এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মাতৃভাষা দিবসে দু চার কথা 

    Bagchi P লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ | ৮৫৮ বার পঠিত
  • আজকে যাকে আমরা সচরাচর ভাষা দিবস বলে অভিহিত করি আসলে তার নাম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ---- ১৯৯৯ সালে ইউনাইটেড নেশন এই দিনটাকে এই নামে চিহ্নিত করেছেন। এখানে একটু বলে নেওয়া দরকার, ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা সাধারণত বাংলা দেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকেই বুঝি। কিন্তু ভাষা নিয়ে আরো আন্দোলন হয়েছে আমাদের দেশেই। আসামের বরাক উপত্যকায় আসামিয়া কে সরকারি ভাষা হিসেবে চালু করার বিরুদ্ধে বাংলা ভাষীদের আন্দোলন হয়েছে। ১৯৬১ সালের ১৯মে সেখানে পুলিশের গুলিতে ১১জন শহিদ হন। ত্রিপুরায় সেখানকার ভূমিপুত্রদের মাতৃভাষা ককবরক কে স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৭৫ সালে ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ধনঞ্জয় ত্রিপুরা নামের এক ত্রিপুরার নাগরিক। পুরুলিয়া জেলাকে বিহারের মানভূম জেলা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ফিরিয়ে আনার দাবিতে সেখানকার অধিবাসীরা ১৯৪৮-১৯৫৩ দীর্ঘ আট বছর লড়াই করেন, বৈদ্যনাথ ভৌমিকের অনশনের কথা আমরা অনেকেই জানি এবং তাদের দাবি মেনে নিয়ে পুরুলিয়া জেলা আবার বাংলায় ফেরত আসে। পরে আবার বাংলা বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে সারা বাংলা জুড়ে আন্দোলন হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। গণ আন্দোলনের চাপে বাংলার বিধানসভায় সেই সংযুক্তির দাবি পেশ করাই যায়নি। এগুলো সবই আজ ইতিহাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এই ইতিহাস আজ আমরা ফিরে দেখব কেন?

    একটা বিষয় সবাইকে খেয়াল করে দেখতে বলি, এই যে রাজ্যে রাজ্যে বা আমাদের প্রতিবেশী দেশে ভাষা নিয়ে আন্দোলন হল, এতজন মানুষ শহিদ হলেন এরা কেউই কিন্তু কোনো বস্তুগত দাবিতে পথে নামেননি। ভাষা নিয়ে আন্দোলন করে কারোর মাইনে বাড়ে না, কারোর এলাকায় রেলপথ বা সড়ক তৈরি হয় না, অথবা স্থানীয় কোনো স্কুল বা হাসপাতাল পরিষেবা চালু হয় এমন নয়। তবু মানুষ তার নিজের ভাষা নিয়ে লড়াই করে, নিজের ভাষা বলতে চেয়ে পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ায়। এর একটাই কারণ ভাষা শুধু আমাদের আবেগ নয়, ভাষা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরেকটা জরুরি বিষয় যা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা দিয়ে যায় তা হল, ধর্ম পরিচয় নয় একটা দেশের বা রাজ্যের মানুষের প্রকৃত পরিচয় নির্ধারিত হয় তার ভাষা পরিচয় দিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই দেখুন, দেশভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে --- পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান --- দুটো দেশের ধর্মগত ভিত্তি ছিল একই। কিন্তু যে মুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দুই পাকিস্তানের জন্যই উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা করল, বিক্ষোভ সৃষ্টি হল পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানকার মানুষ মনে করতে শুরু করলেন তাদের মুখের ভাষা বাংলার অপমান হচ্ছে। কার্যত, তাদের এই ক্ষোভ ধূমায়িত হয়েছিল আরো আগেই। ১৯৪৮ সালে সদ্য গড়ে ওঠা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিন্না সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি সভায় উর্দুতে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করা মাত্র ছাত্রদের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়, পরিণামে প্রেসিডেন্ট জিন্না সভা ছেড়ে চলে যান, তার জীবৎকালে তিনি আর কখনো ঢাকায় যাননি। অর্থাৎ ধর্ম পরিচয়ে এক হওয়া সত্ত্বেও ভাষার পরিচয়ই প্রধান হয়ে দেখা দিতে দেখলাম আমরা। আমাদের দেশে দক্ষিণের রাজ্যগুলি, যা স্বাধীনতার আগে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির মধ্যে ছিল, পরবর্তীকালে সবই প্রায় ভাষার ভিত্তিতে গঠিত, তারাও তাদের ভাষার পরিচয় কেই প্রধান করে দেখেছেন। যদি আমরা নৃ তত্বের দিক দিয়ে ভাবি তাহলেও হয়তো এই কথা বলা ভুল নয় যে মানুষ আগে তার ভাষায় যোগাযোগ করতে শিখেছে, ধর্মের ভাবনা এসেছে তার পরে।

    ভাষা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা আরো একটা ভুল করে ফেলি এবং কিছুটা ভুল করতে আমাদের প্ররোচিত করা হয় যে অমুক ভাষা শক্তিশালী, তমুক ভাষা তত জোরালো নয় ---- এইসব আর কি। ভাষাতত্ত্ব নিয়ে সামান্য কিছু পড়াশোনা করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। নিজের মাতৃভাষা প্রত্যেকের কাছে একটা আত্মপরিচয় । আর ভাষা শক্তিশালী বা দুর্বল এমন মাপার আদৌ কোনো তুলাদণ্ড নেই। হ্যাঁ, ভাষা পুরোনো বা সমৃদ্ধ এই বিচার করা চলে। তার মধ্যেও আবার একটা প্রচারের বিষয় থাকে। একটা উদাহরণ দিই। সংস্কৃত ভাষাকে প্রাচীন ভাষা বলে একটা প্রচার আছে, কিন্তু ভারতে তামিলও কিন্তু অত্যন্ত প্রাচীন একটা ভাষা, তার সাহিত্য সম্ভার ঈর্ষা করার মতো --- সেটা কিন্তু সেইভাবে শোনা যায় না । একইভাবে সংস্কৃত ভাষা থেকে ভারতের সব ভাষা সৃষ্টি হয়েছে এরকম একটা ভুল প্রচারও কোনো কোনো মহল থেকে করা হয়, এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভাষাচার্‍্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এটিকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করেছেন। আবার বাংলার মতো উর্দুও কিন্তু খুব সমৃদ্ধ একটা ভাষা ---- এদের মধ্যে কে উচু কে নিচু এই হিসেব করাটাই বাতুলতা। আমাদের দেশে এই ব্যাপারে একটা বিপজ্জনক কথা প্রচার করা হয়, রাজ্যের ভাষাগুলিকে বলা হয় আঞ্চলিক ভাষা বা রিজিওনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ---- এই প্রচারের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ জানাই। দুনিয়ার কোনো ভাষা আঞ্চলিক হতে পারে না, প্রতিটি ভাষার সমান অধিকার থাকা উচিত, এই বিষয়ে আমাদের সকলের দাবি জানানো উচিত বলে আমি মনে করি। মাতৃভাষা নিয়ে যে আন্দোলনগুলির কথা এর আগে বললাম তার মূলে কিন্তু রয়েছে এইভাবে একটা ভাষার ওপর অন্য ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার আপত্তিকর চেষ্টা । আমাদের দেশেও কিন্তু হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা বলে দাবি করে সেটাকে সরকারিভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। আদৌ আমাদের সংবিধানে কোনো ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা বলে স্বীকার করা হয়নি--- তার অষ্টম শিডিউলে ২২টি ভারতীয় ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এই ২২টি ভাষায় ইচ্ছে করলে লোকসভা বা রাজ্যসভায় সাংসদরা বক্তৃতা দিতে পারেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার স্বাধীনতার পর থেকেই তাদের প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে হিন্দি কে সারা ভারতে তাদের ভাষা বলে চালু করার চেষ্টা করেছে। আমাদের মনে পড়তে পারে, এটা নিয়ে একসময় দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে হিন্দি বিরোধী জোরালো আন্দোলন হয়েছিল । ইদানিং হিন্দি নিয়ে কেন্দ্রের সরকারের বাড়াবাড়ি অত্যন্ত আপত্তিকর জায়গায় পৌঁছেছে বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি । রেল স্টেশনের নাম, ডাকঘর বা ব্যাঙ্কের কাজেকর্মে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ভাবে হিন্দি ভাষাকে চালিয়ে দেওয়া চেষ্টা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের যেসব সরকারি চিঠিপত্র বা আদেশনামা প্রকাশ হচ্ছে তাতেও হিন্দির আধিক্য। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে নজিরবিহীন ভাবে হিন্দি ভাষায় অনুষ্ঠান পরিচালনা করা হল এবং উপাচার্য স্বয়ং হিন্দি ভাষায় ভাষণ দিলেন – এই ঘটনা নিন্দার।

    এখানে এটাও বলতে চাই, ভাষা হিসেবে হিন্দির সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই, সন্দেহ নেই হিন্দি ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যভাষা। কিন্তু খেয়াল করলে বা একটু খোঁজ নিলে আপনারা দেখবেন, আজ যেটাকে সরকারিভাবে হিন্দি ভাষা বলে ব্যবহার করা হচ্ছে তার সঙ্গে সাহিত্যিক হিন্দির তফাত আছে। আরো জরুরি হল, প্রত্যেক ভাষারই কিছু আঞ্চলিক উপভাষা থাকে এবং কিছু কিছু আঞ্চলিক রূপভেদ থাকে ---- হিন্দির ক্ষেত্রে ওইসব আঞ্চলিক বিভিন্নতাগুলো অস্বীকার করে ও সেইসব ভাষার বাসিন্দাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে নতুন এক সরকারি হিন্দির প্রচলন করা হয়েছে ---- একজন ভাষাপ্রেমী হিসেবে এই ঘটনা আমায় বিচলিত করে।

    এখন কথা হচ্ছে, আজকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার উদযাপনের মুহূর্তে আমরা কী নিয়ে ভাবব, কতদূর পর্যন্ত ভাবব। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা আর আমি নিজেকে সেই ভাষার একজন কর্মী বলে মনে করি আর সেই কারণেই বলব, বাংলা ভাষা আজকে যে চরম একটা সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাতে আমি নিজেকে বিপন্ন মনে করছি। কেমন সে বিপদ ? এই প্রসঙ্গে বলতে গেলে খেয়াল রাখতে হবে একটা ভাষা আসলে বেঁচে থাকে তার ব্যবহারকারীদের মধ্যে, তার সাহিত্যের মধ্যে, তার চর্চার মধ্যে। আর একটা কথাও বলি, ভাষার বিকাশের সঙ্গে আর্থ সামাজিক ও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সম্বন্ধ থাকে। আপনারা খেয়াল করে দেখুন, একটা সময় বাংলাদেশে যখন মুসলিম শাসন ছিল না তখন বাংলা ভাষার যে চেহারা ছিল, ইসলামি শাসনের আরম্ভ হওয়ার পর তার চেহারা কিন্তু পালটে যায়। শাসকের ভাষা হিসেবে আরবি ফারসির কার্যকারিতা বেড়ে যেতে থাকে, ওই ভাষা হয়ে ওঠে সরকারি কাজকর্মের ভাষা তাই মানুষ ওই ভাষা শিখতে আগ্রহী হয়। পাশাপাশি বাংলার মধ্যেও প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ এসে পড়ে। যদিও আমরা জানি মধ্যযুগের সুলতান হুসেন শাহ বাংলা ভাষার যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ---- তার উদ্যোগেই মহাভারতের উপাখ্যান বাংলায় অনুদিত হয় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দির কলমে, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল তার আমলেই লিখিত । ঠিক একইভাবে ইউরোপীয়দের আগমনের পর পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরিজি শব্দ নিয়ে বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। আলমারি শব্দটা যে আসলে পর্তুগিজ শব্দ আজ কি আমরা সেটা মনে রাখি, এর পাশে পাশে স্কুল কলেজ চেয়ার টেবিল এসব তো আছেই। তার মানে হল শাসকের ভাষা সব সময়ই প্রাধান্য পায়। সেই হিসেবে দুশো বছরের উপনিবেশিক শাসনের ফল হিসেবে ইংরিজি ভাষা যে প্রাধান্য পাবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাছাড়া আমরা উনিশ শতকের নব জাগরণের মধ্যে দিয়ে যে জ্ঞান বিজ্ঞানের আলো পেয়েছি তা তো ইংরিজির হাত ধরেই। কিন্তু খেয়াল করতে হবে, ওই একই সময় কিন্তু বাংলা ভাষা ধীরে ধীরে সম্পন্ন হয়ে উঠেছে নানা মনীষী দের হাতে। আদপে বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ওই সময়েই যার মূলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন এবং সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ। এঁরা সকলেই কেউই ইংরিজির গুরুত্ব অস্বীকার করেননি কিন্তু আমাদের ভাষা হিসেবে বাংলার প্রতিও আমাদের যে দায় তা তাঁরা তাদের কাজে ও লেখায় বারেবারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমরা সকলেই জানি, সেক্সপিয়ারের “কমেডি ওফ এরর” বিদ্যাসাগর মশাই সুন্দর করে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথও কিছু কিছু ইউরোপীয় কবির লেখা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু তাদের ফোকাস ছিল বাংলা ভাষার ওপর, এই মায়ের ভাষাটাকে উপেক্ষা করে ইংরিজি ভাষাকে মাথায় করে রাখতে হবে এমন চিন্তা কারোর ছিল না। আপনাদের মনে থাকতে পারে ‘নাটোরে কংগ্রেসের সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথের জেদে এবং জবরদস্তিতে ডব্ল্যু সি ব্যানার্জি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিতে বাধ্য হন। ... কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম সমাবর্তন ভাষণ দেন রবীন্দ্রনাথ’ । এ কারণে তাঁকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। তা হলেও, তিনি যে এ কাজে সফল হয়েছিলেন, আর শেষ পর্যন্ত বাংলায় বক্তৃতা করার রীতি যে প্রচলিত হয়েছিল, তার কারণ, এ ছিল যুগের দাবি। নিজের শিক্ষালাভ প্রসঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘আমি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষার পথ দিয়েই শিখেছিলেম ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, কিছু-পরিমাণ প্রাকৃত বিজ্ঞান, আর সেই ব্যাকরণ যার অনুশাসনে বাংলাভাষা সংস্কৃতভাষার আভিজাত্যের অনুকরণে আপন সাধু ভাষার কৌলীন্য ঘোষণা করত’। এর প্রভাবে কি না জানি না, অনেকটা পরিণত বয়সে তিনি ‘বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ’ প্রকাশ করার কথা ভাববেন যেখানে বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা কে সহজ বাংলার পরিবেশন করার ব্যবস্থা হবে। এই বিষয়ে আচার্য যদুনাথ সরকার কিছুটা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন বলে শোনা যায়।

    তার মানে ইংরিজির সঙ্গে বিরোধ করে নয় বা বাংলার বিরুদ্ধে ইংরিজিকে লড়িয়ে দিয়ে নয় আমাদের ভাষাকে তার উপযুক্ত মূল্যেই আমাদের সম্মান দেখাতে হবে। এক সময় আমাদের রাজ্যে মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ স্লোগান তুলে ইংরিজি ভাষার একটা কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল, বলা বাহুল্য এই প্রয়াস আমি সমর্থন করি না । ইংরিজি ও বাংলা যে যেটাই শিখুক তা ভাল করে শিখুক, কোনো ধর্ম যেমন ভিন্ন কোনো ধর্মকে হিংসা করতে শেখায় না, কোনো ভাষাও অন্য ভাষাকে হেয় করার শিক্ষা দেয় বলে আমি মনে করি না। এখন যে কোনো ভাষায় তার চর্চা মূলত করেন সেই সমাজের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি যারা স্কুলে কলেজে পড়ান, সরকারি বা ব্যাঙ্ক বীমা বা সওদাগরি অফিসে কাজ করেন। বাংলা ভাষার মূল সঙ্কট হল, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি আসলে এই ভাষাটা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন বেশ কয়েক দশক হল, তাঁরা আর মনে করেন না যে বাংলাটা আর কেজো ভাষা তার থেকে ঢের ভালো নাকি ইংরিজি কারন ওটা শিখলে চাকরি বাকরি পাওয়া যায়, করে কম্মে খাওয়া যায় ---- তাহলে তাঁরা কেন বাংলা শিখবেন। ঠিক এই মুহূর্তে শহর কলকাতা তো বটেই জেলা সদর বা মফস্বলের প্রচুর সরকার পোষিত বাংলা মাধ্যম স্কুল পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে বা উঠে যাওয়ার অতিক্রম হয়েছে। অবস্থা এতটাই সঙ্গিন যে বাধ্য হয়ে সরকার তাদের অধীন স্কুলে ইংরিজি মাধ্যম শাখা খুলছেন। যে বইমেলা নিয়ে আমাদের এত আহ্লাদ সেই বিষয়ে তথ্য খুজে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় বাংলা বইয়ের থেকে অনেক বেশি বিক্রি হয় ইংরিজি বই। বাংলা প্রকাশকরা কোনো লেখকের বই পাচশো কপির বেশি ছাপেন না, খুব নামী জনপ্রিয় লেখক হলে সেটা বড়জোর দেড় হাজার হয় অথচ আমাদের রাজ্যে দশ কোটি বাংলাভাষী মানুষ বাস করে, সাক্ষরতার হার খুব খারাপ নয়। বাংলা সিনেমা বেশির ভাগ ফিল্ম ফেস্টিভালে পুরস্কার পেলে তবেই লাভের মুখ দেখে, নয়তো আজকে উপগ্রহ সত্ত্ব বিক্রি করে বিনিয়োগ ফেরত পায়। রাজ্যের কটি সিনেমা হলে বাংলা ছবি দেখানো হয় সেই পরিসংখ্যান একবার ঘেঁটে দেখুন। বাংলা গান শোনেন কজনা? সার্বিকভাবে বাংলা ভাষা তাই আজ গভীর সংকটের মুখে। কেউ কেউ বলতে পারেন, নব্বই

    দশকে বিশ্বায়নের পর ইংরিজি ভাষার কদর সারা বিশ্বেই বেড়ে গেছে, কথাটা ভুল নয়। কিন্তু সেই প্রয়োজন চাকরি বা কাজের জগতের সঙ্গে যুক্ত, কারণ মূলত কম্পিউটার প্রযুক্তি ইংরিজি ভাষা নির্ভর। তা বলে বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে এই যুক্তি সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। বিশ্বায়নের প্রভাবে ভাষাগত অস্তিত্ব কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিপন্ন হতে পারে তবে যদি ভাষা ব্যবহারকারীরা নিজেদের অবস্থানে, নিজেদের ভালবাসার জায়গাটায় স্থির থাকে তবে তা হওয়ার নয়। আমাদের পক্ষে আক্ষেপের কথা আমরা বাংলা ভাষাটাকে ভাল বাসতেই ভুলে গেছি, সেই ভাষাতেই যে আমাদের জন্ম আমাদের প্রথম কথা বলতে শেখা এই আবেগ ক্রমশ শিথিল থেকে শিথিলতর। এই খানে এসে ভয় করে। কারণ আমরা যারা এই ভাষাটা নিয়ে চর্চা করি তাঁরা ক্রমশ স্বজন হারা হতে চলেছি। ইংরিজি শেখা দোষের নয় কিন্তু তার জন্য বাংলাটা ভুলে যাওয়াটা বা ত্যাগ করে যাওয়াটা বেদনার। তার ওপরে হিন্দি ভাষার ব্যাপক আগ্রাসন বাংলাকে আরো কোণঠাসা করে দিচ্ছে, বদলে যাচ্ছে বাঙ্গালির মুখের ভাষা অনুভূতি প্রকাশের রকম। কেবলই ভয় করে আমাদের।

    তাহলে কি ভরসা নেই কোথাও? হ্যাঁ তাও আছে। এই বাংলার গ্রাম মফস্বলের সাধারণ মানুষ এখনো বাংলা ভাষাতেই কথা বলে, সেই এখনো তাদের প্রাণের ভাষা। সেই ভাষাতেই লোক সঙ্গীত বাউল গীতি রচিত হয় আজো, বাংলার মাঝি আজো ভাটিয়ালি গায়, আমাদের মতো একটা সংখ্যালঘু মানুষ এখনো মন দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনি। আর একটা ভরসা হল ওপার বাংলা। যারা বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল তাঁরা আজো প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন সেই ভাষাটাকে। সারা পৃথিবীতে আজ পচিশ কোটি বাংলাভাষী ---- ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে সবথেকে সুমধুর ভাষা আখ্যা দিয়ে আমাদের বুকটাকে চওড়া করে দিয়েছে। ওপার বাংলার বাঙালিরা বাংলা ভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ করছেন। তাঁরা বাংলা সফটওয়ার তৈরি করেছেন বলে আমরা তাতে লিখতে পারি, আজ মাইক্রোসফট তার উইন্ডোজ এর বাংলা সংস্করণের কথা ভাবছেন, গুগল সার্চ ইঞ্জিন বাংলা ভাষাতেও আমাদের সব খুঁজে দিচ্ছে অনায়াসে। না আমরা এপারের বাঙালিরা এসবের জন্য কিচ্ছু করিনি। সবটা করেছেন ওপারের ভাইরা। তাই আজকের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের আত্মস মালোচনার দিন, আমাদের ফিরে ফিরে নিজেদের দিকে তাকানোর দিন আয়নার সামনে তাকানোর দিন। এই বাংলা থেকে কি বাংলা ভাষা লুপ্ত হয়ে যাবে অচিরেই? এই প্রশ্নে টানটান হয়ে সচেতনতা তৈরির এক উপলক্ষ। আসুন আজ আমরা শপথ নিই বাংলা ভাষাকে তার হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার, বাংলা ভাষাকে নতুন চুম্বনে জড়িয়ে ধরি বাংলা ভাষায় ভাবি কথা বলি ভালবাসি প্রতিবাদ করি গান গাই কবিতা বলি স্বপ্ন দেখি বাংলা ভাষাকে রুখে দিই ভাষা সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। সবার ওপর বাংলা বর্ষিত হোক। জয় বাংলা ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • প্রতনু সাহা। | 2402:3a80:196b:8e62:398c:6b8e:e95:b664 | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৫:৩২102973
  • সময়োপযোগী,  সুপাঠ্য। 

  • বাইরে দূরে | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৪:২৮103018
  • সহমত । এটুকু বলতে পারি ঢাকা গেলে মনে হয় বাঙ্গালীর রাজধানীতে এসেছি। বাংলায় কথা বলা যায় সবার সঙ্গে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন