এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অলোক স্যার 

    raju Sengupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ নভেম্বর ২০২০ | ৮৬৯ বার পঠিত
  • আমার বিদ্যে, বুদ্ধি আর বানানের বহর দেখে অনেকেরই বদ্ধ ধারণা, আমি বোধহয় স্কুলের ঘন্টা শুনি নি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি স্কুলে পড়েছি, যদিও সেটা কোনো কুলীন সম্প্রদায়ের স্কুল নয়। নেহাতই সাদামাটা এক বাঙলা মাধ্যম স্কুল।

    রাস্তায় পড়ে থাকা কোনো স্টোন চিপকে লাথি মারতে মারতে স্কুলে পৌছে যেতাম, ফেরার পথে ঐ রকম কোনো সহজলভ্য বস্তুকে পায়ের সংযত ঠেলায় নিজের আয়ত্তে রাখার এক অদম্য প্রয়াস নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কোনো কোনো দিন অসাবধনতায় লাথির জোর বেশি হয়ে রায় বাবুদের বাগানের গেটের তলা দিয়ে ঢুকে পড়লে তখনকার মতো খেলা শেষ!

    রায়বাবুদের বিশাল বাগান বাড়ি। গেটের সামনে এক বিশাল চেহারার হিন্দুস্তানি দারোয়ান থাকত। রায়বাবুর চেয়ে ঐ দারোয়ানকেই বেশি ভয় পেতাম। পাড়ার লোকেরা বলাবলি করত রায়্দের নাকি অনেক কালো টাকা। তখন ঠিক বুঝতাম না কালো টাকাটা ঠিক কি। ভাবতাম টাকাগুলো বোধায় সত্যি সত্যি কালো রঙের, আর সেই টাকাগুলো শুধু রায় বাবুদের মতো বড়লোকেদের কাছেই থাকে। নিমাইদা বলেছিলো রায়বাবুদের নাকি ফ্রীজ আছে, সেখানে বরফ হয়, আর জলটা নাকি হেব্বি ঠান্ডা। বড়লোকেদের বাড়ি দেখাতে আমায় একবার রায়বাবুদের বাড়ি নিয়ে যাবে বলেছিল নিমাইদা। কিন্তু সেই বছরই নকশাল হামলায় নিমাইদা মারা যায়। তাই আজও আমার বড়লোকের বাড়ি দেখা হল না।

    ফেরত যাই আবার সেই স্কুলবেলায়। অতুলবাবু আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। ইতিহাস পড়ানোর সাথে সাথে ক্লাসের শেষের দিকে মাঝে মাঝেই মহাভারতের গল্প বলতেন। আর আমরা অবাক বিস্ময়ে শান্ত ছেলের মতো মহাভারতের গল্প শুনতাম।

    সেই বছর পরীক্ষায় মোগল সাম্রাজ্যের অনেক বাঘা বাঘা প্রশ্ন ছেড়ে অতুলবাবু সামান্য একটা প্রশ্ন রাখলেন, বাবরের বাবার নাম কি? সঠিক উত্তরে ২ নম্বর। পরীক্ষার ভয়ে তখন নিজের বাবার নাম ভুলে যাবার অবস্থা, তো বাবরের বাবার নাম!

    অলোক সহজে ২ নম্বর ছাড়তে চায় না। লিখে দিল বাচ্চু মিঞা (ডাক নাম)। অতুলবাবু পড়লেন মহা বিপদে, ভাবলেন কে জানে বাপ ঠাকুর্দার কেউ হয়ত ঐতিহাসিক, বা ইতিহাসের প্রফেসর। ২ নম্বর দিয়েই দিলেন। কিন্তু মনের মধ্যে একটা সংশয় থেকেই গিয়েছিল ওনার। তখন গুগুল না থাকায় বাবরের বাবার ডাকনাম যাচাই করা সম্ভব হয়নি অতুল স্যারের। বোধ হয় ন্যাশনাল লাইব্রেরী ঘেঁটেও কোথাও খুঁজে পান নি বাবরের বাবার ডাক নাম। কিন্তু স্যার জানতেন অন্য উপায়!

    পরের সপ্তাহে স্যার ক্লাশে ঢুকলেন হাতে বেত নিয়ে। সোজাসুজি অলোককে প্রশ্ন বাবরের বাবার আসল নাম কি?

    অলোক দুতিন বার - বাবর, বাবর করে বিড়বিড় করলো। কিন্তু ততদিনে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে গেছে, তাই বাবরের কোনো সৈন্য সামন্ত অলোকের সাহায্যে এগিয়ে এল না।

    স্যার তখন ক্ষত্রিয় ধর্ম ভুলে নিরস্ত্র অলোককে "মারি অরি পারি যে কৌশলে" ভুমিকায়। সপাসপ বেত চলছে সাথে বলে চলেছেন "বাবরের বাবার ডাকনাম বাচ্চু মিঞা? ডাক নাম! আমার সাথে জ্যাঠামো?"

    অলোকের আর্তনাদে পরিত্রাতা হিসেবে হেডস্যার ছুটে এলেন। হেডস্যার কে দেখে অতুলবাবু বলেন স্যার আমার শিক্ষক জীবনে এমন হতচ্ছাড়া ক্লাশ জীবনে পাইনি। অর্থহীন এদের পড়ানো! সরকার শিক্ষাখেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করছে এই অপগন্ডগুলোর পেছনে।

    আমাকে দেখিয়ে অতুলবাবু হেড স্যার কে বলেন, কনিষ্ক সম্পর্কে লিখেছে, "কনিষ্কের ছোটো বেলা থেকেই মুন্ডু ছিল না"! স্যর এদের পেছনে শ্রম আর অর্থ দুটোর কোনোটারই দরকার নেই।
    হেডস্যার আমাকে আর অলোককে নিজের ঘরে নিয়ে এসে বলেন, "তোরা কেনো এমন হয়ে গেলি? এই তো কিছু দিন আগে পর্যন্ত ভাল ছিলি। তার পরে দিন দিন বখাটে হতে শুরু করলি। বিড়ি, সিগারেট ধরলি, টুকতে শুরু করলি, স্কুল কেটে সিনেমা দেখতে শুরু করলি, পড়াশুনা থেকে ক্রমশ দুরে সরে গেলি। জীবনটা সিনেমা দেখে কাটবে না। ভিড়ের মধ্যে মিশে নিজেকে আড়াল করে রাখ্ছিস এখন, তবে বাইরে একটা বিরাট পৃথিবী, তখন দেখবি সেই বিশাল পৃথিবীতে বড্ড একা।"

    তখনকার দিনে শিক্ষকেরা ছাত্রদের ইনকামের চেয়ে আউটকামের কথাই বেশি চিন্তা করতেন। সেইদিন স্কুল ছুটির পরে অতুলবাবু অলোককে গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, খুব লেগেছে না রে?তোদের ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার হতে হবে বলছি না, তবে মানুষ হবার চেস্টা করিস। তুই তো খেলাধুলায় এত ভালো, সেটাই না হয় মন দিয়ে করিস।

    এই পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল, বাধ সাধলো ঠিক তার দুদিন পরে। ইংরেজি ক্লাশে জয়ন্ত বাবু ট্রান্সলেশন দিলেন, "রামের সৎমা...."

    অলোক ট্রান্সলেশনে লিখলো, "the honest mother....."

    এই ট্রান্সলেশনের জন্য অলোক মার খায় নি, কিন্তু সব শিক্ষকরা হাসাহাসি করায় অলোক খুব অপমানিত বোধ করে। ঠিক করে এই স্কুলে ওর সঠিক মুল্যায়ন হচ্ছে না। তাই পাড়ার অনতিদুরে আর এক স্কুলে বছরের মাঝখানেই ভর্তি হতে চলে যায়।

    সেই স্কুলের হেডস্যার অলোককে বলেন, "বছরের মাঝে এই সময় স্কুলে এখন কোনো সিট খালি নেই।"

    অলোক বিনীত অনুরোধ করে হেডস্যারকে "স্যর একটু চেপেচুপে একটা সিট হবে না?"

    হেড্স্যার দারোয়ান ডেকে অলোককে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেন। অলোকও বাঘের বাচ্চা। আর কোনো দিন স্কুলমুখো হয় নি।

    হঠাৎই সেদিন অলোকের বাড়ির সামনে দেখা। গোটা দশেক রাস্তার কুকুরকে খাবার খাওয়াচ্ছিলো তখন। একটা কুকুরের পায়ে ওষুধও লাগিয়ে দিলো। অলোকের কাঁচাপাকা চুল যেন স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর চক দিয়ে লিখে জানান দিচ্ছে আমাদের মাঝে প্রায় বছর ৪০ অতিক্রান্ত। (আমার মাথা ভর্তি টাক থাকায় বুঝি নি আমার চুলেও পাক ধরেছে!)

    সেই একই রকম প্রাণবন্ত অলোক, আমায় বলে বুঝলি খেলার দৌলতে তো একটা চাকরি পেলাম। গতো ৩০ বছরে অফিসে স্পোর্ট্স কোটায় আর কোনো রিক্রুট হয় নি। তাই অফিসের হয়ে খেলে যেতেই হচ্ছিল এই বয়সেও। তা গত বছর অফিসের খেলার দিনে রেফারিকে ডেকে বলি, আমি খেলা শুরু হবার মিনিট ১৫ এর মধ্যে আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপনকে লাথি মারবো, আর আপনি যদি রেড কার্ড দেখিয়ে আমায় মাঠ থেকে না বের করে দেন তাহলে খেলা শেষ হবার পরে আরও পিটবো। দুই পুরোনো বন্ধু এক সাথে হেসে উঠি।

    তা এখন কি তুই আর মাঠে যাস না?

    পাসের বস্তিতে সব মিলিয়ে প্রায় ২২ জন ছেলেমেয়েকে ট্রেনিং দিই। সবকটাই আমার মতো স্কুল ছুট। আমার তো পড়াশুনা হল না, কিন্তু বিশ্বাস কর যখন এই ছেলেমেয়েগুলো আমায় মাঠে "অলোক স্যার" বলে ডাকে আমার খুব ভালো লাগে।

    অলোকের চোখের কোনাতে কি জল চিক চিক করছিল? নাকি আমার দেখার ভুল!

    চলি রে আজ, একদিন সময় নিয়ে আড্ডা মারবো তোর সাথে। ছেলেমেয়েগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

    শান্ত সরু লম্বা গলিতে আর কেউ নেই, অলোক এগিয়ে চলেছে সাথে চলেছে ঐ ওষুধ লাগানো রাস্তার কুকুরটা। খুব চেনা চেনা এই পরিবেশটা।

    ফিরে গিয়েছিলাম আমার স্কুল বেলাতে, ঠিক এমনি শান্ত ছিলো সারা ক্লাসরুম। অতুলবাবু বর্ণনা করে চলেছেন মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠীর আর তাকে অনুসরণ করে চলেছে সেই কুকুর!

    আসলে অলোকরা ইতিহাস পড়ে না, ইতিহাস গড়ে!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন