এমনিতে শান্তিনিকেতন বহুবার গেছি। খুব সাধের জায়গা। সাধ্যের ও বটে। মনের মধ্যে বেড়ানোর সাধ প্রচুর থাকলেও সাধের সংকুলান অপ্রতুল। করোনার জন্য সঙ্গত কারণেই এ বছর নয়। আগের বছর ঠিক এই সময়ে গিয়েছিলাম। শান্তিনিকেতন বহুবার গেলেও সোনা ঝুরির হাট টি দেখার সৌভাগ্য কোনোবারই হয়নি। এটা আমার দূর্ভাগ্য। এবার মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম, সোনা ঝু রির জঙ্গলেই রাত্রিযাপন করব। তাই আগে থেকে শকুন্তলা রিসোর্টে একটি ঘর বুক করে রেখেছিলাম। সত্যিই অপূর্ব এক রিসোর্ট, শকুন্তলা। সুচারুরূপে কৃত্রিম গ্রাম্য পরিবেশ সাজিয়ে তোলা। রিসর্টের ভিতরে পুকুরে রাজ হাঁস চরছে। গরুর গাড়ি দাঁড় করানো। মাটির প্রলেপ মাখানো খড়ের চালের কুটির। পোড়া মাটির সাজ সজ্জায় ভরানো রেস্তোরাঁ। তাতে মাটির থালায় খেতে দেওয়া। মেনুও বাঙালিয়ানার ভরপুর। সব মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল। হাওড়া থেকে শান্তিনিকেতন যাওয়াটা আর বর্ণনায় রাখলাম না। কারন তাতে সময় বিলম্বিত হবে।
শন্তিনিকেতন পৌঁছেছিলাম শুক্রবার দুপুর বারোটা নাগাদ। প্রান্তিক স্টেশনে নেমে টো টো তে চড়ে নির্ধারিত শকুন্তলা রিসোর্টে গিয়ে উঠেছিলাম। আগেই বলেছি, সোনা ঝুরি জঙ্গলের মধ্যেই এই রিসোর্ট। ফ্রেশ হয়ে বেলা তিনটে নাগাদ শান্তিনিকেতনের দিকে পা বাড়ালাম। হাট বসবে আগামীকাল অর্থাৎ শনিবার। তাই আজ একটু ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো। বিকেলটা শান্তিনিকেতন আর সন্ধ্যেটা কাটালাম কোপাই নদীর ধারে।
শুক্রবার রাত থেকে শুরু হল রিসোর্টে সাখে ধুনি জ্বালিয়ে বাউলদের গান। এক অভূতপূর্ব উপলব্ধি। শনিবার সকালে শান্তিনিকেতনের ক্যানেল পাড় সংলগ্ন রাস্তা ধরে এগোনোর সময় নজরে এলো, মেয়েরা বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে পণ্যসামগ্রী নিয়ে হাটের দিকে যাচ্ছে।
আক্ষরিক অর্থেই এটি হাট। কোথাও কোনো স্থায়ী ঘর নেই। নেই অস্থায়ী ঘর কিংবা সামিয়ানাও। কেউ ত্রিপল, কেউ চট, কেউবা মাটিতে কাপড় বিছিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। গ্রাম-গঞ্জের বাজারের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই।
খোয়াই বনের মধ্যে বসা হাটটিতে মেলার মতো আমেজ। কিন্তু মেলার সঙ্গেও পুরোপুরি মেলে না। গ্রাম্য মেলাতেও অস্থায়ী ঘর থাকে। ঘর না থাকলেও হয়তো রোদ থেকে রক্ষা পেতে উপরে ডেকোরেটরের সামিয়ানা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে কোনো দোকানের উপর ছাউনি নেই। কারণ, স্থায়ীভাবে এখানে কিছু স্থাপন করার নিয়ম নেই। তপ্ত রোদের মধ্যেই চলছে বেচা-কেনা। বনের মধ্যে হাট হওয়ায় আকাশমণি ও ইউক্যালিপ্টাস গাছ কোথাও কোথাও ছায়া দিচ্ছে। অল্প সংখ্যক দোকানি ট্রাফিক পুলিশের মতো ছাতা গেড়ে বসেছেন।
হাটটি পুরোপুরি ফড়ে (মধ্যসসত্বভোগী) মুক্ত। বিক্রেতারা সবাই প্রান্তিক উৎপাদক। পার্শ্ববর্তী কোপাই, বোলপুর, গোয়ালপাড়া, সিলিকেতুন, পাটুলডাঙা, চুরুল, প্রান্তিক ও ভুবনডাঙা গ্রামের নারী-পুরুষরা তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন দ্রবাদি নিয়ে হাজির হয়েছেন হাটে।
সওদার মধ্যে কাপড়, পুরুষদের পাঞ্জাবি ও সাজগোজের জিনিসের আধিক্য বেশি। তবে নান্দনিক শো-পিস, খেলনা, মনোহারি সামগ্রী ও তৈজসপত্রও রয়েছে। তবে প্রচলিত বাজারের চেয়ে ভিন্ন ঢংয়ের। এখানে অনেক কিছুই পাওয়া যায়, যা আর কোথাও চোখে পড়বে না।
হাটে ক্রেতা রয়েছে তবে গিজগিজ নেই। অধিকাংশই দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন। সূর্য যতো পশ্চিমে ঢলে পড়ে ততোই জমে ওঠে হাট। ঢোকার সময়ই কানে ভেসে আসছিল ঢোল আর মাদলের শব্দ। হাটের একপাশে সাঁওতাল দল মাদলের তালে তালে নাচে মগ্ন। গোল হয়ে নাচ চলছে। মাঝখানে গামছা পাতা, নাচ দেখে যার ভালো লাগছে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন।
পাশাপাশি তিনটি দল অবিরাম নেচে চলেলে। প্রত্যেকটি দলে তিনজন করে ছেলে যারা যন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন, আর নাচিয়ে মেয়ে রয়েছে দশজন করে। দলগুলো বয়স ভেদে ভাগ করা। মাঝের দলটি মাঝবয়সী যাদের প্রত্যেকের বয়স চল্লিশের ওপরে। মেয়েদের মাথায় উপর দু’টি করে কাঁসার ঘটি বসানো।
যেভাবে মাথায় মাটির হাঁড়ি নিয়ে দৌড় খেলা হয়, সেভাবে একটি ঘটির উপর আরেকটি বসানো। উপরের ঘটিতে ফুল ও সতেজ পাতা দেওয়া। দেখে মনে হবে, নাচিয়েদের মাথা ফুঁড়ে ফুল গজিয়েছে। এভাবে ঘটি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকের পক্ষে কঠিন। কিন্তু তারা এগুলো মাথায় করেই বিরামহীনভাবে নেচে চললেন।
পাশের দলটি অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েদের দিয়ে গড়া। দলপতি প্রতিমা মার্ডি পড়েন আলমধা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে। আরতি পড়ে, দরপছিনা উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে। এই দলের সবচেয়ে লম্বা প্রতিমা সবার সমানে, তারপরের মেয়েটি তার চেয়ে ছোট। সবচেয়ে ছোট মল্লিকা পড়ে বনোগ্রাম গান্ধী বিদ্যাপীঠে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তাদের সবার পরনে হলুদ শাড়ি।
এর দশ হাত দূরে আরেকটি খুদে দল। তারা অবশ্য কেউই এখনও ঠিকমতো তাল, লয় ও নাচের মূদ্রা রপ্ত করতে পারেনি। প্রত্যেকের বয়স এগারোর নিচে। যন্ত্রীরাও তাদের সমবয়সী। তারাও মাদলের তালে তালে নাচ ও সাঁওতালি গান গেয়ে চললো, ‘অকয় লাগি মাঞ্জি থান...’।
সোনাঝুরি হাটের খানেক দূরে বেশি কিছু দোকান মূল হাট থেকে দূরে হওয়ায় এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘খোয়াই বনের অন্য হাট’। এখানেও দু’টি সাঁওতালী দল তাদের শৈল্পিক কসরত প্রদর্শনে ব্যস্ত।
উৎসুক ক্রেতা-দর্শনার্থীদের অনেকেই এসব দলের সঙ্গে তাল মেলালেন। চেষ্টা করলেন তাদের পায়ের সঙ্গে পা মেলাতে। অনেকে দাঁড়ালেন স্রেফ সেলফি তোলার জন্য।
রবিঠাকুরের বিশ্বভারতীর অদূরের এই হাটটি প্রতি শনিবার দুপুরের পর বসে, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। শনিবার বসে বলে হাটটির চলতি নাম, শনিবারের হাট। তবে সাঁওতালী নাচ চলে বিকেল পর্যন্ত। সামান্য বাড়তি আয়ের জন্য তাদের এই আয়োজন। তবে তারা যেন নীতি ও সততার মূর্ত প্রতীক। কারও কাছে হাত পাতেন না। লোকজন স্বেচ্ছায় যা দেয় তাতেই তারা সন্তুষ্ট।
দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠতম সদস্য মাদল বাদক বিষ্ণুপদ জানান, হাট শেষে একেকজন এক থেকে দেড়শো টাকা পান, এতেই তারা তৃপ্ত। দলের আয় সেই দলের সবার মধ্যে ভাগ করা হয়।
হাটের বিকিকিনিও দারুণ। দাঁড়িয়ে তাঁতের গামছা বিক্রি করছিলেন একজন। দাম জানতেই বিক্রেতা দাম হাঁকলেন ২৫০ টাকা। ২৫০ টাকা শুনে অবাক হতে হয়। ভেবেছিলাম, একটি গামছার দাম ২৫০ টাকা চেয়েছেন।
অবাক করে দিয়ে বিক্রেতা বললেন, এখানে চারটে গামছা রয়েছে, এর চেয়ে কম দামে কোথাও পাবে না।
এবার বিস্ময়ের সীমা থাকলো না। দুশো টাকায় রফা হলো চারটি গামছা। এই মানের একেকটি গামছা গড়পড়তা দোকানে ১০০-১২০ টাকার কমে পাওয়া সম্ভব নয়। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এই হাট ও হাটের চারপাশের বন প্রায়ই ভারতীয় বাংলা সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা যায়। ভারতের জি বাংলা ও স্টার জলসার অনেক জনপ্রিয় সিরিয়াল এখানে চিত্রায়িত হয়েছে। জানা গেল, স্টার জলসার ইস্টিকুটুম সিরিয়ালের জনপ্রিয় চরিত্র ‘বাহা’ পাশ্ববর্তী গ্রামেরই মেয়ে।
ভাঙ্গা হাটে দেখলাম অনেক পর্যটক দরাদরি করে প্রচুর সস্তায় শাড়ি থেকে পাঞ্জাবি সওদা করলেন। অনেকেই একতারা কিংবা দোতারা কিনলেন। দু চারজন লোকগীতি গায়ক গাছের তলার মাচায় বসে অাপন মনে গান গেয়ে চলেছেন। কনকনে ঠান্ডায় মাঝরাত পর্যন্ত রিসর্টের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে বাউল গানের আসরে মেতে রইলাম।
ফেরার তাড়া উঁকি দেয়। ট্রেন ধরতে হবে, কাজেই মন না চাইলেও না ফিরে উপায় নেই। কিন্তু মন পড়ে থাকে লাল মাটির বুকে ছড়িয়ে থাকা সোনাঝুরির শনিবারের হাটে। রোববার দুপুরের লাঞ্চ সেরে হাওড়াগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। বিদায় সোনা ঝুরি।
________________________