এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • পথ চলাতেই আনন্দ:ছোটগল্প  

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৭০৪ বার পঠিত
  • পথ চলাতেই আনন্দ                

    ঠিক এরকমই একটা লালচে ইঁটের পুরনো বাড়ি, সামনে জং ধরা লোহার গেট আর একটা কি যেন ছিল, ঠিক মনে পড়ছে না । বোধহয় গেটের পাশে কোন একটা ফুলের গাছ—রাধাচূড়া, নাকি টগর বা শিউলি? উঁহু, ইদানীং এই হয়েছে এক জ্বালা। কিচ্ছু মনে থাকে না।

    হ্যাঁ, মনে পড়ছে—একটা সাদা কালো আয়তাকারের সাইনবোর্ড, তাতে বড় বড় করে লেখা ছিল --‘ শ্রীরাম সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়। নীচে ব্র্যাকেটের মধ্যে ছোট হরফে ‘গন্ধর্ব সঙ্গীত অ্যাকাডেমি, মুম্বই দ্বারা অনুমোদিত’। কিন্তু বাড়িটা ঠিক কোথায়? কেন চিনতে পারছি না ?

    শীতের সকাল ন’টা। বুধবার হলেও পথে লোকজন কম। শীতলহর চলছে দু’দিন ধরে। পারা নেমেছে ৬ ডিগ্রিতে। রাস্তাঘাটে হাতে গোণা যে ক’জনকে দেখছি সবাই বাঁদুরে টুপি অথবা শালে মাথামুখ ঢেকে চলছে।

    একটা চায়ের খোমচাওলার সামনে কিছু লোক জমেছে। কাঁচের গেলাসে ধোঁয়াওঠা চা – এই সকালে তার আকর্ষণ এড়ানো কঠিন। আমি গেলাস চেপে ধরে হাত সেঁকতে সেঁকতে বলি—শ্রীরাম সঙ্গীত কলেজটা কোন দিকে?

    চাওয়ালা নির্বিকার মুখে কালচে কাপড়ে দুধে ফোটানো চা ছাঁকতে থাকে। একজন ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখে। তারপর বলে—এ’দিকে তো কোন গানের স্কুল নেই।

    সেকী? টিমোথি স্যারের স্কুল? খুব নাম!

    --এ’পাড়ায় ম্যাথসের কোচিং ক্লাস আছে, ভাবনানী স্যারের। গানের স্কুল ছোটাপাড়ার দিকে হবে।
    --এটা ছোটাপাড়া নয়?
    --আপনি বোধহয় রায়পুরের বাইরে থেকে এসেছেন। এটা আজাদ চৌকের পাশের গলি।
    --তাইতো! বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা, জয়সোয়ালের হাড্ডি দাওয়াখানা? মানে অর্থোপেডিক? সেটা এই দিকে?
    --জাস্ট পাশের গলি।

    আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। হাড্ডি দাওয়াখানার পাশে আমার বন্ধু বোধিসত্ত্বের বাড়ি। আমাকে দেখে ওরা হইহই করে ওঠে।

    অ্যাই, দেবু এসেছে। একরাউন্ড কফি হয়ে যাক। কি ব্যাপার রে? আজ পথ ভুলে নাকি?

    বন্ধুপত্নী ধোঁয়াওঠা কফির সাথে কিছু চিপস এনেছেন।

    তারপর? একা এসেছেন যে বড়! অণিমাকে নিয়ে জোড়ে আসুন, আগামী সপ্তাহে? ভাত খেয়ে যেতে হবে কিন্তু।

    বোধি এবার ঘন হয়ে আসে। নীচু গলায় বলে—তোর কী হয়েছে বল দিকি, দেবু? কোন সমস্যা? টাকাপয়সা? ডাক্তার?

    আমি হাত নেড়ে আশ্বস্ত করি । তারপর ওইরকম নীচু গলায় বলি –টিমোথী স্যারের মিউজিক স্কুল, তোর বাড়ির কাছে ছিল না?

    ও অবাক। সেতো অনেক আগের কথা । আমরা যখন ছোটাপাড়ার দিকে ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। বাড়ি করে এ’পাড়ায় উঠে এসেছি প্রায় বছর পনের হল।

    ও হ্যাঁ, তাই তো। আমারই ভুল, আজকাল বড্ড ভুল হয় ।

    সেতো রিটায়ার করার পর সবারই একই দশা। আপনার বন্ধু এ’মাসে কালীবাড়িতে দু’বার চাঁদা দিয়ে এসেছেন।  ব্যাংকের লোকদের ভুলে যাওয়ার রোগ খুব কমন।

    --মানে ডেটা নিয়ে কাজ করতে করতে আপনাদের ব্রেনের হার্ডডিস্ক র‍্যাম সব জ্যাম হয়ে যায়।

    ছোটভাই বাচ্চুর কথায় সবাই হেসে ওঠে। বোধি চোখ পাকিয়ে বাচ্চুকে বলে –তুই তো এখন আড্ডা মারতে বেরোবি? ওদিকেই তো যাবি। দেবুকে শ্রীরাম সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে যাস।

    আমি লজ্জা পাই; মানা করি। একটা রিকশ ডেকে দিলেই হবে।

    বাচ্চু বলে—কাহে শর্মাতে হো দেবুদা? একটু বোস, আমি তৈরি হয়ে আসি।

    বোধির চোখ ছোট হয়। কী কেস? ভর্তির ফর্ম নিবি? তোর জন্যে ?

    কী সর্বনাশ! ও জানল কী করে? আমতা আমতা করি। হ্যাঁ, মানে না, ওই টিমোথি স্যারের কাছে।  মানে ওই ভায়োলিন--।

    আমি চুপ করে যাই।

    তোর পাগলামিটা এখনও যায়নি দেখছি।  ঠিক আছে যা; ফর্ম নিয়ে আয় । আগামী সপ্তাহে অণিমাকে নিয়ে দুপুরে আসিস কিন্তু।  সদরবাজারের একটা দোকানে যা প্যায়রা-পুটু (মাশরুম) পাওয়া যায় না, আর বটেরের মাংস।

    বাচ্চু স্কুটার চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করে। যদি আমার তাড়াতাড়ি কাজ মিটে যায় তাহলে আমায় বাড়ি অব্দি এগিয়ে দেবে কি?  আমি মাথা নাড়ি।

    হ্যাঁ, সেই  লালচে ইঁটের পুরনো বাড়ি বটে, কিন্তু নতুন রঙ করা হয়েছে। সাইনবোর্ডটাও নতুন। অনেক ছাত্রছাত্রী; কলকল করে ঢুকছে বেরোচ্ছে। নোটিশ বোর্ডের সামনে ভিড় করছে। বুড়ো ক্যাশিয়ারকে খেপাচ্ছে। আমি সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি—একটু টিমোথি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

    ওরা আমাকে পা থেকে মাথা অব্দি জরিপ করে। একটু পরে একজন এসে জানায় যে উনি একটা মীটিঙে আছেন। আধঘন্টা বসতে হবে। আমি লম্বা বেঞ্চের এককোণে বসে পড়ি।

    বসন্ত টিমোথি। ভায়োলিনের জাদুকর।  হিন্দুস্থানি ও ওয়েস্টার্ণ – দুটোতেই সমান দক্ষতা। সেবার সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চের একশ’ বছর হল। কেরালা থেকে কয়্যার এল, তারপর ছত্তিশগড়ের থেকে একা টিমোথি স্যারের ভায়োলিন। আমরা গর্বিত। কাকে বলে চেম্বার কঞ্চার্টো, আর কোনটা সিম্ফনি কিস্যু জানতাম না। বেটোফেন, মোজার্ট, বাখ এসব আমাদের কাছে মাত্র ক’টি নাম। কিন্তু আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। তবে এই ওয়েস্টার্ন ক্ল্যাসিকাল অনেক দূরের স্বর্গলোক , আমাদের এন্ট্রি নেই। শ্রদ্ধা করা যায়, অবাক হওয়া যায়, ভালবাসা যায় না।

    তারপর একদিন। গণেশ উৎসবে বিলাসপুরের রামমন্দিরে উনি এলেন। মহারাষ্ট্র মন্ডল ওঁকে রীতিমত খরচাপাতি দিয়ে রায়পুর থেকে আনিয়েছে। ওঁর প্রোগ্রাম – হিন্দি ফিল্মে রাগসঙ্গীত ।

    সেই রাত্তিরে দুটো ঘন্টা কীভাবে কেটেছিল আমার মনে নেই। উনি একটি একটি রাগ ধরে চলন দেখাচ্ছিলেন এবং কোন ফিল্মের গানে তার প্রয়োগ।  তারপর ভৈরোঁতে কোমল রে এবং ধৈবতের আন্দোলন, মালকোষে কোমল নিষাদ ধৈবত হয়ে মধ্যমে বারবার ফিরে আসা, ইমনের নিরেগামা, দরবারীর কোমল নিষাদ, পঞ্চম ছুঁয়ে কোমল গান্ধার ধীরে ধীরে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।

    আমি গ্রীনরুমে ওনার সঙ্গে দেখা করে  বললাম—শিখতে চাই।

    রায়পুরে আমার মিউজিক স্কুলে এসে দেখা কর।  প্রথম বছর মিশ্র গুরুজির কাছে শিখতে হবে। পরের বছর আমি শেখাব। নিজের ভায়োলিন নিয়ে আসবে।

    একটু দমে গেলাম। ভায়োলিন কিনতে হবে, টাকা কই ?

    কুছ পরোয়া নেহি। নতুন বৌ অণিমাকে লুকিয়ে টিই বিলের পয়সা বাঁচিয়ে টাকা জোগাড় করতে পাঁচমাস লেগে গেল। এক শনিবার ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে রায়পুরের সুরানা ব্রাদার্স থেকে পাঁচ’শো পঞ্চাশ টাকায় কেনা হল ভায়োলিন। ওর গায়ে হাত বুলিয়েই কাঁটা দিচ্ছিল। সন্ধ্যেবেলায় বোধিসত্ত্বের সঙ্গে গিয়ে ভর্তি হলাম। ওর পাড়ার স্কুল, বেশি ফর্মালিটি করতে হল না। একটা স্যাঁতসেঁতে হলঘরে মাটিতে শতরঞ্জি বিছিয়ে হলদেটে বাল্বের আলোয় শুরু হল মিশ্রগুরুজির কাছে প্রাথমিক পাঠ।

    খুব যত্ন করে দেখালেন ভারতীয় পদ্ধতি কীভাবে যন্ত্রটিকে ধরতে হবে, তারগুলো কীভাবে টিউন করতে হবে—মা-সা-পা -সা? নাকি পা-সা-পা-সা? ছড়ে কীভাবে রেজিন ঘষতে হয়, ডানহাতের আঙুলগুলো ছড়ের বাঁটের উপর কীভাবে থাকবে, বাঁহাতের আঙুলের পজিশন, সেতার বা গিটারের মত ফ্রেট নেই, তাই কান দিয়ে স্বর বুঝতে হবে ইত্যাদি।

    প্রাথমিক আরও কিছু পাঠ দিচ্ছিলেন এমন সময় বাধা পড়ল। পাশের একটা ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন বসন্ত টিমোথি স্বয়ং। কিছু সিনিয়র ছেলেমেয়ে কথা বলতে বলতে ওঁর সঙ্গে সঙ্গে চলছে। হলঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় উনি থমকে দাঁড়ালেন। ভুরূ কুঁচকে উঠল । তারপর আমাদের কাছে এসে বললেন—দেখি যন্ত্রটি!

    একবার উলটে পালটে দেখে মিশ্রগুরুজির হাতে ফিরিয়েদিয়ে বললেন—ডিফেক্টিভ পিস; ভাল করে দেখুন। তারগুলো মূল বোর্ড থেকে হাফ ইঞ্চি উঁচু হয়ে আছে,হাওয়াইয়ান গিটারের মত। আসলে লেপ্টে থাকা উচিত বোর্ডের সঙ্গে, স্প্যানিশ গিটারের মত। নইলে আওয়াজ বেরোবে কী করে?

    তারপর আমাকে বললেন—এটা দোকানে ফেরত দাও, ওরা বদলে দেবে । ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্ট। সুরানা ছোকরাকে বলবে টিমোথি স্যার বলেছেন।

    আমি ভ্যাবাচাকা । কোনরকমে থ্যাংক ইউ বলি, ততক্ষণে উনি বেরিয়ে গেছেন।

    ভায়োলিন সুরানা ব্রাদার্স কথা না বাড়িয়ে বদলে দিল। টিউন করে বাজিয়ে দেখিয়েও দিল। হেসে বলল—একসময় টিমোথি স্যারের ছাত্র ছিলাম!

    কিন্তু আমার আর সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে যাওয়া হল না। ব্যাংকের চাকরিতে একের পর এক ট্রান্সফার। তাও ওই বিলাসপুর জেলার বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চে, অনেক ইন্টিরিয়র এলাকায়। আমার পারফরম্যান্স নাকি অ্যাভারেজ!  স্পেশ্যাল কোন ইনিশিয়েটিভ দেখাতে পারিনি। টার্গেট একবারও ১০০% অ্যাচিভ করতে পারিনি। প্রমোশনে আটকে গেলাম।

    আমার চেয়ে আমার বৌ বেশি দুঃখ পেল।

    আমার দুঃখের একটাই কারণ – এত দূরে থেকে টিমোথি স্যারের স্কুলে কী করে যাব? ভায়োলিন শেখার কী হবে?

    অণিমা মুচকি হেসে বললে তোমার মত দীনহীন অভাগারা কী করে? একলব্য হয়ে যায় । সে মুরোদ আছে?

    কোথাও কি মুরোদ শব্দটা আঁতে ঘা দিয়েছিল?

    ঠিক করলাম একলব্য হব। আমার এই ভাল। কিনলাম ‘মাত্র ১৫ দিনে ভায়োলিন শিখুন’।

    আমার ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে হত । শুরুর কয়েকটি মাস ছড় টানার কর্কশ আওয়াজ বাড়ির সবার এবং পড়শির হাসি-তামাশা ও ক্রমশঃ বিরক্তির কারণ হয়ে উঠল । ধীরে ধীরে আমার এই পাগলামি সবার গা-সওয়া হয়ে গেল।

    একদিন বিলাসপুরে জগজিত সিংয়ের গজলের ক্যাসেট কিনতে গিয়ে চোখে পড়ল স্যারের ক্যাসেট। বসন্ত টিমোথির ক্যাসেট। সিরিজ।

    খানিকটা উন্নতি হল বটে। ‘জনগণমন’ মোটামুটি তুলে ফেললাম। একদিন দেখি আমার যন্ত্রে বেজে উঠছে “ আলো আমার আলো ওগো” । আমাকে আর পায় কে! অণিমার চোখেও প্রশংসা। কিন্তু দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? আমি যে লম্বা মীড়ের গান বাজাতে চাই। একটু গমক দেওয়া শিখতে চাই, যেমন ‘হৃদয়বাসনা আজি মম পূর্ণ হল” বা “চোখের জলের লাগলো জোয়ার” । আমাকে যেতেই হবে টিমোথি স্যারের কাছে।

    চেষ্টা করলাম রায়পুরে ট্রান্সফারের, বন্ধুরা ভরসা জুগিয়েছিল, বন্ধু বোধিসত্ত্ব তখন আমাদের পার্সোনাল ম্যানেজার;   — কিন্তু হল না।

    পরে জানতে পারলাম আমার স্ত্রী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে কিছু কলকাঠি নেড়েছিলেন। ওদের বুঝিয়েছিলেন যে ওই ট্রান্সফার হলে আমার ভায়োলিন নিয়ে পাগলামি মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে । ওনার সংসার ভেসে যাবে । এমনিতেই আমি একটু আলাভোলা টাইপের, হয়তো ব্যাংকের হিসেবনিকেশেও কিছু গন্ডগোল করে ফেলব। অতএব আমার এবং সবার ভালোর জন্যেই এ’ধরণের ট্রান্সফার হওয়া উচিৎ নয় । ফলে আমায় গাছে তুলে পরে মই কেড়ে নেয়া হল।

    তারপর আমাকে একদিন অণিমা ডঃ গুপ্তার চেম্বারে নিয়ে গেল । উনি গিন্নিকে বাইরের কামরায় অপেক্ষা করতে বলে আমাকে একটা অল্প আলোর ঘরে বসিয়ে আমার সঙ্গে অনেক গল্প করলেন।

    ফেরার পথে আমি অণিমাকে জিজ্ঞেস করলাম – আমার কী হয়েছে?

    --কিছু না । বয়স হচ্ছে, তুমি আজকাল কিছু কিছু জিনিস ভুলে যাচ্ছ। এই ট্যাবলেট রোজ একটা করে খেলে তোমার স্মৃতিশক্তি আগের মত হয়ে যাবে।

    আমি সেদিন থেকে নিয়ম করে রোজ ট্যাবলেট খাচ্ছি। সকালে থাইরয়েডের, রাত্তিরে ওটা।এসব নাকি এখন বেশ কিছুদিন চলবে।

    কয়েক বছর হয়ে গেছে। রিটায়ার করেছি। ব্যাংকের কাজে কোন গন্ডগোল হয়নি। চাকরি শেষের মুখে একটা প্রমোশনও হয়েছে। একটি মাত্র মেয়ে, তার ভালভাবে বিয়ে হয়ে গেছে। আমি ঝাড়া হাত-পা। গিন্নিকে রাজি করিয়ে রায়পুরে একটা দু’কামরার বাড়ি ভাড়া করেছি।

    আমার এখন্ সবই মনে থাকে। এমনকি ওষুধ খেতে কোন ভুল হয়না। সকালে খালিপেটে থায়রয়েড, রাত্তিরে ভরা পেটে ডাক্তার গুপ্তা।

    চটকা ভেঙে গেল। চাপরাশি এসে আমায় বলছে ওর সঙ্গে যেতে, টিমোথি স্যার দেখা করবেন। আমি উত্তেজনায় কেঁপে উঠি। এ্যাট লাস্ট!

    কিন্তু প্রিন্সিপাল কাম ডায়রেক্টর টিমোথি স্যারের কামরায় ঢুকে অবাক হই। মেজেতে দামি কার্পেট, গদি আঁটা চেয়ার, সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উলটো দিকে  দামি চশমা চোখে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে বসে থাকা স্যুট পরা ভদ্রলোকটিকে তো চিনতে পারলাম না।

    --বোলিয়ে?
    --্টিমোথি স্যারসে মিলনা চাহতা হুঁ।
    -- জী হাঁ; ম্যায় হুঁ অ্যালেক্স টিমোথি।বাতাইয়ে আপকা ক্যা সেবা করুঁ?
    -- আচ্ছা, ম্যাঁয় বসন্ত টিমোথি স্যারসে মিলনা চাহতা হুঁ; মতলব উনসে ভায়োলিন শিখনা চাহতা হুঁ। শাস্ত্রীয়।

    ভদ্রলোকের ভুরূ কুঁচকে যায়।

    --পর উয়ো তো সম্ভব নহীঁ।
    --কিউঁ ? স্যার আজ নহীঁ আয়েঙ্গে ক্যা?

    ভদ্রলোক রিভল্ভিং চেয়ার ঘুরিয়ে পেছনে ম্যান্টলপীসের দিকে ইশারা করে। সেখানে ফ্রেমবন্দী হয়ে বসন্ত টিমোথী আমার দিকে মুচকি হাসছেন।

    --বহোত দুখ কে সাথ বতানা পড় রহা হ্যায় কি বাবুজী হমেঁ ছোড় কর চলে গয়ে, হেভেনলি অ্যাবোড মেঁ। তিন সাল পহলে।

    উত্তেজনায় আমার গলার স্বর ভেঙে যায়।

    এটা কী করে সম্ভব? কালকেই তো রাত্তিরে ওনার সঙ্গে কথা বলেছি। উনিই তো আজ এসে ফর্ম নিয়ে যেতে বললেন। এও  বললেন যে গ্রুপে বসে শিখলে মাসে ২০০ টাকা, আর ওনার কাছে আলাদা করে একা শিখলে ১০০০ টাকা। আমি তো টাকাপয়সা সঙ্গে নিয়েই এসেছি।

    নাঃ; আমার ভুল হতে পারেনা। কথা বলেছি ওই ওষুধটা খাওয়ার পর ।

    অ্যালেক্স টিমোথি উঠে এসে আমাকে যত্ন করে চেয়ারে বসিয়ে জলের গেলাস এগিয়ে দেন। চাপরাশিকে বলেন বড়বাবুকে বল একটা ফর্ম নিয়ে এখানে আসতে ।

    বলেন—বাবুজি আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন তো ! আপনি ভর্তি হয়ে যান, সবার সঙ্গে। অবস্থী গুরুজির ক্লাসে।  ক্লাস শেষ হলে আমি আপনাকে পনের মিনিট এক্সট্রা শেখাব , না, কোন এক্সট্রা চার্জ নেব না । ওই ২০০ টাকাই দেবেন, বাবুজি যখন বলেছেন!

    ফর্ম এসে গেছে। বড়বাবুর নির্দেশ অনুযায়ী আমি যন্ত্রের মত ফিল আপ করি, উনি যেখানে যেখানে আঙুল রাখেন সেখানে সাইন করি । টাকাটা গুণে নিয়ে ডাকটিকিটের সাইজের ফটো দুটো চিপকাতে চিপকাতে হঠাৎ চমকে উঠে আমার দিকে চোখ ছোট করে দেখলেন।

    --আপ দেবেশ দত্তাজি? পিছলে সাল ভী আয়ে থে না ? ফর্ম ভরকে চলে গয়ে থে, ফির কভী ন আয়ে । আখির বাত ক্যা হ্যায়? কোই নারাজী?

    আমি? এসেছিলাম? গত বছর? কই , নাতো?

    দাঁড়ান, আমি রেজিস্টারটা নিয়ে আসছি।

    অ্যালেক্স টিমোথী আমাকে একদৃষ্টিতে দেখছেন।

    এই দেখুন স্যার,  গতবছর কেন , উনি পরপর দু’বছর ভর্তি হয়ে আর আসেননি। কিসের যে রাগ কে জানে !

    --কী ব্যাপার বলুন তো? যদি আসতে ইচ্ছে না করে আসবেন না, আপনার মর্জি। কিন্তু ফর্ম নষ্ট করবেন না ।

    প্রিন্সিপাল অ্যালেক্স স্যারের গলার স্বরে যুগপৎ বিস্ময় ও বিরক্তি।

    আমি ভর্তির রসীদ ও আইডি কার্ড হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরি এবং চটপট উঠে পড়ি।

    --না, না। কোন ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। আসবো, পাক্কি বাত, আসবো—কসম সে!

    রাস্তায় নেমে রিকশা নিই না। বেলা বেড়েছে, রোদ উঠে শীতটা তেমন বোধ হচ্ছে না।

    আমি হাঁটতে থাকি। একবার গরম ফুটন্ত চা খেলে কেমন হয়? ডিসিশনটা নিতে পেরে বুকটা হালকা লাগছে।

    তারিয়ে তারিয়ে চা খাই, ভালোলাগাটা যেন ঠোঁট জিভ ছাপিয়ে গলা বেয়ে ভেতরে নামছে। শেষ করে খালি ভাঁড়টা পাশের ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলি। তারসঙ্গে ফেলে দিই সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির রসীদ ও আইডি কার্ড।

    কথা যখন দিয়েছি আমাকে টিমোথি স্যারের সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে যেতেই হবে। হ্যাঁ, আমি আসব, আবার আগামী বছর, ভরতির সময়ে। তারপরের বছর। তারও পরে ।
    ====================================================
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শিবাংশু | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১০:৩৫732758
  • ভালো লাগলো...

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন