নির্মল করো, মঙ্গল করো, মলিন মর্ম বাজেটে
দিনের শেষে সরল প্রশ্ন, আমজনতা কী পেল? তবে, এই প্রশ্ন করার আগে, আমজনতার কাছে প্রশ্ন রাখতে হবে, সরকারের কাছে আসলে কী চায় তারা? সেই প্রত্যাশা কি বাজেট পেশ করে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পূরণ করতে পারলেন?
গত এক বছর ধরে করোনা শিখিয়েছে, বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে কীভাবে যুঝে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয় আমজনতাকে। তার জন্য আলাদা কোনও চিত্রনাট্যের প্রয়োজন হয় না। লকডাউন পরবর্তী সময়ে কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে গিয়ে হেরে গিয়েছেন, আত্মবিশ্বাস খুইয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যার ইয়ত্তা নেই। ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটে পায়ের চেটো ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন তাঁরা। সাহায্য বলতে সরকারি চাল-ডাল। কিন্তু তাদের হাতে টাকা কই, কাজ কই? আজ কি নির্মলা সীতারামন তাদের জন্য কাজের ঠিকানা দিতে পারলেন?
অর্থাৎ আমজনতা কাজ খুঁজছে। হাতে নগদ টাকা চাইছে যাতে আবার নতুন করে জীবন শুরু করা যায়। নির্মলা যে বাজেট তুলে ধরলেন, তাতে সরাসরি কর্মসংস্থানের দিশা নেই। আছে আশা। রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাঙ্ক ও সংস্থা বেচে আগে নিজের ঘর গোছানোর চিন্তা করেছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, যথেষ্ট বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নির্মলার। কারণ, রাজকোষ ঘাটতি প্রায় ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনার কামড়ে আরও প্রশস্ত হয়েছে সেই ঘাটতি। উৎপাদন নেই। কর থেকে আয় কমেছে। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের জিনিস বেচে যদি কিছু অর্থ জোগান করা যায়, তাতে ক্ষতি কী? তবে, প্রশ্ন ক্ষতির নয়, প্রশ্ন সংশয়ের। এমন ভাবে কত দিন নিজের ঘরের জিনিস বেচে সংসার চালাবে সরকার?
এ বার সরকার জনমোহনী বাজেট করার পথে হাঁটেনি। পরিকাঠামোয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। সড়ক সংস্করণে প্রচুর মানুষের কাজ মিলবে এমন কথাও বলেছেন নির্মলা। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি প্রকল্পে কি আদৌ এই মুহূর্তে আশু সমাধান হবে আমজনতার। পেটে ক্ষিদে, দরকার ভাত। আর নুন-লেবু-জল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে সরকার। এত দিনে স্পষ্ট, সরকারের হাতে যেমন অর্থ নেই, সাধারণ মানুষেরও একই হাল। এর মাঝে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে এক শতাংশ ধনকুবেরের আয়। কিন্তু তাদের আয়ে কর বসানো হয়নি। শিল্পপতিদের প্রতি সরকারের যে উদাসীনতার অভিযোগ বিরোধীরা বারবার করেন, এই বাজেটে সেই ইঙ্গিতই মিলল। বিমায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা আরও খুলে দেওয়া হয়েছে। এলআইসি-র মতো ভরসাযোগ্য সংস্থার শেয়ার খোলা বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে নির্মলার সিন্দুকে অর্থ আসবে বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের টাকা কতটা নিরাপদ থাকবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট দিশা দেখাতে পারেননি অর্থমন্ত্রী।
এ ছাড়া সরকারের গলায় কাঁটা যাঁরা, সেই কৃষকদের জন্যও তেমন কোনও আশার বাণী শোনাননি নির্মলা। কৃষি ঋণে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। পূর্ব ঘোষিত কিসান সম্মান নিধির প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চাষিদের কল্যাণের জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষি আইন প্রত্যাহারে ইঙ্গিত তো দূর, ভরা শীতে সিংঘু সীমান্তে কৃষকদের বাড়ি ফেরানোর জন্য এমন কোনও চমক ঘোষণা শোনা গেল না নির্মলার মুখে। কৃষকরা হয়তো সংসদের অদূরে বসেই সেই প্রত্যাশা করছিলেন। আর পরিযায়ী শ্রমিকরা? প্রধানমন্ত্রী আগেই বলে দিয়েছেন, এর আগে চারটে 'মিনি বাজেট' ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। নির্মলার এই বাজেটে এক ধরনের 'মিনি বাজেট'। তাই 'ধার চাহিয়া লজ্জা দিবেন না'-র মতো পরিযায়ী শ্রমিকদের কিছু আশা করাই অন্যায়। গিরিখাতে আটকে জিডিপি, আর নির্মলার বাজেটে ঘুমিয়ে কর্মসংস্থান। দুটোই কবে উঠবে বলা কঠিন।