এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • যীশু, বাবু জন ও কয়েকটি অনন্য অভিজ্ঞতা

    পারমিতা চট্টোপাধ্যায়
    আলোচনা | বিবিধ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ | ৮৫৭ বার পঠিত
  • আমার ধার্মিক জেঠুর কড়া পাহারায় ভাই বোনেরা সন্ধ্যেবেলায় নাম করতে বসতাম। সার সার বসে আমরা হাতজোড় করে গাইতাম "অপরূপ সে গুরু রূপ....'। চোখ বন্ধ করে অপরূপ সেই কোনো এক মুখ মনে করার সময় ভেসে উঠতো শুধু একজনেরই মুখ। জ্বলন্ত অথচ শান্ত মুখ ,চোখে কি অদ্ভুত মায়া, কোঁকড়া চুলের রাশ কাঁধের ওপর , দু হাত আড়াআড়ি করে রাখা সাদা আলখাল্লায় ঢাকা চওড়া বুকের ওপর। মাথার পেছনে সুর্য্যের ছটা। যীশুর এই অনন্যসুন্দর ছবিটি জেঠুর শোবার ঘরের দেওয়ালেই টাঙ্গানো ছিল।
    সেই শুরু।

    কলেজে পড়তে এসে দেখলাম আবার সেই ছবি। জেঠুর শোবার ঘর থেকে প্রায় সতেরোশো কিলোমিটার দুরে। সেই দুর চেন্নাই এ। অবশ্য ঠিক চেন্নাই ও নয়।চেন্নাই থেকে বাসে গেলে এই ঘন্টা খানেক।
    ছবির সমনে এক দল ছাত্র-ছাত্রী অদ্ভুত সুরেলা গলায় গাইছে
    " সিং হ্যালেলুইয়া টু দ্য লর্ড
    জিসাস ইজ কামিং ব্যাক এগেন........'
    সাথে অর্গ্যানের গম্ভীর শব্দ। মন্ত্রমুগ্ধের মতন দাঁড়িয়ে গেলাম। গান শেষ হতে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে ভেতরে নিয়ে গেলেন। বললেন ক্রিস্টান মাইনরিটি কলেজ বলে প্রতি বুধবার হয় প্রেয়ার মিটিং। যখন জানলেন আমার খুব ভালো লেগেছে আর আমি একটু আধটু গান গাই, খুব খুশি ভদ্রলোক। সবাইকে ডেকে বললেন আজ থেকে আমিও নাকি কয়ারের অংশ। ছুটে গিয়ে প্রিন্ট আউট নিয়ে এলেন সব গানের। দিলেন একটা ক্যাসেটও। আসার আগে বললেন বুধবার আমি যেন ঠিক আসি। কথা দিলাম। জানলাম ওনার নাম বাবু জন। আমাদের কলেজেরই কেমিস্ট্রির প্রফেসর।

    পরের বুধবার তৈরী হচ্ছি যাবো বলে , আমার বৌদ্ধ রুমমেট দুমদুম করে রুমে ঢুকে বলে "ইয়ার্কি হচ্ছে? ফার্স্ট ইয়ারে প্রেয়ার মিটিং কম্পালসারি বললেই হয়'। ওমা কম্পালসারি হবে কেন। আমার ইচ্ছে আমি তাই যাচ্ছি। কমলা বোঝায় ওয়ার্ডেন প্রিয়দর্শনী ম্যাডাম সব্বাইকে ডেকে বলেছে যেতেই হবে। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছিল। বেরিয়ে গেলাম।
    প্রথমে প্রেয়ার। বাবু জন ডায়াসের ওপরে। একধারে কয়ারের লোকজন। বাকিরা সামনে বেঞ্চে। দেখলাম সমস্ত ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা গোমড়া মুখে এক কোনে বসে। বাবু জন প্রেয়ার বলেই যাচ্ছেন, দুহাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে " জীসাস ইজ দ্য ওনলি লর্ড। হালেলুয়া। প্রেজ দ্য লর্ড'। চোখ দিয়ে দরদর জল। সবাই চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে কিছু ,শুধু ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা এদিক ওদিক তাকায়। এর পর শুরু হল গান । আহা। গাইছি আমরা সবাই "সাইলেন্ট নাইট.......... হোলি নাইট ........'। হল ভরে যাচ্ছে সুরে। আমাদের রিনরিনে গলা আর অর্গ্যান। বাবু জন তখোনো যন্ত্রের মত বলে চলেছেন "হ্যালেলুইয়া হ্যালেলুইয়া.......... জীসাস ইজ দ্য ওনলি লর্ড.....সাবমিট ইওরসেল্ফ টু দ্য লর্ড.... ইউ উইল বি সেভড....... হ্যালেলুইয়া হ্যালেলুইয়া.... '। গান শেষ। আমি বুকে তখোনো বাজছে সাইলেন্ট নাইট। ধীরপায়ে হস্টেলে ফিরি, মন ভারী , চোখে জল। কয়ারের বাকী ছেলেমেয়েরা দেখি ইয়ার্কিতে মেতেছে। ওদের কি আমার মত লাগছে না ? ভারী মন ? চোখে জল?

    রবিবার রাত। প্রিয়দর্শিনী ম্যাডাম নিজের রুমে ডেকেছেন সব ভক্তিমতী ক্রিস্টানদের আর সমস্ত ফার্স্ট ইয়ার মেয়েদের। কম্পালসারি। আবার প্রেয়ার। প্রিয়া ম্যাম দুলে দুলে প্রে করছেন।" জীসাস ইজ দ্য ওনলি লর্ড... প্রেজ দ্য লর্ড....জীসাস লিসেন্স টু ইউ, ইফ ইউ হ্যাভ অ্যান এক্স্যাম কামিং আপ , প্রে টু দ্য লর্ড। হি উইল শো ইউ দ্য কোয়েশ্চেন পেপার। ইফ ইউ হ্যাভ অলরেডি রিটেন অ্যান এক্স্যাম অ্যান্ড ডিন্ট ডু ভেরি ওয়েল। প্রে টু দ্য লর্ড। হি উইল মেক ইউ পাস।"
    আমি চমকে যাই।

    কাল ফিজিক্স প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা। আমার ভক্তিমতী রুমমেট পড়তে বসেছে। প্রথমেই বাইবেল বের করে পড়ে নিল কপাতা। তারপর দেখি পড়া শুরু। চল্লিশ মিনিটেই পড়া শেষ। হয়ে গেল শীনা ? এগারোটা এক্সপেরিমেন্ট ? শীনার ঝটপট জবাব , "সবগুলো তো পড়ি নি, প্রে করে নিয়ে তিনতে পড়লাম, জীসাস ঐ তিনটের মধ্যেই দেওয়াবেন'। পরদিন শীনা হস্টেলে ফিরলো ছুটতে ছুটতে "প্রেজ দ্য লর্ড , আমি দু নম্বরটাই পেয়েছি,মির‌্যাকল"।
    তার ঠিক তিন বছর পর শীনা যখন কলেজ শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে , শীনার তখন সতেরোটা এরিয়ার। শেষ খবর পেয়েছি শীনার বিয়ে হয়ে গেছে দুবাই য়ের এক ব্যবসায়ীর সাথে, ও আর ইঞ্জিনীয়ার হতে পরে নি।

    রবিবার সন্ধ্যেতে প্রিয়া ম্যামের রুমে প্রেয়ার মিটিং আবার। আজকে প্রিয়া ম্যাম গল্প বলছেন। দুই পরিবার , প্রথম জীসাসে উৎসর্গিত প্রাণ আর দ্বিতীয় বাইবেলটুকুও পড়ে না নিয়ম করে। ক দিনেই প্রথম বাড়ির ছেলের বিদেশে চাকরি , মেয়ের ভালো বিয়ে ইত্যাদি উন্নতি। দ্বিতীয় বাড়িতে তখন শোকের ছায়া , ছেলে মারা গেছে কার ক্র্যাশে আর মেয়ের নাকি ক্যানসার। জিগ্গেস করে উঠি "ভগবান কি এতই নিষ্ঠুর'। উত্তর এতে ভগবানের কিছুই করার নেই , এ শুধু পাপের ফল। সিন সিন। ম্যাম বলেই চলেন , তিনি নিজে হিন্দু বাড়ির মেয়ে। কনভার্ট করার পরেই তাঁর জীবন ভরে ওঠে, বিয়ে , চাকরি , বাচ্চা, "প্রেজ দ্য লর্ড '। আমি মাঝপথেই ধীরপায়ে বেরিয়ে আসি। ম্যামের জ্বলন্ত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই। রবিবার সন্ধ্যেটা এরপর থেকে বন্ধুদের সাথে গল্প করেই কাটে।

    বুধবার কিন্তু যাই।
    বাবু জনের দুলে দুলে প্রেয়ার আর আমাদের গান -
    "এভরি সিঙ্গল সেল অফ মাই বডি ইজ হ্যাপি
    এভরি সিঙ্গল সেল অফ মাই বডি ইজ ফাইন
    আই থ্যাংক ইউ লর্ড
    আই ফীল সো গুড
    এভরি সিঙ্গল সেল অফ মাই বডি ইজ ফাইন'।
    আমরা সবাই তালি দিয়ে তালে তালে নাচি। বাবু জন হাসেন। শুধু দেখি ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা কেউ আসে না আর।

    একদিন দুপুরে বাবু জন ডাকলেন আমায় ওনার রুমে।আমি কয়ারের লীড সিঙ্গার হব , তাই নতুন গান শেখাবেন -
    "হ্যাভ ইউ বীন টু জীসাস ফর দ্য ল্কেন্সিং পাউয়ার
    আর ইউ ওয়াশড
    ইন দ্য ব্ল্যাড
    ইন দ্য সোল-ক্লেনজিং ব্ল্যাড অফ দ্য ল্যাম্ব
    আর ইওর গারমেন্টস স্পটলেস্‌স
    আর দে হোয়াইট অয়াজ স্নো
    আর ইউ ওয়াশড ইন দ্য ব্ল্যাড অফ দ্য ল্যাম্ব'
    আমি শিখে নি চটপট। এর পর কোল্ড ড্রিংক অফার করে পাড়লেন আসল কথাটা। আমি যদি কনভার্ট করি তাহলে উনি আমার বাবা-মার সাথে কথা বলবেন। আমি চেয়ারে বসে থাকি হতভম্ব হয়ে , আর ভেতরে কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠে রাগ। ইচ্ছে হয় খুব কড়া একটা কিছু করি বা বলি। ঠিক পারি না বোধহয়। কিছু বলি , অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য। বেরিয়ে যেতে যেতে শুনি বাবু জন বলছেন পেছন থেকে যে উনি আমাকে ফেল করিয়ে দিতে পারেন। আমি থামি না। বাবু জন আরো রেগে যান। উনি আমাকে বুঝিয়ে দেবেন উনি কে। আরো বলেন , ততক্ষণে আমি কলেজের মাঠ দিয়ে দ্রুত হাঁটছি। যতদুরে যেতে পারি।

    বুধবার কিন্তু প্রেয়ার মিটিং চলতেই থাকে। আসে এক দল ছেলেমেয়ে। সব ভক্তরা। কলেজের অন্য ছেলেমেয়েরা ওদের দেখে হাসে। ব্যাঙ্গ করে বলে প্রেজ-দ্য-লর্ড প্রেজ-দ্য-লর্ড। আমি এখন এদেরই দলে। আমিও হাসি। বুধবার দুপুরে হলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনি "হিন্দুস হ্যাজ টু গো টু টেম্‌প্‌ল টু সি দেয়ার গড, আওয়ার গড ইজ এভরিহোয়ার , যেখানেই তাকাবে তুমি জীসাসকে সেখানেই দেখবে"। আমি মনে মনে বলি "জাঁহা জঁহা নেত্র পড়ে তঁহা তঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে' আর হাসি। সব বোকারাই একরকম করে ভাবে।
    এর মধ্যেই আমার মালয়ালী বন্ধু সুজান দিনরাত কাঁদে। তার প্রেমিকের সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। সুজান মারতোমাইট আর অ্যাব্রাহাম ক্যাথোলিক। অন্য ডিনোমিনেশান। দুই বাড়িতেই প্রচন্ড আপত্তি।সুজানকে দেখে অন্য মেয়েরা পাঠ নেয়। জেকোবাইট মেয়ে জেকোবাইট ছেলে খোঁজে আর পেন্টিকোস্টাল মেয়ে পেন্টিকোস্টাল।

    আমি সেকন্ড ইয়ার পেরিয়ে থার্ড ইয়ারে উঠি। বুধবারের প্রেয়ারও চলে। প্রতি বছর ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেমেয়েরা দলে দলে আসে তারপার আবার সেই শুধু প্রেজ-দ্য-লর্ড ক্রাউড। বাবু জন আমার পড়াশুনায় অসুবিধা সৃষ্টি করতেই থাকেন। আমার নামে কুৎসা রটাতেই থাকেন। আমি নি:শব্দে অগ্রাহ্য করি। এরই মধ্য জ্যোতি সেরা পিল্লাই ভর্তি হয় কলেজে। তার অনেক দোষ। ছেলে বন্ধু অনেক , জিন্স ছাড়া পরে না , আর হাফ ক্রিস্টান হওয়া সত্তেও প্রেয়ার মিটিং মুখো হয় না। বাবু জন ওকে ডেকে বোঝান। জ্যোতি সটান বেরিয়ে আসে। বাবু জন জ্যোতিকে কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায় ফেল করান। জ্যোতির বাবা আবার প্রিন্সিকে চিনতেন। অনেক জল ঘোলা হয়। স্ক্রুটিনিতে জ্যোতি পাশ করে যায়। ওর মুখটা ঝলমল করে। আমারও। আরও অনেকের। যাদের বাবারা প্রিন্সিকে চেনে না , তাদেরও।

    আমি হস্টেলের রিপ্রেসেন্টেটিভ হয়ে বড় করে দিওয়ালী সেলিব্রেট করি। দিল্লীর মেয়েরা মন্দিরে যায়। আমার মন্দির ভালো লাগে না। বড় ভীড়। বড় লাউড। ওরা ফিরে এলে আমি প্রসাদ বাঁটি হস্টেলে। ক্রিস্টান ভক্তরা হাতে প্রসাদ নিয়ে ফেলে দেয়।
    আমরা হোলি খেলি হস্টেলে। সারারাত কাঠের আগুন জ্বালিয়ে আন্তাক্ষরী আর সকালে সবাই একে অপরকে রং মাখাই। দুই একজন ভক্ত খেলতে চায় , অন্যরা শক্ত হাতে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়।
    আমার পরম বন্ধু একদিন খুব সেজে-গুজে ডেটে যেতে তৈরী হয়। কেমন দেখাচ্ছে জিগ্গেস করে। বেশ দেখায় ওকে। পুতুলের মত চেহারায় গাড় লাল সালোয়ার। কি যেন একটা নেই , আমি একটা ছোট্টো টিপ এনে পরিয়ে দিই ওর কপালে। ছিটকে সরে যায়। টিপ ফেলে দিয়ে কপাল ঘসে। দমচাপা রাগ মুখে " জানো না , আমাদের কপালে ক্রস দিয়ে ব্যাপটাইজড করে , জানো না ওতা হোলি জায়্‌গা। টিপ শুধু শয়্‌তানের পুজারীরা পরে , আসল ক্রিস্টানরা নয়'। হাত ধরে মাপ চেয়ে নিই। সত্যিই জানতাম না। বড় ভুল হয়ে যায় আমার। বারবার।

    এর মধ্যেই আবার দু এক ভক্ত " saved ' হয়ে যায়।যীশু স্বয়ং স্বপ্নে এসে তাদের সাথে কথা বলে তাদের জীবন ধন্য করে যান।সেভ করে যান।তারা তাই টিভি দেখা বন্ধ করে দেয়, গান শোনাও।লবিতে টিভি চললে তারা উল্টোদিকে মুখ করে বসে বাইবেল পড়ে। তারপর একদিন কার একটা রুমে দেখি দরজা-জানলা বন্ধ করে তারা সবাই কম্পিউটারে সিনেমা দেখছে - বেসিক ইন্সটিংক্ট।

    এমনি করেই একদিন কলেজের ফেস্টের সময় হয়ে আসে। এবারে স্পেশাল রক শো। পরিক্রমার রক শো। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে।শুরুতে অনেক বাধা।রক গান তো শয়্‌তানের পুজারীরা গায়। কলেজে তা হতে দেওয়া চলে না। বাবু জনের আর্জি প্রিন্সিপ্যালের কাছে। আমরা কালচারাল কমিটির ছেলেমেয়েরা গিয়ে প্রিন্সিকে বোঝাই। রক শো হবেই। আমরা উদ্দাম আনন্দ করি।ফেস্টের সন্ধ্যেতে দেখা গেল ভাড়া করে আনা সাউন্ড সিস্টেম কাজ কারছে না।নটা বেজে গেছে। পরিক্রমার ছেলেরা এসে অপেক্ষা করে ক্লান্ত। কিছুতেই ঠিক করা যাচ্চে না।আমরা চিন্তিত। দর্শক অধৈর্য্য।আমি ছুটি একটা কারোর গাড়ি জোগাড় করার জন্যে। সিটিতে গিয়ে নতুন সিস্টেম আনাতে হবে। বাস্কেটবল কোর্টের মধ্যে দেখি অন্ধকারে একদল ছেলেমেয়ে আর চেনা সুর।" স্টপ দ্য রক শো লর্ড,দে আর এগেনস্ট ইউ, ডু অ মির‌্যাকল এগেন, হ্যালেলুইয়া হ্যালেলুইয়া"। আমি ছুটতে ছুটতে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। পেছন থেকে জীতেশ , জিনি রা তাড়া দেয়।প্রিন্সি খবর পেয়ে সিকুইরিটি পাঠিয়ে বাস্কেটবল কোর্টের কীটগুলোকে তাড়ায়। এদিকে শুনতে পাই , সিস্টেম ঠিক হয়ে গেছে। শো শুরু হল বলে।
    আমরা আবার এরিনায়। গানের সুরে মাতাল আমরা।আমার প্রিয় গান - "আই হ্যাভ বিকাম , কম্ফর্টেবলি নাম্ব"।
    পরেরদিন কলেজের আকাশে-বাতাসে ফিসফাস শুনতে পাই "প্রেয়ারের কত জোর দেখলে , যতক্ষণ প্রেয়ার চলেছে ততক্ষণ সিস্টেম কাজই করে নি। প্রেয়ার মেকস এভরিথিং হ্যাপেন। জীসাস মেকস এভরিথিং হ্যাপেন"।
    আমি আগের দিনের টাটকা শোনা শয়তানের গান গুনগুন করে কলেজে ঘুরে বেড়াই "আই হ্যাভ বিকাম , কম্ফর্টেবলি নাম্ব"।

    হঠাৎ একদিন বাবু জন আমাকে ডেকে পাঠান। প্রিন্সি নাকি আমাকে ডেকেছেন। আমি প্রিন্সির কেবিনে ঢুকতেই প্রিন্সি অবাক "আরে বাবু তোমার কথা বলছিল নাকি। তোমাকে তো আমি ভালো চিনি। তুমি কস্তুরবার হস্টেল রিপ্রেসেনটেটিভ না। ক মাস আগে কি ঝগড়া করে পাঁচটা নতুন জলের ফিল্টার আর দুটো ফ্রিজ আদায় করলে ডিরেক্টরের কাছ থেকে তুমি"। প্রিন্সি মিষ্টি হাসেন। চেয়ারে বসে বাবু জন অধৈর্য্য হন। "স্যার কমপ্লেনের কথাটা"।
    প্রিন্সি গলা ঝেড়ে শুরু করেন আবার " মিস্টার জন বলছিলেন তুমি নাকি আজকাল পড়াশুনা সেরকম করছ না। ক্লাশও অ্যাটেন্ড কর না"।
    "আমার অ্যাটেন্ডেন্স তো ৮৫% স্যার। আর লাস্ট সেম এ ক®¾ট্রাল সিস্টেম এ চেন্নই ইউনিভারসিটিতে সেকেন্ড। আপনি আমার ক্লাশ টিচারকে ফোনে কথা বলে ভেরিফাই করে নিতে পারেন স্যার"।
    প্রিন্সি এবারে বাবু জনের দিকে তাকান। চোখে জিজ্ঞাসা।
    এই বার বাবু জন গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন " ৮৫% ?? বাকী ১৫% কি কর ? ক্যান্টিনে বসে ছেলেদের সাথে নোংরামি? আমি তোমাকে নিজে দেখেছি স্যভিওর মাথায় গাট্টা মারতে। ইউ নো , ইফ এ ম্যান টাচেস অ উওম্যান , শি লুসেস হার ডিগনিটি দেন অ্যান্ড দেয়ার ?"।
    আমি ততদিনে শিখে গেছি হজম করতে। আমি প্রিন্সির দিকে তাকাই " এই কমপ্লেনের জন্যে ডেকেছিলেন স্যার?'
    প্রিন্সি যেন পাথর। " এ আপনি কি বলছেন মিস্টার জন। তুমি যাও । তোমার বিরুদ্ধে কোনো কমপ্লেন নেই আমার , টেক কেয়ার মাই চাইল্ড । বাবু জন আপনি ও আসুন'।
    আমরা একসাথেই বেরিয়ে আসি। বাবু জন আমার কানে হিসহিসিয়ে গরম সীসা ঢেলে দিতেই থাকেন। আমি পুড়ি না। আমার প্রিয় বন্ধুরা প্রিন্সির কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে , উৎকন্ঠিত। আমি হাসতেই যেন সব বুঝে যায়। স্যাভিও দৌড়ে আসে। হাই ফাইভ দেবার জন্য ডানহাতটা তোলা। আমি বাবু জনের চোখে চোখ রেখে আমার প্রিয় বন্ধুর হাতে রাখি হাত।

    আমাদের ফোর্থ ইয়ার।
    আর কটা দিন। প্রজেক্ট জমা দিয়েই মুক্তি। কলেজ শেষ। আমরা বন্ধুরা প্ল্যান করি একসাথে বেড়াতে যাবার প্ল্যান, কেরিয়ারের প্ল্যান , নিজের পছন্দের মানুষ-মানুষীকে নিয়ে ঘর বাঁধার প্ল্যান। আরো প্ল্যান হয় , শেষ দিনে সবাই বাবু জনের রুমে ঢুকে কিভাবে তাকে মাঝের আঙ্গুল দেখিয়ে আসবো। সাথে যাবার লোকের সংখ্যা বেড়েই যায়।

    বাবু জন ইস্তফা দিয়েছেন। আমরা খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে হন্যে হয়ে বাবু জনকে খুঁজি। প্রতিটি রুমে , প্রতিটি কোণে।মাঝের আঙ্গুল দেখাবো বলে। পাই না কোত্থাও।

    সেই থেকে খুঁজেই চলেছি। আমরা সবাই। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। আজও।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৬ | ৮৫৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন