পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
ওকে মনে পড়লে কিংবা মনে করার চেষ্টা করলে কাঁচা চিংড়ির ঘ্রাণ মনে পড়ে। কুয়াশার মতো মুখটাকে ঘিরে থাকে ধূসর চিংড়ি। সে কুয়াশা বরাবর একটানা হেঁটে গেলে মুখোমুখি দাঁড়াবে পুরনো কালো পাথরের ফেরেশতা, ফাটলে তার কবেকার পশলা বৃষ্টি, সেখানে একটা লাল গামছা, গামছায় ঢেকে থাকা অর্ধেক মুখ। তখন মনে হবে লাল গামছায় ঢেকে থাকা অর্ধেকটা মুখ দুই হাজার একশ নব্বুই আর অন্যান্য দিন ধরে জ্বলতে থাকা সাকুরাজিমা আগ্নেয়গিরি যেন। লাভা হয়ে উপচে আসছে অগুনিত চিংড়ির লাল আর স্মৃতি আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি হয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা ছোঁয়া। বৃষ্টিকে তখন হাসপাতালের সিস্টার মনে হয়। কাছে এলেই কেমন অসুখ কমে যায় মনের পাশটায় ।
অথচ যখন বাজার থেকে আনা রান্না করা কিংবা কাঁচা চিংড়ি গুছাই, আজ সকালেও যেমন গুছিয়েছি, তাকে আমার মনে পড়ে না। আমার বরং মনে আসবে তাতানটা চিংড়ি খেতে ভালোবাসে, চিংড়ি আমার বরফ গলির আদর দিদিমণি, 'কিচ্ছুটি মুখে তুলব না' দিনেও ঠিক ভেসে এসে গল্প শুনিয়ে যাবে। আমার বরং মনে পড়বে ঈশানের সাজানো আক্ষেপ থেকে টুপ করে ঝড়ে পড়া আচমকা আপেল 'জামাই আদর নেই কপালে। চিংড়ির মালাইকারিও জুটলো না।' অবশ্য ঝগড়ার সময় সেটাই হয়ে যাবে ফসকে যাওয়া আঘাত- 'কি করেছো আমার জন্য, আমার পরিবারের জন্য?' কাঠগড়ায় দাঁড়ানো প্রশ্ন বরাবরই শোনার থেকেও আরো বেশি কিছু দাবী করে। ওর পরিবার বলতে ওর বাবা, মা, ভাই, বোন, জ্যাঠু, ও বাড়ির ময়না, সতেরো রকম বেড়াল। তখন ওর পরিবারে কোন তাতান নেই, তাতানের জন্য আমার খেটে যাওয়া নেই, নিজের একেকটা স্বপ্নকে চুপসে দেয়া নেই! দিন শেষে আছে কিছু ফাঁস লাগানো কথার সংসার, একটা বাটি, ফেসবুকে ঝুলতে থাকা চিংড়ির মালাইকারি - ওর বন্ধুর বউয়ের রান্নার ছবি।
একদিন আমিও আঠারো বার রেসিপি চোখে চর্চা করে, কানে গুলিয়ে রান্না করেছিলাম চিংড়ির মালাইকারি। 'আহা, অপূর্ব বউ'- ঈশানের সাজানো প্রশংসা থেকে ঝড়ে যায় একঘেয়ে দুপুরের আপেল। সেদিনও একবারের জন্যও স্মৃতিকাতর চামচে ওঠে আসেনি লাল গামছা, গামছায় ঢেকে থাকা মুখটা। আমি তখন ভেঙে যাচ্ছি তাতানের গন্ধ চুরির গল্পে। এক গরীব ভালো মানুষ বাড়ির পাশের ময়রার দোকানের গন্ধ ভালবাসতো। প্রতিবেশী গন্ধেই যেন ওর নিজের শুকনো রুটিটা হয়ে উঠতো সুস্বাদু। একদিন কিপটে ময়রা এসে বলে 'প্রতিদিন তুমি আমার দোকানের গন্ধ নাও বিনে পয়সায়। এখন থেকে গন্ধের দাম দিতে হবে।'
গন্ধের জন্য দাম দিতে হয় কে কবে শুনেছে। ময়রা নাছোড় বান্দা, শেষমেষ গেল হাকিমের কাছে। হাকিম রায় দিলেন 'চুরি করা অপরাধ, সুতরাং শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে, বের করো মোহর।' বেচারা ভালো মানুষ শেষ সম্বল দুটো মোহর বের করতেই হাকিম হাতে নিয়ে বাজাতে বললেন। তাতান তখন গল্পের হাওয়া- ছুটছে ওর ঘরে, আবার ফিরে আসছে গল্পে। এক ঝাঁক পয়সা ওর ছোট্ট হাতের ভেতর হয়ে গেছে ঝুমঝুমি। এইবার আমাদের দিকে ছুঁড়ে দেবে যাদু -হাসি- এই নাও ঘ্রাণের দাম- ঝুমঝুম ঝুমঝুম ঝুমঝুম...
শৈশবও বুঝি এক খেলনা ঝুমঝুমি অথবা এক দিঘল হুহু। মনে আছে 'পুরনো সেই দিনের কথা'- গানটা প্রথম শুনেছিলাম ক্লাশ সিক্সে যখন পড়ি। স্কুলের ফেয়ার ওয়েলে, শিহাব স্যার চলে যাবেন। ক্লাস টেনের এক দিদি গেয়েছিলেন। গাইতে গাইতে হঠাৎ সুরের কোণে কেঁদে ফেলেছিলেন। ঠিক কেন কে জানে। দেয়ালে দেয়ালে, আমাদের মেঘ সাদা সব ইউনিফর্মে, দুপুরের রোদে লেগে গেল সেই কিশোরীর হুহু। তারপর জীবনে কতবার শুনেছি এই গান, তবু সেদিনের সেই একইরকম হুহু পাইনি কোথাও আর। দুপুরের রোদে লেগে থাকা হুহু গেল না এতসব নতুন ধুলোজলে।
হুহু লেগে আছে সেই দুপুরে যেদিন রোশনি ছোট্ট আমাকে নিয়ে মাছ ধরতে গিয়েছিল। পোনা, চিংড়ি ছাড়া তেমন কিছু ছিল না পুকুরে। রোশনির পেটে ছিল আলুর মতো শিশু, বরের মারের থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ছোট লোটায় চিংড়ি আর আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে, কে যেন ঝাপটে ধরলো। আসলে পালিয়ে কতো দূর যেতে পারে মানুষ? পাশের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল ওর বর, বরের বন্ধুরা। রোশনিকে দু হাতে টেনে, মাটিতে হেঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিল মানুষগুলো। ওর শরীরের নিচে চ্যাপ্টা হয়ে, ওর লম্বা চুলে গেঁথে ছিল কত হুহু চিংড়ি। বাতাসে ছিল চিৎকার 'আমারে ছাইড়া দাও, আমি হেঁটে যামু, ছাইড়া দাও।' না, হেঁটে যেতে ও পারেনি। ছোট্ট আমি তখন কী নির্বিকার, কাঁদা জলে চিংড়ি নিয়ে খেলছি, মুখে কাঁচা চিংড়ির স্বাদ! নাহ, কাঁচা চিংড়ি গোছানোর সময় রোশনিকে আমার মনে পড়ে না। হয়তো মনে করতে ইচ্ছেও হয় না।
না ফেরার ঐপাশটায় নিরাপদ ঝঞ্ঝাটহীন ইচ্ছেই বসানো। মাঝেমধ্যে এইসব ইচ্ছের মধ্যে হেঁটে বেড়াতে বেশ লাগে। সেদিন নিলয়ের সাথে কথা হলো। হঠাৎ বৃষ্টি হলে, ঝড় নামলে আমাদের যেমন কথা হয়ে যায়- ছোট্টবেলার গল্প, বড়োবেলার বিষন্নতা, হুহু বৃষ্টি, মেঘালয়ের গল্প। ও ফিরতে চায় তুমুল বর্ষায় শৈশবের নদীর আধ-ডুবা পাথরে পাথরে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে। এই তো কাছেই শহর তবু ফেরা হয় না তার। আমি তখন ভাবি বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা তাতানের দোলনাটার কথা, ভাবি ঈশান কতদিন প্রয়োজন ছাড়া হুটপাট চুমু খায় না। এমন উলোট পালট বৃষ্টিতে কি হতে পারে না চুমুর যোগ্য দিন, যোগ্য চুমুর দিন! ভাবি-এই যে ঢেউ, বৃষ্টি, বর্ষা- এইসব তো আমাদের জীবন থেকে আদৌ হারায়নি। তবু যেন মনে হয় ঠিকঠাক কি যেন নেই। হয়তো সেই ঝুমঝুমিটা আর নেই। ছোটবেলার একটা সিঁড়ি থাকে, যেখানে একটা ভ্রমণ থাকে। আমরা উঠি, নামি। একটা সময় আমাদের শৈশব, অতীত হয়়ে যায় বারান্দা, সেখানে কেবল থেকে যায় পায়চারি।
সেই পায়চারিতে অস্বস্তিকর চিংড়িওয়ালাকে মনে না পড়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। মনে পড়ার দেশে বরং চানাচুরওয়ালা আকবর ভাই চানাচুর হাতে সাম্রাজ্য বিস্তার করে থাকে। একটা ট্রেন হয়ে কাছে থেকে দূরে চলে যায়। একটানা বাজতে থাকে লংকা-তেলে চানাচুর মাখার শব্দ ঝুপুট ঝুপুট। তবু শৈশবের খোঁজ করলে ট্রেন বাস ছাপিয়ে একটা তলা থেকে উইপোকা হয়ে বেরিয়ে আসে লাল গামছায় ঢাকা মুখ। চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছ বিক্রি করতে দেখেনি কোনদিন তাকে। তখন ভাবতাম চিংড়িরা ওর জালের গন্ধ চিনে। ও আসতো সব বাবারা রোদের ম্যাপে পায়ের ছাপ ফেলে অফিসে চলে যাওয়ার পরে। ও এলেই আমাদের কলোনিতে ওর আসার অপেক্ষা টের পেতাম। প্রতিটা বারান্দায় দাঁতে লাল গামছার একপাশটা চেপে দাঁড়াত তার ডাক- 'চাচী ইছা মাছ রাখবাইন। বিশ টাকা ভাগ।' বিশ টাকার কমবেশি কখনো হতো না চিংড়ির দাম। তবু দরদামে মায়েরা মুখর থাকতো, তারও বেশি মুখর থাকতো কেমন উঠছে-কমছে নদীতে বর্ষার জল, নদীর মাছের গল্পে। সে ছিল গিন্নীপাড়ার এক চিলতে স্বাধীনতা। বাবা বাড়ি ফিরে চিংড়ির চচ্চরি খেতে খেতে বলতেন- 'এসেছিল তোমাদের ভাগনে বুঝি? এই পাড়ায় ওর ঢুকা নিষেধ করা উচিত। নদীর ঘাটে এর থেকেও ভালো মাছ পাবে এই টাকায়। ও তোমাদের সিমপ্যাথি আদায় করে ঐ মুখটার জন্য।'
আমার অবশ্য মনে হতো ছেলেটা করুণার থেকে সমীহ আদায় করে নিয়েছে। তার বলিষ্ঠতা, টিকে থাকার চেষ্টার সাথে মানুষের করুণার দরদাম হওয়ার সুযোগই হতো না। অবশ্য তখন আমাদের সময়টাই ছিল এমন- ভিক্ষে চাইতে যিনি আসতেন, তাকেও মনে হতো আমার আপন গাছের ফুল। যার পাশে বসিয়ে মা বলতেন 'একটু দোয়া করে দেন, লেখাপড়ায় মন নেই।' ছেলেটার ভেতরে উদ্যম ছিল। ভিক্ষে করতে দেখিনি কখনও। আরেকটু বড়ো হতে দেখেছি চিংড়ির মৌসুম চলে গেলে ওকে রিকশা চালাতে। দাঁতে গামছার একটা কোণ চেপে হুহু করে বয়ে যাচ্ছে শহরের পথে। তার অর্ধেকটা মুখ আমি দেখেছি, আবার মনে হয় দেখিনি কোনদিন। আমার আর ওর দৃষ্টির মুখোমুখি একটা লাল গামছা ছিল বরাবরই। অনেকবার ভেবেছি কি হতো সরে গেলে আড়াল? মানুষের ভালোলাগার মাপে নিজেকে বসাতে না পারলে কেন এত অপাঙক্তেয় লাগে নিজেকে! পৃথিবীকে লবডঙ্কা দেখিয়ে পুড়ে যাওয়া বীভৎসতা নিয়ে হেঁটে যেতে পারেনি সে। কিংবা এভাবেই সে ধরে রেখেছে রহস্য। যে রহস্য তাকে নিয়ে গেছে করুণার গাছ থেকে দূরে। আহা লাল ঘোমটায় ঢাকা মুখ- আহা বধূ, কোন আলো লাগলো চোখে...
ঈশানের ফিরতে আজ রাতেও দেরী হচ্ছে। আজকাল গভীর রাতে আমার ঘুম ছুটে যায়। এইসব একাকীত্বে কবি, সম্ভাব্য প্রেমিকের কাছে যেতে সাধ হয় না। আমিও বুঝি ঠোঁটে চেপে আছি নিজের অর্ধেক মুখ। আমার বরং ভীষণ ভয় পেতে ইচ্ছে করে। কেউ আমাকে উলোটপালট ভয় দেখাক। একেকটা ভয়কে আমি অন্ধকারে দুমড়ে দুমড়ে চেপে ধরব নিজের উপর। বাতাসে তাতানের বানানো ঘুড়িটা নড়ে, দেয়ালে ধাক্কা লেগে চমকে উঠে শব্দ। মনে হয় কুমিরের মতো কেউ হাঁটে আমার চারপাশে। আমি অস্থির মেঘ হয়ে ডাকি আমাকে গ্রহণ করো। জীবনের গভীরে লুকোনো আঠারো শিশি থেকে উপচে ওঠে ঘ্রাণ, খুব কাছে নিঃশ্বাস জড়ো হয়, আমাকে ডাকে ‘চাচী’…
চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে পৃথিবীর লাল, অবগুণ্ঠন। কালো পাথরের ফেরেশতার আলোয় আমি দেখি অদেখা অর্ধেক মুখ, সারে সারে চিংড়ি বসানো। ওর চোখের ভেতর থেকে গড়িয়ে নামে ভ্রমণ- এক ঝাঁক চিংড়ি। চিংড়িরা হেঁটে চলে, শিশুর পায়ের মতো টলমলে তাদের শুয়ো, ঘুম চোখ। আহা অর্ধেক ঠোঁট, সেখানেও লেগে আছে টুকটুকে হরিণা চিংড়ি। নিজেকে ভাঙচুর করা আকাঙ্ক্ষায় আমি হাত বাড়াই- যে মুখে ভ্রমণ লেগে থাকে। আমাদের আকুলতায় ঝড়ে পড়ে বৃষ্টিভর্তি হাজার শিশি, ঝিরঝিরে অবিরাম চিংড়ি…
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |