ভাবল জিজ্ঞাসা করবে- তুমিই বুঝিয়ে দাও না হয়, ভাল শরীর আর খারাপ শরীরের পার্থক্য। জিজ্ঞাসা করল না, খালি বলল,
    "তুমি টাকার জন্য অনেক কিছুই তো করো?"
    "অনেক কিছু তো না! টাকার জন্য দুটো কাজই করি, গাইডের কাজ আর লোককে আনন্দ দেয়ার কাজ​।"
    "ঐ আনন্দ দেয়ার কাজটাই করতে হবে, তবে মানুষকে ন​য়​, ক্যামেরাকে। আমার মাথায় কিছু ফোটোগ্রাফির আইডিয়া এসেছে। এই দ্রাবিড় শৈলীর মন্দিরের ভাস্কর্য​, আর তোমার এই কষ্টিপাথর শরীরের ভাস্কর্য​, দুটো একসঙ্গে নিয়ে।"
    "দশ হাজার লাগবে।"
    ঠিক হল পরদিন সকালে হেমকূট পাহাড়ের উপর ফোটোশুট​। হেমকূট পাহাড় খুব উঁচু ন​য়​, কিন্তু হাম্পির দূরদূরান্ত অবধি দেখা যায় এখান থেকে। পাহাড় থেকে বিরূপাক্ষ মন্দির দেখলে মনে হয়, পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে মন্দিরের এই বিশাল চূড়াটা। ফটোগ্রাফারদের প্রিয় দৃশ্য এটা।

    আগের দিন হাম্পি থেকে দেড় দেড় তিনশো কিলোমিটার যাত্রা করে বাদামি-আইহোলে ঘুরে দুজনেই ক্লান্ত ছিল। রেশমী বলে দিয়েছিল দশটার আগে ঘুম থেকে উঠবে না। ঋষভ শারীরিক ভাবে ক্লান্ত হলেও উচ্ছ্বাসের অভাব ছিল না। সারথির ক্লান্তি বিশেষ নেই। ঋষভ শুধু সারথিকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, সে উত্তর দিল, "সারথি ক্লান্ত হয় না। হলে রথটা কে চালাবে শুনি?" অত​এব পরদিন সূর্যোদয়ের এক ঘণ্টা আগে থেকে ফোটোশুট শুরু করার পরিকল্পনা হল।

    ঋষভ ক্লান্ত, তবু ঘুম আসতে চায় না। কীসের একটা উত্তেজনা- হয়তো আগামীকালের ফোটোশুটকে ঘিরে। হাল্কা হাল্কা ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে স্বপ্নও ভেসে আসছে। পট্টাভিরাম মন্দিরের মণ্ডপে অনেক অনেক থামের মাঝে নাচছে সারথি। তার বলিষ্ঠ পা সশব্দে মন্দিরের মেঝেতে ফেলে সে নাচছে।
    "এই নাচ দেখলে সে যুগের রাজারা গলার হার খুলে দিয়ে দিত।" এই নাচের শেষেও সারথি ঐ একই কথা বলল।
    "কী চাও তুমি।"
    "অনেক কিছু। থাক গে, তুমি দিতে পারবে না।"

    ঘুমন্ত রেশমীর কপালে আলতো চুমু খেয়ে ঋষভ বেরিয়ে পড়ল- ভোরের আলো ফোটার আগেই। ডিএসেলার ক্যামেরাটা হাতে নেয়ার সময় একটু অপরাধবোধ হচ্ছিল- কিন্তু নিজেকে বোঝাল- ফটোগ্রাফিটা শিল্প, আর শিল্পীর কিছু স্বাধীনতার দরকার হয়। নিজেকে কী বোঝাতে পারল সে নিজেই জানে, পা টিপে টিপে নিঃশব্দে হোটেলরুমের বাইরে এল। হোটেলের মেইন গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা- সারথির এত দেরি কেন! এখনও আলো ফুটতে দেরি আছে। এই অন্ধকারটার মধ্যে নিজেকে কেমন চোর চোর মনে হচ্ছে। হোটেলের সিকিউরিটি গার্ড যদি কিছু জিজ্ঞেস করে বসে- কী উত্তর দেবে কে জানে।

    ঋষভ উপরে তাকিয়ে দেখল। অদ্ভুত পরিষ্কার আকাশ যা শহরের দিকে দেখা যায় না, তারার আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখল- জঙ্গল- সেখান থেকে কখন কীবেরিয়ে আসবে জানা নেই। ডানদিক-বাঁদিক তাকিয়ে দেখল- রাস্তা- খালি রাস্তা-আর একরাশ অপেক্ষা। একটা বাইক এল, দেখে ঠিক বুঝতে পারছিল সারথি নয়, তবে সারথির বাইক বলে ভাবতে ইচ্ছে করছিল। বাইকটা অন্ধকারে মিলিয়েও গেল। আর একটা বাইক এল। অনেকটা সারথির বাইকের মত দেখতে- সেও পাশ দিয়ে গিয়ে কিছুদূর এগিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তাহলে সারথি নয়। কিন্তু বাইকটা ইউ নিয়ে ফিরেও এল।
    "কী হল, আমাকে দেখে চিনতে পারলে না?"
    "হেলমেট দিয়ে ঢাকা, তার উপর অন্ধকার। তুমিই বা ওরকম হুশ করে বেরিয়ে গেলে কেন?"
    "হুশ করে তো বেরোই নি।"
    এটা ঠিক বাইকটা একটু স্লো করেছিল ঋষভের সামনে এসে। সারথি বলে গেল, "দেখছিলাম চেনো কি না! মুখ না দেখে আমায় চেনো কি না!"
    ঋষভ ভাবল বলবে- তোমার মুখ ছাড়াও অনেক কিছু চিনি- কিন্তু মুখে খালি বলল,
    "কিন্তু অন্ধকারে চিনব কীভাবে..."
    "আরে তুমি তো ব্যাখ্যা দিতে বসলে। মজা করছিলাম।"
    "হুঁ।"
    "আর আমার বাইকের নাম্বার এখনও মুখস্থ করোনি!"
    "সেটাও কাজের আওতায় পড়ে নাকি?"

    ঋষভ বাইকে ওঠার সময়ে সারথি যথারীতি ঋষভের মাথা থেকে পা অবধি মাপল। হেলমেটের আড়ালে দেখা যাচ্ছে না- কিন্তু ঋষভ স্পষ্ট বুঝতে পারছে সারথির চোখের গতিবিধিগুলো।

    হেমকূট পাহাড়ের মাথায়সারথি একে একে তার পোশাকগুলো বার করছে, আর ঋষভ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। যখন যে পোশাক সারথি বার করছে, ঋষভ মানসচক্ষে একবার সারথিকে সেই পোশাকে দেখে নিচ্ছে। ঋষভের মনে হচ্ছে এই ক'দিনে তার কল্পনাশক্তি অনেক বেড়ে গেছে।

    "সারথি, এ তো কাঞ্জিভরম শাড়ি। তুমি শাড়ি পরবে নাকি?"
    "শাড়ি না গো- ধুতি এটা, প্রায় একই হল!"
    "আমাদের বাংলায় ধুতি সাদা ঘেঁষা রং হ​য়​।"
    "এখানেও তাই, তবে ভারতনাট্যম ডান্সাররা আর কর্ণাটিক সিংগার বা প্লেয়াররা রঙিন ধুতি পরে, কাঞ্জিভরম স্টাইলের​।"
    "দারুণ তো!”
    “সাদা ধুতিও এনেছি।“
    “জুয়েলারিও এনেছ দেখছি।"
    গয়নাগাটি আনতে ঋষভ বলেনি, তবে এটা দেখে ঋষভ বুঝল যে সারথিরও বেশ আগ্রহ রয়েছে কাজটাতে। ঋষভ নিজের মানসচক্ষে যে খসড়া বানিয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি সারথি নিজেই কল্পনা করে রেখেছে।

    "অ্যাই সারথি, এই গেরুয়াটা তো একটা পলিটিক্যাল পার্টির পোশাক মনে হচ্ছে!"
    "পলিটিক্যাল পার্টির কেন হতে যাবে? এটা প​রেই আমি মন্দির​-মঠে যাই!"

    ঋষভ এতদিন ভাবত অনেক কঠিন সাধনা করে গেরুয়া পাওয়া যায়। তারপর ভেবে দেখল, আজকাল ভারতের রাস্তায় যাকে-তাকে সে গেরুয়ায় দেখতে পায়। সব পোশাক আর সারথিকে বারকয়েক দেখার পর ঋষভ এবার নিজের খসড়াটা বলল,

    "শোনো, প্রথমে একটা গেরুয়া থিম ফোটোশুট- নাম দেবো ধর্ম​!"
    "বেশ।"
    "তারপর একটা কাঞ্জিভরম থিম ফোটোশুট জুয়েলারি সহ​- নাম হবে অর্থ!"
    "বেশ।"
    "তারপর একটা সাদা ধুতি থিম- জুয়েলারির বদলে গায়ে থাকবে বন্য লতা, ফুল, ছোটো ছোটো বুনো ফল​- নাম দেবো কাম!"
    "আচ্ছা।"
    "আর শেষ থিমটা- নাম দেবো মোক্ষ​! ধর্ম​, অর্থ, কাম​, মোক্ষ​- এই চার নিয়ে হ​য় পুরুষার্থ। পুরো শুটটার নাম হবে- পুরুষার্থ!"
    "মোক্ষ থিমের পোশাক কি হবে?"
    "মোক্ষের পোশাক হ​য় না, মোক্ষ মানে মুক্তি! সব বন্ধনের ঊর্ধ্বে যেতে পারলেই মোক্ষ! পারবে?"
    "ন্যুড ফোটোশুট? আচ্ছা এটার কফি টেবিল বুক বানালে আমাকে আধা র​য়ালটি দেবে তো?"
    ঋষভ নিজের মনে বলল- কোথায় মোক্ষ নিয়ে কথা হচ্ছে, আর এ এখনো অর্থের স্টেজেই প​ড়ে আছে!

    "কফি টেবিল বুক তো ভাবিনি! এটা খালি আমার নিজের জন্য​!"
    সারথিকে দেখে মনে হল সে এটা শুনে যেন একটু মনঃক্ষুণ্ন। কফি টেবিল বুকের একটা কী সুন্দর ব্যাবসায়িক আইডিয়া- ঋষভ মাটি-ই করে দিল! খালি নিজের বিলাসিতার জন্য এত টাকা আর সময় খরচ- এই ব্যাপারটাও তার অদ্ভুত লাগল।
    "আইডিয়াটা মন্দ বলোনি। কফি টেবিল বুক ভাবতেই পারি। নিশ্চ​য়ই র​য়ালটি পাবে।"
    "তবে ন্যুডের জন্য বাড়তি টাকা লাগবে!"
    "নো প্রবলেম​!"

    ঋষভের মনে হচ্ছিল রেশমী হোটেলের বিছানায় শুয়ে হ​য়তো স্বপ্ন দেখছে এখন​, আর ঋষভ জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে এই হেমকূট পাহাড়ের মাথায়​। স্বর্গের কোন বন থেকে নেমে এসেছে কোনো গন্ধর্ব বা স্ব​য়ং কন্দর্পদেব​, এই মন্দিরনগরীকে নিজ রূপরসে সিক্ত করে পবিত্র করার জন্য​। সব দেবদেবীর বন্দনার একটা মন্ত্র হ​য়​। ব্রাহ্মণের ছেলে হবার সুবাদে ঋষভ সে সব মন্ত্র ছোটবেলায় শিখেছিল। কিন্তু কন্দর্পদেবকে বন্দনার মন্ত্র সে শেখেনি। হ​য়তো তাঁর বন্দনার মন্ত্র হয় না। তাঁর বন্দনা গান হ​য়তো অনাহত নাদে রচনা হ​য়​, যে অনাহত নাদ আর সব নাদের থেকে আলাদা, যা নশ্বর বস্তুর আঘাতে তৈরি হ​য় না, যার কোনো শব্দ হ​য় না!

    মোক্ষ থিমটা দিয়ে ফোটোশুট শুরু হয়েছিল, কারণ সূর্যোদয়ের সময়ে এখানে লোকের ভিড় হবে। মোক্ষ দিয়ে শুরু করাটা ভুল হয়েছিল- ঋষভের মনে হল। ভোরের আলো আঁধারে সারথির এই নির্মুক্ত শরীর- নাহ, সহজ ছিল না ঋষভের পক্ষে কাজে মনোযোগ দেয়াটা। সে নিজেকে বলল, "ঋষভবাবু, বড় ভুল করছ। ধর্ম, অর্থ আর কাম- না পেরিয়ে সোজা মোক্ষের স্তরে লাফিয়ে উঠতে নেই।"

    উল্টো ক্রমে ফোটোশুট হল। কামের থিমটার জন্য সারথি বুনো ফুল-ফল সংগ্রহ করতে বসল। ঋষভ সেই দৃশ্যগুলোরও ছবি তুলে রাখল। দেখে সারথি বলল,
    "তোমার ক্যামেরাটা আমাকে এত্ত ভালবাসে, স্যার?"
    "আমিও বাসি।"- বলতে গিয়েও ঋষভ বলল না।
    তারপর এল অর্থ। উজ্জ্বল রঙিন ধুতিতেসারথি। সে যখন গয়না পরছে, ঋষভ বলল, "বাহ! ভাল কালেকশন তো তোমার?"
    "হ্যাঁ, মা রেখে গিয়েছিল বৌমার জন্য। সে তো আর হল না- আমিই পরি।"
    যদিও বালার সাইজ আর হারের স্টাইল দেখে ঋষভের মনে হল না এগুলো মেয়েদের পরার গয়না।

    সূর্য উঠবে উঠবে করছে। হেমকূট পাহাড়ের যে অংশেমানুষ কম আসে এখন সেইদিকে ফোটোশুট চলছে।কোথা থেকে দুটো বাচ্চা ছেলে হাজির হল- বছর দশেক বয়স হবে। দেখে মনে হল বেশ মজা পেয়েছে ফটোশুট দেখে। একজন সারথিকে ইংরাজিতে জানতে চাইল, "হে, য়ু আর দ্যাট গাইড নো?"
    "আই অ্যাম নো গাইড। য়ু নো, আই অ্যাম গড! গড অফ দিস সিটি। গড অফ দিস টেম্পল- লর্ড বিরূপাক্ষ।"
    "রিয়্যালি?"
    "ইয়েস। ওয়ান নেভার আস্কস দা গড- রিয়্যালি? অলওয়েজ ইউ হ্যাভ টু বিলিভ হিম। তোমরা ভোরবেলা এলে তাই দেখতে পেলে। ভোরের এই সময়টাতে আমি পৃথিবীতে নামি।"
    ঋষভের মজা লাগছিল এগুলো শুনে। বাচ্চা দুটোও হেসে ফেলল।

    ফোটোশুটের শেষে সারথি গেরুয়া চাদর আর ধুতি পরেই পাহাড় থেকে নামছিল। কিছু অচেনা লোকজন ঘাড় নিচু করে ভক্তিভরে নমস্কারও করে গেল। সারথি আবার হাত দেখিয়ে আশীর্বাদও করে দিল! সব শেষেসারথি জানতে চেয়েছিল পুরুষার্থ মানে কী?
    "ধর্ম​, অর্থ, কাম​, মোক্ষ- যে চারটি বস্তু মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য​, যা সব মানুষ অর্জন করতে চায়​, যা মানুষের জীবনকে একটা অর্থপূর্ণ রূপ দেয়, ঐ চারটি জিনিসকে একত্রে পুরুষার্থ বলে।"
    "ওহ্! আমি ভাবলাম অর্থের বিনিম​য়ে পুরুষ পাওয়া গেলে তাকে পুরুষার্থ বলে।"

    ফোটোশুটের শেষে সারথি একটু লজ্জা লজ্জা করেই টাকাটা নিল। যাক সারথি যে লজ্জা পায় সেটা দেখেও ঋষভের ভালো লাগল। সারথি বলল,
    "আসলে গাইডের কাজ তো আর স্টেডি প্রফেশন ন​য়​, একটা নিজস্ব ট্রাভেল এজেন্সি খোলার ইচ্ছে আছে। তার জন্য টাকা জোগাড় করছি।"
    দুম করে টাকার প্র​য়োজনের কারণটা বোনের হার্টের চিকিত্সা থেকে হ​য়ে গেল ট্রাভেল এজেন্সি খোলা! ঋষভ মনে মনে বলল- তোমার টাকার প্র​য়োজনটা কেন​, সেটা আমাকে না বললেও চলবে। তুমি একটা সার্ভিস দিচ্ছ​, তার বদলে টাকা পাচ্ছ, সেটা নিয়ে কুণ্ঠা কেন​? তুমি টাকাটা কীভাবে ব্যবহার করবে তার বিচার আমি কেন করব? যাই হোক​, এসব কথা ঋষভ সারথিকে আর বলল না।

    ঋষভ ডিএসেলার থেকে নিজের মেমোরি কার্ডটা খুলে সেটাকে পার্সে ভরে, রেশমীর মেমোরি কার্ডটা ডিএসেলারে ভরতে ভরতে সারথিকে বলল, "চলো এবার হোটেলে দৌড়োই, আর হ​য়তো দেখা হবে না!"
    "চা তো খেয়ে যাও!"
    এবারের মত এই শেষ ঋষভের চায়ের কাপে সারথি বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে খেলো। একে অপরের চোখে চোখ রেখে রেখে। ঋষভ মনে মনে বলছিল অন্যের চায়ে বিস্কুট ডুবোতে খুব মজা লাগে, না? আর তারপর যা হওয়ার তাই হল! বিস্কুটের শেষ টুকরোটা টুপ করে নরম হয়ে চায়ে ডুবে গেল, আর তাতে দুজনেরই বেশ হাসি পেয়ে গেল- সেই কথা ভেবে ঋষভ এই চার বছর পরেও আপন মনে হাসছিল এই আমেরিকার বাড়ির উঠোনে রোদে বসে চায়ে বিস্কুট ডুবোতে ডুবোতে!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১০ জুলাই ২০২১ | ১৭৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন