এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • সংবাদ সারাক্ষণ - পর্ব চার

    শ্রমণগৌতম শীল লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ০৮ জুলাই ২০১৩ | ৭০২ বার পঠিত
  • (আগের পর্বের পর)

    অমিতাভ যখন গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছিল খবর কলকাতার অফিসের দিকে তখন কলকাতায় প্রকৃত মধ্যদুপুর। কলকাতার সংবাদমাধ্যমগুলোর অফিসে তখন সম্পাদকীয় বৈঠক শেষ হয়েছে সবে। ডেস্ক এডিটররা যে যার কাজে লেগে গিয়েছে। যে যে সংবাদমাধ্যমের মালিকের আনুগত্য যার যার প্রতি সেই অনুযায়ীই তার সংবাদ সাজানোর কার্যক্রম মোটামুটি শেষ। খবর কলকাতা ছাড়া বাকি সকলেই তখন খবরটা দেখাতে শুরু করেছে। না দেখালে পিছিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু প্রথমে তারা শুধু ফুটেজ চালিয়েই ক্ষান্তি দিয়েছে। তারপরে সম্পাদকীয় মিটিং চলতে চলতেই তারা একযোগে বলতে শুরু করেছিল পুলিশকে প্রথমে আক্রমণ করেছে গ্রামবাসীরা। তারপরে পুলিশ তাদের তাড়া করে নিয়ে এসেছে গ্রামে। যদিও গ্রামের অংশটুকুর ফুটেজই তারা দেখাতে পেরেছে তখন, তাও শেষ দিকটার মাত্র। যখন খবর কলকাতায় সম্প্রচার শুরু হয়েছে তখনই তারা তাদের স্থানীয় সংবাদদাতাদের ফোন করেছিল। তারা সব বাইক নিয়ে তাড়াহুড়ো করে পৌঁছয় ঘটনাস্থলে।

    খবর কলকাতার স্থানীয় চিত্র-সাংবাদিক অনিমেষ বৈদ্য তুলেছিল ছবিগুলো। তার কাছ থেকে কিছুটা ট্র্যান্সফার নিয়ে নেয় প্রথমে। অনিমেষ তার ফিডের সামান্য অংশ অফিসে না পাঠিয়ে রেখেছিল। মোটামুটি নির্বিষ অংশ। এ তাদের নিত্যিদিনের পদ্ধতি। সকলে সব সময়ে জায়গায় পৌঁছবে না। জ্বর-সর্দি-মায়ের অসুখ নানা সমস্যা আছে তাদের জীবনে যা নিয়ে অফিস কখনো চিন্তিত না। সে সব নিজেদের মতন ম্যানেজ করতে হয়। তাই কেউ আগে গেলে অন্যের জন্যও কিছু রাখতে হয়, তবেই না অন্যে তার জন্যেও রাখবে। সকলে প্রথমে অনিমেষের ফিডের আলাদা আলাদা অংশ পাঠিয়েছিল। তারপরে যে যার মতন শ্যুট করা অংশ। কিন্তু তখন অভিযানের শেষ দিক, কাজেই তারা  খুব বেশি ছবি পায়নি। আর ততক্ষণে খবর কলকাতার ফিডের উপরে জ্বলজ্বল করছে এক্সক্লুসিভ কথাটি। সুতরাং তাদের অনুমতি ছাড়া তাদের ফিড দেখানোর উপায় ছিল না।

    এ নিয়ে লড়াইটা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল প্ল্যানেট সুখ এবং খবর কলকাতার। অনেকদিন ধরে চলছিল। অথচ বামেদের আসল চ্যানেল বার্তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালই ছিল খবর কলকাতার। সে জন্য তারা পেয়ে গেছিল র-ফিডের কিছু অংশ, অনুরোধ করে। সুখ পায়নি। সবার আগে সুখ শুরু করলো পুলিশের উপরে গ্রামবাসীর হামলার খবর। এর পেছনে আলোক সরকার আর তরু দত্তের একটা ফোনালাপ আছে। সেইটা বেশ প্রাসঙ্গিক।

    -তরু?
    - আলোকদা, গুড মর্নিং।
    - এখন দুপুর বারোটা ভায়া!
    - এই তো কথা হচ্ছে প্রথম দিনের শুরুতে। তাই-
    -হুঁ! তা সিদ্ধার্থ ফোন করেছিল। বললো সুনীলের হাত দিয়ে একটা বই আসবে দিল্লি থেকে, তুমি নাকি বেছেছো?
    - হ্যাঁ আলোকদা। আমার তো জানাই ছিল না। এবার গেছি যখন আমি কনফারেন্সে ছিলাম। চিত্রা গেছিল ইণ্ডিয়া সেন্টার। ওখানে আর কে সিং-এর সঙ্গে দেখা। বইটা উনিই দিয়েছেন। আমি বঙ্গভবনে ফিরে এসে দেখি বইটা। কী অসামান্য লেখা! রাজস্থানী মিনিয়েচার নিয়ে এত ভাল-
    - তা এটা তো আমার চেয়ে আঁখির বেশি কাজে লাগবে। ওরই তো গ্যালারির কাজটাজ-
    - আপনি আর আঁখিদি কি আলাদা?
    -হুঁ!

    ফোনে সামান্য নীরবতা।

    -আচ্ছা। আমি একটু বেরোবো।
    - হ্যাঁ আলোকদা।
    - তা আজকেরটা তোমরা আগে করবে না আমরা?
    - আপনি কী বলেন?
    - যা ইচ্ছে।

    কেউ কাউকে জমি দেবে না। কেউ আগে হাঁটু মুড়বে না। এ সব সমঝোতার মধ্যে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু উপায় নেই। তরুর ঘরে এখন আগুন লেগেছে।

    -    আপনারাই বোধ হয় ভালো!
    -    ঠিক আছে। রাখলাম হে! অমিয় ওদের বলে দেবে।

    রিসিভার রাখার শব্দ। আলোক সরকার মোবাইল ব্যবহার করেন ক্কচিৎ কখনো। দপ্তরে থাকলে ঢাউস একটি ল্যান্ড টেলিফোন যাতে কোনো এল সি ডি-ও নেই তা ব্যবহার করেন। সেটা এখনো বাজে ক্রিং ক্রিং করে, যদিও নীচুস্বরে। একজন ফোন মিস্ত্রি গত চল্লিশ বছর এই ফোনটা সামলাচ্ছে। ওটাই তার কাজ যার জন্য সে মাস মাইনে পায়। বাইরের ঘরে অমিয় বসে। আলোকের সহকারী। তার সামনে সব অত্যাধুনিক গ্যাজেট।

    প্ল্যানেট সুখ সন্ধে থেকে খবরের পাশাপাশি বসিয়ে দিল মুখোমুখি আলোচনা। যুযুধান পক্ষরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত এবং রেকমেণ্ডেড দুই পন্থায় এলেন। চায়ের দোকানের এককালের উত্তপ্ত ঝগড়া উঠে এল আধুনিক টেলিভিশনের সেটে। পুলিশের উপরে গ্রামবাসীর আক্রমণের চেহারা হিসেবে হাজির করা হল এক কনস্টেবলের স্টেট জেনারেল হাসপাতালের বেডে শোওয়া ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথা। ইনি সেদিন সবে নদীয়ায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে দুপুরে ডিউটি জয়েন করেছিলেন। লোকাল ট্রেন থেকে নেমে পান খাচ্ছিলেন থানায় বসে। এমন সময় আই সি তাঁকে ডেকে বলেন তাঁর ডিউটি হচ্ছে ব্যান্ডেজ বেঁধে দু দিন হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হবে। তিনি অনেক কষ্টে একটু রাতে রেসিডেন্ট ডক্টরের কোয়ার্টারে শোয়ার অনুমতি আদায় করেছেন সন্ধেতে আই সি যখন গেছিল তখন তাঁর কাছ থেকে। হাসপাতালে বড় বড় ইঁদুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইঁদুরে এখানে রোগীর পায়ের আঙুল খেয়ে নিয়েছে এমন কেস নিজে জানেন তিনি। তাই হাসপাতালের বেডে রাত কাটাবেন না। তিনি বাইট দিয়েছেন ক্যামেরাকে যে জিপ থেকে নেমে প্রতিরোধকারীদের বোঝাতে এগোচ্ছিলেন এমন সময়ে একটা আধলা এসে মাথায় পরে তাঁর। কোনোক্রমে মারা যাওয়া থেকে বেঁচেছেন হেলমেট থাকায়। চোখের আশপাশ ক্ষতিগ্রস্ত।

    তাঁকে নিয়ে ঝড় ওঠে মুখোমুখিতে। ইন্সপেক্টর অনাদিচরণের মতন এঁকেও মারতে চেয়েছিল মাওবাদীরা। মাওবাদীরাই ভাঙ্গুর উস্কোচ্ছে। অন্যপক্ষ যথারীতি তারস্বরে তার প্রতিবাদ করেন। তাতে লাভ হয়নি। এক প্রখ্যাতা লেখিকা প্রায় অবরুদ্ধ কন্ঠে তার কিছুক্ষণ আগেই বলেছেন যে পুলিশ লাঠি চালিয়ে, গুলি ছুঁড়ে হয়তো ঠিক করেনি - কিন্তু শিল্প আমাদের জন্যে যে কি ভয়ানক প্রয়োজনীয় তা কেন আমরা বুঝি না! আমরা আত্মঘাতী - এ কথা বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ প্রায় বুজে এসেছিল। তাঁর সঙ্গেই গলা মেলান দুই অভিনেতা, এক রাজনীতিবিদ, এক অর্থনীতিবিদ, দুই শিল্পপতি, এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তা। এঁরা সব নানা পর্বে এসেছেন সেদিনের অনুষ্ঠানে। অ্যাঙ্কর হৃদ্‌কমল এঁদের বিরোধীদের তর্ক যখনই জোরালো হচ্ছিল তখনই প্রশ্ন করে বসছিলেন অন্যদের। কিম্বা কে কত জোরে চেঁচাতে পারে তার প্রতিযোগিতায় কোনো কথাই শোনার উপায় থাকছিল না দর্শকের। কিন্তু সন্ধ্যেবেলায়, যে সব মধ্যবিত্তের জীবন থেকে চায়ের দোকান উঠে গিয়েছে, অর্কূট-ও নেই- সেই ২০০৭ সালে- তাঁদের উত্তেজনার কোনো সীমাপরিসীমা ছিল না সেদিন। এ এক নতুন এন্টারটেইনমেন্ট। চ্যানেল চালকরা মুচকি হেসেছিলেন এ সব বুঝে। হুঁ হুঁ বাওয়া, একে বলে ইনফোটেইনমেন্ট!

    এই সমস্ত কিছুর মধ্যে অমানিশ কিন্তু যত দিন গড়িয়েছে তত ধীর স্থির হয়েছেন। যা হয়ে গিয়েছে তা আর তাঁর হাতে নেই। তাঁর এত কষ্টে গড়ে তোলা সব গিয়েছে জলে। এবারে? অমানিশ সেদিন আর ফোন করেননি  নির্মলকে। সন্ধে অব্দি নানা জায়গায় ফোন করেছেন, টেলিভিশন দেখেছেন চ্যানেলে বসে। তাঁরা সারাদিন শুধু পুলিশের লাঠিচার্জ আর পুলিশের আক্রান্ত হওয়ার খবর করেছেন, অথচ কোনোটাতেই আলাদা জোর দিয়েছেন এমন না। ঠিক হয়েছে আজকে পরিস্থিতি দেখে নিয়ে কাল যা করার করা হবে। সন্ধে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়েছেন গাড়ি নিয়ে। বাড়ি যাবেন তিনি। যখন বেরিয়ে যাচ্ছিলেন অফিস থেকে তখন দেখলেন অফিসে হন্তদন্ত হয়ে আওরঙ্গজেব ঢুকছে। তাঁদের পশ্চিম মেদিনীপুরের সাংবাদিক। তিনি দেখেছিলেন তাকে, সে দেখেনি। তিনি গাড়ির দরজা যখন বন্ধ করলেন তখন নিশ্চিন্ত যে তাঁকে কী করতে হবে এবারে তিনি জানেন। সহজে হেরে যাবার মানুষ তিনি না। গাড়ি চলতে শুরু করল।

    আওরঙ্গজেব থাকে পশ্চিম মেদিনীপুরের মাহিষ্যপাড়ায়। এই মাহিষ্য পাড়াতে এক সময় থাকতেন বীরেন মাহিষ্য। স্বাধীনতার আগে বীরেন মাহিষ্য ছিলেন ফেডারেশনের এক বড় নেতা। বাংলার নেতৃত্ব তাঁরই দেওয়ার কথা এমন এক বিশ্বাস ছিল তাঁর। কিন্তু তার বদলে তিনি একটু একটু করে কোণঠাসা হয়ে গেছিলেন। প্রথমে সুভাষ, তারপরে যতীন সেনগুপ্ত- তিনি বুঝে নিয়েছিলেন তাঁর জায়গা ফেডারেশন নয়। গড়ে তুলেছিলেন মাহিষ্য দল। নির্বাচনে যখন মাহিষ্যরা এই অঞ্চলের সব কটা আসনই পেল তখন ফেডারেশন চাইলো একটা সন্ধি করতে। কিন্তু যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন সে চুক্তি হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পরে মাহিষ্য দল গেল ভেঙে। তাঁর নিজের ছেলেরা অপদার্থ ছিল। দলের অন্য কেউ তাঁর প্রতাপে নেতৃত্বের যোগ্য হতে পারেনি। সুতরাং এদের বেশিরভাগ অংশই চলে গেছিল ফেডারেশনে। কেউ কেউ সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। নরনারায়ণ ভূঁইঞা ছিলেন প্রথম দলে। কিন্তু তা বলে সমাজতন্ত্রীদের অংশটার সঙ্গে যোগযোগ ছাড়েননি। তাঁরা একটা গোপন মিটিং করেছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল দলগুলোর মধ্যে ঢুকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করাই হবে তাঁদের কাজ। সে কাজ আজও চলছে। এবং সে কাজের অন্যতম সহায়ক আওরঙ্গজেব।

    আওরঙ্গজেব ইসলামধর্মীয় এবং সাংবাদিক। সেটাই তার সুবিধে। জেলাস্তরে সবার কাছে তার যাতায়াত। সে মাহিষ্য দলের লোক এ কথা চট করে কেউ ভাববে না। আওরঙ্গজেবের বাবা ছিলেন ভাগচাষী। ছেলেকে ক্লাস এইট অব্দি পড়াতে পেরেছিলেন। সেই সময় এই অঞ্চলের বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন নিত্য মালাকার। তিনি আওরঙ্গজেবকে বাগানের মালির কাজে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর কাছে। আওরঙ্গজেবের বাবার আপত্তি করার মতন অবস্থা ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন ছেলে যদি কিছু করতে পারে তো করুক, না হলে আবার ভাগচাষ। অবশ্য যদি অভ্যাস থাকে আর করতে পারে চাষ। তা সে রাস্তায় আর ফিরতে হয়নি আওরঙ্গজেবকে। প্রথমে সাইকেলের পেছনের সিটে বসে নিত্যর ব্যাগ বওয়া, তারপরে নিত্যর সাইকেল চালানো, তারপরে নিত্য-র মোপেডের ড্রাইভার হয়ে ওঠা তার শিক্ষানবিশী। শেখার ইচ্ছে ছিল অত্যন্ত। তাই নিত্য মালাকারের বন্ধু চিত্র-সাংবাদিক পলাশ দামের কাছে শেখে স্টিল ক্যামেরার কাজ। লেখা তার দ্বারা হয়নি। সে ছবি তুলতে শিখে নেওয়ার কিছুদিন পরেই মারা গেলেন পলাশ দাম, সিরোসিস অব লিভারে। খুব আশ্চর্য্যজনক ভাবে আরো অনেক যোগ্য প্রার্থীকে সরিয়ে আওরঙ্গজেব হয়ে গেল সুখ বাজারের চিত্র-সাংবাদিক।

    নিত্য মালাকার কলকাঠি নেড়েছিলেন, লাভ হয়নি। সুখবাজারের তখনকার সাংবাদিক অজিত মৈত্রর সঙ্গে একটা চাপা লড়াই ছিল নিত্যর। জেলাস্তরের সাংবাদিক সংগঠনে বা প্রেস ক্লাবে নিত্য যে বারেবারে তাঁকে হারিয়ে নিজে সেক্রেটারি হয় বা নিজের লোককে সেক্রেটারি করে এর শোধ নিয়ে নিলেন অজিত আওরঙ্গজেবকে চিত্র-সাংবাদিক করে। মোপেডের ড্রাইভারির জন্য অন্য লোক নিতে হবে নিত্যকে, আর সবচেয়ে বড় কথা তার ড্রাইভারও এখন প্রেস কার্ড হোল্ডার এটাও সইতে হবে। সেই প্রথম মাহিষ্য দলের জোর জানলো আওরঙ্গজেব। নিত্য নিত্যদিন তাকে যে হেনস্থা করতেন তা সামলালো তারা। অজিত নরনারায়ণকে ঘনিষ্ঠ ভাবে জানতেন। তিনিই ব্যবস্থা করলেন। নরনারায়ণ নিত্যকে ডেকে বলে দিলেন এরপরে যদি নিত্য আওরঙ্গজেবকে ঘাঁটায় তাহলে সন্ধেবেলার পর যেন পথে আর না বেরোয়। খড়গপুরের রাস্তা সন্ধের পরে নিরাপদ না। খড়গপুরের রাস্তায় যাদের শাসন চলতো সেই বাবু তেলেগু-র মাথায় ছিল নরনারায়ণের হাত। বাবু তেলেগু তাঁর রেলের লোহা সরাবার কারবারের প্রধান স্তম্ভ। অতএব নিত্য ক্ষান্তি দিলেন। ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে হতে নিত্য সাংবাদিকতা ছেড়ে দিলেন অবশেষে। মারাও গেলেন একদিন হার্ট অ্যাটাকে। অজিত আর আওরঙ্গজেবও গেছিলো সে রাতে শ্মশানে।

    আওরঙ্গজেবের উত্থান হল ধূমকেতুর মতন। প্রেস ক্লাব থেকে শুরু করে জেলার কাগজের সরকারী বিজ্ঞাপন সবেতেই তার কথাই শেষ কথা। তখন মেদিনীপুর জেলা বিভাজন হয়নি। বিস্তীর্ণ এক ক্ষেত্রে সে ছিল মুকুটহীন রাজা। যে কাগজের সাংবাদিক হোক না কেন তাকে না জানিয়ে কাজ করার হিম্মত কারোর ছিল না। সকলেই জানতো নিত্যর পরিণতির কথা। সকলেই যথাযথ ভয়-ও পেত। নরনারায়ণ ফেডারেশনে। বরেন ঘোষ বঙ্গীয় সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে। দুজনেই দু দলের জেলার মাথা। দুজনেই আছেন মাহিষ্য দলে। শাসক-বিরোধী খোলতাই এই কম্বিনেশনের মধ্যে আওরঙ্গজেব রাজা। অজিত অবসর নিলে আওরঙ্গজেব নিজে হয়ে গেল সাংবাদিক সুখ বাজারের। লেখা তার কম্ম না। লেখার জন্য সে ভাড়া করে লোক রাখলো। সুখ বাজার জানতো সব। সঙ্গে এও জানতো যে আওরঙ্গজেব থাকলে তাদের সার্কুলেশনে কেউ কামড় দিতেও পারবে না। ততদিনে কাগজের ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসাও আওরঙ্গজেব করে নিয়েছে বৌ-এর নামে। সুতরাং সে লিখতে পারে কি পারে না এ নিয়ে কে মাথা ঘামায়! লোক সে পুষেছে, আর সেও না পারলে মাইনে দিয়ে ডেস্কে তারা লোক রাখে কী করতে!

    এই সুখের দিন ভাঙল। দূরদর্শন ছাড়াও নতুন চ্যানেল একটা এল বাজারে। এই চ্যানেল আসার পরে বেশ কিছু নতুন সাংবাদিক এল। তাদের অনেকেরই উত্থান কেবল অপারেটর পরিবার থেকে। বা বিয়ে বাড়ির ভিডিওগ্রাফার হিসেবে অঞ্চলে ব্যবসা করা পরিবার হিসেবে। পরিবারে সম্পত্তি আছে। জমি আছে। কারো কারো আছে চালের কল। অনেকের মাথার পেছনেই অন্যান্য নেতাদের হাত। আর গ্রামাঞ্চলে বা মফস্বলে কেবল ব্যবসা পেশিশক্তি ছাড়া চলে না। তাই পেশিশক্তিতেও তারা কম যায় না। বাবু তেলেগু-র ভয়ে তারা ঘরে বসে থাকবে এমন না। নরনারায়ণই একদিন ডাকলেন আওরঙ্গজেবকে। বললেন মুঠো আলগা করতে। বীরেন ঘোষের জোর কমছে। তিনিও চাইছেন না আওরঙ্গজেবের জন্য আসল কাজ নষ্ট হোক। তাছাড়া কাগজ আর ডিস্ট্রিবিউশান তো রইলই তার। এবারে কিছু জায়গা ছাড়তেই হবে।

    আওরঙ্গজেবের মাথাটা পাকা। সেও বুঝলো যে সত্যিই এভাবে চলবে না। আর নরনারায়ণের সঙ্গে লড়ার কোনো মানে নেই। সে যতই হোল বাবু তেলেগু না। এলাকা দখলের লড়াইতে তার লেগে থাকলেই চলবে এমন না। তাছাড়া এলাকার দখল নিতে গেলে তাকেও এবারে আরো আগে বাড়তে হবে। সে নিঃশব্দে চলে এল মিটিং থেকে। কিছুদিন চুপ করে রইলো। এলাকা সব ভাগাভাগি হতে দেখলো। তার মধ্যে দু চারবার বৌকে নিয়ে গেছিলো কলকাতা। লোকে দেখলো সে প্রচুর বাজার-টাজার করে এনেছিল। কিছুদিন পরেই আওরঙ্গজেব আরেকটি নতুন চ্যানেলের সাংবাদিক হয়ে গেল সুখ বাজারের পাশাপাশি। চ্যানেলটার নাম বার্তা। শাসকদলের চ্যানেল বলেই তার পরিচিতি।

    নরনারায়ণ মাথা নাড়লেন। খেলা তাঁর হাতের মধ্যে রইলো না। বীরেন ঘোষের বয়স হয়েছে সত্তর। তিনি এ সবে থাকেন না। আওরঙ্গজেবকে ডেকে মিষ্টি খাওয়ালেন নরনারায়ণ। বললেন,

    - দ্যাখ, তোকে সেই কত ছোট্ট থেকে দেইখছি। সাইমলে চলিস র‍্যে! উন্নতি কর্‌, উন্নতি কর্‌- জীবোধম্মো! কিন্তু কেচাল লাগাইস না। মনে লিবি যে সয় সে রয়! আমি আর কদ্দিন!

    আওরঙ্গজেব বাইকে ফিরতে ফিরতে ভাবছিল তাদের সন্ধিও নেই আর, যুদ্ধও নেই। এবারে কে কাকে কতটা ব্যবহার করতে পারে সেইটাই দেখার। কিছু করার নেই। জীবন এমনই। উঁচু ডালে তাকে খুঁটো বাঁধতেই হত, নইলে নিত্য মালাকার হতে হত। না, অত সহজে সে হবে না নিত্য মালাকার। তার কীসের ভয়? ভাগচাষীর ব্যাটা ভাগচাষী সে। আজকে তার মাথার উপরে তরু দত্তের হাত। ভাবা যায়? তরু দত্ত? রাজ্যের রাজার অঘোষিত ডান হাত? জেলার নেতারা একবার দেখা করতে তিন দিন কলকাতায় পড়ে থাকে। আর সে যে কোনো সময় ফোনটা করলেই হল।

    শালতোড়ের জঙ্গল চিরে চলে গিয়েছে রাস্তা। বাইকটা চালাতে চালাতেই বাইকের শব্দ ছাপিয়ে একটা ঘন্টার শব্দ কানে আসছিল তার। দূরে কোনো মন্দিরে ঘন্টা বাজছে যেন। যত এগোচ্ছে তত সে শব্দ বাড়ছে। এক সময় মনে হচ্ছিল একশো ঘন্টা বাজছে বুঝি। সে বাইকটা থামালো। হেলমেট এতক্ষণ ঝুলছিলো তার ডান হাতে। এবারে হেলমেটটা পরে নিল সে। জঙ্গল সম্পর্কে যার অভিজ্ঞতা নেই সে আগন্তুক অবাক হবে এমন দৃশ্য দেখলে। হেলমেটবিহীন লোক ঘন্টার শব্দে হেলমেট পরে কেন? কিন্তু যে জঙ্গল জানে সে জানে এটাই করা দরকার। এখন আওরঙ্গজেবের থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরত্বে ঘন্টার শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে। না, এ কোনো মন্দির না। কোনো পূজো হচ্ছে না এখানে। মৌমাছির মতন একদল মাছি, অন্তত হাজার খানেক- এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। তারা এক জায়গায় স্থির হয়ে তাদের ডালাগুলো নাড়িয়ে চলেছে। সেই ডানার শব্দ এটা। একশো ঘন্টার শব্দের মতন জোরালো। এর পাশ দিয়েই যেতে হবে আওরঙ্গজেবকে। নইলে আবার পনেরো কিলোমিটার ফেরত যেতে হবে। তেল বা সময় কোনোটাই পোড়াবে না সে। হেলমেটটা পরে বাইকে স্টার্ট দিয়েছিল আওরঙ্গজেব। তীব্র গতিতে পেরিয়ে গেছিল ওই বিষাক্ত হুলেল মাছিদের জমায়েত। কেউ কেউ ধাওয়া করেছিল, সুবিধে করতে পারেনি। এটাই জীবন। সে এ নিয়মেই খেলে থাকে, খেলবেও।

    আজ-ও খেলছে সে। বার্তার অফিসে ঢুকে যখন সে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামালো তখন একটা শ্রান্তি গ্রাস করলো তাকে। আসতে হয়েছে বাসে। রাস্তাটা বেশ খারাপ। ট্রেনে আসতে পারেনি। তার কোমরে যে বস্তুটা এখন গোঁজা থাকে তা নিয়ে ট্রেনে উঠলে বিপদ। রেল পুলিশ যদি চেকিং করতে গিয়ে ধরে তাহলে বেশ হ্যাপা। লাইসেন্সবিহীন মাল। আর এখন ওটা ছাড়া চলে না। ব্যাগটা রেখে রিশেপসন টেবিলে রাখা জলের বোতলটার দিকে হাত বাড়ালো সে। সিকিউরিটি হাসলো। তারা দুজনেই জানে এখন তাকে আরো পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। নিত্যপ্রিয় ফোন করেছিল তাকে একটু আগেই। নির্দেশ পেয়ে গিয়েছে সে। তরু দত্ত মিটিং করছেন এ অফিসে আজ। রিসেপশন টেবিলের সামনের সারি সারি চেয়ারের একটাতে বসল সে। কোমরটা একটু আলগা করে নিল। যন্তরটা কোমরে ঠেকে আছে অনেকক্ষণ। দাগ হয়ে গিয়েছে নিশ্চই।

    [ধারাবাহিক]


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৮ জুলাই ২০১৩ | ৭০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন