বসন্ত এসে গেছে...
আজকাল কবে বসন্ত আসে, কবে চলে যায় কিছুই বুঝতে পারি না। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কাঠফাটা রোদ্দুর আর প্যাচপেচে ঘাম, মাথা ঝিমঝিম করে। তারই মাঝে মাইক চালিয়ে সরস্বতী পুজো নয় শিবরাত্রির কানে তালা লাগিয়ে দেওয়া উৎসব পালন। দক্ষিণ ভারতেও মাইক সংস্কৃতির হিড়িক লেগেছে, আজ গনেশ কাল ছত্রপতি শিবাজি পরশু ব্রাহ্মণ ভোজন চলছেই। দোলযাত্রা বা হোলির উৎসব তো এক যুগ আগেই উন্মাদ নৃত্যে পরিণত হয়েছে, হিন্দি বেল্টে ছোটবেলা কাটানোর ফলে আমার অভিজ্ঞতা অন্তত খুব একটা সুখকর নয়। কিন্তু আজকাল সবচেয়ে বেশি মাথা ধরে ফেসবুকে একটানা দশ পনেরো মিনিট কাটালে। এক একজনের রাজনৈতিক পোস্টকে যদি ন্যূনতম ডেসিবেলে বদলে দিই, সমস্ত পৃথিবী বদ্ধ কালা হয়ে যাবে।
অথচ আমাদের দেশেই কী সুন্দর সুন্দর কিছু পরব আছে। মনে পড়ছে, বছর বারো আগে হোলির ছুটিতে কলেজ ফাঁকি মেরে উত্তরাখন্ড পালিয়ে গিয়েছিলাম। সেমেস্টার ব্রেকের পর ক্লাস ফ্লাস বিশেষ হয় না, সবাই খোশমেজাজে থাকে, হোলির ছুটিতে অনেকেই বাড়ি চলে যায়। তাছাড়া দুনিয়া রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ার একরাত পড়ে ডিগ্রির উপর কব্জা করছে, আমরা কেন খামোখা অত পড়াশুনা করতে যাব?
যাই হোক, কোথায় যাব সেটা ঠিক করিনি। আমার এক বন্ধু থাকত আলমোড়ায়, সে বলল আমার সঙ্গে এক বন্ধুর গ্রামে যাবে। আড়াই দিন ধরে ধাপে ধাপে বাসের ভিতর গাড়োয়ালিদের সঙ্গে গুঁতোগুতি করে যে জায়গায় পৌঁছলাম, তার নাম চৌখুটিয়া। বন্ধু অপেক্ষা করে ছিল, কুলহড় স্পেশল চায়ে চুমুক দিয়ে সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে শুরু হল হাঁটা। ঘন সবুজের মাঝ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে, মাঝে মাঝে পাহাড়ি নালার কুলকুল শব্দ কানে আসে। একসময় চড়াই-উতরাই হয়ে পাহাড়ের রিজ লাইন ধরে কিছুটা এগোতেই দেখলাম, দূরে সম্ভবত অলমোড়া শহর চোখে পড়ছে।
আমরা যাব অন্যদিকে, সুতরাং হেঁটে চললাম। পথের ধারে রাশি রাশি বুনো ফুল আর রঙিন ঝোপ, মন কেমনিয়া গন্ধে মন মাতোয়ারা। আমার নেশা লেগে যাচ্ছে বার বার, যেখানে সেখানে বসে পড়তে চাইছি বার বার। বন্ধু ঠেলা দিয়ে বলছে, "চল চল! বাওরা হো গয়া কেয়া? কভি বসন্ত নাহি দেখা?" কী করে বোঝাবো, আমাদের বসন্ত আসে বইয়ের পাতা আর কবিতার ছন্দ ধরে, সেখানে ফুলের কথা আছে, ফুল নেই। প্রজাপতি, ভ্রমর, আমের মুকুল, পাখি, প্রেম সব কিছুই আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বসন্তের কথা পড়েছি, শুনেছি...চাক্ষুষ দেখা হয়নি। আমার তখন চোখ ঢুলু ঢুলু, মুখে হাসি। লতা-পাতা-গুল্ম যা দেখি, চোখ সরতে চায় না। দূরে পাহাড়ের মাথা থেকে ঠান্ডা হাওয়া এসে চুমু খাচ্ছে মাথায়, আলতো করে গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘাসিয়ারি মেয়েরা পিঠে ঝুড়ি নিয়ে ঘাস কুড়োতে যাচ্ছে, আমাকে দেখে তাদের সে কী হাসি! বন্ধু হেসে স্থানীয় ভাষায় তাদের বোঝাচ্ছে, "বাওড়া হো গয়া ইয়ে বসন্ত দেখ কে!"
আমার মাথায় তখন সোয়ানন্দ কিরকিরের সুরেলা গলা শুনতে পাচ্ছি... "বাওরা মন দেখতে চলা এক সপনা"
সবজিখেত আর সবুজের সমারোহ দিগন্ত অব্দি চলে গেছে। এক জায়গায় থমকে পড়ে দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি উড়ছে। কী বলব, অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। সব কিছুই ঠিক আছে! সবুজ দেশে সবুজ পাখি, আমরাই বরং বেমানান!
দিনের শেষে যে গ্রামে পৌঁছলাম, তার নাম শুনে আরেকবার চমক লাগল। তেরাগাঁও। তোমার গ্রাম! কী মিষ্টি, কী আপন করে নেওয়া নাম! ইন্ডিভিডুয়ালিস্টিক সোসাইটিতে সব কিছুই 'মেরা', এর মাঝে আজও একটা পাহাড়ি গ্রামের নাম 'তেরাগাঁও।'
বন্ধুর বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিবাস। আপ্যায়নের আতিশয্য ছিল না, ছিল আপন করে নেওয়া আদর। রাতে রুটির সঙ্গে পাহাড়ি টম্যাটো আর শাকের তরকারি, তারপর ঘুম। সকালে ঘুম ভাঙল বাচ্চাদের কিচিরমিচির শব্দে। ভিড় করে এসেছে একদল কচি ছেলেমেয়ে, তাদের হাতে ফুলের ঝুড়ি, মুখে অনাবিল হাসি। মিষ্টি সুরে তারা গাইছে...
"...ফুল দেই, ছম্মা দেই, দ্যাণী দ্বার, ভরী ভকার
ইয়ে দেলী স বারংবার নমস্কার,পুজে দ্বার বারংবার, নমস্কার..."
মানেও খুব সহজ। বন্ধু বুঝিয়ে দিল। তোমাদের বাড়ির চৌকাঠ সর্বদা ফুলে ভর্তি হোক, এই চৌকাঠ যেন সকলকে আশ্রয় দেয়, সকলকে ভালোবাসে, এই বাড়িতে অভাব না আসে, এই চৌকাঠকে বার বার নমস্কার করি। জানলাম এই পরবের নাম 'ফুলদেই'। গড়ওয়াল আর কুমায়ুন অঞ্চলের নানা জায়গায় ফুলদেই পরব পালন হয়। কিছু জায়গায় চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু হয়, সাত আট দিন ধরে চলে। আবার কয়েকটা গ্রামে ফুলদেই চলে সারা মাস ধরে। বিকেলের দিকে গ্রামের কচিকাচারা রিংগালের ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফুল কুড়োতে। বসন্তের এই মরশুমে কত কত যে ফুল। ফিউলি,বুরানশ (মানে রডোডেনড্রন), বাসিং, আড়ু, পুলম, খুবানি নিয়ে বাড়ি ফেরে বাচ্চারা। পরদিন সকাল সকাল স্নান করে গ্রামের সকলের বাড়িতে ফুল ছড়িয়ে মঙ্গল কামনা করে। বাড়ির লোকজনও ছেলেমেয়েদের খালি মুখে যেতে দেয় না। চাল, ডাল, আটা, গুড় আর দক্ষিণা ও দেওয়া হয়। ফুলদেইয়ের সময় মেয়েরা দেয়াল আর মাটিতে নানা রকম ট্র্যাডিশনল 'এপন' বা আলপনা তৈরি করে। শেষ দিন মিষ্টি ভাত তৈরি করে গ্রামের সকলকে পরিবেশন করা হয়।
বাচ্চার দল বেরিয়ে গেছে। দূরে পাহাড়ের মাথায় মেঘ আর কুয়াশার লুকোচুরি চলছে সে সময়। গুড় দেওয়া গরম গরম চা চলে এল চারপাইয়ের উপর। ঘটির ঠান্ডা জলে মুখ ধুয়ে সেই এলাচ দেওয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বসন্তের কাছে নিজেকে সঁপে দিলাম। দূর থেকে তখনও বাচ্চাদের কলকল আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
"...ফুল দেই, ছম্মা দেই, দ্যাণী দ্বার, ভরী ভকার
ইয়ে দেলী স বারংবার নমস্কার,পুজে দ্বার বারংবার, নমস্কার..."
বসন্ত এসে গেছে।
এমন সব লেখা আর ছবি এলে কি আর কাজে মন বসে