পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
নব বৎসরে করিলাম পণ, করিয়াছি পণ, নেবো না পণ। এই হোক দিনের বাণী। একুশ সালের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সেই একুশ অবশেষে ধরা দিল। দুনিয়া করোনা মুক্ত হয়েছে বলা যাবেনা। তবে উৎকন্ঠা এই মুহূর্তে অনেকটাই কম। বহু সহ নাগরিককে আমরা গত এক বছরে হারিয়েছি। তারা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। বহু মানুষের কাজ গিয়েছে। পরিযায়ী মানুষ আজও ছন্নছাড়া, না আছে চাল, না চুলো। সরকারের সাহায্য এসেছে। কিন্ত তা পেতে দাদা ধরতে হবে। সেই দাদা খালি হাতে হাত উপুড় করবেন না। তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। নগদ কুড়ি হাজার টাকা বুঝিয়া পাইলাম। প্রাপ্তি রসিদে স্বাক্ষর হল। কপালে জুটলো পনের। পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। কোন অপরাধে? পণ প্রথা নাকি উঠে গিয়েছে। এটাই কি তাহলে কাট মানি? একুশের ডাক, কাটমানি নিপাত যাক। আজকাল খালি হাতে নাকি কিছুই পাওয়া যায় না। ভিখারীর ভেক লাগে। রাস্তায় খুঁটি পুঁতে মাদারির খেলা। বেশ উত্তেজনা। কচি বাচ্চা বাঁশ বেয়ে টঙে উঠে যাচ্ছে। জোরসে হাততালি, টপাটপ পয়সা। এসবের তবু মানে আছে। খেটে কসরৎ দেখিয়ে পয়সা রোজগার করো। কিন্ত লোকের কাছে কোনো কৈফিয়ত না দিয়ে পয়সা কেড়ে নেওয়া, আসলে সেও তো এক ধরনের ছিনতাই। আর নয় ।এই মুহূর্তে আসুন আমরা নতুন বছরের প্রথম দিন সিদ্ধান্ত নিই, জনসেবা মানে জনসেবা - ই। মাঝখানে কোনো দেওয়া নেওয়া নেই। জীবে প্রেম করে যেই জন,সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। সত্যিই কি তাই সম্ভব ?
পাথর প্রতিমা । ভারি সুন্দর নাম। এখান কার মানুষ জন খুবই সরল সোজা। কৃষি প্রধান অঞ্চল। চাষবাস ছাড়াও মাছ ধরার কাজে অনেক মানুষ জড়িত। জনমজুরের কাজে কিছু মানুষজন এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেন। জেলা শহরের দিকে কাজের সন্ধানে বাড়ির মেয়েরাও ছোটেন কেউ কেউ। এদেরই একজন কল্যাণী। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। বাবা রঙের মিস্ত্রি। রোজগার সামান্যই। বাড়িতে সব মিলিয়ে সাত জন লোক। কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিলো কল্যাণীর। ফর্ম তুলে ছিল। কিন্তু টাকা পয়সা জোগাড় করতে না পারায় ভর্তি হতে পারেনি।
খেয়া ঘাটের কাছে ছোট একটি চায়ের দোকান। ছোট কিন্ত বেশ কাট্তি। শঙ্কর নামের এক উঠতি বয়সী ছেলে দোকানটি নতুন খুলেছে। বেশ মিশুকে। সবার সঙ্গে হেসে হেসে আগ বাড়িয়ে কথা বলে। কল্যাণী টিউশনি সেরে ফেরার পথে চায়ের খোঁজে শঙ্করের দোকানে একদিন ঢুকে পড়ল। পা জামা, পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন শঙ্কর কে দেখে মুগ্ধ। কল্যাণী চা টোস্ট সঙ্গে ওমলেটের অর্ডার দিল কাউন্টারের সামনে এগিয়ে গিয়ে। দৃষ্টি বিনিময় হলো। হাসি হাসি মুখ করে শঙ্কর জানতে চাইলো –“পাথর প্রতিমার স্কুলে পড়তেন না? ওই স্কুলের সামনে ই আমাদের বাড়ি। আপনাকে আগেও দেখেছি অনেকবার। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে একবার উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছেন। মনে আছে।“ চায়ের সঙ্গে মুখোরোচক টিফিন টেবিলে নিজের হাতে পৌঁছে দিল শঙ্কর। কল্যাণী খানিক হাসল। তাতেই শঙ্কর গলে জল। কল্যাণীর বেশ খিদে পেয়ে ছিল। কিন্তু খাবে কি? একেই বোধহয় বলে, লাভ এট ফার্স্ট সাইট। শঙ্কর গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে কল্যাণীর উদ্দেশে বলল
- “ আবার যেন দোকানে পায়ের ধুলো পড়ে। “
- “ চেষ্টা করব, ধন্যবাদ”।
কল্যাণী হেসে বিদায় নিল। এইভাবে আলাপ এবং প্রেমের সূচনা। শঙ্কর কল্যাণীর জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। টিউশনি ফেরৎ কল্যাণীও চায়ের নেশা অগ্রাহ্য করতে না পেরে দোকানে একবার ঢু মারবেই। শুধু চা খেলে শঙ্কর হেসে বলতো – “থাক, পয়সা দিতে হবেনা” । কল্যাণী অবশ্য সুযোগ নিতো না। একরকম জোর করেই পয়সা হাতে গুজে দিত।
এই ভাবেই দিন কাটছিল বেশ। সরস্বতী পুজো নাকি বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে চিহ্নিত। ওইদিন পুষ্পাঞ্জলি দিতে গিয়েছিল কল্যাণী। সঙ্গে অন্য বন্ধুরাও ছিল। ফেরার পথে শঙ্করের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। শঙ্কর নিজের থেকেই বলল -
“আজ তো পড়ানো নেই। সন্ধেবেলা চলে আসুন দোকানে। কাছেই একটা মেলা বসেছে। ওখান থেকে দোকানের জন্য কয়েকটি বেতের মোড়া কিনব। মেলায় রেশমি চুড়ি পাওয়া যাচ্ছে। আপনার জন্য যদি কিনি, আপত্তি করবেন? তা ছাড়া আপত্তি করলে শুনছে কে ?”
সত্যি সত্যিই শঙ্কর কোনো ওজর আপত্তিতে কান দেয়নি। দু'হাত ভর্তি চুড়ি পরে বাড়ি ফিরল কল্যাণী। সঙ্গে শঙ্কর। প্রথম দিন পরিচয় হলো বাড়িতে যারা ছিলেন, তাদের সবার সঙ্গে। বাবা রঙের মিস্ত্রি। পাড়ায় মোটামুটি সবাই চেনে কার্তিক ঘোড়ই কে। শঙ্কর হাত তুলে নমস্কার করলো। সৌজন্যে সবাই প্রসন্ন।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বিয়ের সানাই বাজলো কল্যাণীদের এক চিলতে বাড়িতে। অদৃষ্ট আড়ালে মুচকি হাসলেন। গন্ডগোলের সূত্রপাত ফুলশয্যার তত্ত্ব পৌঁছানো মাত্র। পছন্দ হয়নি শুধু তাই নয়, অত্যন্ত নিম্নমানের খাদ্য সামগ্রী দেখে বরের বাড়ির লোকেরা চটে লাল। কোনো রকম রাখ ঢাক নেই। হৈ চৈ চেঁচামেচি।
- “দশ হাজার টাকা নিয়ে এলে তবেই মেয়ে জামাই অষ্ট মঙ্গলায় বাপের বাড়ি হাজির হবে।“
ছেলের মা মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন। অগত্যা রাজি।
এখানেই চাহিদা পেশ শেষ নয়। জামাই ষষ্ঠী, পুজোয় বিশাল ফর্দ। না মেটাতে পারলে বিশাল অশান্তি। আমফানের ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেল গোটা এলাকা। নদীর পাড়ে শঙ্করের চা দোকান তছনছ। এখন উপায়? কল্যাণীর বাবার বাড়িতে ডাক পড়ল।
- “দাও টাকা । কমপক্ষে বিশ হাজার।“
লক ডাউনে রঙ মিস্ত্রি দীর্ঘ দিন বাড়িতে বসা। সঞ্চয় ভেঙ্গে সংসার চলছে কোনো রকমে। অক্ষমতা জানাতেই মেয়ের ওপর অত্যাচার শুরু হলো। ফোন কেড়ে নেওয়া হল কল্যাণীর কাছ থেকে একরকম জোর করেই,পাছে বাপের বাড়িতে খবর চলে যায়। শঙ্কর নীরব দর্শক। কল্যাণীর পাশেও বাড়ির কেউ নেই। রঙ মিস্ত্রি বাবাকে অতগুলো টাকা কে ধার দেবে? মেয়ের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ। ফোন থেকেও নেই। মেয়েকেও বাড়ি থেকে বেরোতে দেওয়া হলনা। দমবন্ধ অবস্থা।
প্রথম ভালোবাসা, তার কি করুণ পরিণতি! বছর ঘুরলো না। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় নাম উঠে গেল কল্যাণীর। নির্মমভাবে গৃহবধূ হত্যা। স্বামী সহ তিনজন গ্রেফতার। এক দিন আমরা কল্যাণীর ভালোবাসা এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর পরিণতির কাহিনী সত্যিসত্যিই ভুলে যাবো। আবার কিছু দিনের মধ্যেই হয়তো একই রকম কাহিনী অন্যান্য জায়গায় ঘটবে। সব ঘটনা খবর হয়না। কল্যাণীর মতো সাধারণ ঘরের মেয়েরা কোনো দিনই সুবিচার পায়নি এবং ভবিষ্যতেও পাবে বলে ভরসা দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
একুশের প্রার্থনা - হানাহানি আর নয়। আর কোনো মেয়ে কে যেন কল্যাণীর মতো মানুষের যৌতুকের লালসার শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণ দিতে না হয়!
অন্ধকারে রৌপ্যরেখার মতো এই একুশে ভিন্ন খবরের দিকে নজর যায়। পথ দূর্ঘটনায় একমাত্র ছেলের মৃত্যুর পর পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহের সঙ্গে নিজের সংসারে সংসারে বেঁধে রাখলেন নিখিলেশ বাবু এবং তাঁর স্ত্রী নিলীমা দেবী। পুত্রবধূও ভালোবাসা পেয়ে আপ্লুত। নিজের বাবা মায়ের কাছে ফেরৎ না গিয়ে স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গেলেন। বাকিটা জীবন কিভাবে কাটবে তা ভবিষ্যৎ বলবে! শুধু এইটুকুই স্বান্তনা, বিধবা মায়ের সংসারে ফিরে গিয়ে অন্যের বোঝা হয়ে বাঁচতে হলনা সদ্য স্বামীহারা সুদেষ্না কে।
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে। এক মুরগীর জোর গায়ে নেই, অথচ কি হম্বিতম্বি! হামবড়া ভাব। তরুণদের সামনে কোনো আদর্শ নেই। আজ এ পার্টি তো কাল ও পার্টি। যখন যেমন, তখন তেমন। অভিভাবক নীরব দর্শক। তাছাড়া কিছু বলতে গেলে শুনছে কে? বেশির ভাগ ছেলেই বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কখন বাড়ি থেকে বেরোয়, কখন ফেরে কেউই হিসাব রাখে না। সামনে ভোট। তরুণদের সবাই আপন করে পেতে চাইছেন। আজকাল টাকা ছড়ালে ভোট হয়না। সবার আগে চাই জন সংযোগ। সেই দিকেই সবার নজর। এই শীতেও হাওয়া গরম!
নারী স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন নতুন নয়। প্রকৃত স্বাধীনতা আজও এসেছে কি? এই একুশে দাঁড়িয়ে মহিলারা কি নিজেদের নিরাপদ ভাবেন? নির্যাতন ঘরে এবং বাইরে। গতকাল যেখানে ছিল, আজ ও সেই জায়গায়। পুলিশ প্রশাসন কি করবে? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ময়না তদন্ত। যার গেল, তার গেল। “বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”। আমরা কি আর একটু সহিষ্ণু হতে পারিনা? আপনি আচারি ধর্ম পরেরে শিখাইবে। এ শুধু উপদেশ হয়েই রয়ে গেল!
এই মাত্র কাগজ দিয়ে গেল। নতুন বছরের কাগজের শিরোনাম – “নিউটাউনের হোটেল থেকে যুবতীর মৃত দেহ উদ্ধার। সঙ্গী উধাও। ময়না তদন্তের জন্যে দেহ মর্গে পাঠানো হয়েছে”।
শুভ নববর্ষ। বছরটা সকলের ভালো কাটুক!
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |