বুকের ভিতর ধাঁইধপাধপ, আসছে আবার আটটা
আবার ব্যাটা ভাষণ দেবে, মারবে আবার গাঁট্টা।
সকাল থেকেই জল্পনার শেষ নেই। গতবার ভাষণে নিয়েছিলেন নোট, এবার কী নেবেন? কেউ বলছিলেন, গোট, অর্থাৎ কিনা পাঁঠার মাংস। নোটের বদলে এবার বাজারের সব আমিষ বাতিল করে দেওয়া হবে, বাঙালি বুড়ো আঙুল চুষে মরবে। কেউ বলছেন, গতবার ক্যাশ টাকা নিয়েছিল, এবার কি তাহলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে হাত দেবে? কেউ ফ্রিজে পাঁঠার মাংস জমিয়ে রাখার নিদান দিচ্ছেন, কেউ আরও সাবধানী। এবার কোথায় লাইন দিতে হবে, জানা নেই, তাই ত্রিপল, টর্চ, মশারি সবই জোগাড় করে সুটকেসে পুরে রাখতে বলছেন। কেউ বলছেন, আসাম আর থেকে এবার এক ধাক্কায় সব 'বাংলাদেশী'কে ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই বাজারে খবর পাওয়া গেল, এলাহাবাদের কোনো এক সাধু বলেছেন, টিভিতে মোদী-অর্ণব গোস্বামী -সুধীর চৌধুরি, এ এক অশুভ যোগ, রাত আটটায় ত্র্যহস্পর্শ তৈরি হতে চলেছে, কাটানোর জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ দরকার। বদ্রীনাথের গুহা থেকে আরেক সাধু বলেছেন, যজ্ঞ কোনো লাভ নেই, টিভির নাম এমনিই শনি (sony), ফলে টিভি বর্জন না করে শনির প্রকোপ আটকানোর কোনো উপায় নেই।
এসবই অবশ্য ভিত্তিহীন গুজব, কারণ কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল এত হট্টগোলের কিছু ছিলনা। প্রধানমন্ত্রী ৩৭০ আর কাশ্মীর ছাড়া আর বিশেষ কিছু বললেন না। এবং সবই নির্দোষ সত্য কথা। তাতে অবশ্য রোমাঞ্চ কিছু কম পড়ল তা নয়। মোদীর ৫০ মিনিটের ভাষণ থেকে যা বোঝা গেল, ৩৭০ ধারায় এতদিন আমাদের ভাই বোন বাচ্চা-কাচ্চার খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছিল। এমনকি এতে কার লাভ জিজ্ঞাসা করলে কেউ কিছুই বলতেই পারতনা। বলবে কীকরে? দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, পরিবারতন্ত্র আর বিচ্ছিন্নতাবাদ ছাড়া এই ধারা তো আর কিছুই দেয়নি। এই ধারা দিয়ে একটাই কাজ হয়েছে। পাকিস্তান ৩৭০ কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ভারতের সর্বনাশ করে দিয়েছে। ভারতের সংবিধানের ধারা, কিভাবে পাকিস্তানের অস্ত্র হয়ে গেল সেটা অবশ্য উনি ব্যাখ্যা করেননি। তাতে কোনো দোষ নেই, মিথ্যাচারণও নেই, কারণ, প্রধানমন্ত্রী, টিভি চ্যানেল, আইটি সেল, কেউই কেন ৩৭০, তার কী ইতিহাস-ভূগোল, সেসব খবর রাখে বলে মনে হয়না। '৩৭০ কেন হয়েছিল?' শুনলে আমাদের টিভির বিখ্যাত সঞ্চালকরা হাঁ করে মাথা চুলকে তারপর তারস্বরে পাকিস্তান-পাকিস্তান বলে চেঁচাতে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক।
৩৭০ এ আর কী কী ক্ষতি হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তারও তালিকা দিলেন। কত যে ক্ষতি, না শুনলে বোঝা যেতনা। মূল ক্ষতি এই, যে, সংসদে খুব কষ্ট করে ঘাম-টাম ঝরিয়ে সাংসদরা আইন-টাইন বানান। এত চিন্তাভাবনার ফসল, এত শ্রমের কোনো মূল্য, ভাবা যায়না, জম্মু কাশ্মীরে নেই। ওখানে সেসব আইন প্রযোজ্য হয়না। ভারতবর্ষের নানা অঞ্চলে, নানা জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সব আইন যে সমভাবে প্রযোজ্য হয়না, সে কথা অবশ্য প্রধানমন্ত্রী জানেন বলে মনে হয়না। নাগাল্যান্ড থেকে আসাম, এমনকি গুজরাত-মহারাষ্ট্রের জন্যও নানা বিশেষ ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেসব উল্লেখ না করায় দোষ দেওয়া ঠিক না। কারণ অজ্ঞানতা মানুষকে নিষ্পাপ করে। ফুলের মতো শিশুসুলভ নিষ্পাপ উচ্চারণে কোনো পাপ নেই। সেরকম উচ্চারণেই প্রধানমন্ত্রী জানালেন, কাশ্মীরে শিক্ষার অধিকার নেই, মেয়েদের অধিকার নেই, সাফাই কর্মচারীদের অধিকার নেই, দলিতদের জন্য কোনো আইন নেই, সংখ্যালঘু অধিকার নেই, ন্যূনতম মজুরির বালাই নেই, জাতিগত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তিনি এবার সবকিছুর ব্যবস্থা করে তবেই ছাড়বেন। ওখানে সরকারী কর্মচারী আর পুলিশের এবার সমান সুবিধে মিলবে। রোজগারের বন্যা বয়ে যাবে। পাবলিক প্রাইভেট সেক্টররা চুটিয়ে বিনিয়োগ করবে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী স্কলারশিপ যোজনায় শিক্ষায় বিকাশের প্লাবন হয়ে যাবে।
কিন্তু তা বলে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল কেন? প্রধানমন্ত্রী জানালেন, এতদিন ধরে এমনিই রাজ্যপালের শাসন চলছে। সেটা সিধে কেন্দ্র সরকারের সঙ্গেই সম্পর্কিত। এর ফলে নানা উপকার হচ্ছে। ঝুলে থাকা প্রকল্প কাজে লাগছে। আইআইটি আইআইএম সব হুহু করে এগোচ্ছে। এবার সিধে কেন্দ্র-সরকার দায়িত্ব নিয়ে বাকিটাও ঝপাঝপ নামিয়ে ফেলবে। পরিবারতন্ত্র, বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতির যে জোয়াল মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে ছিল, তা থেকে কাশ্মীরি জনতার এবার চিরমুক্তি। কাশ্মীরি জনতা এই ব্যবস্থা চেয়েছিল কিনা, দুম করে কেন্দ্রীয় সরকার এমন কাটাছেঁড়া করে ফেলতে পারে কিনা, সে নিয়ে অবশ্য তিনি কিছু বলেননি। একটি কথা বলেছেন, যে, এম-এল-এ, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সবই আগের মতই থাকবে। কিছুই বদলাবেনা। তাহলে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আর রাজ্য আলাদা কীসে? সব রাজ্যকে ধরে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দিলেই তো হয়। প্রধানমন্ত্রী সেই নিয়ে কিছু বলেননি। কে জানে হয়তো পরিকল্পনা তেমনই। তবে এও বলেছেন, যে কাশ্মীরকে (লাদাখকে নয়), আবার তিনি রাজ্য বানিয়েও দিতে পারেন। যেমন ঝপ করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বানিয়ে দিতে পারেন, তেমনই। কী ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে বলেননি, তোমার বাঁচা-মরা আমার হাতে, আমি এমন শক্তিমান। আমার প্রচন্ড অভিমান।
এসব করে কী কী হবে, সে আর আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। ভূস্বর্গ আবার ভূস্বর্গ হবে। টেকনোলজিতে ফেটে পড়বে। হার্বাল প্রোডাক্টের ব্যবসা হবে ( কে করবে বলেননি, আন্দাজ করে কিছু বলা ঠিক নয়)। এবং সর্বোপরি, কাশ্মীরে আবার শুটিং হবে। হিন্দি, তামিল, তেলুগু তো বটেই, সারা দুনিয়া থেকে লোকে আসবে শুটিং করতে। ভূস্বর্গ জমজমাট হবে। বলিউড-হলিউড হবে। এর চেয়ে বেশি উন্নতির লক্ষণ আর কীইবা হতে পারে ভূভারতে?