পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
আকাশে কৃষ্ণা তিথির সপ্তমীর চাঁদ – অর্ধেকের একটু বেশী – ঘোলাটে হলুদ – যেন কেউ খানিকটা ধূসর রং মিশিয়েছে তাতে। চাঁদের চারিদেকে মেঘগুলোও ধূসর সাদাটে - অদ্ভুত আকারের । হাওয়া স্তব্ধ । তাই মেঘ স্থির । কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় কোন একটা সরীসৃপের হা মুখের আলজিবে চাঁদটা যেন আটকে আছে।
সেজানের চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে কয়েকদিন ধরে। মা বলতেন কিছু একটা খারাপ খবর আসবে এ তারই ইঙ্গিত। সেজান বসে আছে । শতাব্দী বয়স্ক মড়া কাঠের একটা গুঁড়ির ওপর। এটা তার বসার - আরাম করার জায়গা । খানিক দূরেই তার পলিথিনের শতচ্ছিন্ন তাঁবু টি । কোন এক কালে তার কোন একটা রং ছিল । তাঁবুর পেছন দিকে স্তরে স্তরে অরণ্য উঠে গেছে পাহাড়ের গায়ে । লতা পাতা গুল্মে সে অরণ্য দুর্ভেদ্য । তাঁবুর চারিদিক ঘিরে বড় বড় ডালপালা মাটিতে বসিয়ে তাদের মাথার দিকটা পরস্পর সংলগ্ন করে দিয়ে সে তাঁবুটির র মাথায় একটা আচ্ছাদন তৈরি করেছে সমতল জমির ওপর । জমিটা ছোট পরিসরের ত্রিকোণাকৃতি । তাঁবুর তিন দিকে সামান্য জমি ছেড়ে ছেড়ে গাম ট্রি উঠে গেছে। বিভিন্ন জাতের , বিভিন্ন আকারের । কারো কাণ্ড সটান সোজা । মসৃণ । বলিষ্ঠ পুরুষের মত দৃপ্ত তার ভঙ্গী । কোন টি ছিপছিপে তরুণ । কোনটির ডালপালা কাণ্ডের শুরুতেই । গায়ে তাদের বাকল দীর্ঘকালের , ফেটে আছে - জড়াজড়ি করে ঝুলে ঝুলে আছে গায়ে - কিছুটা মাটিতে - যেন অগোছালো জামাকাপড় নিয়ে শীতকালে রোদে দাঁড়িয়ে কোন বৃদ্ধা – বয়সের ভার তার শিথিল চামড়ায় কেটেছে অজস্র আঁকিবুঁকি।
তাঁবুর বাইরে সেজান রাত হলেই এই কাঠের গুঁড়ির ওপর এসে বসে থাকে । নিস্তব্ধ প্রকৃতির সঙ্গে চুপ করে বসে থাকে । নিস্তব্ধ , কিন্তু নির্জন নয় । হাওয়া বয়ে যায় । তার অস্পষ্ট শব্দ । দূরে বহুদুরে কোন গাড়ী যেন চলে যায় পাকা রাস্তায়। পাখীরা মাঝে মাঝে ডানা ঝাঁপটায় । রাত জাগা প্রাণী নিঃস্বারে এ ডাল থেকে ও ডালে যায় – নেমে আসে মাটিতে । তাদের চলার অস্পষ্ট আওয়াজ । কোথাও মধু ঝরে পড়ছে চাক থেকে টুপ – টুপ – টুপ ......... দূরে অনেক নীচে যেখানে সেজান জল আনতে যায় সেই ক্ষীনা ক্রিকটির উঁচু নীচু পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার মৃদু ধ্বনি - সেজানের অস্তিত্ব এসবে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
সেজান এখানে আরও অনেকক্ষণ বসে থাকবে। যতক্ষণ না চাঁদ পশ্চিম গগনে ঢলে পড়বে । তারপর সে উঠবে । তাঁবুর ভেতরে তার বিছানায় শুয়ে পড়বে। সে বিছানা শুকনো ঘাস বিছিয়ে তৈরি। এ ঘাস শহরের ঘাস নয় । এ ঘাস মাটি থেকে দু আড়াই হাত লম্বা হয়। খুব নরম না হোলেও রুক্ষ মাটির কাঠিন্য কিছুটা আটকায় তাতে। তাতে কিছু এসে যায় না সেজানের । কারণ সে ঘুমাতে পারে না । নিদ্রা দেবী অকরুণ তার প্রতি । সে চেয়ে থাকে । চেয়েই থাকে.........
ছোট্ট সেজান সকালে উঠেই বাড়ির বাইরে মাঠের শেষে ছোট পুকুরটার পাড়ে বসে আছে। মাঠটা কম বড় নয়। বেলা প্রখর হতে থাকে। মা এসে তাকে টানাটানি করে তুলে নিয়ে যায়। জোর করে তাকে স্কুলে পাঠায় । সেজানের প্রচণ্ড অনীহা স্কুলে যেতে। ক্লাসে এসে চুপ করে বসে থাকে লাস্ট বেঞ্চে। তার কোন বন্ধু নেই । একজন ছাড়া । সেও তারই মত। উদাসীন- যেন এখানে নেই – যেন অন্য কোথাও ...। বিরতিতে স্কুলের টয়লেটে যাবার নাতীদীর্ঘ পথটির শেষে একটি ছোট বুক - লিফ পাইনের ঝাড়ালো আড়ালে দুজনে বসে থাকে । যাতে কেউ তাদের সহজে দেখতে না পায়। দুজনেই কেউ কারো সাথে কথা বলে না । দুজনেই জানে তারা বড় হলে ‘লোনার’ হবে। গাছের নীচে তাঁবু খাটিয়ে থাকবে । কি খাবে ? কি আর বেশী কিছু লাগে খেতে ? খাবে গালা পায়রার মাংস । স্লিং শটে মেরে নেবে। ঝলসে নেবে কাঠের আগুনে। লোহার কেটলি ঝুলিয়ে দেবে আগুনের ওপর – মুভিতে যেমন দেখে । জল গরম হবে। জঙ্গলে টি – ট্রি আছে তারা জানে । সেই পাতা দিয়ে দেবে বানাবে হট ড্রিংক । জেলিবুশের ফুল থেকে মিষ্টি মধু খাবে ।
সেই জীবন আজ সত্য হয়েছে । সেজান প্রায় ওইরকম ভাবেই থাকে। অনেক দিন সে এখানে । সে এখন অনেক বেশী জানে এই জঙ্গলকে,জংগলের গাছপালার চরিত্রকে । সে জানে জল আনতে না পারলে কোন গাছের পাতার ভেতরের জেলি তাকে জলের জোগান দেবে। সে জানে কোন মাশরুম খাওয়া যায়। জানে ক্রিকের কোন জায়গায় গেলে কিছু ঈল পাওয়া যাবে, পাবে কড মাছ , কি ভাবে তাদের ধরতে হয় – কখন তারা ক্রিকে আসে। শহরের ওয়াটল ফুল এখানেও ফোটে । তারাই ফুটে ইঙ্গিত দেয় ক্রিকে এখন কড মাছেদের এসে যাবার খবর
। এই ফুল জলে ফেলে দিলে তার রেণু খেতে কড আসবেই । এ সবই তার এখানকার অভিজ্ঞতা । আরও অদ্ভুত অদ্ভুত তার অভিজ্ঞতা হয়েছে এখানে। পাহাড়ের অনেক উপরে এক জায়গা আছে । সেখানে পাহাড়ের ফাটল থেকে সে দেখেছে জল বেরোয় । অবিরাম । পাহাড় অনেক উঁচুতে । আসে পাশে কোন নদী নেই । সে জল ঘুরে ফিরে ক্রিকে গিয়ে পরেছে । সেখানে জন্মায় মাশরুম, আর কেল মানে বুনো বাঁধাকপি । সুতরাং জঙ্গল সেজান কে খারাপ রাখে নি এখানে । কিন্তু সে একা । তার বন্ধুটি কোথায় কি ভাবে সে আছে তার জানা নেই । সভ্য জগতের সঙ্গে সেজানের কোন সম্পর্ক নেই। একেবারে যে নেই তা বলা চলে না । । এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে আছে এক আশ্চর্য গুহা । মিলিয়ন বছরের পুরনো । সে গুহার ভেতরে জল চুইয়ে পড়ে পড়ে বিচিত্র বর্ণ ও আকারের সব আকৃতি তৈরি হয়েছে। সেসব দেখতে লোক আসে । তাদের কথাবার্তা মৃদু মৃদু গুঞ্জনের মত বাতাসে ভেসে ভেসে আসে । কোন কোন সময় কোন শিশুর উত্ফুল্ল চিৎকারও একটু জোরে শোনা যায় । রাতে কেউ কেউ থাকে অতিথি নিবাসে । তাদের গাড়ির ক্ষীন আওয়াজ শোনে সে । সভ্য জগতের সঙ্গে এই তার যোগাযোগ।
কিন্তু এই যোগাযোগ যেন ক্ষীন হয়ে আসছে কিছুদিন ধরে । পাখীর ডাকে সেজানের ঘুম ভাঙে। সব পাখী একসাথে ডাকে না । তাদের সময় আছে। তারাই সময় জানিয়ে দেয় । তাদের সে চেনেও। শুনতে পায় গাড়ীর আওয়াজ যখন পাখীরা ডাকে না । এই গাড়ির আওয়াজ আজকাল সে আর শুনতে পায় না । শুনতে পায় না মানুষের কথার কোন গুঞ্জন। একেবারেই না । অসীম নিস্তব্ধতা দিনের বেলায় । রোদ বাড়ে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে । যখন হাওয়া থাকে না তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন নিশ্বাস বন্ধ করে আছে । তখন তীব্র সূর্যালোক এই ঘন সবুজ পাতার মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে । সেই সবুজ রঙের আলোর নির্যাসে ঘন জঙ্গল যেন ডুবে থাকে । সেই আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় যেন আলো পড়ার শব্দ পায় সেজান । যেন সবুজ গন্ধ পায় সে নির্যাসের । এতো তীব্র তার শ্রবণেন্দ্রিয় । সেই শ্রবণেন্দ্রিয়তেও কোন শব্দ ধরা পড়ে না আজকাল। নৈঃশ্বব্দ এমন জমাট বাঁধা ।
ক’দিন ধরে সে তার তাঁবু ছাড়িয়ে পাকা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোন জনমানব তো দুরস্থান একটি গাড়িও সে দেখতে পায়নি । দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা সেখানে সে দাঁড়িয়ে। ডায়াসমা ঝোপের আড়ালে । তার শত চ্ছিন্ন পোশাক, তার দীর্ঘ অযত্ন বর্ধিত চুল দাঁড়ি দেখে লোক ভয় পেতে পারে । তাই এই আড়াল। যখন সে ফিরে আসছে তখন এক হতাশা তাকে গ্রাস করেছিলো । কিসের হতাশা সে বোঝেনি । পর পর ক’দিনই তার ঠিক এই একই রকম অনুভূতি হয়েছে। অচেনা বিস্বাদ এক অনুভূতি – শূন্যতার অনুভূতি । এই শূন্যতার কি কোন রং আছে? অনুভব করার চেষ্টা করছিল সেজান। বুঝতে চেষ্টা করছিল তার অনুভূতির বর্ণ – তার অবয়ব তার উৎস । এই কি অবসাদ ? শুনেছিলো অবসাদের রং নাকি বাঁদুরের কালো ডানার মত । কালোও তো এক উজ্জ্বল রং। সেই উজ্জলতায় অবসাদ কোথায় ? শুন্যতা কোথায় ? তবে কি সেই অবসাদের রং? সেকি মৃত বর্ণ হীন ফ্যাকাসে ঝিনুক – মাস? সারি সারি সমুদ্র সৈকতে পড়ে থাকা - একের পর এক মৃত – ক্ষয়াটে সাদা গুটিয়ে যাওয়া – ভঙ্গুর – সেই কি তার অনুভূতির রং?
সেজান চঞ্চল হয়ে ওঠে । সত্যি কি তাই? যেটা সে ভাবছে , যাকে সে নিজের মধ্যে দেখছে সে কি সে নিজে ? সেকি সেজান ? এটা কি করে সম্ভব? সেজান মাথা ঝাঁকায় জোরে । এতদিনকার অরণ্যচারীতা তবে কি মিথ্যা ? সেকি অভিনয় ? নিজের সাথেই ? না কি সে ভুল? নিজেকে বোঝার ভুল । সে বুঝতে পারে নি একদম বুঝতে পারে নি যে সে আসলে এক অবিচ্ছেদ্য পরম বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছে মানুষের সাথে! সে মানুষের নাগরিক কোলাহল শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। মানুষ তার প্রাণ ভোমরা – তার জীবন রস । এটা অবিশ্বাস্য লাগছে শুনতে , মানতে তার অসুবিধে হচ্ছে, সে কি তা হলে নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছে এতো দিন ? এক অবদমিত যন্ত্রণায় মনে হচ্ছে তার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসবে। সে তা হলে কোন সেজান ? এই --এই মুহূর্তের মানুষ - সঙ্গ কাতর সেজান ? না কি বহুদিন আগের সেই কৃষ্ণা রাত্রিতে অরণ্যের টানে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসা সেই তরুণ সেজান? কে বলে দেবে তাকে ? দুহাতে মাথা টিপে যন্ত্রণায় কাৎরাতে থাকে সেজান। কে যেন বলতে থাকে
-গহন অরণ্যের মধ্যে একাকী জীবনেও তুমি দূরাগত মানুষের মৃদু কথার গুঞ্জন , তাদের যান্ত্রিক বাহনের আওয়াজ শুনতে, গ্রহণ করতে তোমার জীবন রস । তুমি বোঝনি । এই ধ্বনি এই গুঞ্জন যতই মৃদু হোক, যতই ক্ষীন হোক না কেন , এই যান্ত্রিক ধ্বনির নিত্য উপস্থিতি তোমাকে তার প্রয়োজনীয়তা কোনদিন উপলব্ধি করতে দেয় নি । আজ , আজ তার নিরঙ্কুশ অভাব বোধ, এই পাথরের মত জমাট নিস্তব্ধতা তোমাকে এই চরম সত্যের প্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে – যে তুমি আসলে লোনার নও।
- তুমি মানুষ- আদ্যন্ত রক্ত মাংসে গড়া এক সাধারন মানুষ , একা থাকা তোমার পক্ষে অসম্ভব । তুমি সামাজিক – যে সঙ্গ চায় তারই মত আর একটি সাধারন মানুষের..........
-তাই ? তাই ? তা……আ ………আ ……ই ? সেজানের গলা চিরে বেরিয়ে আসে এক জান্তব আওয়াজ .........
তারপর ...... যুদ্ধে ক্লান্ত বিধ্বস্ত সেজান বসে থাকে মাটির পড়ে ধুলায়। দীর্ঘ ক্ষণ । হাওয়া বয়ে যায়, ধুলো ওড়ে সেজানের শরীর ঘিরে । সেজানের ভ্রূক্ষেপ নেই............ তার অরণ্য প্রিয় সেজান যে এটা মানতে পারছেনা এখনো..................
অনেক অনেক অনেক পড়ে সে শান্ত হয়। উঠে পড়ে মাটি থেকে ক্লান্ত শরীরটি টেনে। জনপদ বাসী সঙ্গ - লোলুপ সেজান ততক্ষনে অরণ্যচারী সেজানের চেতনা অধিকার করে নিয়েছে ধীরে ধীরে। । চাঁদ অনেকটা ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশের নিচে । আজ সে আর অপেক্ষায় থাকবে না গাড়ির আওয়াজের জন্য। আজ সে হেঁটে যাবে নগরীর দিকে। শুনবে সভ্যতার আওয়াজ, শুনবে মানুষের কোলাহল –– আঃ কতদিন কতদিন সে এই কোলাহল শোনে নি ? কতদিন সে শোনে নি শিশুর ক্রন্দন। কতদিন দেখেনি তরুণ পিতা – তরুণী মা...............
তারার অস্পষ্ট আলোয় সেজান তাঁবুর বাইরে পা রাখে পাকা রাস্তায় ।
4numberplatform এর September সংখ্যায় প্রকাশিত