এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একটি নির্বাসন কথা 

    Mousumi GhoshDas লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ মে ২০২১ | ৯৮২ বার পঠিত
  • একটি নির্বাসন কথা


    #মৌসুমী_ঘোষ_দাস# 


      নদীর এই দিকটাতে কোন লোকালয় নেই। ঘন জংগল, মাঝেমধ্যে দু-একটি ক্ষুদ্র পাতার কুটির রয়েছে । এই নিরালায় নির্জনে এই কুটিরগুলোতে স্বল্পসংখ্যক তপস্বীর  বাস। নদীর এই ঘাটেই একটি নৌকো এসে ভিড়ল। 


      নৌকা থেকে নেমে এলো এক অসামান্যা সুন্দরী নারী আর সুন্দর এক পুরুষ। সম্পর্কে তাঁরা দেবর বৌদি।  দেবরটি অতি সন্তর্পণে এক হাঁটু কর্দম পেরিয়ে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বৌদিকে এনে বসালো ঘাট থেকে সামান্য উঁচুতে অবস্থিত একটি ছায়াশীতল বৃক্ষের নিচে। নিজে দাঁড়িয়ে রইল শুষ্ক, বিষন্ন, বিচলিত মুখে। যেন কিছু একটা বলতে চায়, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারছে না। 


         দেবরের শুষ্ক বিষন্ন মুখ দেখে এবারে মেয়েটি ভারি চিন্তিত হল। সে তাঁর এই দেবরটিকে দীর্ঘ বছর ধরে দেখে আসছে। তাঁর মুখের ভাষা অনায়াসেই পড়তে পারে। যাত্রাপথে একটি কথাও বলেনি, সর্বক্ষণ শুস্ক  চিন্তিত মুখে থেকেছে। কিছু কি লুকোচ্ছে? প্রথমেই  আশংকা হল স্বামীর জন্য! শরীর ভালো আছে তো মানুষটার? 


    এবারে ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেই ফেলল মেয়েটি , “কি ব্যাপার বল তো? সেই তখন থেকে তোমাকে শুকনো বিষন্ন  দেখছি! দীর্ঘ নৌকা যাত্রায় তুমি কি অসুস্থতা অনুভব করছো? 


     নির্বাক নতমুখে দাঁড়িয়ে রইলো  দেবর। 


    মেয়েটি আবারও বলল _” আমাকে কি কিছু লুকোচ্ছো তুমি ? বাড়ির সব খবর ভালো তো? আসবার সময় তোমার দাদা আমাকে বিদায় জানাতে আসে নি। তাঁর কিছু হয় নি তো? ঈশ্বরের দিব্য তুমি আর চুপ থেকো না, আমাকে সত্যি কথা বল”। 


    এতক্ষণ, সংযত রেখেছিল নিজেকে। এবারে ভেঙে পড়লো,     


    বৌদির পাদুটি জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বলল, “ঘৃণ্য কাজের আদেশ হয়েছে আমার ওপর!  কেন যে আপনি এখানে আসার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন বৌদি? দাদার আদেশে আজ থেকে আপনি নির্বাসিত হলেন। আমি আপনাকে এখানে একেবারে রেখে যেতে এসেছি”। 


      কিছুই বুঝতে পারলো না মেয়েটি!  কাল স্বামীর কাছে এখানে একটু ঘুরে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল ঠিকই । কিন্তু তার সাথে নির্বাসনের কি সম্পর্ক? বিস্ফারিত চক্ষে কিছুক্ষণ চেয়ে তারপর অস্ফুটে বলল - নির্বাসিত? কেন বলো তো? আমার অপরাধ?  


    -সমাজের লোকেরা যে আপনার চরিত্রে অপবাদ দিয়েছে। বলেছে পর-পুরুষ আপনার হাত ধরে টেনেছে, তাদের  ঘরে  আটকে রেখেছে। তাই আপনি অপবিত্র হয়ে গেছেন। আপনি তো জানেন, দাদা সমাজের মাথা! তিনি যা করেন, সেটাই সমাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। তিনি যদি অপবিত্র স্ত্রী নিয়ে ঘর করেন, তবে অন্যেরাও কলঙ্কিত স্ত্রী নিয়ে ঘর করবে! তখন সমাজটা যে উচ্ছন্নে যাবে! তাই তিনি আপনাকে পরিত্যাগ করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। 


    এই আকস্মিক সর্বনাশে মেয়েটি নির্বাক প্রস্তর মূর্তি হয়ে গেল!   


    দেবরটি বলে যেতেই থাকল, আমরা অন্য ভাইয়েরা দাদার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে কিছুতেই প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তিনি তো কোনোদিনই আমাদের মতামত গ্রাহ্য করেন না। কিছু নিচমনা মানুষের কুটিল সন্দেহকেই তিনি অধিক গুরুত্ব দিলেন।  হায়! একে আপনি সন্তানসম্ভবা, তার মধ্যে আমাদের মাও এই সময় বাড়িতে নেই, ঠিক এমনি একটি সময় বেছে নিলেন দাদা আপনাকে পরিত্যাগ করার জন্য!!  


    এবারে ধীরেধীরে মেয়েটি বলল, তিনি তো আমাকে নির্বাসন দিয়েছেন! আমার গর্ভস্থ সন্তানের কি হবে? নাকি সেও বঞ্চিত হবে বাপ-ঠাকুরদার অর্জিত সম্পদ থেকে? 


    কোন উত্তর না দিয়ে মাথানত করে রইলো দেবর।


    মেয়েটি আবারও বলল, তিনি কি কোন নির্দেশ দেননি এই অরন্যে আমার গ্রাসাচ্ছাদন হবে কি করে? সন্তানের যখন মাতৃদুগ্ধে পেট ভরবে না, তখন তাঁরই বা পেট ভরবে কি করে? আমাকে স্পষ্ট করে বল তো আমার এই নির্বাসন কতদিনের জন্য? 


    ব্যাকুল হয়ে বলল দেবর, সমাজের লোকের মনোরঞ্জনের জন্য তিনি আপনাকে সারাজীবনের মত ত্যাগ করেছেন- আপনি এখনো বুঝতে পারছেন না? আপনার এবং সন্তানের সারাজীবনের ভরণপোষণের কোন দায়িত্বই তিনি আর নেবেন না বলেছেন ।  


      স্তম্ভিত হয়ে গেল মেয়েটি। বাহ! যাকে অগ্নিসাক্ষী রেখে একদিন বিয়ে করেছিল, সমাজের লোকের  সামনেই যার সারাজীবনের ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বীকার করেছিল! যার গর্ভে তাঁরই ঔরসজাত সন্তান আছে, সেই গর্ভবতী স্ত্রীকে এমন অসহায় অবস্থায় জংগলে নির্বাসন! এ আবার কোন বিচিত্র ধর্ম? 


     এক রাত্তিরেই এতোটা বদলে যেতে পারে একটা মানুষ!! বিগত এতগুলো বছর যে মানুষটার সাথে সুখে দুঃখে পাশে থেকেছি, সেই মানুষ আসবার আগে একটি বারের জন্যও বুঝতে দিল না তাঁর বদলে যাওয়া মনের ভাব! এত নিপুন ছলনা !  


    মেয়েটি চোখ মুছে দৃঢ় কন্ঠে বলল, বেশ! আমাকে যখন একেবারেই ত্যাগ করেছে, তবে শোনো, তোমাদের  ধর্মনিষ্ঠ,  সমাজের মাথাকে অবশ্যই এই প্রশ্নটা কর , "আজ তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, এবারে অন্যরাও যদি ছলছুতোয় তাঁদের স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করে- তখন তাঁর সমাজ উচ্ছন্নে যাবে না"? 


    "তাঁকে  বল, এই আকস্মিক ছলনায়, আঘাতে যতই ভেঙে পড়ি না কেন, আত্মহত্যা আমি করবো না। সন্তানের জন্ম দেবো, তাকে মানুষও করবো একা। শত কষ্টেও যে মা সন্তানের দায়িত্ব ত্যাগ করে না। সেই মা যুগে যুগে সমাজে শ্রেষ্ঠ, শ্রদ্ধেয় হয়ে থাকবে । 


    আর বোলো, তোমাদের ন্যায়ের অবতারকে কেবল সমাজের চোখে মহান সাজাটাই যার ধর্ম, অথচ বিবাহিত স্ত্রী, ঔরসজাত সন্তানের দায়িত্ব নেওয়া -যার ধর্মের আওতায় পরে না- সেই মানুষ যুগযুগ ধরে নিন্দিত ধিকৃত হবেন তারই সমাজের কাছে । অবশ্যই বলো"।    


    -----------------------------------+++++++++++++------------------------------


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sch | 115.187.62.34 | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:৩৬503904
  • স্বামীর নাম কি রাম ছাগল ছিল?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন