এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • উদ্ভট_চিন্তা OR 

    SHRUTISAURABH BANDYOPADHYAY লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ৭৭৯ বার পঠিত
  • প্রতিবার শীতকালে এইচ জি ওয়েলসের লেখা 'ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস্' উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায় আমার। শীত পড়ার আগে থেকে রোদে দিয়ে রাখা কম্বলের গায়ে কেচে রাখা ওয়ার পরানো নিয়েই আর কি! ওয়ার পরাতে পরাতে রীতিমতো ওয়ার‌ই বেধে যাবার জোগাড়। আর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সে কাজ যিনি করতে পারেন তিনিই যে ঐ গরম গরম কম্বলগুলোর ওয়ারিশ হবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিকঠাক করে ওয়ার পরাতে কি না করতে পারে মানুষ! আমি তো ঢুকে যাই ওয়ার আর কম্বলের ভিতরের ফাঁকটায়, ঠিক যেমন ফুসফুসের দুটো স্তরের ফাঁকে জল ঢুকে যায়। তারপর এটার চার কানে ওটার চার কান মিলিয়ে দেবার চেষ্টা করি। এই কানাকানি পর্ব সমাপ্ত করে ঐ ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা আবার আরেক যুদ্ধ! একেবারে চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার মতোই। ফাটা গোড়ালির কার্নিশে লেগে ওয়ার অথবা কম্বল কোণচ্যুত হলেই আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। গোটা জিনিসটা নিজে করলে একরকম, আর যদি আপনার উপর সুপারভাইজার হিসাবে কাউকে জুটিয়ে দেন ভগবান, তাহলে আরেকরকম। বাসের খালাসীর মতোই সে ক্রমাগত আপনাকে ডিরেকশন দিতে থাকবে, হয় নি, হয় নি, আরেকটু ডাইনে, আরেকটু বাঁয়ে চেপে, আস্তে বালিশ!

    যুদ্ধ অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এর পরে সেই ওয়ার পরানো কম্বল গায়ে দিয়ে যখন শোবেন, তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ নিয়ে বিশেষ হিসাব কষে নিতে হবে। নচেৎ মাঝরাতে এরকম হতেই পারে---কম্বল গুটিয়ে গেছে ওয়ারের ভিতরে একপাশে আর গায়ে রয়েছে শুধুই ফিনফিনে সাদা ওয়ারখানা। এরকম হ‌ওয়া উচিত না। বস্তুতঃ তাপগতিবিজ্ঞান বলে, বস্তুর পক্ষে এরকম না হ‌ওয়াই দস্তুর। জিনিসের ধর্ম‌ই হচ্ছে, যদি ছড়াতে চায়, তো ছড়িয়ে লাট করে ফেলবেই, আপনি কিছুতেই আটকাতে পারবেন না! সেক্ষেত্রে না ছড়ানোর সম্ভাবনা এতটাই কম যে কোনো ব্যাপারে ছড়িয়ে ফেললেও আমি খুব বেশি লজ্জিত বোধ করি না। এখানেও ছড়ায়, তবে ওয়ারের ভিতরে কম্বল ছড়ায় না। তখন মনকে এই বলে প্রবোধ দিই যে বস্তুর গণ্ডাখানেক বিভিন্ন অবস্থানের মধ্যে এই গুটিয়ে একপাশে সরে যাওয়া অবস্থানটাও হিসেবের মধ্যে ধরতে হবে বৈকি। চোখের সামনে যত‌ই দেখি---ধূপের ধোঁয়া এককোণ থেকে গোটা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে, কম্বলের রোঁয়াও বাতাসে ভেসে আপনার ছাদ থেকে প্রতিবেশীর ছাদে যেতে পারে, কিন্তু ওয়ারের ভিতরে কম্বলের অবস্থা এর বিপরীত। অন্ততঃ যখন আপনি গায়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। অত‌এব যুদ্ধ চলাকালীন ঘুমিয়ে পড়লেও মনে রাখতে হবে, আপনি যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছেন আর কম্বল এবং তার ওয়ার যেন এক‌ই সমতলে থাকে।

    যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পৃষ্ঠপ্রদর্শন করলে তার যেমন শাস্তি হয়, এই লড়াইয়েও আপনি পাশ ফিরে শুলে, খেয়াল রাখবেন, আপনার পিঠের দিকের কম্বল সরে যাবেই। সেই সরে যাওয়া কম্বল টেনে আনার জন্য সৃষ্টিকর্তার উচিত ছিল পিছনের দিকে আরেকটি হাত, নিদেনপক্ষে শক্তপোক্ত একটা লেজ রেখে দেয়া। সেটা যখন নেই তখন নিজেকেই একটু বেশি বলপ্রয়োগ করে কোমর এবং কনুইতে ট্যুইস্ট খেলিয়ে কম্বলটাকে পিছনের দিকে আছড়ে ফেলতে হয়। আর ঠিক তখনই মনে হয় যে কেন এ জিনিসের নাম কম্বল হল! কম বল লাগে নাকি এ জিনিস এদিক ওদিক করাতে! কম্বল নিয়ে যত‌ই বলি না কেন, সবসময় মনে হয় খুব কম বলা হল।

    এ তো গেল প্রস্থের কথা। দৈর্ঘ্য সামলে নিতে হবে এর অনেক আগেই। অন্ততঃ ঘুমিয়ে পড়ার আগেই। এর আগে কম্বলে ওয়ার পরাতে গিয়ে মাথা যেহেতু গরম হয়ে গেছে, কাজেই এখন কম্বলের পায়ের দিক (অর্থাৎ আপনার পায়ের দিক, কম্বল কি আলাদিনের শতরঞ্চি যে তার পা গজাবে!) থেকে কুলকুল করে ঠাণ্ডা ঢোকা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এ থেকে রেহাই পেতে হলে পায়ের দিকটা ইউটার্ন দিয়ে ভিতরে ভাঁজ করে নিতে হয়। এসব কায়দা কোনো স্কুলে শেখানো না হলেও মানুষ আশ্চর্যরূপে কারো সাহায্য ছাড়াই শিখে যায়, খেয়াল করে দেখবেন। সুতরাং আমাদের বিবর্তনে কম্বলের কি তাৎপর্য্য সেটা বিজ্ঞানীদের আরেকবার গবেষণা করে দেখা উচিত বলে মনে হয়।

    এসব তত্ত্বকথা অবশ্য আমার মনে এমনি এমনি আসে না। অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি কেন আমি এরকম ভাবতে পারি। আমার মতো এরকম নিজের ঘরে নিজের খাটে নিজের কম্বলে নিজে একাই শুতে পারার মতো সৌভাগ্য পৃথিবীর সবাই তো আর অর্জন করেন নি! পৃথিবীতে সবাইকে নিজের নিজের ঘর, নিজের নিজের খাট আর নিজের নিজের কম্বল দেয়া হবে, এমন উদ্ভট প্রতিশ্রুতি কোনো দেশের সরকার কখনো দিয়েছে বলে জানা নেই। সবাইকে নিজের নিজের কম্বল দিলে অবশ্য‌ই সেটা একটা দেখার মতো বিষয় হতো বৈকি। একজায়গায় জড়ো করা থাকতো কোটি কোটি কম্বল। উপরে একটা বোর্ডে লেখা থাকতো 'কম্বল অব দ্য ওয়ার্ল্ডস্'! 'কম বল' বলে লেখা থাকলেও তাই গায়ে দিয়ে, শীতের রাতটায় রাস্তায় শুয়েও, অনেকে বুকে বেশি বল পেত। আরেকজায়গায় জড়ো করা থাকতো সেই সংখ্যক ওয়ার। উপরে সেইভাবে লেখা থাকতো, 'ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস্'! সেসময় টাইম মেশিনে করে এসে পৌঁছতেন এইচ জি ওয়েলস। তিনি বাংলা না বুঝলেও, ব্যবস্থাটা দেখে নিশ্চিত খুব খুশি হতেন। কম্বল বুনে বিক্রি করে সেই পয়সায় কম্বল কিনে গায়ে দিচ্ছে সবাই। কম্বল বিতরণের সময় কেউ অতিরিক্ত কম্বল নিয়ে কালোবাজারির চেষ্টা করলে তাকে সেই অতিরিক্ত কম্বল জড়িয়েই কম্বল-ধোলাই দিচ্ছে সবাই। পাড়ার মোড়ে মোড়ে দেয়ালে লেখা হচ্ছে, এক কম্বল, এক সম্বল। কম্বল গায়ে দিয়েও সকলের গায়ে বেশি বেশি বল হয়েছে। একমাত্র দুর্বল আর সবল থাকলেই শোষণ আর শাসন চলে। বাকি ধর্ম, জাত, লিঙ্গ---এইসব তো কেকের উপর আখরোট, পেস্তা, কিসমিস। সবাই সমান বলবান হলে সবাই সবাইকে সমঝে চলে। তখন সকলের গায়ের ওম মিলে মিশে গোটা বিশ্ব জুড়ে এক উদ্ভট অভূতপূর্ব শান্তি বিরাজ করবে। কেবল খেয়াল রাখতে হবে, নাকটা যেন কম্বলের বাইরে থাকে। ন‌ইলে একে অন্যের ব্যাপারে নাক গলাবেই বা কি করে! নাক না গলাতে পারলে তখন মানুষের জীবন খুবই একঘেয়ে হয়ে উঠতে পারে। এইসব ভাবছি, এমনসময় হঠাৎ খুব শীত করতে লাগল। গা যেন পুরো ভিজে গেছে জলে, এমনটা মনে হল। ধড়মড় করে উঠে দেখি আমার অনুমান এবং অনুভূতি আমাকে ফাঁকি দেয়নি। সত্যিই আমি কম্বলসমেত একটু ভিজে গেছি এবং তার‌ই কারণ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমার সামনে জলের জগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে, 'বলি, বেলা দশটা বাজে, এ বেলা কি আর বাজার-টাজারে যাওয়া হবে না?'
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন